ফিলিস্তিন সমস্যা : মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ অপরিহার্য
পোস্ট হয়েছে: জুন ১২, ২০২০
নূর হোসেন মজিদী
একবিংশ শতাব্দীরও দুই দশক অতিক্রান্ত হতে চলেছে, কিন্তু ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের কোনো লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য অধিকার অনুযায়ী সমগ্র ফিলিস্তিনী ভূখ- নিয়ে মুসলিম, খৃস্টান ও ইযাহূদী নির্বিশেষে ফিলিস্তিনী ভূমিপুত্রদের জন্য একক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা তো দূরের কথা, ১৯৯৭-র চুক্তি অনুযায়ী জাতিসংঘ-স্বীকৃত ফিলিস্তিনী এলাকায় খ-িত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনেরও কোনো খবর নেই। শুধু তা-ই নয়, উক্ত চুক্তি অনুযায়ী পশ্চিম তীরের যে এলাকা ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে অর্পিত হওযার কথা তারও শতকরা ৬০ ভাগ এখনো যায়নবাদী ইসরাঈলের নিয়ন্ত্রণে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তায় যায়নবাদী ইসরাঈল তার সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এগিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে ফিলিস্তিনী ও লেবাননী জনগণ এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ব্যতীত বিশ^সম্প্রদায়ের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
চলতি ২০২০ সালেও ফিলিস্তিনী জনগণ অধ্যুষিত পশ্চিম তীরে ও পূর্ব বায়তুল মুক্বাদ্দাসে নতুন নতুন ইয়াহূদী বসতি স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। অন্যদিকে যায়নবাদী ইসরাঈল সরকার বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পূর্ব দিকে একটি দেয়ালঘেরা সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেÑ যে সড়ক দিয়ে ফিলিস্তিনী যানবাহন বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উত্তর ও দক্ষিণে অবস্থিত ফিলিস্তিনী গ্রামাঞ্চলের মধ্যে যাতায়াত করতে পারবেÑ যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনী জনগণকে দেয়াল দ্বারা পরস্পর থেকে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন করে ফেলা।
এরই পাশাপাশি যায়নবাদী বাহিনীর দ্বারা গাযা, পশ্চিম তীর ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের ফিলিস্তিনীদেরকে হত্যা ও তাদের বাড়িঘর ধ্বংসকরণ এবং একই সাথে ফিলিস্তিনীদের পক্ষ থেকে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু যায়নবাদী ইসরাঈল কর্তৃক ফিলিস্তিনীদের হত্যা ও নির্যাতন এবং নতুন নতুন ইয়াহূদী বসতি নির্মাণের প্রতি না বিশ^সম্প্রদায় যথাযথ দৃষ্টি দিয়েছে, না এ ব্যাপারে বিশ^সম্প্রদায় যে অযথেষ্ট আপত্তি ও নিন্দা জানিয়েছে যায়নবাদী ইসরাঈল ও তার পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা তার প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেছে।
ফিলিস্তিনী জনগণ অধ্যুষিত সমগ্র এলাকা গ্রাসের সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনা সহ যায়নবাদী সরকারের সমস্ত অবৈধ কার্যকলাপের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চোখ বুঁজে সমর্থন দিয়ে আসছে। এ প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে মার্কিন সরকার ইসলামের প্রথম ক্বিব্লা পবিত্র শহর আল্-ক্বুদ্স্ বা বায়তুল মুক্ব্াদ্দাস্কেÑযা জেরুসালেম নামেও পরিচিতÑইসরাঈলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং এ স্বীকৃতির নিদর্শনস্বরূপ ২০১৮ সালের ১৫ই মে তার দূতাবাস তেল আবীব থেকে সেখানে স্থানান্তরিত করে। ফিলিস্তিনী জনগণ, বিশেষত গাযার অধিবাসীরা আমেরিকার এ পদক্ষেপের প্রতিবাদে এবং সেই সাথে অধিকৃত ভূমিতে তাদেরকে ফিরে যেতে দেয়ার দাবিতে ঐ তারিখের আগে-পরে সাম্প্রতিক কালের অন্যতম প্রচ- বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। আর যায়নবাদী সরকার নির্মম হত্যাকা-ের মাধ্যমে এর জবাব দেয়; ঐ সময় এপ্রিল-মে মাত্র দুই মাসে যায়নবাদী সরকার কমপক্ষে ১২১ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে।
