বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ফারসি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের গুরুত্ব

পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ২৮, ২০২১ 

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
হাল জামানায় দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষিত লোকেরা কাগজে লিখেন না। তাঁরা সরাসরি টাইপ করেন কম্পিউটারের স্ক্রীনে। আমরা যারা প্রথম প্রজন্মের লোক, আমাদের মধ্যে ভালো ভালো লেখকদেরও দেখা যায়, লিখতে গিয়ে তাঁদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। কারণ হলো, দিনদিন কাগজ-কলমের চর্চা অচল হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা আশংকায় থাকেন, কখন তাঁদের দিনকাল অচল হয়ে যায়।
প্রাইমারিতে পড়ার সময় দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর আমরা জামার পকেটে কালি লাগাতাম। উদ্দেশ্য বিদ্যার দৌড়ের কথা জানান দেওয়া। কারণ, এর আগে লিখতে হতো স্লেটে খড়িমাটি দিয়ে। তারও আগে দোয়াতের কালিতে বাঁশের কঞ্চি চুবিয়ে অ আ ক খ লিখতে হতো শিল্পীর দক্ষতায়। মোবাইলে কম্পিউটারে এখনকার শিশুদের নিপুণতা দেখলে অতীতকে স্মরণ করে লজ্জা হয়।
বই-পুস্তক প্রকাশনায় কম্পিউটারের চর্চা ব্যাপক হয়েছে বেশিদিন হয় নি। এর আগে কাগজের গায়ে হাতে লেখা হতো কলম কালির বিন্যাসে। সেই লেখা সীসা বা দস্তায় তৈরি অক্ষর খাঁজে বসিয়ে বসিয়ে বইয়ের পাতা আকারে সাজানো হতো। তারপর তা মেশিনে কালির ছাপ দিয়ে ছাপানো হতো। মুদ্রণ শিল্পের আগের ইতিহাস বিচিত্র হলেও মূল কথা হলো, বই-পুস্তক, দলিল-দস্তাবেজ টাইপ বা কম্পোজ করার পরিবর্তে কাগজ বা কাঠ, চামড়া কিংবা অন্য কোনো উপকরণের উপর লেখা হতো। সেই লেখা দেখে দেখে কপি বা অনুলিপি তৈরি করা হতো। এই যে প্রথম লেখা, সেটির নাম পা-ুলিপি। অর্থাৎ লেখকের হাতের মূল লেখা। অনেক সময় কপিকারের অনুলিপিও হাতের লেখা বিধায় পা-ুলিপি বলা হতো বা এখনো বলা হয়।
পঞ্চাশ বছর আগের লেখা বইয়ের কথা চিন্তা করলে ধরে নিতে হবে যে, সে বই কলম-কালি ব্যবহার করে কাগজের গায়ে লেখা হয়েছে। তারপর মুদ্রণ যন্ত্রের সাহায্যে শত শত বা ইচ্ছামত ছাপা আকারে বের করা হয়েছে। শুধু বই-পুস্তক কেন, জায়গা জমির দলিল, বিয়ের কাবিন, চুক্তিপত্র সবই এ পদ্ধতিতে লিখিত ও সংরক্ষিত হয়েছে।
এই যে বই-পুস্তক, দলিল-দস্তাবেজ, চুক্তিপত্রের কথা বললাম তার হাকিকত কী? হাকিকত হলো, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের লিখিত সনদ এসব পা-ুলিপি। বর্তমানের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে যদি অতীতের সাগরের রূপ দেখতে চাই তাহলে এসব পা-ুলিপির শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
আমরা সাধারণত বাপ-দাদার ভিটেমাটিতে বসবাস করি। জমি-জিরাত অধিকাংশ পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। এই ভিটেমাটি, জামি-জিরাত আমার, তাতে অন্যের মালিকানা নেই, এ কথার প্রমাণ কী? নিশ্চয়ই জমির দলিলপত্র। দলিলপত্র ঠিক না থাকলে জমির মালিকানা বেহাত হবে এ কথা যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বুঝানোর প্রয়োজন হয় না। জমির মালিকানা সাব্যস্ত করতে দলিল-দস্তাবেজের যে গুরুত্ব, শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রমাণে প্রাতিষ্ঠানিক সনদ বা সার্টিফিকেটের যে মূল্যমান, জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে প্রাচীন পা-ুলিপির গুরুত্ব তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
