বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

কবি হোসাইন শাহরিয়ার ও তাঁর কাব্য ভাবনা

পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ২২, ২০১৮ 

 

কবি হোসাইন শাহরিয়ার ও তাঁর কাব্য ভাবনা
তারিক সিরাজী*

আমরা জানি যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইরানে নাগরিক স্বাধীনতার দাবি মূর্ত হয়ে ওঠে। সে সময় দেশে এক প্রচণ্ড সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়। দীর্ঘস্থায়ী এ আন্দোলন ও দাবি অবশেষে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মুজাফ্ফর উদ্দীন শাহ কাজার মেনে নেন। সাংবিধানিক আন্দোলন জয়ী হওয়ার পর ইরানে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই ফলে সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত হয়। সাথে সাথে জনগণের মধ্যে দেশপ্রেমের ভাবধারাও উচ্চকিত হয়ে ওঠে। এর পাশাপাশি ইরানের কবি-সাহিতত্যিকরা জাতীয়তাবাদের নতুন ভাবধারায় উজ্জীবিত হন।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইরানে ইনকিলাবে মাশরুতিয়াত১(সাংবিধানিক বিপ্লব)-এর প্রাক্কালে স্বাধীন লেখক ও কবিদের মধ্যে একটি নতুন চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে। এ চিন্তাধারাটি ছিল স্বাধীনতা ও সর্বজনীনতার ভাবধারায় পরিপুষ্ট অর্থাৎ তাঁরা স্বাধীন ভাবধারা, সর্বজনীনতা ও স্বকীয়তার আদর্শকে তাঁদের কাব্য ও সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় হিসাবে গ্রহণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। সমকালীন যুগে এসেও তাঁরা এ চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটাতে থাকেন। কিন্তু এ সকল কবি-সাহিত্যিক অন্যসব মানুষের মতোই সমাজে বিরাজমান নানাবিধ সমস্যার জালে বন্দী হয়ে পড়েন। এ বন্দিদশা থেকে নিজেদের ও জনগণের মুক্তির জন্য তাঁরা লেখনী ধারণ করেন।
এক শ্রেণির কবি-সাহিত্যিক তাঁদের সমাজ সংস্কারমূলক চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটাতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরা তাঁদের সাহিত্যকর্মে শ্রম ও শ্রমজীবী মানুষের কথা একটি ভিন্ন বিশ্বাস ও ভিন্ন আঙ্গিকে নানাভাবে তুলে ধরেন। আবার এ সময়ই এক শ্রেণির তোষামোদে কবি-সাহিত্যিকেরও আবির্ভাব ঘটেছিল, যাঁরা ছিলেন মূলত রাজতন্ত্রপন্থী। তাঁদের হীন তৎপরতার কারণেও শিল্প-সাহিত্যে ও সমাজে এক অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছিলÑ যে কারণে স্বাধীনতার জন্য এ সময় কবি-সাহিত্যিকগণ মরিয়া হয়ে ওঠেন। এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে তাঁরা চিন্তার স্বাধীনতার আন্দোলনে শরীক হন।
ফারসি সমকালীন সাহিত্য বলতে মূলত এই নবধারার সাহিত্যকেই বুঝিয়ে থাকে। কাজার যুগের শাসন ব্যবস্থার সমাপ্তি এবং মাশরুতে তথা সাংবিধানিক আন্দোলনের ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে যে সাহিত্যের পুনরুত্থান ঘটেছে তা-ই সমকালীন সাহিত্য। সামাজিক বিবর্তনের ফলে সৃষ্ট অবস্থা তথা আইন, স্বাধীনতা, উন্নয়ন, সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পচর্চা এবং উপনিবেশবাদ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই, দেশপ্রেম, অসহায় ও বঞ্চিতদের সাহায্যে এগিয়ে আসা ইত্যাকার বিষয় ফারসি সমকালীন সাহিত্যে বিপুলভাবে পরিলক্ষিত হয়। লেখক, সাহিত্যিক ও কবিগণ সমকালীন বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি নতুন সাহিত্য ধারা প্রবর্তনে প্রয়াসী হন।
