পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে সেমিনার
পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ১৫, ২০১৮
মহানবী (সা.) মুসলিম ঐক্যের প্রতীক এবং আমাদেরকে তাঁর পথেই ফিরে আসতে হবেÑ আবুল কালাম আজাদ এমপি
গত ২ ডিসেম্বর ২০১৭ বিএমএ মিলনায়তনে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুসলমানদের বর্তমান সমস্যা ও মুসলিম ঐক্য’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যন জনাব আবুল কালাম আজাদ এমপি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল মারুফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সেমিনারে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম ড. জাওয়াদ মাজলুমী, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জনাব এ কে এম বদরুদ্দোজা। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন ইরান সাংস্কতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী। পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন বিশিষ্ট কারী এ কে এম ফিরোজ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনাব আবুল কালাম আজাদ এমপি বলেন, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (র.) মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিবসকে কেন্দ্র করে বারো থেকে সতেরই রবিউল আউয়াল যে ঐক্য সপ্তাহের ঘোষণা দেন সেটি ছিল একটি সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত। মহানবী (সা.) মুসলিম ঐক্যের প্রতীক এবং আমাদেরকে তাঁর পথেই ফিরে আসতে হবে। মুসলমানদের মাঝে আজ নানা বিভক্তি বিরাজমান। তারা আজ সারা বিশ্বে মার খাচ্ছে। তারা নানামুখী চক্রান্তের শিকার। মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করে বিভক্ত করেছে তাদের শত্রুরা। শিয়া-সুন্নি ভেদাভেদ ও জাতিগত ভেদাভেদ ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের মাঝে বিদ্বেষ উস্কে দেয়া হচ্ছে। মুসলমানদেরকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য তাদের ভেতর নানা উগ্র মতবাদ ঢুকিয়ে দিয়ে হত্যা ও ধ্বংসের কাজে প্ররোচিত করছে। মহানবী (সা.) কখনো সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন নি। মানুষকে বল প্রয়োগে ধর্মান্তরিত করেন নি। তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ নবী, বিশ্বনবী, মানবতার নবী। তিনি সত্যের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছিলেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন । দেশ থেকে হিজরত করেছেন। আক্রান্ত হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু আক্রমণ করে মানুষ হত্যা করেন নি। তিনি মক্কা বিজয় করতে পেরেছেন প্রায় বিনা রক্তপাতে। তিনি মানবতার অতুলনীয় আদর্শ ছিলেন। আমাদেরকে আল্লাহর নবীর কাছ থেকেই শিখতে হবে। আরবের এমন এক বর্বর জাতিকে সভ্যতার আলো প্রদান করেছিলেন মহানবী (সা.) যে জাতি কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত। তিনি নারীদের মর্যাদা দিয়েছেন। বলেছেন ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ ধর্মে কোন জবরদস্তি নেইÑ এটি আমরা মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) থেকেই শিখেছি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিবিশেষে ইসলাম সবার জন্যই নিরাপত্তা বিধান করে। এই আদর্শ থেকেই সকল ধর্মমতের মানুষ মিলে মিশে আমরা বাংলাদেশে বসবাস করছি। এই উদারতা আমরা রাসূল (সা.) থেকে শিখেছি। সহিংসতার পথ ইসলামের পথ নয় এবং তা রাসূলের দেখানো পথ নয়। রাসূল (সা.) বিধর্মীদের প্রতিও কোন খারাপ আচরণ করেন নি। তিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করেন। ক্রীতদাসদের মানবিক মর্যাদা দেন। রাসূল (সা.)-এর প্রতিটি বক্তব্যই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ও সূদুরপ্রসারী।
তিনি উপস্থাপিত প্রবন্ধের সূত্র ধরে বলেন যে, তিনি সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে যে নির্যাতন হয়েছে এবং এখনো যে দেশে দেশে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চলছে এর একটি সমীক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীটা আজ বড় অশান্ত। ব্যক্তি পরিবার, রাষ্ট্র, বিশ্ব কোথাও শান্তি নেই। সমাজে সৃষ্টি হয়েছে অবক্ষয়। এমতাবস্থা থেকে রেহাই পেতে আমাদেরকে মুহাম্মাদ (সা.)-এর পথেই ফিরে আসতে হবে এবং তাঁকে ঐক্যের প্রতীক ধরে মুসলিম উম্মহকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।