একটি দালান টিকে থাকে তার ভিত্তিমূলের উপর। গাছ মাথা তুলে শাখা বিস্তার করে তার মূল বা শিকড়ের উপর ভর করে। একটি জাতিও বিশে^র দরবারে মাথা উঁঁচু করে দাঁড়াতে পারে তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দাবি নিয়ে। যে গাছের শিকড় শক্ত মাটির গভীরে প্রোথিত নয় সেটি সামান্য ঝড়ের ঝাপটায় কুপোকাত হয়ে পড়ে। যে জাতির পেছনের ইতিহাস জানা নেই, দুই একশ বছর বা পাঁচ সাতশ বছরের আগে কোথায় কী হয়েছিল জানা নেই, বিশ^সভায় মাথা উঁচু করে সভ্যতার বড়াই করার অধিকার সে জাতির নেই।
এ কারণেই বিশে^র উন্নত জাতিগুলো ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে। প্রত্নতত্ত্ব গবেষণায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে। দেশে বিদেশে খনন কার্য চালায়। তার উপর ইতিহাসের পাঠ তৈরি করার জন্য গবেষকরা জীবন উৎসর্গ করেন। বিশ^বিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা হয়। জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্বের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাচীন পা-ুলিপি। এ জন্য পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা এর প্রতি এত লোভী।
আমেরিকার ইরাক আগ্রাসনে বাগদাদের পতন হলে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি ইতিহাসবিদ প্রফেসর আব্দুল মুমিন এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাগদাদের যে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার লুণ্ঠিত হয়েছে, ইউরোপ আমেরিকার সংগ্রহশালায় সেগুলোর খোঁজ পাওয়া যাবে। তার মানে পা-ুলিপিগুলো চোরাই পথে ইউরোপ আমেরিকার সংগ্রহশালায় গিয়ে জমা হয়েছে। কারণ, তারা এর মাধ্যমে একটি জাতির অতীত ও ভবিষ্যতকে জিম্মি করে রাখতে পারে। ভারতবর্ষে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনের অভিজ্ঞতাও তার চেয়ে ভিন্ন নয়। তাই বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে মৌলিক গবেষণা করতে হলে আমাদের গবেষকদের লন্ডন চলে যেতে হয়।
প্রশ্ন হলো, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের শিকড় কোথায়? মুসলিমপ্রধান বাংলদেশ ভূখ-ে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে। তবে বাংলায় ইসলাম ও মুসলমানদের আগমন তারও আগে। তখনকার দুনিয়ার সকল বাণিজ্য ছিল সাগর পথে। সমুদ্র বাণিজ্যে তখন একক রাজত্ব ছিল আরব বণিকদের। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য সফরে যাত্রাবিরতির ঐতিহাসিক স্থান ছিল চট্টগ্রাম বন্দর। সেখান থেকেই চট্টগ্রাম ও আরাকানে ইসলামের বিস্তার হয়। চট্টগ্রাম ‘ইসলামাবাদ’ নামে আখ্যায়িত হওয়ার প্রেক্ষাপটও তাই। আরব বণিকদের মতো বাংলাদেশে ফারসিভাষী সুফি-দরবেশদের আগমন হয়েছিল ব্যাপকভাবে। আর বখতিয়ার খলজির সামরিক বিজয়ের পর এই ভূখ- পুরোপুরি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে হালাকু খাঁ (১২৫৬-১২৬৫ খ্রি.) বাগদাদে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ফলে দলে দলে আলেম, সুফি-দরবেশ ও শাসকশ্রেণির লোকজন বাংলায় আগমন করেন।
