নববী জ্ঞানের তোরণ আলী ইবনে আবি তালিব
পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৬, ২০২২
১৩ রজব আমিরুল মুমিনীন (আ.)-এর জন্মদিবস উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ
ড. এম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
ঐতিহাসিকরা লিখেছেন ৩০ আমুল ফিল তথা হস্তিসনের ১৩ রজব পবিত্র মক্কায় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, মানব জাতির ইতিহাসে যার কোনো নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। পরবর্তীকালেও যার কোনো পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। সেদিন হযরত আলী (কা.) খানা কা’বার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন হযরত আবু তালিব ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আবদে মানাফ। যিনি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা। আর মাতা ছিলেন ফাতিমা বিনতে আসাদ বিন হাশিম। সুতরাং হযরত আলী পিতৃ ও মাতৃ উভয় দিক থেকে হাশিমী বংশীয় ছিলেন। তাঁর প্রধান লকবগুলো ছিল ‘আসাদুল্লাহ’, ‘মুরতাযা’ ও ‘আমিরুল মুমিনীন’ আর প্রধান কুনিয়াত ছিল ‘আবুল হাসান’ ও ‘আবু তুরাব’।
হযরত আলীর কা’বা ঘরের মধ্যে জন্মগ্রহণের ঘটনাটি ছিল তাঁর জন্য এক বিশেষ ফযিলত। শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে ‘ইলমুল আনসাব’ শাস্ত্রের প-িতবৃন্দ তাঁদের গ্রন্থাবলিতে এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। মুহাম্মাদ মালেকি বলেন : ‘তিনি ৩০ আমুলফিলের ১৩ রজব রোজ শুক্রবার পবিত্র মক্কা শরীফে বায়তুল্লাহ’র মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন… তাঁর আগে কেউই বায়তুল হারামের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেনি। এটি এমন একটি বিশেষ ফযিলত যা মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন তাঁর উচ্চতর মর্যাদাকে সমুন্নত করতে এবং তাঁর কারামাত তথা সম্মানকে প্রকাশ করতে।’
হাকেম নিশাবুরি বলেন : হযরত আলী খানা কা’বার মধ্যে জন্মগ্রহণের খবরটি তাওয়াতুর সূত্রে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। অদ্যাবধি আর কেউ এই বিরল মর্যাদা লাভ করেনি।
আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (কা.) এরূপ অসংখ্য বিরল ফযিলতের অধিকারী ছিলেন। কবি আবুল আইনা’র ভাষায় বলতে হয় : ‘আমি যদি আপনার ফাযায়েল বর্ণনা করতে চাই তাহলে ব্যাপারটা এমন হবে যেন সূর্যের আলোয় ঝলমলে দুপুরে আমি দিনের পরিচয় বর্ণনা করতে চাই, যা কারও সামনে অপ্রকাশিত নয়।’
হযরত আলীর এই অশেষ ফযিলতের মধ্যে তাঁর জ্ঞান-গরিমার মহিমা ছিল সর্বজনস্বীকৃত। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) আলীর শৈশবকাল থেকে মা যেমন বুকের দুধ পান করিয়ে তিলে তিলে আপন শিশুকে বড় করে, ঠিক সেভাবেই আলীকে জ্ঞানের আহার দিয়ে লালন পালন করেন। ‘নাহজুল বালাগা’র ১৯২ নং খুতবায় বর্ণিত হয়েছে যে হযরত আলী স্বয়ং এভাবেই তাঁর সেই সৌভাগ্যধন্য শৈশবের স্মৃতিচারণ করেছেন : ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে আমার শৈশবের প্রারম্ভ থেকেই নিজের কোলে পিঠে করে লালন পালন করেছেন এবং প্রত্যেকদিনই তিনি জ্ঞান ও চরিত্রের একটি করে দরজা আমার সামনে খুলে দিতেন আর আমাকে তা মেনে চলতে নির্দেশ দিতেন।’
হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (কা.) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিজের হাতে গড়া পূর্ণ ইসলামের এবং পূর্ণ ঈমানের মূর্তমান প্রতীক। অনেকে তাঁকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আল-কুরআনের পরে দ্বিতীয় চিরন্তন মু’জিজা হিসাবেও আখ্যায়িত করেন। বরং কারও কারও ভাষায় তিনি ছিলেন জীবন্ত কুরআন। কুরআনের সাথে হযরত আলীর এই অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘নাহজুল বালাগা’য় বর্ণিত তাঁর ১৫৮ নং খুতবার ভাষ্য থেকে। তিনি বলেন :
ذلک القرآن فاسْتنطقوه ولنْ ینطق ولکن أُخبرکم عنه ألا إنّ فیه علم ما یأتی والحدیث عن الماضی و دواء دائکم ونظم ما بینکم.