ইরান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রধান অতিথি বলেন, ইরান একটি ঐতিহ্যশালী, ঐশ্বর্যশালী ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্মবিশ্বাসে সমৃদ্ধশালী দেশ। ইরানের জনগণ দেশপ্রেমিক।
সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল মারূফ বলেন, মুসলমানদেরকে বিভক্ত করার জন্য. তাদের ভেতর থেকে সত্যিকার ইসলামের রূপকে বিদূরিত করে উগ্র, গোড়া, একদেশদর্শী মনোভাব মুসলমানদের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের ভেতর থেকে নবী (সা.)-এর ভালোবাসা উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে ও হচ্ছে। তাসাউফকে অস্বীকার করা হচ্ছে। মুসলমানদেরকে ইতিহাসশূন্য করে দেয়ার জন্য ইহুদি চক্রান্ত ও হামফ্রের পরিকল্পনা মোতাবেক নিরস মতবাদের মাধ্যমে মুসলমানদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সা¤্রাজ্যবাদীরা ইসলাম ও মুসলমানদের মাঝে দ্বৈত চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে। একদিকে তারা সরাসরি মুসলমানের প্রতি ও মুসলিম দেশসমূহের প্রতি অত্যাচার করে চলেছে। অপর দিকে মুসলমানদের ভেতর নানা বিতর্কিত উগ্র মতবাদ ঢুকিয়ে দিয়ে ইসলামের চিরন্তন বৈপ্লবিক প্রচার-প্রসারকে বাধাগ্রস্ত করছে। মুসলমানদের ভাব অবয়বের ক্ষতি সাধন করছে। ইসলামের শত্রুরা আমাদেরকে বিভিন্ন নামে বিভক্ত করে আমাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। আমাদের ওপর খবরদারি করছে এবং মুসলমান দিয়ে মুসলমানকে ধ্বংস করে চলেছে। এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে।
ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী বলেন, মুসলমানদের দুর্দশার প্রধান কারণ হলো মুসলমানরা কোরআন থেকে দূরে সরে গিয়েছে। তারা শিক্ষা গ্রহণ করছে পাশ্চাত্যের চিন্তা-চেতনা থেকে। অথচ কোরআনের শিক্ষাই মুসলমানের মূল পাথেয় হওয়ার কথা ছিল। কোরআন সবসময় ঈমানদারদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলেছে। বলেছে, ‘তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরো, কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ কোরআন বলেছে, ‘এসো সেই কথায় যা তোমাদের ও আমাদের মাঝে অভিন্ন।’ শিয়া ও সুন্নি মাজহাবের মুসলমানদের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিল রয়েছে। তাদের মধ্যে বিরাজমান সমস্যার সমাধানকল্পে সেইসব মিলের ভিত্তিতেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মুসলমানরা কোরআন থেকে দূরে সরে গেছে তার প্রমাণ হলো কোরআনের শিক্ষাকে তারা ঐক্য ও সংহতির পক্ষে কাজে লাগাচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে কোরআন থেকে পথ অন্বেষণ করছে না। কোরআন বলছে, ‘তোমাদের মাঝে দুটি দলে যদি দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তবে তা মীমাংসা করে দাও’, কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা এ আয়াতের বাস্তবায়ন দেখতে পাই না। সারা বিশ্বে মুসলমানরা আজ মজলুম। মুসলিম বিশ্ব আজ ক্ষতবিক্ষত। ফিলিস্তিনে মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা দেখছি ইসরাইলের অপকর্মের বিরুদ্ধে আরব রাজা-বাদশাহরা নীরব। আর মুসলমানদের দুর্বল আন্তর্জাতিক সংস্থা ওআইসির ভূমিকা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। ইসরাইলের সাথে যারা সম্পর্ক স্থাপন করে তারা ইসলামের পক্ষ নয়। মুসলমানদের সমস্যা সমাধানে তারা আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। রহস্যজনক তাদের নীরবতা। মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (র) নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হলো মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-কুদস মুক্তি বা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে সারা বিশ্বের মুসলমানদেরকে এক মেরুতে আনার জন্য রমযান মাসের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদ্স দিবস’ ঘোষণা। অপরটি হলো পবিত্র মিলাদুন্নবী (সা.)-কে কেন্দ্র করে ‘ঐক্য সপ্তাহ’ ঘোষণা করা। তিনি শিয়া ও সুন্নি মাজহাবের মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সবসময় আন্তরিক ছিলেন। তাছাড়া বিপ্লবের পূর্বেও ইরানের মহান আলেমগণ বিশেষ করে আয়াতুল্লাহ বোরুজারদি (রহ.) আল-আযহারের আলেমদের সাথে নানা বিষয়ে মাজহাবী ঐক্যের ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছেন।