এর পাশাপাশি হামাস-শাসিত গাযায় যায়নবাদী বিমান হামলাও অব্যাহত থাকে। বস্তুত গাযায় যায়নবাদী বিমান হামলা একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া; চলতি ২০২০ সালের শুরুর দিকেও যায়নবাদী বিমান বাহিনী গাযায় হামলা চালায়।
অবৈধ যায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাঈল প্রতিষ্ঠিত হবার দিন (১৫ই মে ১৯৪৮) থেকেই একে রক্ষা করা, শক্তিশালী করা ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে এর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির অক্ষ হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
অবশ্য কেবল বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান, বিশেষ করে বাইরে থেকে অ-ফিলিস্তিনী ইয়াহূদীদেরকে ফিলিস্তিনে এনে বসানোর সুযোগ প্রদানের ফলেই যায়নবাদী সংস্থা (তরড়হরংঃ ঙৎমধহরুধঃরড়হ)-এর পক্ষে ইসরাঈল রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হয়েছিল। কারণ, প্রথম বিশ^যুদ্ধের শেষে যেখানে ফিলিস্তিনে ইয়াহূদী জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫৪ হাজার (ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ঔঁফরপধ, ঠড়ষ. ৯, চ. ৪৭৪), সেখানে অভিবাসনের ফলে ১৯২২ সালে তা দাঁড়ায় ৮৪ হাজারে (যা ছিল ফিলিস্তিনের ঐ সময়কার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭% ভাগ) এবং ১৯৪৭ সালে তা দাঁড়ায় ৬ লাখ ১৪ হাজার ২৩৯ জনে (ফিলিস্তিনের তখনকার মোট জনসংখ্যার ৩১.৭৬% ভাগ) (প্রাগুক্ত, পৃ. ১০২৪)। কিন্তু যেহেতু দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর পুঁজিবাদী পশ্চিমা শিবিরের তথা সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের নেতৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যায় সেহেতু অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই যায়নবাদী রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বও তার ওপরে ন্যস্ত হয়। এ কারণেই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাঈলের প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষিত হবার মাত্র ১১ মিনিট পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি প্রদান করে (ওংৎধবষ – টহরঃবফ ঝঃধঃবং জবষধঃরড়হং: ডরশরঢ়বফরধ; ছঁড়ঃবফ ভৎড়স ঞযব টহরঃবফ ঝঃধঃবং ধহফ ঃযব জবপড়মহরঃরড়হ ড়ভ ওংৎধবষ: অ ঈযৎড়হড়ষড়মু)। আর এর পর থেকে সব সময়ই আমেরিকা যায়নবাদী রাষ্ট্রটিকে সর্বাত্মকভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে, ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে যায়নবাদীদের সমস্ত মানবতাবিরোধী অপরাধকে সমর্থন দিয়েছে এবং ভেটো-ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যূনতম মানবিক অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সকল উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।
যায়নবাদী ইসরাঈলের প্রতি আমেরিকার সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও মুক্তিকামী ফিলিস্তিনী জনগণ ও তাদের প্রতিরোধ ফ্রন্ট হামাস-ও যায়নবাদী রাষ্ট্রটির ওপর বার বার বহু নৈতিক ও বাস্তব ক্ষতি চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
এমনকি বৃটেন কর্তৃক ফিলিস্তিন দখল ও অ-ফিলিস্তিনী ইয়াহূদীদের ফিলিস্তিনে অভিবাসনের সূচনাকাল থেকে শুরু করে অবৈধ যায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিনী জনগণ অবৈধ অভিবাসনের প্রতিবাদে ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে অনবরত রাজনৈতিক বিক্ষোভের ও বহুবার সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আশ্রয় নেয়Ñ যার মধ্যে শহীদ শায়খ্ ‘ইয্যুদ্দীন আল্-ক্বাস্সামের গৌরবময় নেতৃত্বে সশস্ত্র জিহাদ (১৯৩২-১৯৩৫) সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।