: ‘এই হলো কোরআন। তোমরা কোরআনকে কথা বলাও। কখনও সে কথা বলবে না। কিন্তু আমি হলাম কোরআনের মুখপাত্র। এর মধ্যের সববিষয়ে আমি তোমাদেরকে অবগত করব। জেনে রেখো! এই কোরআনের মধ্যে ভবিষ্যতের জ্ঞান রয়েছে, রয়েছে অতীতের কথাও। তোমাদের সমস্ত বেদনার উপশম আর সুষ্ঠ জীবন ব্যবস্থা বিধৃত রয়েছে এর মধ্যে।’
একইভাবে ‘নাহজুল বালাগা’র ১৭৫ নং খুতবায় তিনি বলেন :
واللّه لو شئتُ أن أُخبر کلّ رجلٍ منکم بمخْرجه وموْلجه وجمیع شأنه لفعلتُ! ولکن أخاف أن تکفروا فىّ برسول الله (صلی الله علیه و آله و سلم) ألا وإنّى مُفْضیه إلی الخاصّة ممّن یؤمّن ذلک منه.
: ‘আল্লাহ্র শপথ! যদি চাইতাম তোমাদের সকলের জীবনের সূচনা ও পরিণতি আর তোমাদের প্রবেশ বাহির সম্পর্কে খবর জানাতে, আমি তা পারতাম! কিন্তু ভয় হয় পাছে তোমরা আমাকে নিয়ে কুফরিতে লিপ্ত হও কিনা এই কথা বলে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যা বলেননি, আলী তা বলছে। জেনে রেখো, আমি বিশেষ কিছু আস্থাভাজন ব্যক্তির কাছে এই জগতের কিছু কিছু রহস্য জ্ঞান প্রকাশ করি।’
হযরত আলী (কা.) এভাবে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিষ্যত্ব লাভে ধন্য হন। এই জ্ঞানের পরিমাত্রা সম্পর্কে ইশারা করে তিনি বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে জ্ঞানের এক হাজারটি দরজা শিক্ষা দিয়েছেন, যেগুলোর প্রত্যেকটি থেকে আবার এক হাজারটি করে জ্ঞানের দরজা খুলে যায়।’ নাহজুল বালাগায় বর্ণিত ৩ নং খুতবায় হযরত আলী বলেন : ‘[আমার জ্ঞানের পাহাড় এতই উঁচু যে] আমার থেকে শুধু জ্ঞানের ঢল নামে এবং কোনো পাখিই আমার চুঁড়ায় পৌঁছতে পারে না।’
তিনি জনগণকে উদ্দেশ করে উদাত্ত ঘোষণা দিতেন : ‘তোমরা আমাকে হারানোর আগে আমার কাছ থেকে প্রশ্ন করে জেনে নাও। আমি জমিনের পথঘাটের চাইতে আসমানের পথঘাটের খবর বেশি রাখি।’ (নাহজুল বালাগা : খুতবা ১৮৯)
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে-গড়া এই শিষ্যের ব্যাপারে উম্মতকে জানিয়ে দিয়েছেন : ‘আমি সমস্ত জ্ঞানের নগরী, আর আলী তার দরজা। কাজেই যে নগরে প্রবেশ করতে চায় সে যেন এর দরজা দিয়েই প্রবেশ করে।’ মহিউদ্দিন আল-আরাবী তাঁর ‘রিসালাতুল কুদ্্স’ এর মধ্যে হযরত আলী (কা.)-এর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে : ‘এই হচ্ছে আলী ইবনে আবি তালিব, সেই ব্যক্তি যিনি হচ্ছেন নববী জ্ঞান-নগরীর দরজা এবং ঐ নগরীর রহস্যকথার মালিক ও ইমাম।’ ( রিসালাতুল কুদ্স : ৩৭; আল-ফুতুহাত আল-মাক্কিয়্যা: ৮/১০৭)