তিনি বলেন, মুসলিম তরুণ সমাজকে সঠিকপথে পরিচালিত করার জন্য অভিভাবকের মতো দ্বীনের আলেম সমাজেরও বিশেষ ভূমিকা থাকে। প্রতিটি মুসলিম দেশের আলেম সমাজের উচিত তাদের দেশের জনগণকে ও তরুণ সমাজকে প্রকৃত দ্বীনের ওপর সচেতন করা। ইসলামি জীবনব্যবস্থার মর্মার্থকে তাদের অন্তরে প্রবিষ্ট করানো আর ইসলামি ঐক্যের পথে কাজ করা। বিভেদবাদকে পরিত্যাগ করা।
হুজ্জাতুল ইসলাম ড. জাওয়াদ মাজলুমী বলেন, সমগ্র মুসলমান এক জাতি। তাদের লক্ষ্য এক। মুসলমানদেরকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য মুসলমানদের শত্রুরা মুসলমানদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়েছে। কোরআনে মুসলমানদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, ‘তোমরা পরস্পর বিবাদ করো না। তাহলে তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে।’ ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদেরকে শিয়া-সুন্নি, আরব-অনারব ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত করেছে। আবার আরবকেও বিভক্ত করেছে নানা ভৌগোলিক পরিচয়ে। কিন্তু এই বিভক্তি সমীচীন নয়। মুসলমানরা পরস্পর ভাই। ইসলাম মানবজাতিকে ঐক্যের চাদরে আবৃত করতে চায়। ইসলাম যেমন ঈমানদার মুসলমানের ঐক্য চায় তেমনি মানবতার ঐক্য চায়। ইসলামে আর মানবতাবাদে কোন পার্থক্য নেই। মহানবী (সা.) সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন। সারা বিশ্বের জন্য তিনি রহমতস্বরূপ। এমনকি প্রাণীকুল উদ্ভীদকুলের জন্যও তিনি রহমতস্বরূপ।
মুসলমানদের ঐক্য প্রসঙ্গে এই ধর্মীয় নেতা বলেন, মহানবী (সা.) সকলের নবী। তিনি ঐক্যের প্রতীক। প্রশান্তি ও রহমতের প্রতীক। আল্লাহকে পাওয়ার পথ হচ্ছে রাসূল (সা.)-এর দেখানো পথ। যিনি রাসূল (সা.)-কে পাবেন বা রাসূল (সা.)-এর ভালোবাসা পাবেন তিনি আল্লাহকে পাবেন বা আল্লাহর ভালোবাসা পাবেন। সকল মত ও মাজহাবের মুসলমানদের আল্লাহ এক, রাসূল (সা.) এক, কলেমা এক, কিতাব এক এবং কিবলাও এক। তাহলে তারা বিভক্ত হবে কেন? আমাদেরকে এসব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ইসলামি জীবনদর্শনকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই এবং মহানবী (সা.)-এর নির্দেশিত পথ তাঁর চিন্তা ও কর্মকে আত্মস্থ করতে পারলেই তাঁর জন্মদিন পালন সার্থক হবে। সার্থক হবে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ।
স্বাগত ভাষণে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর শুভেচ্ছা জানিয়ে কালচারাল কাউন্সেলর জনাব মূসা হোসেইনী বলেন, হাদিসে আছে, বিশ্বের গোটা ঈমানদার মানবসমাজ হলো একটি দেহের মতো। এর এক স্থানে ব্যথা হলে সমগ্র শরীরে তা অনুভূত হয়।’ এই বাণীটিকে কেন্দ্র করে মহাকবি শেখ সাদী (র.)-এর কবিতার দুটি বিখ্যাত লাইনও আছে। শেখ সাদী (র.) উক্ত লাইন দুটিতে বিশ্বমানবতার ঐক্য চেয়েছেন। বিশাল বিশ্ব মানবসমাজের কোথাও অন্যায় অবিচার হলে সমগ্র মানবসমাজেই এর প্রভাব পড়বে। যদি না পড়ে তবে বুঝতে হবে মানবতার শরীরে কোন চেতনা নেই। মুসলমানদের ঈমানের ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা। মুসলমানদেরকে আজ মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে ইসলামের দুশমনরা। তারা যে বিভেদের জাল তৈরি করেছে তা ছিন্ন করতে হবে এবং মুসলমানদেরকে পারস্পরিক ঐক্য ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়তে হবে।
