সোমবার, ৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

নওরোয- নতুন দিনের উৎসব

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ২৪, ২০১৩ 

news-image

তিনি হাজার বছর পূর্বে তাহমূরাস-এর ভাই জামশীদ চাইলেন, আপন জাতির জন্য একটি উৎসবের আয়োজন করবেন। সূর্য ‘হামাল’ কক্ষপথে পরিবর্তনের শুভক্ষণে তিনি এক বিশাল মিলনায়তনে তাঁর অলঙ্কৃত সিংহাসনে আরোহণ করলেন। রঙ-বেরঙের মণিমুক্তা খচিত একটি মুকুট মাথায় পরিধান করলেন আর লোকদেরকে তাঁর সাক্ষাতের জন্য সময় দিলেন।

সূর্যের কিরণ মুকুটের রং-বেরঙের মণিমুক্তার ওপর পড়ছিল আর বিজলীর মতো চমকাচ্ছিল। উপস্থিত লোকেরা তখন বিস্ময়ে হতবাক। কারণ, এ পর্যন্ত এত শান-শওকত, এত জৌলুস আর কখনো দেখে নি তারা। তাই বলল, এই দিন নতুন দিন। একে অপরকে মোবারকবাদ জানাল। শুভেচ্ছা বিনিময় করল। জামশীদকে তখন বলা হত ‘জাম্’। কিন্তু এদিনের পর থেকে তাতে যুক্ত করা হল ‘শীদ্’ মানে কিরণ, সূর্যের রশ্মি।

জামশীদ জনগণকে সুন্দর সুদপদেশ দিলেন। সুন্দর অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য পরামর্শ দিলেন। আর সেই দিনটিকে জাতীয় উৎসবের দিন হিসাবে নির্ধারণ করলেন।

নতুন দিন, পরিভাষায় নওরোয। বিশ্বের সকল উৎসবের ওপর নওরোযের চিরায়ত অহংকার আছে। কারণ, কোনো চাপিয়ে দেয়া রাজনৈতিক উৎসবের সাথে এক প্রকার কৃত্রিম সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে এ উৎসবের সৃষ্টি হয় নি। এটি বিশ্ব উৎসব। যমীন, আসমান, সূর্যেরই আনন্দের তিথি। পত্রপল্লবের বিকশিত হওয়া, উদ্গম হওয়া ও যেকোনো সূচনার প্রাণবন্ত উৎসরণের দিন নওরোয।

নওরোয এক বিরাট স্মৃতির রোমন্থন। এ স্মৃতি প্রকৃতির সাথে মানুষের আত্মীয়তার। প্রকৃতির বিস্মৃতি-প্রবণ সন্তান মানুষ দৈনন্দিন কাজে-কর্মে তার মা প্রকৃতিকে ভুল যায়। কিন্তু যখন শিহরণ জাগানো বসন্ত আসে, তখন সে মায়ের আঁচলে ফিরে যায়। এই যে ফিরে যাওয়া, পুনঃসাক্ষাৎ, একে নওরোয উৎসব হিসাবে পালন করা হয়। তখন মায়ের কোলে সন্তান নিজকে ফিরে পায়। আর সন্তানের পাশে মায়ের চেহারা বুকভরা আনন্দে বিকশিত ও প্রস্ফুটিত হয়। আনন্দাশ্রু প্রবাহিত হয়। নতুন জীবন ফিরে পায়, প্রাণবন্ত হয়। উদ্ভিদ ও গাছ-গাছালির এই যে নতুন উদ্গম, আসলে এ মুহূর্তটি ইউসুফকে ফিরে পেয়ে দৃষ্টিলাভ ও জাগ্রত হওয়ার আনন্দঘন তিথি। তাই দিনটি আলোকোজ্জ্বল হয়, আকাশ থাকে মেঘমালাশূন্য।