ফারসি সাহিত্যে সমকালীন যুগের বৈচিত্র্যময় তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে ফারসি কাব্যচর্চার ধারাবাহিকতা চলে এসেছে। সমকালীন যুগে বহু খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক তাঁদের কাব্যচর্চার মাধ্যমে সমাজের নানাবিধ বিষয়কে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছেন, যার ফলে জনগণ ও সমাজের মাঝে নব নব চিন্তা-চেতনা, কৃষ্টি-কালচার, মানবতাবোধ ও সাংবিধানিক শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ গড়ে উঠেছিল। পাশাপাশি এ সময় পুরানো ধাঁচের চিন্তা-চেতনা তথা শাহী দরবারকেন্দ্রিক কাব্যচর্চারও বহুলাংশে বিলোপ ঘটেছিল। অপরদিকে কাব্য কলায় সৌকর্য বৃদ্ধি ও সাবলীলতা আনয়নের জন্য কাব্যরীতিতে নতুন আঙ্গিকেরও উৎপত্তি এ যুগেই দেখতে পাওয়া যায়। আর এসব কবিতায় যে সকল ব্যতিক্রমী বিষয় ও ভাবধারা সন্নিবেশিত হয়েছিল তা হলো মুক্তিকামিতা, সামাজিক জাগরণ ও জাতীয় চেতনাবোধের বিকাশ।
ইরানের এ সমাকালীন ধারার একজন সুবিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক হলেন সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন শাহরিয়ার তাবরিযি (১৯০৬-১৯৮৮ খ্রি.)। তিনি ইরানের পূর্ব আযারবাইজানের প্রাদেশিক শহর তাবরিযের খোশগোনাবি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শাহরিয়ার ছিলেন ইরানের আযারবাইজান প্রদেশের অধিবাসী। অসুস্থতার কারণে তাঁর শৈশবকাল কাটে পূর্ব আযারবাইজানের বোস্তানাবাদ পৈত্রিক গ্রামের বাড়িতেই। তাঁর পিতা মির্যা আগা খোশগোনাবি, যাঁর পূর্ব নাম ছিল সাইয়্যেদ ইসমাইল মুসাভি,তাবরিযের একজন নামকরা আইনজীবী ছিলেন। শাহরিয়ার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা তাবরিযের মোতাহারি বিদ্যালয়ে(পূর্বনাম মানসুর উচ্চবিদ্যালয়) সমাপ্ত করেন এবং পরবর্তীকালে তেহরানের দারুল ফনুন স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপণ করেন। এরপর চিকিৎসা বিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন এবং অধ্যয়নের শেষ পর্যায়ে এসে তথা ছয় মাস পূর্বে তা ছেড়ে দেন। শাহরিয়ার নিজ ও পরিবারের জীবন ধারণের জন্য ১৯৩১ সালের দিকে সরকারি দলিল রেজিস্ট্রি তথা তফসিল অফিসে চাকুরিতে যোগদান করেন। প্রথম দিকে নিশাপুরে পরে মাশহাদে চার বছর চাকুরি জীবন অতিবাহিত করেন। নিশাপুরে থাকাকালীন তাঁর পিতা মারা যান।এরপর১৯৩৫ সালেরদিকে তিনি তেহরানে ফিরে আসেন এবং পৌরসভার স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিদর্শক পদে বেশ কিছুদিন চাকুরি করেন। এরপর ইরানের কৃষি ব্যাংকে কাজ শুরু করেন।