হামাস গঠনের প্রায় সমসময়ে ইন্তিফাদাহ্ নামে মশ্হূর ফিলিস্তিনী জনগণের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয় (৯ই ডিসেম্বর ১৯৮৭)Ñ যা ১৯৯৩-র ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় বছর অব্যাহত থাকে। এ প্রথম ইন্তিফাদায় যায়নবাদী বাহিনীর হাতে এক হাজার ছয়শ’রও বেশি ফিলিস্তিনী নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধ শহীদ হন। কিন্তু যায়নবাদীরা ফিলিস্তিনী জনগণের মনোবল নষ্ট করতে ব্যর্থ হয় এবং তারা সমগ্র ফিলিস্তিন উদ্ধারের লক্ষ্যে অটল থাকে।
এরপর ১৯৯৬-র সেপ্টেম্বরে যায়নবাদী সরকার বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মসজিদুল আক্বসা ধ্বংস করার লক্ষ্যে এর দেয়ালের নিচের সুড়ঙ্গটি লোক চলাচলের জন্য খুলে দিলে ফিলিস্তিনী জনগণ প্রচ- প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এ ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দিতে সক্ষম হয়।
অতঃপর ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ইন্তিফাদাহ্ শুরু হয় এবং ২০০৮ সালের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদাহ্ দমনের লক্ষ্যে যায়নবাদী সরকার সাড়ে পাঁচ হাজার ফিলিস্তিনীকে শহীদ করে, কিন্তু এর পরও ফিলিস্তিনী জনগণ আগের মতোই তাদের দাবিতে অটল থাকে।
হামাস এ সবের পাশাপাশি স্বীয় জনপ্রিয়তার প্রমাণ তুলে ধরার জন্য ২০০৬ সালের ২৫শে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনী স্বায়ত্ত্বশাসন কর্তৃপক্ষের পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ১৩২টি আসনের মধ্যে ৭৪টিতে জয়লাভ করে। এরপর হামাস ঐ বছর মার্চ মাসে সরকার গঠন করে। কিন্তু গণতন্ত্রের পতাকাবাহী হবার দাবিদার ও এ জন্য অহঙ্কার প্রদর্শনকারী আমেরিকা অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে হামাস সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। এরপর মাত্র সোয়া এক বছরের মাথায় (২০০৭-এর ১৪ই জুন) ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট আমেরিকা ও যায়নবাদী সরকারকে খুশি করার লক্ষ্যে হামাস সরকারকে বরখাস্ত করার কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু এর ফল হলো দু’টি ফিলিস্তিনী সরকারের অস্তিত্ব লাভ : একটি গাযায় হামাসের সরকার, আরেকটি পশ্চিম তীরে আল্-ফাতাহ্র সরকার।
অন্যদিকে, হামাস কর্তৃক ফিলিস্তিনী সরকার গঠনের মাত্র তিন মাসের মধ্যে ২০০৬ সালের ৯ই জুন যায়নবাদী সরকারের বাহিনী গাযায় বিমান হামলা শুরু করে। এর ফলে সূচিত যুদ্ধ ঐ বছরের ২৭শে ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। যায়নবাদী সরকার ২০০৮ সালের ২৭শে ডিসেম্বর পুনরায় গাযায় হামলা শুরু করেÑ যা ২০০৯-এর ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে, কিন্তু যায়নবাদী বাহিনী লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। যায়নবাদী সরকার গাযার জনগণের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৮ই জুলাই একটি সর্বাত্মক হামলা শুরু করে, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে যায়নবাদী সরকার পরবর্তী ২৬শে আগস্ট একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
লেবাননের প্রতিরোধ সংগঠন হিয্বুল্লাহ্-ও ফিলিস্তিনী জনগণের পক্ষে ও যায়নবাদী ইসরাঈলের বিরুদ্ধে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৮২ সালের জুনে ইসরাঈল লেবাননের রাজধানী বৈরুত সহ দেশটির অর্ধেকের বেশি ভূখ- দখল করে নেয়ায় যায়নবাদীদের বিতাড়িত করে লেবাননের ভূখ- পুনরুদ্ধার ও ফিলিস্তিনী জনগণের মুক্তিসংগ্রামকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার লক্ষ্যে দক্ষিণ লেবাননে হিযবুল্লাহ্ গঠন করা হয় (১৯৮৩)। নবগঠিত হিয্বুল্লাহ্ বাহিনী ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে দখলদার ইসরাঈলী বাহিনীকে লেবানন ত্যাগে বাধ্য করে।