তিনি বলেন, মুসলিম উম্মাহ এমন এক সময় রহমতের নবী ও ঐক্যের প্রতীক মহানবী (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করছে যখন তারা সবচেয়ে জটিল ও কঠিন সময় অতিবাহিত করছে। মুসলিম বিশ্বের মধ্যকার ঐক্য ও সহানুভূতি এবং ইসলামি উম্মাহর সম্মান ও মর্যাদা এখন দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্তের কবলে নিমজ্জিত। মুসলমানরা তাদের গৌরবান্বিত ইতিহাসের প্রায় সমস্ত সময় ধরেই বড় বড় সফলতার পাশাপাশি কোনো না কোনো সমস্যাও অতিক্রম করেছে। বর্তমান সময়ে মুসলিম উম্মাহ যখন তাদের পরিচয় ও ভাগ্য সম্পর্কে আরো সচেতন ও জাগ্রত হচ্ছে তখন ইসলামের শত্রুরা গোপনে ও প্রকাশ্যে ইসলাম আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি ইসলামি উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করে এই ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেয়া এবং মুসলমানদের মধ্যে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব তীব্রতর করার মতো বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে ইসলামি উম্মাহর বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক শক্তিকে দুর্বল ও ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। এই অবস্থার স্পষ্ট নমুনা আজ আমরা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই নয়; বরং বিশ্বের নানা প্রান্তের বিভিন্ন মুসলিম ও অমুসলিম দেশগুলোতেও প্রত্যক্ষ করছি।
তিনি আরো বলেন, অতীতে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি গোপনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। কিন্তু আজ দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা প্রকাশ্যে ইসলামি দেশগুলোতে তাদের এজেন্ট ও অনুসারীদের ব্যবহার করে মুসলমানদের মধ্যে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব তীব্রতর করার পাশাপাশি এই জাতির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে তাদের মানবতাবিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু মহান আল্লাহর অসীম কৃপায় ও ইসলামি উম্মাহর সচেতনতা ও প্রতিরোধের ফলশ্রুতিতে শত্রুরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের ফাঁদে নিজেরাই আটকা পড়ছে।
প্রবন্ধকার অ্যাডভোকেট এ কে এম বদরুদ্দোজা তাঁর প্রবন্ধে সমসাময়িক দুর্দশাগ্রস্ত মুসলিম বিশ্বের করুণ চিত্র তুলে ধরেন। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, মিয়ামনার, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান সহ সারা বিশ্বে নির্যাতিত মুসলিম জনতার অবর্ননীয় দুঃখ-দুর্দশার কথা এবং মুসলমানদের প্রতি আমেরিকা-ইসরাইলের নানামুখি চক্রান্তের কথা করেন। তিনি সমসাময়িক পরিস্থিতিতে মুসলিম ঐক্যকে দৃঢ় করার আহ্বান জানান।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বিশ্বব্যাপী যুগের পর যুগ ধরে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি ব্যাপক ষড়যন্ত্রের পরও মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ না হওয়া এবং শত্রুদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ওয়াকেবহাল না হওয়াটা একেবারেই অনভিপ্রেত ও ভীষণ দুঃখজনক। পরিশেষে তিনি বলেন, মুসলিম জনতার ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজন সচেতন মুসলিম উম্মাহ।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী সালাউদ্দীন আহমেদ ও তাঁর দল কর্তৃক মহানবী (সা.)-এর শানে রচিত বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর বিখ্যাত নাতে রাসূলের সুমধুর পরিবেশনা। মহানবী (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহকে ঘিরে উক্ত সংগীত সন্ধ্যাটি সুধীমহলের কাছে একটি হাম্দ-নাতের জলসায় রূপান্তরিত হয়।
আমিন আল ্আসাদ
বগুড়া শেখ সা’দী কালচারাল সেন্টারে
ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উদ্যাপন
১২ই রবিউল আউয়াল ১৪৩৪ হিজরি মোতাবেক গত ২ নভেম্বর ২০১৭ শেখ সা’দী কালচারাল সেন্টারের উদ্যোগে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উদ্যাপন করা হয়।
ইমামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আবু জাফর মন্ডলের সভাপতিত্বে এবং শেখ সা’দী কালচারাল সেন্টারের পরিচালক মোঃ শাহীনুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ টিপু সুলতান। সংক্ষিপ্ত আলোচনা রাখেন বগুড়া আল-মাহদী শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষা বিভাগের প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম মোঃ আনিসুর রহমান। মূল আলোচনা উপস্থাপন করেন বগুড়া আল-মাহদী শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম মোঃ মোজাফফর হোসেন। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইমামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনের সহ-সভাপতি এবং রাজশাহী সুগার মিল্্স লিঃ এর সাবেক মহাব্যবস্থাপক কৃষিবিদ আলহাজ্ব মীর সিদ্দিকুর রহমান।