তেহরান থাকাকালীন তিনি সে সময়ের বিখ্যাত কবি মালেকুশ শুয়ারা বাহার, আরিফ কাযভিনি, ফররুখি ইয়াযদি, মিরযাদে এশকি প্রমুখের সাথে সাক্ষাত করেন। তাঁদের বিভিন্ন কবিতার আসর ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের সাহচর্যের ফলে তাঁর মাঝে কাব্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। কবিতাচর্চার শুরুর দিকে শাহরিয়ার তাঁর কাব্যনাম ‘বেহজাত’ লিখতেন। কিন্তু হাফিযের গজল-কাব্য থেকে ভাগ্য গণনার (ফারসি পরিভাষায় ‘ফা’ল’ বলা হয়) মাধ্যমে পরবর্তীকালে‘শাহরিয়ার’ ভণিতা ধারণ করেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হলো রুহে পারভা’নে (প্রজাপতির আত্মা)। এটি মাসনাভি (দ্বিপদী) আঙ্গিকের কবিতা সংকলনÑ যা তৎকালীন কাব্যজগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।এর ভূমিকা অংশটি বিখ্যাত কবি মালেকুশ শুয়ারা বাহার ও সাইদ নাফিসি লিখে দিয়েছেন। এটি প্রকাশিত হয়েছিল১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তকবি শাহরিয়ার তাবরিয বিশ^বিদ্যালয়ের সাহিত্য অনুষদে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। এ সময় তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হেইদার বা’বা’য়েঅথবা হেইদার বা’বা’য়ে সালা’মপ্রকাশিত হয়। এটি কবির অনবদ্য রচনা। তুর্কি-আযারি সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত তাঁর হেইদার বা’বা’য়েশীর্ষক কাব্য সংকলন গ্রন্থটি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।এটি ফারসির ন্যায় তুর্কি-আযারি ভাষায় তাঁর সমান দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।‘হেইদার বা’বা’ পূর্ব আযারবাইজানের একটি পর্বতের নাম। এ পর্বতের পাদদেশেই কবির শৈশবকাল অতিবাহিত হয়েছে। এ কবিতায়তিনি অত্যন্ত নিপুণভাবে তাঁর নৈসর্গিক পল্লি জীবন ওস্মৃতি বিজড়িতশৈশবের কাহিনী বর্ণনা করেছেন।ফারসি সাহিত্য সমালোচকদের মতে তাঁর এই অপূর্ব সৃষ্টি তুলনা রহিত।কবিতাটি ত্রিশটিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
শাহরিয়ার ক্ষমতাধর কাব্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁর সমগ্র কাব্যে মনস্তাত্ত্বিকতা, সংবেদশীলতা ও কবিসুলভ মনোভাব অনুরণিত হয়েছে। যেখানে তিনি কল্পনার ডানায় চড়ে সৃষ্টিশীল ও অনুসন্ধানী হয়ে উড়ে বেড়ান। তাঁর কবিতা যেকোনো বিষয়ের হোক না কেনো এতে আধুনিকতা ও নব ধারার ঝোঁকপ্রবণতার বৈশিষ্ট্যগুলো অনুভূত হয়ে থাকে। তিনি যেসকল কবিতা নিমার জন্য এবং তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচনা করেছেন এবং বিশেষ আকৃতি বা গঠনে রচিত তাঁর কবিতাসমূহ যেমনি বিশ্লেষণধর্মী তেমনি কল্পচিত্রের দিক থেকে সনাতনী ধারার পরিবর্তন প্রকাশের নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছে। কবি মালেকুশ শুয়ারা বাহার সেদা’য়ে খোদা’ নামক একটি কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় এই বলে কবি শাহরিয়ারের প্রশংসা করেছেন যে, ‘শাহরিয়ার কেবল ইরানেরই গৌরব নয়, বরং তিনি প্রাচ্যেরও গৌরব বটে।’
