নজরুল হাফিজ গবেষণা ও বাংলায় অনূদিত আত্তারের রুবাই
পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ১৭, ২০২৫

ফারসি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি,সেই সাথে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ফারসি ভাষা শেখা ও ইরানের নওরোজ, মহররম উৎসব নিয়েও রয়েছে তাঁর কবিতা। তিনি তাঁর কবিতা ও গানে তুলে ধরেছেন শিরাজ সাকী, শিরাজের গোলাপ, শরাব পেয়ালার কথা যা সাহিত্যপ্রেমী সবারই জানা। নজরুল যেহেতু স্বভাব কবি ছিলেন এবং পরে ফারসি ভাষা শেখেন ফলে তিনি ফারসি সাহিত্যের বিখ্যাত কবি হাফিজ সিরাজীর “দিওয়ানে হাফিজ” থেকে কিছু গজল বাংলায় অনুবাদ করেন। কবি নজরুল মূল ফারসি থেকেই অনুবাদ করেন। যা বাংলাভাষী পাঠকদের হৃদয়ে ও বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে,সেই সাথে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টি হিসেবে পরিগণিত হয়। ইরানের বুলবুল হাফিজের রুবাই অনুবাদ যখন নজরুল শেষ করেন তখনই তাঁর শিশুপুত্র বুলবুল দুনিয়া থেকে বিদায় নেন৷ একদিকে কলিজার খুনের চিরবিদায় অপরদিকে হাফিজের আগমন নজরুলের জীবনে মহাবিস্ময়! বেদনার্ত হৃদয় দ্যুতিময় হয়ে ওঠে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় কবি হাফিজের শুভাগমনে। দুই কবির অন্তর্গত মিল যেন মহাকালের এক গভীর অনুভবের পরশ। যা অনাদিকালেও বহমান। এই হৃদয়বিদারক ঘটনাই হয়তো হাফিজ ও নজরুলের আত্মিক সম্পর্কে আরও গভীর করে তোলে। তাই যখনই ইরান ও ফারসি সাহিত্য নিয়ে কথা হয় তখন অবচেতন মনেই আমাদের মনে এসে যায় নজরুলের কথা, তাঁর ইরান ও ফারসি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগের কথা। আর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে নজরুল ও হাফিজ,ফারসি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখিও হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড.মো.কামাল উদ্দিন তাঁর গবেষণা গ্রন্থ “নজরুল ও হাফিজের কবিতা : শিল্প ও বৈশিষ্ট্য” এর মধ্যে অত্যন্ত সুন্দর ও সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নজরুল ও হাফিজের কাব্য ও সাহিত্যের সম্পর্কের এই নানাবিধ দিক। যাতে ওঠে এসেছে জানা অজানা অনেক বিষয়।
অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার নরুন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সী ও উর্দু বিভাগে ফারসি বিষয়ে বি এ (সম্মান) শেণিতে ভর্তি হয়ে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে এই বিভাগ থেকে বি এ (সম্মান) এবং ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ও ইরানে অনুষ্ঠিত ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ের বিভিন্ন গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগে ফারসির শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে ড. মো. কামাল উদ্দিন তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ২০০৫ সালে ইরান সরকারের বৃত্তি নিয়ে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে ফারসি উচ্চতর গবেষণা প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ‘ফরীদ উদ্দীন আত্তার: কাব্য-প্রতিভা ও সূফীবাদ’। ২০০৯ থেকে ২০১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি ২০১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ফারসি বিভাগে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ‘আনজুমানে ফারসি বাংলাদেশ’ এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইন্সটিটিউশনাল কোয়ালিটি এস্যুরেন্স সেল ( আইকিউএসি)-এর এডিশনাল ডিরেক্টরের দায়িত্বেও নিয়োজিত আছেন।
ড.কামাল উদ্দিনের লেখা “নজরুল ও হাফিজের কবিতা : শিল্প ও বৈশিষ্ট্য” বইটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে নজরুল ও হাফিজের ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যভুবন। দ্বিতীয় অধ্যায় যার শিরোনাম নজরুল ও ফারসি কবিতা এতে স্থান পেয়েছে নজরুলের কবিতায় ফারসি প্রভাব,ফারসি শব্দের ব্যবহার,নজরুলের অনুবাদ সাহিত্য,হাফিজের গজল ভাষান্তর,হাফিজের গজল অনুবাদের তুলনা-প্রতিতুলনা, রুবাইয়াৎ-ই-খৈয়াম, রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ,নজরুল-কাব্যে ফারসি শৈল্পিকতা,হাফিজের প্রিয়ার উদ্দেশ্যে নজরুলের কবিতা,সমাধিঘিরে হাফিজ ও নজরুলের ভাবনা।