আল্লামা সিবত ইবনে জাওযি হযরত আলী (কা.)-এর জ্ঞানের বিষয়ে লিখেছেন : “…তাঁকে আল-বাত্বীন নামে আখ্যায়িত করা হতো। কেননা, তিনি ছিলেন জ্ঞানের গভীরতায় পরিপূর্ণ। আর তিনি (আ.) বলতেন : ‘যদি আমার জন্য একটি ক্লাসের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে একটি উটের পিঠে যতটা বহন করা যায় ততটা পরিমাণ কেবল ‘বিসমিল্লাহ’র তাফসিরে বক্তব্য রাখতাম।’ আর তাঁকে ‘আল-আনযা’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। কারণ, তিনি ছিলেন র্শ্কি থেকে বিমুক্ত।” (তাযকিরাতুল খাওয়াস : ১৬)
বিখ্যাত খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদ নিভিসিয়ান যেন হযরত আলী (কা.)-এর আফসোসকে লক্ষ্য করেই বলেন : ‘যদি আলী ইবনে আবি তালিব, এই শক্তিমান ও বাগ্মী বর্তমান যুগেও কুফার মিম্বারে বসতেন তাহলে আপনারা দেখতে পেতেন মসজিদে কুফা ঐ বিশাল বিস্তৃতির পরও পাশ্চাত্য ও গোটা বিশ্ব থেকে কিভাবে বিজ্ঞানী ও প-িতরা আলীর উত্তাল জ্ঞানের দরিয়ায় অবগাহন করার জন্য ভিড় জমাতেন। (উদ্ধৃত: আবদুল ফাত্তাহ আবদুল মাকসুদ রচিত আল ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) : ১/১৫)
আল্লামা মুহাম্মাদ তালহা আল-শাফেয়ী হযরত আলীর ফযিলত সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য আরব কবির পথনির্দেশনা অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কবি বলেন : عن المرء لا تسأل وسل عن قرینه * فکل قرین بالمقارن یقتدی : যদি কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চাও তাহলে তার সঙ্গীকেই প্রশ্ন কর। তাকে প্রশ্ন করো না। কারণ, প্রত্যেক সহচর তার সঙ্গীর কর্ম ও আচরণের অনুকরণ করে থাকে। অতঃপর তিনি হযরত আলীর সঙ্গী ও সহবৎ সম্পর্কে বলেন: ‘দিগন্তে দিগন্তে যে নবুওয়াতের জ্যোতি ছড়িয়ে পড়েছিল, মহান আল্লাহ তা থেকে তাঁর [আলীর] মধ্যে বিকিরণ ঘটান এবং তাঁকে এক পূতপবিত্র প্রাণ দান করেন। আর তাঁর আপন সত্তায় যে নির্মলতা ও নিষ্কলুতা বিদ্যমান ছিল একারণে আল্লাহ তাঁর মধ্যে সমস্ত মানবিক ও নৈতিক সদগুণ ধারণ করার যোগ্যতা প্রদান করেন। এরূপ এক শুদ্ধাচারী মানবসত্তার অধিকারী হওয়ার সুবাদে তিনি সকল পঙ্কিলতা, কুফ্রি, অশুদ্ধতা ও অসূচিতা থেকে পবিত্র থাকেন। র্শ্ক,ি পাপাচারিতা, মিথ্যা, নিফাক কোনো কিছুই তাঁর সে বিশুদ্ধতায় আঁচড় কাটতে পারেনি। আর একারণেই তিনি ছিলেন পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনেন এবং মূর্তি ও প্রতিমাগুলো গুড়িয়ে দিয়ে মসজিদুল হারামকে বাতিল সব খোদা এবং র্শ্কি ও গোমরাহির চিহ্নসমূহ অপসারণে অনুপ্রাণিত হন। আর এ কারণেই তাঁকে আনযা‘ [অর্থাৎ র্শ্কি থেকে বিমুক্ত] আখ্যায়িত করা হয়…।’
এ প্রসঙ্গে লেবাননের বিখ্যাত খ্রিস্টান লেখক ও কবি এবড়ৎমব ঔড়ৎফধপ এর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন : ‘আমার মতে ইবনে আবি তালিব ছিলেন প্রথম আরব পুরুষ, যিনি রুহে কুল্লি তথা সামগ্রিক আত্মার সাথে সহচর ও সহবতে ছিলেন। আলী তাঁর আযামতের কারণেই শহীদ হন।’ (দ্য ভয়েস অব হিউম্যান জাস্টিস : ৪৬৭)