আলোচকগণ প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মের পূর্বে আরবের আইয়্যামে জাহেলিয়াত ও জন্মকালীন ঘটনাবলি এবং মহানবী (সা.)-এর চিরস্মরণীয় অবদান ও শিক্ষামালা হতে আলোচনা করেন।
তাঁরা বলেন, মহানবী (সা.) বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়া আমাদের জন্য অতীব জরুরি। আলোচকগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনচরিত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তা বাস্তব জীবনে প্রতিফলন ঘটানোর আহ্বান জানান।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান স্থপতি মরহুম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী (র.) কর্তৃক ঘোষিত ১২ই রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ই রবিউল আউয়াল পর্যন্ত ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ ঘোষণা প্রসঙ্গে বিশ্বে মুসলিম উম্মার ঐক্যের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ও ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্য স্থাপন করতে হবে।
ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে
লালকুঠি সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে কবিতা পাঠ ও আলোচনা অনুষ্ঠিত
পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে লালকুঠি সাহিত্য পরিষদ-এর উদ্যোগে মীরপুর লালকুঠি দরবার শরীফ মিলনায়তনে উক্ত দরবার শরীফের পীর সাহেব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব আহসানুল হাদীর সভাপতিত্বে মহানবী (সা.)-কে নিবেদিত কবিতা পাঠ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও নজরুল গবেষক কবি আবদুল হাই শিকদার। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক আজকের ভোলা সম্পাদক জনাব মুহাম্মদ শওকত হোসেন ও ইতিহাসবিদ মুহাম্মাদ আশরাফুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেন মাসিক অর্থবীমা পত্রিকার সম্পাদক কবি আতিক হেলাল, মেরিন সানন্দ পত্রিকার সম্পাদক ও অনলাইন টেলিভিশন আদ দাওয়া’র ইসলাম ও নারী বিষয়ক অনুষ্ঠান সুন্দর জীবনের জন্য-এর নিয়মিত ভাষ্যকার কবি উম্মূল খায়ের, মাওলানা আবু বক্কর সিদ্দিক, কবি আমিন আল আসাদ, কবি রোকন জহুর, সাংবাদিক মুহাম্মদ আবু হানিফ ও জনাব আসাদুজ্জামান। পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওয়াত করেন হাফেজ ক্বারী মুহাম্মদ ইবরাহিম। কবিতা পাঠ করেন কবি আতিক হেলাল, কবি দেলোয়ার হোসেন, কবি জামশেদ ওয়াজেদ, কবি জাফর পাঠান, কবি আমিন আল আসাদ, কবি রোকন জহুর, কবি তাজ ইসলাম, কবি ক্বারী ওবায়দুল্লাহ, মর্সিয়া লেখক কবি শাহনেওয়াজ তাবীব, কবি ইবনে আবদুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা কবি মুহাম্মদ রফিক মিয়া, কবি শেখ জাহিদ, কবি আলমগীর হোসেন জোয়ারদার, হাফেজ ক্বাল মুহাম্মদ ইব্রাহিম ও কবি সুজন।
সভাপতির বক্তব্যে লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব আহসানুল হাদী বলেন, মহানবী (সা.)-এর জন্মদিনে সব মুসলমানই আনন্দিত হবে এবং এটাই স্বাভাবিক। তাঁর জন্মমাত্রই আরবের এক গোলম আযাদ হয়ে গিয়েছিল। মুক্ত বাতাসে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল। অর্থাৎ তিনি পৃথিবীতে এসেই মানুষকে মানুষের গোলামি থেকে মুক্তির সূচনাটি করেছিলেন। মহানবী (সা.)-এর পবিত্র মিলাদ ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে মুসলমানের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। মতপার্থক্যকে মতপার্থক্যের জায়গায় রেখে অন্তত মৌলিক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে হলেও মুসলমানদের এক হওয়া দরকার। কারণ, বিশ্বে মুসলমানদের এখন ভয়াবহ দুর্দিন চলছে। মুসলমানদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করা দরকার।
