মঙ্গলবার, ১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

তায়েফে মহানবী (সা.)

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৬ 

news-image

হযরত আবু তালিব ও হযরত খাদিজা ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর একনিষ্ঠ সমর্থকদের অন্যতম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো তাঁরা মহানবী (সা.)-কে শোকের সাগরে ফেলে মাত্র অল্প কিছু দিনের মধ্যে পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন। এভাবে মহানবী (সা.) তাঁর প্রতি যত্নশীল একজন চাচাকে এবং একজন প্রিয় স্ত্রীকে হারান।

ইসলামের শত্রুরা এতে খুব স্বস্তিবোধ করতে থাকে। কেননা, মহানবী (সা.)-কে রক্ষা করতে এখন আর কেউ এগিয়ে আসবে না। আবু তালিবের ইন্তেকালের কিছুদিন পর এক গলিপথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এক মহিলা বাড়ির জানাল দিয়ে মহানবী (সা.)-এর ওপর ময়লা ফেলে দেয়। তিনি মাথায় মাটি ও ধুলো-ময়লা ভর্তি অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন। কিশোরী কন্যা ফাতিমা (আ.) তখন তাঁর পাশে বসে সান্ত্বনা দিলেন এবং ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে দিলেন।

এভাবে মক্কার পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠলে মহানবী (সা.) তায়েফে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ভেবেছিলেন, তথাকার সাকিব গোত্রের লোকদের কাছে আল্লাহর দাওয়াত পৌঁছে দিবেন। তায়েফের আবহাওয়া ছিল খুবই সুন্দর ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল নয়নাভিরাম।

মহানবী (সা.) ভালোভাবেই জানতেন যে, তায়েফের লোকজন মক্কার লোকদের থেকে আলাদা ছিল না। তারাও পুতুলপূজা করত এবং মক্কার লোকদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখত। কিন্তু তিনি তাতে হতাশ হননি। তায়েফে প্রবেশ করেই তিনি তাঁর নবুওয়াতের কথা ঘোষণা করেন, কিন্তু সেখানকার লোকজন তাঁকে বিদ্রূপ করতে থাকে। একজন বলল : ‘আল্লাহ তাঁর নবী বানানোর জন্য তোমাকে ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাননি?’ অপর একজন বলল : ‘আমি কি বোকা না চোর যে, তোমাকে নবী বলে বিশ্বাস করব।’ আল্লাহর নবীর সাথে সেদিন এভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছিল।

ইসলামের প্রচার কাজ থেকে নবী করিম (সা.)-কে বিরত রাখার জন্য তায়েফের লোকের তাঁর পেছনে একদল বখাটে ছেলে লাগিয়ে দেয়। তারা বিভিন্নভাবে তাঁকে কষ্ট দিত এবং তাঁর প্রতি পাথর নিক্ষেপ করত।

নবী করিম (সা.) একদিন ক্লান্ত ও আহত অবস্থায় নিকটবর্তী একটি বাগানে আশ্রয় নেন। বাগানটির মালিক ছিল কুরাইশ গোত্রের দুই সম্পদশালী সর্দার উতবা ও শাইবার। নবী করিম (সা.) যখন ঐ বাগানে প্রবেশ করে একটি গাছের নিচে বসে পড়েন তখন সর্দারদ্বয় সেখানে উপস্থিত ছিল। নবী (সা.) ছিলেন একা। তিনি আসমানের দিকে মুখ উত্তোলন করলেন এবং কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করলেন : ‘হে আল্লাহ!  আমার দুর্বলতা, অক্ষমতা, সহায়-সম্বলহীনতা, বিচক্ষণতার অভাব এবং মানুষের কাছে আমার নগণ্যতা ও অবজ্ঞা-উপেক্ষার জন্য আপনার কাছেই আমি ফরিয়াদ করছি। হে শ্রেষ্ঠ দয়াবান! আপনি দুর্বল ও উপেক্ষিতদের প্রতিপালক। আপনি আমারও প্রতিপালক। কার রহম ও করুণার ওপর আপনি আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন? আমার সাথে যে নিষ্ঠুর আচরণ করে সেই অনাত্মীয়ের ওপর, না সেই শত্রুর ওপর যে আমার ওপর প্রভাবশালী ও পরাক্রান্ত হয়ে উঠেছে? আমার ওপর আপনি যদি অসন্তুষ্ট না হয়ে থাকেন তাহলে আমি কোন কিছুর পরোয়া করি না। তবে আপনি যদি স্বস্তি ও নিরাপত্তা দান করেন, তাহলে আমার জন্য তা হবে নিঃসন্দেহে স্বস্তির কারণ। আমি আপনার সেই জ্যোতির আশ্রয় চাই যার আবির্ভাবে সকল অন্ধকার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এবং যার সাহায্যে দুনিয়া ও আখেরাতের সকল সমস্যার সুরাহা হয়। আপনার সকল অসন্তুষ্টি আমি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত। আপার সাহায্য ছাড়া আর কোন উপায়ে শক্তি-সামর্থ্য লাভ করা সম্ভব নয়।’

উতবা ও শাইবা এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করছিল। তারা তাদের ভৃত্য আদাসের মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর কাছে এক থালা আঙুর ফল পাঠাল।

আদাস ছিল একজন খ্রিস্টান। সে আঙুরগুলো নিয়ে মহানবী (সা.)-এর কাছে গেল এবং তাঁকে তা খাওয়ানোর চেষ্টা করল। আঙুর মুখে দেয়ার সময় মহানবী (সা.) বলে উঠলেন : ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ (দয়ালু মেহেরবান আল্লাহর নামে)। আদাস এর আগে এ ধরনের কথা আর কখনও শোনেনি। এই নির্জন ও নিপীড়িত অবস্থার মধ্যেও মহানবীকে আল্লাহ তাআলার রহমত ও সাহায্য প্রার্থনা করতে দেখে আদাস খুবই মুগ্ধ হলো।

সে জিজ্ঞাসা করল : ‘আপনি কে?’

মহানবী (সা.) জবাব দিলেন : ‘আমি আল্লাহর নবী। তুমি কোথা হতে এসেছ?’

ভৃত্য বলল : ‘আমার নাম আদাস, আমি একজন খ্রিস্টান। আমি নায়নাভা থেকে এসেছি।’

নবী করিম (সা.) বললেন : ‘নায়নাভা? তুমি এমন এক জায়গা থেকে এসেছ যেখানে আমার ভাই ইউনুস বিন মাত্তা বসবাস করতেন।’

আদাস এই নামটি শুনে বিস্মিত হলো। সে বলল : ‘আপনি কি ইউনুসকে চিনেন? এখানকার কেউ তাঁকে চেনার কথা নয়। এমনকি নায়নাভাতেও  খুব বেশি হলে দশ জন লোক তাঁর পিতার নাম জানতে পারে।’

মহানবী (সা.) বললেন : ‘আমি তাঁকে চিনি এই কারণে যে, তিনি আমার মতোই আল্লাহর নবী ছিলেন।’

আদাস নতজানু হয়ে মহানবী (সা.)-এর সামনে বসে তাঁর হাতে চুম্বন করল এবং ইসলাম গ্রহণ করল।

(নিউজলেটার, অক্টোবর ১৯৯১)