আল্লামা মুহাম্মাদ তালহা আল-শাফেয়ী আরও বলেন : …রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে তাঁর সার্বক্ষণিক সাহচর্যের কারণে আল্লাহ অবিরত তাঁর জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে দিতেন। এই জ্ঞানের প্রাচুর্য এতটাই বৃদ্ধি লাভ করে যে তিরমিযী শরীফের সহিহ হাদিসের ভাষ্য মোতাবিক স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলীর ব্যাপারে ঘোষণা করেন : ‘আমি সমস্ত জ্ঞানের নগরী আর আলী তার দরজা।’ এই অসামান্য জ্ঞান দ্বারা তিনি বাদি-বিবাদির জটিল সব বিচারের ন্যায্য মীমাংসা করে দিতেন আর কঠিনতম মাসলাসমূহের সঠিক ফয়সালা বলে দিতেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় তাঁর কোনো না কোনো অবদান চোখে পড়বে… আর যেহেতু আল্লাহ তাঁকে বিভিন্ন প্রকার জ্ঞান ও হিকমত দান করেছিলেন, একারণে সকলের কাছে সেটা প্রকাশ হয়ে যায় এবং তাকে ‘বাত্বিন’ নামে আখ্যায়িত করে। বাত্বিন বলা হয় তাকে যার পেট মোটা থাকে। কিন্তু হযরত আলীর ভিতরে নানা প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও হিকমতের অপূর্ব সমাহার ঘটেছিল একারণে তাঁকেও ‘বাত্বিন’ আখ্যা দেওয়া হতো। জড় খাদ্যদ্রব্যে নয়, অজড় জ্ঞান-বিজ্ঞান আর হিকমতেই তাঁর পেট পরিপূর্ণ। (মাতালিব আস-সাউল : ৭০-৭৬)
সুতরাং মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকল ব্যক্তির কাছে দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট যে আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (কা.) অফুরান ও বৈচিত্র্যময় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, যা নির্ঝরিণী ঝরনাধারার মতো শুধু প্রবহমাণ ছিল নিরন্তর। ব্যিখাত মুসলিম গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি বলেন: ‘[জ্ঞানের দিক থেকে] তিনি ছিলেন এমন এক সদা প্রবহমাণ ঝরনাধারা, সকল প-িত তাঁদের জ্ঞানসূত্রকে তাঁর সাথেই যুক্ত করত।’ (তাজরিদ আল-ই’তিকাদ) তিনি সেই বিশাল জ্ঞানভা-ার থেকে কিছু প্রজ্ঞা জ্ঞান মানুষদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকায় এবং উপকারী হওয়ায় এবং তাদের বোধগম্যতার সাধ্যের মধ্যে থাকায় প্রকাশ করেছিলেন। আর কিছু গোপন রেখে যান, যাতে সত্যান্বেষী যোগ্যতাসম্পন্ন লোকেরা সেগুলো খুঁজে পায়।