তিনি বলেন, রাসূলের সীরাত ও মিলাদকে কেন্দ্র করে সীরাতুন্নবী (সা.) ও মিলাদুন্নবী (সা.) এই দুইভাবে বিভক্ত হয়েছে জাতি। অথচ দুটিই সঠিক। দুটিই একটির ভেতরে অন্তর্লীন। রাসূল (সা.)-এর মিলাদ বা জন্ম না হলে তাঁর সীরাত কি করে চর্চা করবেন? আর সীরাতচর্চা করতে গেলে তাঁর মিলাদও এসে পড়ে। কাজেই এই দুই জিনিস নিয়ে আমাদের দেশে অহেতুক বিতর্ক হয়।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, ইতিহাসের এক বর্বর যুগে আরবে মহানবী (সা.) পৃথিবীতে এসেছেন; মানবিকতা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, ইতিহাসচর্চার জন্য মহানবী (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শনসমূহ সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে, অথচ মুসলমানদেরকে ইতিহাসশূন্য করে দেয়ার জন্যই ইহুদিবাদী ষড়যন্ত্রে ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যার নামে এসব নিদর্শন ধ্বংস করা হয়েছে ও হচ্ছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দৈনিক আজকের ভোলা পত্রিকার সম্পাদক জনাব মুহাম্মদ শওকাত হোসেন বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.)-এর জীবিতাবস্থায় আমরা ইরানে গিয়েছিলাম। তিনি ইসলামি ঐক্যের আহ্বান সব সময় জানাতেন। তিনি একটি মাত্র উদাহরণ দিয়ে আমাদেরকে সেদিন বুঝিয়েছিলেন ঐক্যের গুরুত্ব। তিনি লেবানন প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে লেবাননের জনগণকে ব্রিটিশরা তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছে। খ্রিস্টান, শিয়া ও সুন্নি। দেখুন, খ্রিস্টানদের মাঝে নানা ভাগ আছে, অথচ তাদেরকে শুধু খ্রিস্টান হিসেবে দেখানো হলো। আর মুসলমানদেরকে বিভক্ত করে শিয়া ও সুন্নি হিসেবে দেখানো হলো। সেখানে সংবিধান তৈরি করা হলো : খ্রিস্টানদের মধ্য থেকে প্রেসিডেন্ট, শিয়া বা সুন্নিদের মধ্য থেকে প্রধান মন্ত্রী ও স্পিকার নির্বাচিত হবে। অথচ আমরা মুসলমানরা যদি সেখানে শিয়া বা সুন্নি না হয়ে মুসলমান হতাম তাহলে আমরাই হতাম সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাহলে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার তিনটি পদই আমাদের হতো। ইমামের ওই বক্তব্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনিই মুসলিম ঐক্যের জন্য পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, আজকের তরুণ সমাজ ইসলামের ইতিহাস জানে না। তারা জানে না ইসলামের জ্ঞান-গরিমা ও সৌন্দর্য সম্পর্কে। তাদেরকে সেসব জানাতে হবে তবেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মিলাদ বা সীরাতচর্চা সফল হবে।
ইতিহাস গবেষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এর রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত রূপ। একে খ-িতভাবে দেখার বা খ-িতভাবে চর্চা করার কোন সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, ইসলাম গোঁড়াদের ধর্ম নয়। এখানে আছে উন্নততর সংস্কৃতি। আল্লাহর রাসূল (সা.) কবিদের মর্যাদা দিয়েছেন। ইসলাম সংস্কৃতিবিমুখ নয়। আল্লাহর রাসূল কবিতার মর্যাদা দিয়েছেন, এমনকি সংগীতেরও মর্যাদা দিয়েছেন। আরবের উটের কাফেলা দূরদূরান্ত অতিক্রম করার সময় এক ধরনের আরবি গান ধরতো। সেটা রাসূলের যুগেও ছিল। ঈদের দিনে দফ বাজিয়ে শিশু-কিশোররা গান গেয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে। আমাদের গ্রামে-গঞ্জে যেমন গীতের মজলিশ হয় তেমনি আরবেও হতো। মদীনায় হিজরতের সময় মহানবী (সা.)-কে স্বাগত জানিয়ে মদিনাবাসী গেয়েছিল বিখ্যাত ‘ত্বালাআল বাদরু আলাইনা’ গানটি। রাসূল (সা.) আরবের এক বৃদ্ধা মহিলা কবি খানছা থেকেও কবিতা বা গান শুনেছেন। কবি খানসা তাঁর প্রিয় ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকের কাসিদা রচনা করে নগরে ঘুরে ঘুরে গাইতেন। রাসূল (সা) তাঁর কাছ থেকে কাসিদা শুনেছেন। সেযুগের দফই আজকের আধুনিক মিউজিকাল ইনুস্ট্রুমেন্ট। অথচ আজকে আমরা দফ পর্যন্তও যেতে চাইছি না। তাহলে সংস্কৃতিসেবীরা কি করে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হবে?
কবি আমিন আল আসাদ বলেন, মানুষ একটি সাংস্কৃতিক জীব। মানুষ সংস্কৃতিবিমুখ হতে পারে না। আপনি যদি তাকে সুস্থ সংস্কৃতি না দেন তবে কিন্তু আপনার জন্য মাঠ খালি পড়ে থাকবে না। সেখানে অন্য সংস্কৃতি এসে বাসা বাঁধবে।
