রবিবার, ২২শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

English

ঢাকায় ‘নজরুল সাহিত্যে ফারসির প্রভাব’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত

পোস্ট হয়েছে: মে ২৮, ২০২৫ 

news-image

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আজ বিকেলে নজরুল সাহিত্যে ফারসির প্রভাব’ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। কবি নজরুল ইনস্টিটিউটআন্জুমানে ফারসি বাংলাদেশ ও ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল সেন্টারের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সেমিনারে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মানসুর চাভোশি। সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের  ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান ও ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীরমোহাম্মদী।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হোসনে আরা। কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মো. লতিফুল ইসলাম শিবলীর সভাপতিত্বে সেমিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আন্জুমানে ফারসি বাংলাদেশ-এর সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন। সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান ও আন্জুমানে ফারসি বাংলাদেশ-এর সাধারণ সম্পাদক ড. মো. মুমিত আল রশিদ।

সেমিনারে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মানসুর চাভোশি বলেন,  বাংলা ও ফারসি ভাষার মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা অনেক কাছের এবং গভীর। আমার মনে হয় নজরুল শুধু ফারসি ভাষা বা পরিভাষাকে আয়ত্ত করেননিফারসির প্রাণসত্তাকে ভাষান্তরিত করার চেষ্টা করেছেন। নজরুল ইন্সটিটিউট এর সাথে আরো কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে তিনি বলেনআমার মনে হয় আন্‌জুমানে ফারসি বাংলাদেশ ও নজরুল ইন্সটিটিউট বাংলা ও ফারসি ভাষার পারস্পরিক অনুবাদের উদ্যোগ নিতে পারে। এই দুটি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বিশেষ কর্মশালার আয়োজন করতে পারে। হাফিজের গজল এবং কবিতার মধ্যে যে সংগীত ও ছন্দ তথ্য আছে সেগুলো নিয়েও কাজ করতে পারে নজরুল ইনস্টিটিউট। নজরুলের সাহিত্য সাধনাকে ইরান ও বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্যের সেতুবন্ধন হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন,  বিশ্বের সকল মহান কবি দার্শনিকদের মনের ভাষা এক এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই নজরুল ফারসি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন এবং অনেক ফারসি শব্দ ব্যবহার করে সাহিত্য রচনা করেছেন। ফারসি সাহিত্যে যেমন স্বাধীনতামানবতাপ্রেমের কথা রয়েছে, নজরুলের সাহিত্য কর্মেও তা লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেন, আজকের এই অনুষ্ঠান শুধু নজরুলের অতীত সাহিত্য রোমন্থন করার জন্য নয়; বরং তাঁকে নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করার জন্যও বটে।

সেমিনারের বিশেষ অতিথি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন,  কাজী নজরুল ইসলাম যখন কবি হিসেবে আবির্ভূত হন তখন বাংলা সাহিত্যের জগতকে আলোকচ্ছটায় প্রভাবিত করে রেখেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর প্রভাবের মধ্যেই নজরুল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এক স্বতন্ত্র মহিমায়। স্বল্প সময়ের মধ্যেই সাহিত্যের প্রতিটি অঙ্গনে তাঁর সরব ও সক্রিয় উপস্থিতি ছিল। নজরুলের কাব্যে ফারসি ভাষার দখলের কিছুটা তিনি পারিবারিক পরিমণ্ডলেই আত্মস্থ করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে সৈনিক হিসেবে করাচিতে গিয়ে ফারসি শিখেছিলেন। নজরুলের কাব্যে পারস্যের কবি হাফিজ ও ওমর খৈয়ামের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন,  ফারসি ভাষা ও সাহিত্যকে ইরানের সরকার যেমনভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে তেমনভাবে অন্য বিদেশী ভাষাগুলো আমাদের দেশে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় না। উদাহরণ হিসেবে তিনি আরবি ও উর্দু বিভাগের কথা বলেন।

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে সাহিত্যচর্চা বিশেষ করে নজরুল সাহিত্যচর্চার উপযোগিতা কতটুকু তা তুলে ধরে ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন,  আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাইনজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।  দেশের  স্বার্থে  যেকোন আন্দোলনে  প্রেরণা হিসেবেশক্তি হিসেবে নজরুলের বাণী বারবার উচ্চারিত হয়েছে।

আমরা গভীর একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে আছে গাজামধ্যপ্রাচ্য, এমনকি ইরানের উপরও সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের আগ্রাসন চলছেবাংলাদেশেও আমরা খুব একটা স্বস্তির মধ্যে নেই। এই অবস্থার মধ্যে নজরুলের সাম্য ও মানবতার বাণী নতুন করে আমাদের পথের দিশা দিতে পারে।

সেমিনারে ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ রেজা মীরমোহাম্মদী বলেন, ইরান ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদারের ক্ষেত্রে  বিস্তৃত এবং গভীর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি এবং প্রেক্ষাপট রয়েছেযার মধ্যে একটি হলো ফারসি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পারস্পরিক প্রভাব।
তিনি বলেন, ৭০০ বছর আগেবাংলার  শাসক সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ যখন ইরানের কবি হাফেজ শিরাজিকে বাংলায় ভ্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানান তখন তিনি  ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলায় ভ্রমণ করতে না পারায়  কবি হাফিজ সুলতান গিয়াসউদ্দিনের কাছে একটি গজল লিখে পাঠন। ঐ গজলে লেখা হয়,  

 

আজকে পাঠাই বাংলায় পারস্যের এই ইক্ষু শাখা  

তাতেই হবে ভারতের সকল তোতার চঞ্চু মিষ্টি মাখা    

এই কবিতা দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের ভূমিকা, তার গুরুত্ব এবং গভীরতা প্রদর্শন করে।

জনাব মীরমোহাম্মদী বলেন, যখন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ফারসি কবিতা ও সাহিত্যের জাদুর সাথে পরিচিত হন এবং হাফেজখৈয়ামরুমি এবং সাদির মতো মহান ফারসি কবিদের দ্বারা মুগ্ধ হনতখন এই সাহিত্যিক বন্ধনের ধারাবাহিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এটা ফুটে ওঠে যে, সাহিত্যই সেই সেতু যা শতাব্দীকাল ধরে দুই দেশকে সংযুক্ত করে রেখেছে।

 

অনুষ্ঠানের সভাপতিকবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মোঃ লতিফুল ইসলাম শিবলী বলেননজরুলের জীবনীতে করাচি পর্বটা পড়লে দেখা যায় তাঁর সাহিত্যের যে উন্মেষসাহিত্য চেতনার জাগরণের স্থান করাচিতেই। তিনি সেখানে ফারসি কবি-সাহিত্যিকদের সাথে পরিচিত হনতাঁদের লেখা দ্বারা প্রভাবিত হন এবং সেখানেই  তিনি ফারসি ভালোভাবে আত্মস্থ করেন।

তিনি বলেনআমাদের আদি রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি। আবার আমরা যারা ইসলামের সাহিত্যকুরআনহাদিসতাফসির পড়েছি এসব কিছুর অনুবাদে প্রভাব ছিল ফারসি ভাষার। ব্রিটিশরা উপমহাদেশে ক্ষমতাসীন হয়েই কিন্তু ফারসি ভাষা বন্ধ করতে পারেনি। আইনআদালত  রাষ্ট্রীয় কর্মের ভাষা হিসেবে ফারসি তখন এতটাই অপরিহার্য ছিল যে, তারা হঠাৎ করে বন্ধ করতে পারেনি। অবশেষে ১৮৩৭ সালে আইন করে ফারসি ভাষা নিষিদ্ধ করে। তারা শুধু আমাদের উপর অর্থনৈতিক আগ্রাসনই চালায়নিঅনেক বড় আকারে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও চালিয়েছিল। সেই আগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরবি ও ফারসি।

ফারসিকে আমাদের ঐতিহ্যের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেনএই ভাষাকে নিজেদের সাথে আরো বেশি যুক্ত করতে হবে।  আমরা যেমন পারস্য ও সেখানকার শিল্প-সাহিত্যকে নজরুলের চোখ দিয়ে দেখিঠিক তেমনি আমরা পারস্যবাসীকে আমাদের নজরুলকে চেনাতে চাই।

সেমিনারের প্রবন্ধ উপস্থাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  বাংলা বিভাগের  অধ্যাপক  হোসনে আরা  বলেনইরান  ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষ করে বাংলার মধ্যে সম্পর্ক অনেক গভীর ও প্রাচীন। তিনি বলেন, মূলত ইরানি  ভারতীয় একই আর্যগোষ্ঠীর দুই শাখা। তাই চিরদিনই ভারত ও পারস্যের আত্মা সমসূত্রে গ্রথিত।

পারস্যের কবি হাফিজ লিখেছেন,

আজকে পাঠাই বাংলায় এই ইক্ষু শাখা 

তাতেই হবে ভারতের সকল তোতার চঞ্চু মিষ্টি মাখা।

অর্থাৎ ফারসি ভাষার মিষ্টি বাংলায় পাঠালে সেই মিষ্টিতে সমগ্র  ভারতের মানুষের ভাষা আরও মিষ্টি হয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়ে কবি বাংলাকে যে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বাংলাকে তিনি কতটুকু ভালবাসেন তার প্রমাণ মেলে অপরদিকে বাংলার অনেক কবি সাহিত্যিক ফারসি  কবিতা  সাহিত্যের দ্বারা দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন বিশেষ করে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মে ফারসির প্রভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়। তিনি কেবল তাঁর সাহিত্যকর্মে ফারসি শব্দই ব্যবহার করেননি। তিনি অনেক ফারসি রুবাইয়াৎ সরাসরি অনুবাদ করেছেন। বিদেশি শব্দের মিশ্রণে বিশেষ করে ফারসি শব্দের মিশ্রণে কবি নজরুলের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।  নজরুল ফারসি সাহিত্য দ্বারা এতোই প্রভাবিত ছিলেন যে, কেউ কেউ বলতেন, ইরান কবির দ্বিতীয় মাতৃভূমি।

অধ্যাপক হোসনে আরা বলেন, সুলতান গিয়াস উদ্দিনের  আমন্ত্রণে কবি হাফিজ বাংলায় আসতে না পারলেও নজরুলের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারেননি। রুবাইয়াতে হাফিজ  অনুবাদ করে কবি নজরুল সবসময়ের জন্য বাংলায় এনেছেন কবি হাফিজকে।

অনুষ্ঠানে আন্জুমানে ফারসি বাংলাদেশ-এর সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ইরান ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ইতিহাস-সংস্কৃতিভাষা-সাহিত্যের সাথে জড়িয়ে আছে ফারসি। বাংলা সাহিত্যের সাথে ফারসি সাহিত্যের সম্পর্ক নিবিড়। ফারসি সাহিত্যের ঐশ্বর্য ধারণ করে সমৃদ্ধ হয় বাংলা সাহিত্য। ফারসি সাহিত্যের ভাবনা ও শৈল্পিকতা কাব্যাকারে প্রকাশ করেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরল ইসলাম। নজরুলের সাহিত্যে ফারসি কবিদের ভাবনার প্রতিফলন ঘটে অনুবাদ সাহিত্যে। ফারসি কবিতা কাব্যাকারে অনুবাদে নজরুল বিস্ময়কর প্রতিভা। ওমর খৈয়ামের রুবাই মূল ফারসি থেকে অনূদিত হয়ে বাংলা সাহিত্যভুবনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ইরানি কবিদের মানবিক মূল্যবোধ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। নজরুল ও হাফিজের কবিতায় মানবতার জয়গান উচ্চকিত হয়।

তিনি বলেনইরানের বিখ্যাত কবি হাফিজওমর খৈয়ামশেখ সাদি ও মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমিকে ধারণ করেই নজরুল বিদ্রোহী কবিপ্রেমের কবিমানবতার কবি।

সেমিনারের শুরুতেই পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত করেন দেশের বিশিষ্ট  ক্বারী এ কে এম ফিরোজ।