‘নাহজুল বালাগা’র ২২১ নং খুতবাটি শুরু হয় এই বাক্যটি দিয়ে : یَا لَهُ مَرَاماً مَا أَبْعَدَهُ، وَ زَوْراً مَا أَغْفَلَهُ، وَ خَطَراً مَا أَفْظَعَهُ : ‘হায়! গন্তব্য কতই না দূর! অথচ পথিকরা কতই না বে-খবর! আর কাজ কতই না দুষ্কর!’ আর খুতবার শেষাংশে বলেন : وَ إِنَّ لِلْمَوْتِ لَغَمَرَاتٍ هِيَ أَفْظَعُ مِنْ أَنْ تُسْتَغْرَقَ بِصِفَةٍ أَوْ تَعْتَدِلَ عَلَى عُقُولِ أَهْلِ الدُّنْيَا. :নিশ্চয় মৃত্যুতে রয়েছে অনেক বিষম যন্ত্রণা, যা বলে বুঝাবার নয় কিংবা দুনিয়াবাসীর আক্ল দ্বারা তা পরিমাপযোগ্য নয়।’
আসলে প-িত ও বিজ্ঞানীরা মৃত্যুর স্বরূপ ব্যাখ্যা করার সক্ষমতা রাখেন না। হযরত আলী (কা.) আলোচ্য খুতবার মধ্যে একটি বাক্যে মৃত ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলেন: لَا يَتَعَارَفُونَ لِلَيْلٍ صَبَاحاً وَ لَا لِنَهَارٍ مَسَاءً أَيُّ الْجَدِيدَيْنِ ظَعَنُوا فِيهِ كَانَ عَلَيْهِمْ سَرْمَداً : ‘.. এরা এক জায়গায় সমবেত হয়েছে বটে কিন্তু নিঃসঙ্গ। একে অপরের বন্ধু বটে কিন্তু পরস্পর থেকে দূরে। এরা রাতের জন্য কোনো ভোর চেনে না, তদ্রƒপ দিনের জন্যও চেনে না কোনো সন্ধ্যা। এরা দিনের বেলায় মৃত্যুর সফরে গিয়ে থাকুক আর রাতের বেলায়ই গিয়ে থাকুক এ সফরই তাদের চিরন্তন যাত্রা।’
এই বাক্যটি ‘নাহজুল বালাগা’র মধ্যে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট (প্রজ্ঞাদীপ্ত) বাক্য হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে এবং যাঁরা ‘নাহজুল বালাগা’র শরাহ তথা ব্যাখ্যা করে থাকেন তাঁরা এই ব্যাক্যটির ব্যাখ্যা করার অনেক প্রয়াস চালিয়েছেন। কিন্তু হযরত আলী (আ.)-এর কথার মর্মার্থ উদ্ধার করা কঠিন। ইবনে আবিল হাদিদ মু’তাযেলি এই বাক্যটির ব্যাখ্যায় বলেন: এই খুতবাটি অদ্ভুত গভীরতাসম্পন্ন এবং বিশুদ্ধ, আলঙ্কারিক ও উন্নত শব্দামালায় গাঁথা। কেউ যদি ‘নাহজুল বালাগা’র এই চ্যাপ্টারটি পর্যালোচনা করে তাহলে অনুধাবন করবে যে এই যে মুয়াবিয়া বলেছেন ‘কুরাইশের জন্য যিনি ফাসাহাত তথা ভাষার বিশুদ্ধতার ভিত্তি স্থাপন করেছেন তিনি আলী ব্যতীত আর কেউ নন’Ñ তিনি ঠিকই বলেছেন। যদি আরবের সমস্ত বিশুদ্ধভাষী প-িত এক জায়গায় সমবেত হন আর এই খুতবাটি তাঁদের সামনে পাঠ করা হয় তাহলে সকলের উচিত হবে এই খুতবার সামনে সিজদা করা! ঠিক যেমনটা কবিগণ আদি ইবনে রুকা’র সামনে সিজদা করেছিলেন। যখন কেউ কেউ একাজের জন্য আপত্তি তুলেছিল তখন তাঁরা বলেছিলেন : ‘আমরা কবিতার মধ্যে সিজদার জায়গা কোথায় তা জানি। যেমনভাবে তোমরা কোরআনের মধ্যে সিজদার জায়গাগুলো কোথায় তা জানো।’ (লোকমান : ৩৩)
অর্থাৎ ইবনে আবিল হাদিদ দাবি করেন, কোরআনের কতক সূরার মধ্যে এমন কিছু আয়াত রয়েছে যেগুলো পাঠ করলে সিজদায় যেতে হয়, আলী ইবনে আবি তালিবের খুতবাগুলোর মধ্যেও এমন কিছু কথা রয়েছে যেগুলোর বলিষ্ঠতা, বিশুদ্ধতা, আলঙ্কারিত্ব ও অর্থের নিগুঢ়তার কারণে ভাষার ফাসাহাত সমঝদারদের সেগুলোর সামনে সিজদা করা উচিত!