ইতিহাসের সাক্ষ্য হলো, ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে মুসলিম শাসনামলে অফিস-আদালত ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাষা ছিল ফারসি। শাসকশ্রেণি আফগান বা তুর্কি বংশোদ্ভূত হলেও তাঁরা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বরাবর ফারসির পরিচর্যা করেন। এ করণে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ বা তারও আগে থেকে এই ভূখ-ে মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সবকিছু লিপিবদ্ধ হয় ফারসি ভাষায়। এই অবস্থা অব্যাহত থাকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
১৭৫৭ সালে ইংরেজ বণিকরা নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পরাজিত করলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। কিন্তু দাফতরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা চালু করতে ইংরেজদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় একশ বছর অর্থাৎ ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তার মানে ছয়-সাতশ বছর পর্যন্ত এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাষা ছিল ফারসি। বস্তুত ঐতিহাসিক সত্য হলো, বাঙালি বা বংলাদেশী বলতে যাদের বুঝায় এই ভূখ-ের সেই ভূমিপুত্র মুসলমানদের জাতীয় চেতনার শিকড় সন্ধান করতে হলে ফারসির মধ্যেই খুঁজতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে যতই চিন্তা করা হবে ততই আমাদের জাতীয় জীবনে ফারসি চর্চার গুরুত্ব উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। যদি বলেন, ফারসি চর্চা করে বৈষয়িক লাভ কী হবে, তাহলে বলব, বিশ^বিদ্যালয়ে যে ইতিহাস বিভাগ আছে, দর্শন চর্চা হয়, তার প্রয়োজন কেন? বিভিন্ন জাতির ভাষা ও সাহিত্য চর্চারও প্রয়োজন কেন হবে? আমরা জানি, মানুষ কোনো উৎপাদন যন্ত্র বা রোবট কিংবা অর্থ উপার্র্জনের হাতিয়ার নয়। তার মন আছে, মননশীলতা আছে। ঐতিহ্যবোধ আছে। নৈতিক চেতনা, যুক্তিবাদ ও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের সঠিক বেঠিক পথ নির্ণয়ের প্রয়োজন আছে। এই প্রয়োজনের দাবিতেই জাতীয় জীবনে ফারসির চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে ফারসি পা-ুলিপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
পা-ুলিপি সংরক্ষণের কথা উঠলে জাতীয় জাদুঘর বা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পা-ুলিপি সংরক্ষণের বিষয়টি সামনে আসে। অথচ মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকায় কতক অমূল্য পা-ুলিপি আছে। এগুলোর প্রতি অযত্ন অবহেলার শেষ নেই। মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার মতো আরো অনেক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে ঢাকার নজরুল কলেজ, চট্টগ্রামের মহসিন কলেজ যেগুলো অতীতে মাদ্রাসা ছিল, নিউস্কীমের খপ্পড়ে পড়ে কলেজে পরিণত হয়েছে, সেখানে পচনশীল প্রাচীন আরবি ফারসি কিতাবপত্র ও পা-ুলিপির খোঁজ খবর রাখার কেউ গরজ করে না। আমরা নিজেদের প্রতি এমনই উদাসীন।
এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে এখনো অনেক পরিবার আছে যারা পূর্বপুরুষের স্মৃতি হিসেবে বাড়িতে ফারসি-আরবি কিতাব বা পা-ুলিপি বুকে আগলে রেখেছেন। অথচ সেগুলো যথাযথ ব্যবহার করেন না, যত্ন নেন না। এই দিকটি চিন্তা করে আনজুমনে ফারসি বাংলাদেশ-এর পক্ষ হতে একটি আবেদন পেশ করা হয়েছে। এ আবেদনে সকলে ইতিবাচক সাড়া দেবেন বলে আশা করছি।