ইসলামি ঐক্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ধর্মীয় নেতা রাহবার সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেছেন, শিয়া ইসলামের ব্রিটিশ ভার্সন এবং সুন্নি ইসলামের মার্কিন ভার্সন তৈরি করে মুসলমানদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এ দুটি হচ্ছে একই ছুরির দুই ধার। আর মরহুম ইমাম খোমেইনী (র.) বলেছিলেন, ‘যারা শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়; বরং তারা সা¤্রাজ্যবাদের দালাল। যারা চায় মুসলিম দেশসমূহকে আমাদের হাত থেকে কেড়ে নিতে।’’ এ দুটি কথা আজ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
কবি উম্মূল খায়ের বলেন, ইসলাম নারীদেরকে মর্যাদা দিয়েছে। দিয়েছে তাকে জ্ঞানার্জন, চরিত্র গঠন, কর্মসংস্থান ও সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অধিকার। দিয়েছে সম্পদে অধিকার। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায় ইসলামের এক ধরনের ব্যাখ্যা দিয়ে নারীদেরকে এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। অপরপক্ষে আরেকদল আছে নারীদেরকে বিজ্ঞাপনের মডেল বানিয়ে আধুনিকতার নামে পণ্য হিসেবে অশ্লীলতার পথে ধাবিত করে। তিনি উভয় ধারাকেই চরমপন্থা হিসেবে অভিহিত করেন।
কবি আতিক হেলাল বলেন, মহানবী (সা.)-এর জীবন ও কর্মকে আত্মস্থ করতে পারলেই মহানবী (সা.)-এর মিলাদ ও সীরাত পালন তাৎপর্যপূর্ণ হবে। অন্যথায় সবই হবে কেবল আনুষ্ঠানিকতা।
মাওলানা আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, রাসূল (সা.)-এর জীবনদর্শনের মধ্যে সবকিছুই আছে, সেজন্য আলাদাভাবে কোন বাদ-মতবাদের কাছে আমাদের যাওয়ার দরকার নেই।
মাওলানা আসাদুজ্জামান বলেন, বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি মহানবী (সা.)-কে ধারণ করেছেন আমাদের দেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আর ফারসি সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি মহানবী (সা.)-কে আত্মস্থ করেছেন মহাকবি শেখ সা’দী (র.) ও আল্লামা রুমী (র.)।
কবি রোকন জহুর বলেন, ভারতে গরু খাওয়ার অপরাধে যখন মুসলমানদেরকে পুড়িয়ে মারা হয়, যখন আরাকানে মুসলমানরা গণহত্যার শিকার হয়, যখন ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ইরাক, সিরিয়া, লেবাননে মুসলিমরা হত্যা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয় তখন সত্যিই দুঃখ লাগে যে, মহানবী (সা.) যে সত্য ও মানবতার কথা বলেছিলেন এর ভিত্তিতে মুসলমান ও মানবতা একাতাবদ্ধ নয়।
আখলাকুল আম্বীয়া
যশোরে ইনকিলাব-এ-মাহ্দী মিশনের উদ্যোগে
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপিত
যশোরে ইনকিলাব-এ-মাহ্দী মিশন এর উদ্যোগে নলডাঙ্গা, আর. এন. রোড এ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে মাহফিলের আয়োজন করা হয়। উক্ত মাহফিলে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ওস্তাদ মল্লিক আব্দুর রউফ এর সভাপতিত্বে রাসূল (সা.)-এর জীবনীর ওপর আলোচনা রাখেন ঐতিহাসিক দানবীর হাজী মোহাম্মাদ মহ্সিন মুড়লী ইমাম বাড়ীর পেশ ইমাম জনাব ইকবাল হুসাইন, মিশনের পরিচালক জনাব সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে রাসূল (সা.)-এর মিলাদ পাঠ করেন জনাব ইরশাদ আহ্ম্মেদ। অনুষ্ঠানে রাসূল (সা.)-এর শানে নাত ও গজল পরিবেশন করা হয়।
বাংলাদেশে ফারসি চর্চার জীবন্ত উদারহরণ মোসাম্মাৎ জামিলা খাতুন সম্বর্ধনা অনুষ্ঠিত
বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে ফারসিচর্চার জীবন্ত উদাহরণ হচ্ছেন ৯৭ বছর বয়স্কা স্মৃতিমান মহীয়সী নারী মোসাম্মাৎ জামিলা খাতুন। গত ২০ অক্টোবর ২০১৭ ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে জাতীয় আধ্যাত্মিক কবিতা পরিষদের উদ্যোগে ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহযোগিতায় আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে মোসাম্মাৎ জামিলা খাতুনকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