শাহরিয়ারের দিভান তথা কাব্যসমগ্রের মূল অংশ জুড়ে রয়েছে গজল বা গীতি কবিতা। তাঁর কাব্যসমগ্রে তুর্কি ভাষার কবিতাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পনের হাজার শ্লোক সম্বলিত তাঁর এ কাব্যসমগ্রটি প্রথমে তিন খ-েএবং পরে দুই খণ্ডে তাবরিযে প্রকাশিত হয়।পরবর্তীকালে এ কাব্যসমগ্রটির একাধিক সংস্করণ বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। গজল ছাড়াও তাঁর এ কাব্যসমগ্রে কাসিদা (স্তুতিমূলক কাব্য), মাসনাভি (দ্বিপদী), কেতয়া (খণ্ড কবিতা), রুবায়ি (চতুষ্পদী) ও নিমাই রীতির কিছু কবিতাসহঅন্যান্য ধারার কবিতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। হযরত আলী (আ.)-কে নিয়ে তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো হযরত আলী (আ.)-কে সম্বোধন করে লেখা দুই আঙ্গিকেরদুইটি কবিতা তথা আলী এই হোমায়ে রাহমাত (আলীওহে রহমতের হুমা পাখি)শীর্ষক গজল ও শাব ও আলীশীর্ষককাসিদা।ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে ঘিরেও তাঁর বেশকিছু কাসিদা আঙ্গিকের (স্তুতিমূলক)কবিতা রয়েছে।
কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল ও হৃদয়বিদারক ঘটনাÑযা প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর মনে বেদনা ও দহন সৃষ্টি করে। আহলে বাইতের প্রতি এহেন ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞও পৈশাচিক আচরণের কথা মনে হলে সকল খোদাভীরু মুসলমানের হৃদয় রক্ত¯œাত হয় এবং তা কোনোভাবেই তাঁরা মেনে নিতে পারেন না। কবি শাহরিয়ার কারবালার সে বিয়োগান্তক ও শোকাবহ ঘটনার কথা স্মরণে হামাসেয়ে হোসাইনি (হোসাইনের বীরত্বগাথা) শিরোনামে একটি কবিতা রচনা করেছেনÑ যার শব্দ, ভাব-ভাষা আমাদেরকে সে ঘটনার গভীরে নিয়ে যায়। এখানে তাঁর সে কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি তুলে ধরা হলো:
محرّم آمد و آفاق مات و محزون شد
غبار محنت ایّام تاب گردون شد
به جامه های سیه کودکان چون دیدم
دلم به یاد اسیران کربلا خون شد
به یاد تشنه لبان کنار نهر فرات
کنار چشم من از گریه رود کارون شد
به خاندان رسالت ببین چه ظلمی کرد
فلک که زینب کبری ز پرده بیرون شد
ولی حسین علمدار عشق و آزادی
لقب گرفت و شهنشاه رُبعِ¬مَسکون شد
মোর্হারম এলো যেন দিগন্তজুড়ে শোক আর দুঃখের অন্ধকার নেমে এলো,
দুঃখ-কষ্টের দিনগুলোসম ধূলিকণা আকাশে পুঞ্জিভূত হলো।
কালো পোশাক পরিহিত শিশুদের যে-ই না দেখলাম
কারবালার বন্দিদের স্মরণে আমার হৃদয় রক্ত¯œাত হলো।
ফোরাত নদীর তীরের তৃষ্ণার্ত অধরগুলো স্মরণে
আমার নেত্র-কোণের অশ্রুধারা যেনো কারুন নদীতে২ পরিণত হলো।
দেখ নবী পরিবারের প্রতি কি জুলুমই না করা হলো
আর স্বর্গীয় যায়নাবে কোবরা (বাধ্য হয়ে) পর্দা থেকে বেরিয়ে এলেন।
কিন্তু হোসাইন, প্রেম আর স্বাধীনতার পতাকা-বাহকের উপাধি নিয়ে
হয়ে গেলেন জগতবাসীর শাহানশাহ (নেতা)।
ভাষার অনাড়ম্বরতা, সর্বজনীনতা ও বিশ্লেষণধর্মী হওয়ার কারণে শাহরিয়ারের কবিতা ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে। শাহরিয়ার তাঁর হৃদয়ানুভূতি ও কাব্য প্রতিভার দ্বারা নিজের কল্পনাগুলো ও চিন্তাধারাকে সাধারণ্যের ভাষায় তুলে ধরেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর কবিতা সকলের জন্য বোধগম্য ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। নব বসন্তের অপরূপ সৌন্দর্য ও গাছগাছালি, ঝোপঝাড় আর ফুলে ফুলে চিত্রিত প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলিকে ঘিরে তিনি তাঁর আরুসে বাহা’র কবিতায় যে বর্ণনা দিয়েছেন তা সত্যিই অতুলনীয়।এ কবিতার শব্দ চয়ন, ভাব মাধুর্য যেন আমাদেরকে এক আনন্দ-ভাবনার গভীরে নিয়ে যায়। এ কবিতায় তিনি বলেন:
عروس باغ و بهارم به خواب دوش آمد
که بانگ بلبلم از نیمه شب به گوش آمد
سحر به بوی گلم دیده باز شد کز در
به عشوه دختر خندان گلفروش آمد
به شادباش بهارم شکوفه بر سر ریخت
کز این شکفتن گل نیش رفت و نوش آمد
به نقش پیرهن پرنیان بشارت داد
که کوه و بیشه و صحرا پرند پوش آمد
গত রাতে আমার স্বপ্ন কাননের বসন্ত-বধু ঘুমঘোরে আমায় ধরা দিলো
আধোরাতে আমার প্রিয়া বুলবুলির কুহ ধ্বনি কর্ণকুহরে বেজে উঠলো
প্রত্যুষে বসন্তের ফুলের ঘ্রাণে আমর নয়নযুগল উন্মেলিত হলো
প্রভাত যেনো হাস্যোজ্জ্বল ফুল বিক্রেতা বালিকার ন্যায়আনন্দ নিয়ে দুয়ারে এসেছে।
আমার এ বসন্তের প্রতি শুভেচ্ছা যার ফোটা কলিগুলো আমার ওপর ছিটিয়ে দিয়েছে
প্রস্ফুটিত ফুলের কাঁটার আঘাত অপসারিত হয়ে এলো সুমিষ্ট পানীয় (মধু)।
ফুলে উৎকীর্ণ নকশি জামা আমাদের এই বলে জানিয়ে দেয় যে,
পর্বত, ঝোপঝাড় আর মরুভূমির পাখিকুল নতুন পোশাকে সেজেছে।
শাহরিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা বৈচিত্র্যের কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর যে কবিতাগুলো দেশ, সমাজ, ইতিহাস, ধর্ম-দর্শন ও কালের ঘটনা প্রবাহের ওপর রচিত সেগুলোর পরিমাণও কম নয়। বিশেষ করে কল্পনা, বিশ্লেষণ এমনকি তাঁর কবিতার কাঠামোর নতুনত্ব অন্যান্য সমকালীন কবি থেকে তাঁকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে।
কবি শাহরিয়ার ইরানের গজল স¤্রাট ওঅধ্যাত্মবাদের কবি হাফিজের গজল-কবিতা দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে ছিলেন। ফারসি সাহিত্যের অন্যান্য স্বনামধন্য কবি তথা ফেরদৌসি, নিজামি, সানায়ি, রুমি, সাদি-এর প্রভাও তাঁর কবিতায় কমবেশি পরিদৃষ্ট হয়; তবে তিনি হাফিজকেই সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করেছেন। তিনি হাফিজের এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে, তাঁর ভণিতা বা কাব্য নামটিও হাফিযের গজল-কাব্য থেকে ভাগ্য গণনার মাধ্যমে গ্রহণ করেছিলেন।তিনি তাঁর পিতা মির আগা খোশগোনাবির নিকটশৈশবেই অন্যান্য বিষয়ের ন্যায়প্রাথমিক পাঠ হিসাবে দিভা’নে হাফেয-এর পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। ফলে, তাঁর কবিতায় ব্যাপকভাবে হাফিজের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। হাফিজের ন্যায় তাঁর কবিতায়ও প্রেম-বিরহ, উচ্ছ্বাস, আকুতি, আনন্দ-বেদনা ও সন্ধিগ্ধতা ফুটে উঠেছে।কবি শাহরিয়ারের মতে, হাফিজের কাব্যে কবিতার রীতিনীতি তথা অলংকারশাস্ত্রীয় বিধিবিধান যথাযথভাবে অনুসৃত হয়েছে।