এরপর হিয্বুল্লাহ্ ২০০০ সালে ইসরাঈলের তাঁবেদার ও পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত তথাকথিত দক্ষিণ লেবানন বাহিনী (এসএলএ)-র দখল থেকে দক্ষিণ লেবাননকে মুক্ত করে।
অতঃপর হিয্বুল্লাহ্কে নির্মূল করার লক্ষ্যে ইসরাঈল ২০০৬ সালের ১২ই জুলাই একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে এবং দক্ষিণ লেবাননের অংশবিশেষ দখল করে নেয়। কিন্তু হিয্বুল্লাহ্র প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে প্রাণ বাঁচানোর লক্ষ্যে মাত্র ৩৪ দিনের মাথায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দেয়া অস্ত্র বিরতি প্রস্তাবের আশ্রয় নিয়ে লেবাননের মাটি থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়।
যায়নবাদী সরকার আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে যতো হামলা চালিয়েছে এবং হিয্বুল্লাহ্ ও হামাসের সাথে যায়নবাদী বাহিনীর যতো যুদ্ধ ও সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে সে সব থেকে যায়নবাদী সরকার মানুষ হত্যা করা এবং ফিলিস্তিন ও লেবাননের ওপর ধ্বংস চাপিয়ে দেয়া ব্যতীত কিছুই অর্জন করতে পারে নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ইসরাঈলকেন্দ্রিক মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণেই, যায়নবাদী রাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে ইসলামি বিপ্লব-পূর্ব শাহ্-শাসিত ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি বানিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পরে আমেরিকা ইরানকে তার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা বা তাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কোনো অপচেষ্টাই বাদ রাখে নি। আমেরিকার এ সব অপচেষ্টার মধ্যে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রসমূহ, অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ইরাকের তৎকালীন সাদ্দাম সরকারের মাধ্যমে আট বছর ব্যাপী যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া অন্যতম। কিন্তু আমেরিকার সমস্ত অপচেষ্টাই ব্যর্থ হয়।
অবশ্য যায়নবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি সরকার হিসেবে মার্কিন সরকারের জন্য এটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) এমনকি বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইরানি আলেম সমাজের নেতৃত্বে বরিত হবার আগে থেকেই সব সময়ই পবিত্র ফিলিস্তিন ভূমি, বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ্র প্রথম ক্বিব্লা আল্-ক্বুদ্স্-কে মুক্ত করা, অবৈধ ইসরাঈল রাষ্ট্রের বিলুপ্তি সাধন এবং সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখ-ের ওপর ফিলিস্তিনী বংশোদ্ভূত মুসলিম, খৃস্টান ও ইয়াহূদী নির্বিশেষে সকল ফিলিস্তিনীর সমানাধিকার বিশিষ্ট স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছিলেন। এ কারণেই, বিপ্লবের বিজয়ের পরে ইরানের ইসলামি সরকার এ বিষয়টিকে স্বীয় পররাষ্ট্র নীতির অক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে যে সব বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর অন্যতম : ইসরাঈলের ওপর থেকে স্বীকৃতি প্রত্যাহার, তেহরানস্থ ইসরাঈলী দূতাবাসকে ফিলিস্তিনী দূতাবাসে পরিণতকরণ, হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) কর্তৃক রামাযান মাসের শেষ শুক্রবারকে আন্তর্জাতিক ক্বুদ্স্ দিবস ঘোষণা, পিএলও সহ ফিলিস্তিনের সকল প্রতিরোধ গ্রুপকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান, হিয্বুল্লাহ্ ও হামাসকেÑএরপর হামাস সরকার গঠন করলে সে সরকারকেÑসম্ভবমতো সব রকমের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান, এবং অতি সাম্প্রতিক কালে হিয্বুল্লাহ্ ও ফিলিস্তিনী জনগণের কাছে ইরানি সাহায্য পৌঁছানোর পথ হিসেবে সিরিয়াকে রক্ষার জন্য সেখানে, আমেরিকা-সৃষ্ট তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্র (আইএস)-কে উৎখাতের লক্ষ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সফলতা লাভ।