সাবেক সচিব ড কামালউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে উক্ত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান। আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, লালকুঠি দরবার শরীফের পীর আহসানুল হাদী, সেন্টার ফর ন্যাশনাল কালচার (সিএনসি)-এর নির্বাহী পরিচালক, শিশু কিশোর মাসিক ফুলকুঁড়ির সম্পাদক শিশু সাহিত্যিক মাহবুবুল হক, পেট্রোবাংলার ডিজিএম মাওলানা বোরহান উদ্দিন, কালান্তর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী জনাব সাঈদ আহমদ আনিস, লেখক-গবেষক ড. হালিমদাদ খান, জনাব এহতেসাম আহমেদ পারওয়েজ প্রমুখ। সভায় কবিতা পাঠ করেন কবি আতিক হেলাল, কবি আমিন আল আসাদ, কবি জাফর পাঠান, কবি ইবনে আবদুর রহমান ও শিশু আবৃত্তিশিল্পী আঞ্জুম ইসলাম। জাতীয় আধ্যাত্মিক কবিতা পরিষদ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শিশুসাহিত্যিক, ছড়াকার কবি মহিউদ্দিন আকবর অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।
মোসাম্মাৎ জামিলা খাতুন আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, নাগরী ও বাংলা ভাষায় বক্তব্য দিতে সক্ষম। তিনি বিভিন্ন ফারসি কবিতার লাইন আবৃত্তি করেন এবং আল্লাহর নিরানব্বই নামসহ মোনাজাতের একটি দীর্ঘ কবিতা মুখস্ত পাঠ করে শোনান।
জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী বলেন, এই মহীয়সী নারী প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন ও ধীমান। তিনি যেভাবে অনর্গল ফারসি কবিতার লাইনগুলো বলে যাচ্ছেন সেই সাথে পবিত্র কোরআন, হাদিস, দোয়া-মোনাজাত করছেন তাতে আমি সত্যিই অভিভূত। এই মা-কে দেখেই বোঝা যায়, ইরানের সাথে বাংলাদেশের জনগণের কী রকম গভীর সম্পর্ক ছিল আর কী রকম গভীর সম্পর্ক ছিল বাংলা ভাষার সাথে ফারসি ভাষার। এই সম্পর্ক যত না বাহ্যিক দিক থেকে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি ছিল অন্তরগত দিক থেকে। হাফিজ, সা’দী, রুমী, ফরিদউদ্দিন আত্তার যে বাংলার মানুষের অন্তরে কতটা নিবিঢ়ভাবে মিশে গিয়েছিলেন তা বোঝা যায় এই মহিয়সী নারীকে দেখে।
অধ্যাপক কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, আমাদের জাতিসত্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইরানের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, ইসলামের আধ্যাত্মিকতার সুশীতল ও প্রাণখোলা চরিত্রটি গৃহীত হয়েছিল তা এই মাকে দেখে বোঝা যায়। তিনি আরো বলেন, ফারসি ছিল এদেশে আগত অগণিত অলি-আওলিয়ার ভাষা। আমাদের দেশে একসময় ফারসি রাজভাষা ছিল। ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করার পরও আরো পঞ্চাশ বছর এদেশে ফারসি ভাষাতেই সকল কার্যক্রম চলেছে। ইংরেজরা সহসাই ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি চাপিয়ে দিতে পারে নি। সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা ফারর্সির স্থানে ইংরেজিকে প্রতিস্থাপিত করেছে। তারপরও দীর্ঘদিন মাদ্রাসাগুলোতে ফারসির চর্চা ছিল।
ড. কামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, শিক্ষিত ও সচেতন মা সচেতন সমাজ গঠনের সহায়ক। অনুষ্ঠানের এই প্রায় শত বছর বয়সী মানুষের স্মরণশক্তি সত্যিই সকলকে বিস্ময়াভিভূত করে। এই ধরনের মানুষ হচ্ছেন জীবন্ত কিংবদন্তির মতো এবং চলমান ঐতিহাসিক নিদর্শনের মতো যা আমাদেরকে আমাদের অতীতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
জনাব আহসানুল হাদী বলেন, এই মহীয়সী নারী মোসাম্মাৎ জামিলা খাতুনের সময়ে শিক্ষার এমন আধুনিক পরিবেশ ছিল না এবং নানা প্রতিবন্ধকতাও ছিল। কিন্তু তিনি সেসব প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন।
জনাব মাহবুবুল হক বলেন, আমরা ছোটবেলায় ফারসি পড়েছি। ফারসি শুনেছি। আজ এ অনুষ্ঠানে বর্ষীয়ান নারী মোসাম্মাৎ জামিলা খাতুনের কণ্ঠে ফারসি শোনাকে আমি উপভোগ করেছি।
এহতেশাম আহমেদ পারভেজ বলেন, আজকের এই মুরব্বি মাতার কাছ থেকে আমরা আমাদের জাতিসত্তা ও জাতীয় সংস্কৃতির সুমধুর অতীত সৌরভ পেলাম। ফারসি ভাষা সুন্দর, শ্রুতিমধুর ও সুমিষ্ট। সেকারণেই এদেশে খুব সহজেই এটি গৃহীত হয়েছে। তিনি বলেন, ফারসি ভাষা কীভাবে আমাদের বাংলা ভাষায় ও বাংলাদেশের বিশেষ অঞ্চলে চেতনার গভীরে মিশে গেছে এ নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।
সভায় উক্ত মহীয়সী নারীকে জাতীয় আধ্যাত্মিক কবিতা পরিষদ-এর পক্ষ থেকে মানপত্র ও সম্মাননা ক্রেস্ট, সেন্টার ফর ন্যাশনাল কালচার (সিএনসি)-এর পক্ষ থেকে সম্মাননা পত্র এবং রিয়েল পিকচার ইউনিট-এর পক্ষ থেকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয় এবং কবি আমিন আল আসাদ তাঁর কাব্য মানপত্রটি সম্মাননা হিসেবে প্রদান করেন।