তৃতীয় অধ্যায় নজরুল ও হাফিজের কবিতায় শিল্প এখানে রয়েছে নজরুলের কল্পনার আকাশ, হাফিজের কবি-মানস, নজরুল-কাব্যে উপমা ও চিত্রকল্প, হাফিজের, কবিতায় উপমা ও অলংকার,নজরুলের সংগীতভুবন, হাফিজের গজলের দ্যোতনা,নজরুলের শিশু-কিশোর কবিতার ভাবনা। সর্বশেষ চতুর্থ অধ্যায় নজরুল ও হাফিজের কবিতার বৈশিষ্ট্য তে লেখক তুলে ধরেছেন নজরুল ও হাফিজের সৃষ্টি বা রচনাবলিতে মহান আল্লাহর প্রশংসা রাসূল (সা.) প্রশস্তি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের সারথি,কোরআনি চেতনা, ঐশীপ্রেমের দ্যুতি, মূল্যমানের প্রেরণা, ঐশ্বর্যময় ভুবন,সৃষ্টিশীল মনন, সর্বজনীন ভালোবাসা, প্রকৃতির নিসর্গ এইসব বিষয়ের সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ। মোটকথা, গ্রন্থটিতে রয়েছে নজরুল ও হাফিজকে জানার এক অতুলনীয় ও বিশদ উপস্থাপনা। গ্রন্থটি ‘ঝিঙেফুল ‘ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
আমরা সবাই ফারসি সাহিত্য নিয়ে নজরুলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পর্কে জানি, আর তা হলো তিনি ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। যা বাংলা ভাষায় অনূদিত রুবাইয়ের সবচেয়ে সুন্দর অনুবাদ ও বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। রুবাইয়াত বলতে আমরা শুধু ওমর খৈয়াম রুবাইয়াতকেই বেশি জানি। যা ফিৎজেরাল্ট কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত হয়। আর ফারসি কবিতাভুবনের অপর এক বিস্ময় হলো আত্তারের রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতা। যিনি রচনা করেছেন প্রায় আড়াই হাজার ফারসি রুবাই। ওমর খৈয়ামের রুবাই সর্বাধিক সমাদৃত হলেও আত্তারের রুবাই রয়ে গেছে আমাদের চোখের আড়ালে। তিনি একজন রহস্যময় ও আধ্যাত্মিক কবি। তাঁর রুবাইগুলোও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ও মানুষের চিন্তার খোরাক যোগায় ও ভিতরের চিন্তাকে নাড়া দেয়। ড.কামাল উদ্দিন আত্তারের ২০০টি রুবাই বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন। বাংলা ভাষায় এটিই প্রথম অনুবাদ। রুবাই নিয়ে তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম ‘ফরিদ উদ্দিন আত্তার-এর রুবাই’। এর শেষে ফারসি ও বাংলা রুবাই’র নম্বরবিন্যাস সাজানো রয়েছে। যা ফারসি গবেষণায়ও খুবই সহায়ক ভূমিকা রাখে। বইটি ‘ঝিঙেফুল’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়াও ড.মো. কামাল উদ্দিন নিয়মিত পত্র-পত্রিকায় লেখা-লেখি ও গবেষণা করছেন। তাঁর রচিত আরেকটি বই হলো: ‘ফরিদ উদ্দিন আত্তার: কাব্য ও সুফি দর্শন’ এটি মূলত তাঁর পিএইচডি থিসিসের ওপরে লিখিত বই। বইটি ‘পরিলেখ’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। পাঁচ অধ্যায়ের এই গ্রন্থটিতে সুফি কবি ফরিদ উদ্দিন আত্তার সম্পর্কে জানা-অজানা খুৃঁটিনাটি সব তথ্য,সাহিত্যকর্ম ও সেগুলোতে ব্যবহৃত ভাষা ও কাবশৈলীর আলোচনা করার পাশাপাশি ইরানের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসসহ ফারসি কাব্যসাহিত্যের বিভিন্ন গবেষণামূলক তথ্য বিশ্লেষিত হয়েছে।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা ছাড়াও তিনি দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের পাশাপাশি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে নিয়মিত গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করছেন। বাংলা, ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় রচিত বিভিন্ন গবেষণা পত্রিকায় এ পর্যন্ত প্রকাশিত ড. মো. কামাল উদ্দিনের গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা ৩৫ এর অধিক।
সুজন পারভেজ
শিক্ষার্থী, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।