যায়নবাদী ইসরাঈল ১৯৮২ সালের জুনে লেবাননের রাজধানী বৈরুত সহ দেশটির অর্ধেকের বেশি ভূখ- দখল করে নিলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান লেবাননকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ইরাকের মধ্য দিয়ে সেখানে সাঁজোয়া ও পদাতিক বাহিনী পাঠাবার জন্য সাদ্দাম সরকারের কাছে অনুমতি চাইলে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সাদ্দাম সরকার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ইসরাঈলের পক্ষে লেবাননস্থ ফিলিস্তিনী মুক্তিযোদ্ধদেরকে ১লা সেপ্টেম্বরের মধ্যে লেবানন ত্যাগে বাধ্য করা সম্ভব হয় এবং ইসরাঈলী বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ ছ¡াব্রা ও শাতিলাস্থ ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবিরে ১৬ থেকে ১৮ই সেপ্টেম্বর ফালাঞ্জিস্ট সন্ত্রাসীরা এক পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। অবশ্য নবগঠিত হিয্বুল্লাহ্ বাহিনী ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে দখলদার ইসরাঈলী বাহিনীকে লেবানন ত্যাগে বাধ্য করে।
আমেরিকান সরকার হিয্বুল্লাহ্, হামাস্ ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে যতো পদক্ষেপ নিয়েছে তার সবগুলোই ব্যর্থ হওয়ায়, তেমনি ইরাকী জনগণকে মার্কিন আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য করার ক্ষেত্রেও ব্যর্থ হওয়ার পর, সিরিয়ার আসাদ সরকারকে উৎখাত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, আসাদ সরকার হচ্ছে একমাত্র আরব সরকার যে সব সময় ফিলিস্তিনী জনগণকে সমর্থন দিয়ে আসছে, তেমনি সিরিয়া হচ্ছে হিয্বুল্লাহ্র কাছে ইরানি সাহায্য পৌঁছানোর পথ। এ লক্ষ্যে আমেরিকা প্রথমে তথাকথিত ফ্রী সিরীয়ান আর্মি গঠন করে এবং এটির ব্যর্থতার পর তথাকথিত ইসলামিক স্টেট্ (আইএস্) গঠন করে। আমেরিকা তার বশংবদ মিত্র দেশগুলোর সীমান্ত অতিক্রম করে সকল প্রকার অস্ত্রশস্ত্র ও বিদেশী সন্ত্রাসীদের আইএস-এর কাছে পৌঁছার জন্য সুযোগ দেয় এবং আইএস-এর শত্রু হবার ভান করে তার বিরুদ্ধে বছরের পর বছর যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা অব্যাহত রাখে। এমতাবস্থায় সিরীয় সরকারের অনুরোধে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও রাশিয়া মঞ্চে পদার্পণ করে এবং আইএসবিরোধী যুদ্ধের সফল সমাপ্তি ঘটায়। অবশ্য সিরিয়ায় বিদ্রোহ দমনের পুরো সময়টিতে হিয্বুল্লাহ্্ গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখ-ের ওপর ফিলিস্তিনী জনগণের অধিকারের সপক্ষে ও বিপক্ষে বিশ^ জনমতের, বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ্র মেরুকরণ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। অ-পারমাণবিক ও অ-রাসায়নিক প্রচলিত সমরাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যে নযীরবিহীন অভিনব সামরিক স্ট্রাটেজি গ্রহণ করেছে তার ফলে আমেরিকা ও যায়নবাদী সরকার ইরানে হামলা চালাতে সাহসী হচ্ছে না। হামাস্, হিয্বুল্লাহ্ ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মোকাবিলায় ইসরাঈল ও আমেরিকার অক্ষমতা থেকে সুস্পষ্ট যে, আল্-ক্বুদ্স্ সহ সমগ্র ফিলিস্তিন উদ্ধারে মুসলিম উম্মাহ্র পক্ষ থেকে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে ক্বুদ্স্ সহ ফিলিস্তিনের মুক্তি সময়ের প্রশ্ন মাত্র।