এই বিষয়টি যখন আল্লামা তাবাতাবাঈ (রহ.) এর কাছে উত্থাপন করা হয় যে ইবনে আবিল হাদিদ কীভাবে এত বড় একটা দাবি করতে পারলেন, তখন উস্তাদ আল্লামা বলেন: ইবনে আবিল হাদিদ অবান্তর কিছুই বলেননি। কারণ, সিজদা হচ্ছে আল্ল্হার কালামের জন্য। সেই একই সারমর্ম হযরত আলী (আ.)-এর খুতবার আদলে নিঃসৃত হয়েছে। সিজদা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কালামের জন্যই, তাঁর সৃষ্টির কালামের জন্য নয়।
ইবনে আবিল হাদিদ অতঃপর বলেন : ‘সেই মহান সত্তার কসম করে বলছি যার নামে গোটা উম্মত কসম করে থাকে, আমি এই খুতবাটি বিগত পঞ্চাশ বছরে এক হাজারেরও বেশি বার পাঠ করেছি এবং প্রত্যেকবার যখন পাঠ করতাম আমার কাছে নতুন মনে হতো। নতুন কোনো কথা এবং নতুন কোনো উপদেশ আমার কলবের মধ্যে জেগে উঠত।’ (নাহজুল বালাগা, খুতবা ২৩০)
ইসলামের মহান মনীষি ও দার্শনিক ইবনে সিনা মি’রাজ এর উপরে একটি গবেষণাপত্র রচনা করেন যা ‘রিসালাতুল মি’রাজিয়্যা’ নামে পরিচিত। সেখানে তিনি রাসূলূল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিস বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন : সাহাবিদের মধ্যে হযরত আলী (আ.)-এর স্থান ছিল ইন্দ্রিয়সমূহের মাঝে আক্্লের ন্যায় کَالْمعقول بِیْن المحْسوس । রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে বলেন : یا على إذا تَقرّب الناس إلی الله بأنواعِ البِرّ، تقرّب إلیه أنت بِالعقل، تَسبقهم : ‘হে আলী! লোকেরা যখন নানা পুণ্যকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ করে তুমি তখন আক্লের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ করো। তাহলে তুমি তাদের আগে পৌঁছে যাবে।’
ইবনে সিনা’র এই বক্তব্যের ব্যাখ্যাকাররা বলেছেন : সাহাবিদের মাঝে আলী (আ.) ছিলেন আক্ল, আর অন্যরা ইন্দ্রিয়সম। ইন্দ্রিয়সমূহ আকলের মুখাপেক্ষী, আর আক্্ল সেগুলোর পরিচালক ও নির্দেশক। আলী হলেন সাহাবিদের মধ্যে সেই পথনির্দেশক আর সাহাবিগণ তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী। (দ্র. হাশিয়া-ই শিফা)
গ্রন্থসূত্র:
১. নাহজুল বালাগা, সাইয়্যেদ রাজি সংকলিত এবং ইবনে আবিল হাদিদ মু’তাযেলি কর্তৃক শরাহকৃত।
২. আল-ফুতুহাতুল মাক্কিয়্য, রিসালাতুল কুদ্স, মহিউদ্দিন ইবনে আরাবি।
৩. তাযকিরাতুল খাওয়াস, সিবত ইবনে জওযি।
৪. আল-ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.), আবদুল ফাত্তাহ আবদুল মাকসুদ।
৫. ঞযব ঠড়রপব ড়ভ ঐঁসধহ ঔঁংঃরপব নু এবড়ৎমব ঔড়ৎফধপ
৬. মাতালিব আল-সাউল, মুহাম্মদ ইবনে তালহা আল-শাফেয়ী।
৭. তাজরিদ আল-ই‘তিকাদ, খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি।
৮. আল শিফা (হাশিয়া), ইবনে সিনা।