পরমাণুবিজ্ঞানী ফাখরিজাদে হত্যাকান্ড- ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়
পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ৯, ২০২১
মোহাম্মদ আতিক –
ইরানের বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষণা ও উদ্ভাবন বিষয়ক সংস্থার চেয়ারম্যান মোহসেন ফাখরিজাদে গত ২৭ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় সন্ত্রাসীদের বর্বরোচিত হামলায় শহীদ হয়েছেন। সন্ত্রাসীরা সুপরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করে। তেহরানের অদূরে দামাভান্দ কাউন্টির আবসার্দ শহরের একটি সড়কে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ফাখরিজাদেকে বহনকারী গাড়িতে হামলা চালায়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী আইআরজিসি জানিয়েছে, ইরানের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেকে হত্যা করার কাজে সাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ব্যবহার করা হয়েছে।
ইরানের এই পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যার পর পরই দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ বলেছেন, এই হত্যাকা-ের পেছনে ইসরাইলের জড়িত থাকার মারাত্মক ইঙ্গিত রয়ে়ছে। অপরদিকে আমেরিকার দুইজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ‘নিউইয়়র্ক টাইমস’কে নিশ্চিত করেছেন যে, এই হত্যার পেছনে ইসরাইল জড়িত। আমেরিকার একজন বেসামরিক কর্মকর্তা একই কথা বলেছেন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’কে। একজন পদস্থ মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ‘দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট’ জানিয়েছে, এই হত্যাকা-ে ইসরাইলের হাত থাকার ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। কয়েক বছর আগে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টার দায়ে অভিযুক্ত করতে গিয়ে তাঁর ভাষায় মোহসেন ফাখরিজাদেকে ইরানের ‘পরমাণু অস্ত্র তৈরির জনক’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘নামটি মনে রাখবেনÑ মোহসেন ফাখরিজাদে।’
ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শামখানি বলেছেন, শত্রুরা গত ২০ বছর ধরে ইরানের এই বিজ্ঞানীকে হত্যা করার চেষ্টা করে আসছিল। এই হত্যাকা-ের পর ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, এটা ১৯৪৮ সালে বৈশ্বিকভাবে গৃহীত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ৩, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির অনুচ্ছেদ ৬, জাতিসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ ১, ১২ ও ৫১ এবং জেনেভা কনভেনশনসমূহের দ্বিতীয় অতিরিক্ত প্রোটোকলের অনুচ্ছেদ ১৩’র সাথে সাংঘর্ষিক। একইসাথে এটা আন্তর্জাতিক অপরাধমূলক তৎপরতার বিষয়ে রাষ্ট্রসমূহের যে দায়িত্ব রয়েছে তার লঙ্ঘন এবং এটা প্রকৃতপক্ষে ‘আন্তর্জাতিক টার্গেট কিলিংয়ের’ নিখুঁত উদাহরণ।
ইরান এই ন্যক্কারজনক কাজের জবাব দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ইরানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান স্ট্র্যাটেজিক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের প্রধান কামাল খাররাজি বলেছেন, দেশের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদে হত্যার বিষয়ে যথেষ্ট হিসাব-নিকাশ করে জবাব দেবে তেহরান।
জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি মজিদ তাখতে রাভানচি জাতিসংঘ মহাসচিব এবং নিরাপত্তা পরিষদের প্রধানের কাছে লেখা চিঠিতে ইরানি পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যার নিন্দা জানানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এ হত্যাকা-ে ইসরাইলের জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। তিনি এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানোর আহ্বান জানান।
বিজ্ঞানী ফাখরিজাদে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতেও গুরুত্বপূর্র্ণ অবদান রেখেছেন। ইরানে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কিট তৈরির পাশাপাশি করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির চলমান প্রকল্পে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। শহীদ ফাখরিজাদে করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির প্রকল্প পরিচালনা করছিলেন। ইরানের পরমাণু গবেষণায় তিনিই ছিলেন মুখ্য ব্যক্তিত্ব। কয়েকবছর আগে যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইরানের আণবিক গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। যার ফলে তাঁকে ইসরাইলের বিষ নজরে পড়তে হয়েছিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই পাশবিক হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। রাশিয়া, তুরস্ক, কাতার, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলা ও দক্ষিণ আফ্রিকা, ওমান, সংযুক্ত আর আমিরাত, ইরাক, আফগানিস্তান এবং কুয়েতসহ আরো বহু দেশ এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা এ হত্যাকা-ের নিন্দা জানায়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা জোসেফ বোরেল ইরানের শীর্ষস্থানীয় পরমাণু ও প্রতিরক্ষাশিল্প বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদের হত্যাকা-কে ‘অপরাধমূলক তৎপরতা’ বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি ব্রাসেলসে এক বক্তব্যে ইরানি বিজ্ঞানী হত্যাকা-ের নিন্দা জানান। তবে এ হামলার পেছনে কারা জড়িত সে সম্পর্কে তিনি কোনো ইঙ্গিত করেন নি।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অগান্স ক্লামন্ড ওই সন্ত্রাসী হামলার পরপরই এক টুইট বার্তায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, এই হত্যাকা- বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছে এবং টার্গেট করে এ হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। এ পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং জাতিসংঘ নীতিমালার পরিপন্থী। জাতিসংঘের এ কর্মকর্তা ইরানের বিজ্ঞানী হত্যার এ পদক্ষেপকে বেআইনি বলেও অভিহিত করেছেন।
রুশ সংসদের নি¤œকক্ষ দুমা’র পররাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ার্যমান লিওনিদ স্লাতেস্কি ইরানের বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদের হত্যাকা-কে সন্ত্রাসী হামলা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইরানকে নতুন করে উসকানি দিতেই এ হত্যাকা- চালানো হয়েছে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা যাতে আর বাড়তে না পারে সে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।’
আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী সিনেটর এবং গত নির্বাচনের ডেমোক্র্যাট দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদের মনোনয়ন প্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্স ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদে হত্যাকা-ের কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই হত্যাকা- অবৈধ এবং নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ইরানের সমঝোতা বা আলোচনার সম্ভাবনা বানচাল করার প্রচষ্টা।
স্যান্ডার্স তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে বলেন, মোহসেন ফাখরিজাদে হত্যার ঘটনা অবৈধ ও উসকানিমূলক। আমেরিকার নতুন একটি প্রশাসন যখন ক্ষমতা নেবে তার আগ মুহূর্তে এই হত্যাকা- একথা পরিষ্কার করে দেয় যে, ইরান ও আমেরিকার মধ্যকার সম্ভাব্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়া বানচাল করার পদক্ষেপ এটি। তবে আমাদের এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেয়া মোটেই উচিত হবে না। খুন নয়, বরং কূটনৈতিক পথ হচ্ছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থা বা এইওআই’র সাবেক প্রধান ও পরমাণুবিজ্ঞানী ফেরেইদুন আব্বাসি বলেছেন, দেশের কৌশলগত গবেষণাকর্ম বাধাগ্রস্ত করতে খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিযাদেকে শত্রুরা হত্যা করেছে। তবে শত্রুদের সমস্ত চাপ ইরান মোকাবেলা করবে।
ইরানের নিউজ চ্যানেল ‘প্রেসটিভি’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ফেরেইদুন আব্বাসি বলেন, ১০ বছর আগে তিনি নিজেও হামলার শিকার হয়েছিলেন। এ ধরনের হামলার একটি অভিন্ন লক্ষ্য হচ্ছে ইরানের বৈজ্ঞানিক সমাজে ভীতি ছড়িয়ে দেয়া যাতে দেশের কৌশলগত গবেষণা বন্ধ হয়ে যায় এবং ইরান এসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে না পারে।
তিনি বলেন, “শত্রুরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তিকে হত্যা করে আমাদের সমাজে ভীতি ছড়িয়ে দিতে চায় যাতে ইরানের কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হন। শত্রুরা অতীতে একই কাজ করেছে। তবে আমরা সমস্ত চাপ মোকাবেলা করে যাচ্ছি এবং আমাদের দেশ কোনো একজন ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়।”
আব্বাসি জোর দিয়ে বলেন, সমস্ত কষ্ট-ক্লেশ সত্ত্বেও আমরা পথচলা অব্যাহত রাখব।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা আইআরআইবি’র প্রধান আবদুল আলী আসকারি বলেছেন, বিশ্বের আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর জেনে রাখা উচিত, ফাখরিজাদের শাহাদাতের কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে ইরানের উন্নতি থেমে থাকবে না বরং এর ফলে উল্টো আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর মোকাবিলায় ইরানের বিপ্লবী তরুণ বিজ্ঞানীরা তাদের দেশকে আরো এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আরো সংকল্পবদ্ধ হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের একাধিক পরমাণুবিজ্ঞানী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের অপরাধ প্রতিহত করার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় নি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কুদস ব্রিগেডের কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায়ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ট্রাম্পের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মৌখিক নিন্দা জ্ঞাপন করা ছাড়া বাস্তবে কোন পদক্ষেপ নেয় নি।
ইরানের অন্যতম শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যার ঘটনায় এক প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ইসরাইলি এই অপরাধযজ্ঞের ব্যাপারে কঠোর নিন্দা ও স্পষ্ট অবস্থান নেয়ার পরিবর্তে সব পক্ষকে সংযত হওয়ার এবং যেকোন উত্তেজনা এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরানি পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যাকা-ের প্রতিক্রিয়ায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসাদ আবু খালিল এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘ধরুন ইরান কিংবা মার্কিন সরকারের বিরোধী কোন দেশের সরকার যদি ইসরাইলের কোন পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করত তাহলে আমরা দেখতে পেতাম পাশ্চাত্যের সরকারগুলো ও গণমাধ্যম থেকে শুরু করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো একযোগে এর বিরুদ্ধে কঠোর ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাতো।’
ইরানের বিচারবিভাগের মানবাধিকার বিষয়ক দফতরের প্রধান আলী বাকেরি কানি জাতিসংঘ মহাসচিব এবং এ সংস্থার মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কাছে লেখা আলাদা চিঠিতে ওই হত্যাকা-ের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এ নীরবতা সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-কে বৈধতা দান করবে এবং উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটাবে।
ইরানের বিচারবিভাগের মানবাধিকার বিষয়ক দফতরের প্রধান আলী বাকেরি কানি তাঁর ওই চিঠিতে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী, বৈষম্যমূলক ও রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক আচরণের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এর ফলে বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের হত্যাকা-ের বিষয়ে নীরবতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর ফলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হবে এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে এ ধরনের হত্যাকা- ঘটার আশঙ্কা বাড়বে।
সূত্র: প্রেসটিভি, পার্সটুডে, মেহর নিউজ, ইরনা।