প্রতি বছর, এমনকি যে বছর আলেকজান্ডার আমাদের জাতির তাজা রক্তে এই মাটির চেহারা রক্তিম করেছিল, সেই বছরও জামশীদের সিংহাসন হতে যখন ভয়াবহ লেলিহান শিখা কুন্ডলী থেকে উত্থিত হচ্ছিল, তখনও সেখানে একই সময়ে আমাদের জনগণ আরো বলিষ্ঠভাবে আরো দৃঢ় প্রত্যয়ে দীপ্ত হয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে নওরোয পালন করেছিল।

প্রত্যেকে কি একথা অনুভব করে না যে, বসন্তের প্রথম দিনটি সৃষ্টির প্রথম দিন? আল্লাহ্ তা’আলা একদিন বিশ্বকে সৃষ্টি করে থাকলে সেদিনটি ছিল আজকের নওরোয। নিশ্চিতভাবেই বসন্ত সৃষ্টিলোকের প্রথম ঋতু। ফারভারদিন প্রথম মাস ও নওরোয প্রথম দিবস। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ জগৎকে শরৎ, হেমন্ত, শীত বা গ্রীষ্ককাল দিয়ে শুরু করেন নি। নিশ্চিতভাবেই বসন্তের প্রথম দিনেই সবুজের সমারোহ শুরু হয়েছে, খাল-নদীর পথচলা, অংকুরের উদ্গম আর কিশলয়ের পল্লবিত হওয়া আজকের দিনেই শুরু হয়েছে।

ইসলাম জাতীয়তা ও গোষ্ঠীপ্রথার সকল রং দূরিভূত করেছে। সকল প্রথার বিবর্তন সাধন করেছে। ইসলামই নওরোযকে অধিকতর ঔজ্জ্বল্য দান করেছে। তার প্রতিটি পাতা পরস্পরের সাথে ভাঁজ দিয়ে নতুন করে বাঁধাই করেছে আর মজবুত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ইরানীদের মুসলমানী জিন্দেগীর অধ্যায়টিতে ধ্বংসের আশঙ্কা হতে নওরোযকে নিরাপদ করেছে।

নওরোয এতকাল জাতীয়তার চেতনায় জীবন্ত ছিল। এবার ধর্মীয় চেতনায় প্রাণবন্ত হয়েছে। জাতীয় ও বংশগত প্রথা, ধর্মীয় ঈমান আর জনগণের মনে সৃষ্ট নতুন প্রেমে সিক্ত হয়ে মজবুত ও অটুট বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। পবিত্রতা অর্জন করেছে, ঈমান ও নিষ্ঠায় আকীর্ণ আর দোয়া ও দরূদে অলংকৃত হয়েছে।

নওরোয শুরু হয়েছিল অগ্নিউপাসক পুরোহিতদের ধর্মীয় গানে, আভেস্তার পাঠ দিয়ে আর আহুরামাযদার আশীর্বাদ নিয়ে; কিন্তু ইসলামের আগমনের পর কুরআন ও আল্লাহর ভাষা দিয়ে আর নামায ও দোয়ার আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে নতুন প্রাণ পেয়েছে।

নওরোয কলুষিত কালচক্রের এই অশীতিপর বৃদ্ধ- অনেক শতাব্দীর ধুলোবালি তার চেহারায় এসে বসেছে সত্য, কিন্তু নতুনের প্রাণস্পন্দনে সে নিজেই সকলের চেহারা থেকে কালিমার আঁচড়ে ধুয়েমুছে সাফ করে দেয়। নওরোয তার মহান দায়িত্ব সবসময় প্রচণ্ড শক্তি, প্রেম, বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে আঞ্জাম দিয়েছে। জাতির চেহারা হতে দুঃখ-দুশ্চিন্তা ও ম্রিয়মানতার জং পরিষ্কার করেছে। আর মানুষের প্রাণকে প্রকৃতির আনন্দ-উচ্ছল প্রাণের সাথে যুক্ত, একাত্ম ও একাকার করেছে।

অনুবাদ: ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী