মঙ্গলবার, ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

English

গণ-সামরিক সার্ভিসের শেষ দিনে শহীদ-হওয়া সেই ইরানি যুবকের কাহিনী

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৫ 

news-image

পবিত্র প্রতিরোধ ও বীরত্বময় যুদ্ধের শহীদ মেহেদী কাহরেমানির জীবনের একটি বর্ণনা বেশ উল্লেখযোগ্য। এই মহান শহীদ বাধ্যতামূলক সেনা সার্ভিসের সদস্য ছিলেন। তিনি এই সার্ভিসের দিনগুলো শেষ হলে কি করবেন তার স্বপ্ন দেখতেন।

(উল্লেখ্য ইসলামী ইরানে প্রত্যেক যুবকের জন্য দুই বছর সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া ও সামরিক সেবা দেয়া অথবা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে ন্যুনতম বেতনে চাকরি করা বাধ্যতামূলক, ফার্সি ভাষায় একে বলা হয় সারবজি বা সৈনিকতা।)

চলতি বছরের তথা ২০২৫ সালের (ফার্সি ১৪০৪ সালের) ২ জুলাই, তেহরানের আফসারিয়েহ ব্যারাকে ইহুদিবাদী ইসরায়েলি আগ্রাসনে ২০ বছর বয়সী এক যুবক মেহদি কাহরেমানি শহীদ হন; এর পরের দিন তার সামরিক চাকরির সমাপ্তি উৎসব উদযাপন করার কথা ছিল।

কারবালার বিখ্যাত শহীদ হযরত আলী আকবর ইবনে ইমাম হুসাইন-আ’র স্মরণে রচিত শোক-সঙ্গীত বা মর্সিয়ার ধ্বনি ঘরের সর্বত্র শোনা যাচ্ছিল। বিলাপরত মা গুনগুন করে বলছেন, “মাহদি জান!, মাহদি জান!” বাবা এক কোণে ঝুঁকে পড়ে আছেন। মেহমানরা আসছেন এবং যাচ্ছেন। তার গুনগুন বিলাপ ও শোকার্ত কথামালার ফরিয়াদ ক্রমেই উচ্চকিত হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, “তোমার মুখের কোথায় চুমু খাবো? প্রিয়, তোমার মুখেরই কোনো অংশ যে আর অবশিষ্ট নেই।”

ইস্! যদি সকালে যাওয়ার আগে তাড়াহুড়ো না করতে, তাহলে আমি তৃপ্ত চিত্তে তোমাকে দেখতাম। এখন থেকে, তোমার মা চিরকাল তোমার চাঁদমুখ না দেখতে পারার আক্ষেপে তথা তোমার মৃত্যুতে আকুল হয়ে শোক করবে।

ঘটনার দিন, শহীদ মেহেদী কাহরেমানির মা মিসেস আজম তালায়ি তেহরানস্থ বাকিয়াতুল্লাহ (ইমাম মাহদি-আ.) হাসপাতালে তার কর্মক্ষেত্রে ছিলেন, মেহেদীর জন্য তার অন্তরে এক অজানা আশাঙ্কা জেগে উঠছিল। সকালে যখন মেহেদি ব্যারাকে গিয়েছিল, তখন থেকেই তার আত্মা মেহদির জন্য অস্থির ছিল। ক্লান্ত মা আমাদের সাথে কথা বলার জন্য তার শক্তি সঞ্চয় করে বলেছেন: “যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন সে আমাকে তার কমান্ডারের নম্বর দিয়েছিল যাতে আমি চিন্তিত হলে তাকে ফোন করতে পারি।”

“আমি সেদিন ফোন করেছিলাম। কমান্ডার বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, মিসেস তালায়ি, মেহেদী ভালো আছে।’ কমান্ডারের এই কথাটাও আমার মন ভালো করেনি। আমি আবার কমান্ডারের নম্বরে ফোন করলাম। এবারও কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।”

সকাল ১০টায়, যখন আফসারিয়েহ ব্যারাকে বোমা হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ে, তখন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় মিসেস তালায়ির মানসিক নিরাপত্তা বলে কিছুই রইল না; তিনি মেহেদীর বাবাকে ফোন করেন এবং তারা একসাথে ব্যারাকের দিকে রওনা দেন। আজম তালায়ি বলেন: “আমরা তখনও ব্যারাকে পৌঁছাইনি যখন আমার ফোন বেজে উঠল। ফোনটি মেহেদীর বন্ধুর। তিনি বললেন: খালা, তুমি কি মেহেদীর কোনো খবর শুনেছো? তারা আফসারিয়েহ ব্যারাকে বোমা হামলা করেছে…”

ইয়া হোসেইন বলে মা তখন ফরিয়াদ করলেন! মেহেদির বাবা তখন গাড়িটি এক কোণে রেখে একত্রে ব্যারাকের দিকে চলে যান। তারা যা দেখতে পান তা হল ধোঁয়া এবং ব্যারাকের দিকে ছুটে আসা ভিড়। একজন লোক চিৎকার করে বলেন: আহত এবং শহীদদের বেসাত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মা বলেন: “আমরা যখন হাসপাতালে প্রবেশ করি, তখন একজন কমান্ডার এগিয়ে এসে মেহেদীর শাহাদাত লাভের কথা ঘোষণা করেন।”

মেহেদী যখন ১৮ বছর বয়সে পা রাখে, তখন সে সিদ্ধান্ত নিল যে তাকে বাধ্যতামূলক সেনা-সার্ভিসে যোগ দিতে হবে। তার মা বললেন, “আমি এর বিপক্ষে অনেক জোরাজুরি করে বলেছিলাম যে, এতো বেশি তাড়াতাড়ি বা খুব আগে হয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ এই সার্ভিসে যাওয়ার সময় এখনও তোমার হয়নি । আমরা তোমার ২০তম জন্মদিন উদযাপন করার পরই সেনাবাহিনীতে যোগদান করো।” আমরা রাজি না হলেও সে পীড়াপিড়ী করছিল সেনা-সার্ভিসে যেতে। অবশেষে, সে তার সামরিক পোশাক পরে নিল।

মেহেদীর নীতিবোধ এবং চরিত্র সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে আজম তালায়ি অধৈর্য হয়ে পড়েন: “আমার ছেলের সামরিক চাকরি শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং সে তার চাকরির সার্ভিস শেষ হওয়া সংক্রান্ত স্বীকৃতি কার্ডে কমান্ডারের স্বাক্ষরও করা হয়ে গিয়েছিল। সেদিনটি ছিল তার চাকরির শেষ দিন, কিন্তু শেষ দিনটিতে তার আর বেঁচে থাকার ভাগ্য ছিল না। আমার ছেলে ছিল সভ্রান্ত। আমি তার পবিত্র আত্মার শপথ করছি যে আমি তাকে কখনও ঘরে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি। সে কখনো নিজে রেফ্রিজারেটরের দরজা খুলত না বা সেখান থেকে কিছু বের করে খেত না।, সে বলত, অপেক্ষা কর, মা আসলে একসঙ্গে খাব। বেচারা মেহেদি খুব অসহায় ছিল, যুদ্ধের দিনগুলোতে নিরবতা তার অসহায়ত্বকে বাড়িয়ে তুলেছিল। আমি বেশিরভাগ সময় শিফট ডিওটিতে থাকতাম, প্রাণভরে তার দিকে তাকিয়ে থাকার সৌভাগ্য হল না-এ দুঃখ আমি কোথায় রাখি? বাচ্চাদের মানসিক শান্তির জন্য আমি বাড়িতে কাঁদতে পারি না, আর আমাকে হাসপাতালের রোগীদের দেখাশোনা করতে হয় বলে সেখানেও কাঁদতে পারি না। মাত্র কয়েকদিন আগে, তার বোন মাহসা তাড়াহুড়ো করে আমার কাছে এসে বলল, “মা, আমি মেহেদীকে দেখেছি। মনে হচ্ছিল যেন সে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি সম্প্রতি তার বোন মাহসাকে বলেছিলেন যে আমি শহীদ হব, আমার সমাধিফলকে লিখতে ভুলো না, ” যুবকের অকালে মৃত্যু বা অপরিণত বয়সে মৃত্যু।”

শহীদ মেহেদী কাহরেমানি মূলত আর্দেবিল অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। তার মায়ের মতে, তিনি সর্বদা আর্দেবিলি জনগণের গৌরব, ব্যক্তিত্ব এবং বীরত্বের কথা বলতেন। যখন তিনি শহীদ হন, তখন তাকে আর্দেবিল প্রদেশে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার পবিত্র দেহ সেখানেই সমাহিত করা হয়।

পার্স টুডে/