কথিত আছে যে, কবি শাহরিয়ার ছাত্রজীবনের কোনো এক পর্যায় এক রমণীর প্রেমে পড়েছিলেন।শাহরিয়ারের একজন শিক্ষার্থীরভাষ্য মতে শাহরিয়ার যখন মেডিকেলে পড়ার জন্য তেহরানে এসেছিলেন তখন তাঁর মা ছেলেকে নিয়ে তেহরানেরনাসের খসরু সড়কে একটি ছোট্ট বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। সে বাসায় থাকাকালীন বাড়ির মালিকের মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন শাহরিয়ার। শাহরিয়ারের মা ও মেয়ের পরিবারের সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, শাহরিয়ারের ইন্টার্নি শেষ হলে তাঁরা উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। এ সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি কেরে তাঁদের বাগদানও সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে মেয়ের বাবা মেয়েকে এক কর্নেলের কাছে বিয়ে দেন। শাহরিয়ার এ ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত ও ব্যথিত হলেন। এ ঘটনা তাঁর শিক্ষা জীবনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। ফলে তিনি মেডিকেলে পড়া ছেড়ে দেন। জীবনের কোনো এক সময়ে সে পুরানো স্মৃতিকথা নিয়ে তিনি একটি গজল কবিতা লিখেছিলেনÑ যা সেইরমণীর দিকেই ইঙ্গিত বহন করে। তাঁর সে কবিতার নিদর্শন হিসাবে কয়েকটি শ্লোক এখানে তুলে ধরা হলো।
آمدی جانم به قربانت ولی حالا چرا؟
بی‌وفا حالا که من افتاده‌ام از پا چرا؟
نوشدارویی و بعد از مرگ سهراب آمدی
سنگدل این زودتر می‌خواستی، حالا چرا؟
نازنینا ما به ناز تو جوانی داده‌ایم
دیگر اکنون با جوانان ناز کن با ما چرا؟
عمر ما را مهلت امروز و فردای تو نیست
من که یک امروز مهمان توام فردا چرا؟
شهریارا بی‌حبیب خود نمی‌کردی سفر
این سفر راه قیامت می‌روی تنها چرا؟
এসেছো, তোমার তরে আমার প্রাণ উৎসর্গিত হোক, তবে এখন কেনো?
হে অবিশ্বস্ত! এখনতো আমি নিশ্চল হয়ে পড়ে আছি, তবে কেনো?
সর্বব্যাধিহর ঔষধ (তুমি), সেই তো এলে তবে সোহরাবের মৃত্যুর পরে,
হে পাষাণ হৃদয়! এতটাই দ্রুত চেয়েছিলে, এখন কেনো?
হে প্রেয়সী! তোমার প্রেমাবেগে আমার গোটা যৌবন বিলিয়ে দিয়েছি
এখন তরুণদের সাথে প্রেমানুরাগে মত্ত হও, আমার সাথে কেনো?
তোমার তরে আজ ও কালের অবকাশ আমার জীবনে অবশিষ্ট নেই
আমি তোমার আজকের অতিথি, তবে আগামীকালের জন্য কেনো?
হে শাহরিয়ার! তুমিতো বন্ধুবিহীন ভ্রমণ করতে না
এই প্রলয়ের পথের ভ্রমণে যাচ্ছ তুমি,তবে একা কেনো?
সুস্থ, সুন্দর ও আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে শাহরিয়ারের যে ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে তা তাঁর কবিতার মাধ্যমে সহজেই অনুমান করা যায়। প্রেমময়ী কাব্য রচনা ছাড়াও শাহরিয়ারের সমাজ সচেতনতাবোধ ব্যাপকভাবে তাঁর কাব্যে প্রতিভাত হয়েছে। সমাজের নানাবিধ বিষয় যেমন যুদ্ধ ও সন্ধি, আধুনিক চিন্তাচেতনার বিকাশ, সামাজিক বিপর্যয়, নগর সভ্যতা, বৈশি^ক ভাবনা, সমাজবদ্ধ মানুষের স্বাদেশিক চেতনাবোধ, পৃথিবীর তাবৎ জাতিগোষ্ঠীর মর্মবেদনা ইত্যাদি তাঁর কবিতায় বিপুলভাবে আলোড়িত হয়েছে।
শাহরিয়ারের কাব্যের প্রতি যদি গভীরভাবে দৃষ্টি দেয়া হয় তবে দেখা যাবে যে, তিনি কেবল ইরানের সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলেননি, বরং গোটা বিশে^র মানব সভ্যতার সমস্যাগুলো নিয়ে দারুণ উৎকণ্ঠিত ছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের কবি ছিলেন; তাই তিনি সমাজের সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষকে একই কাতারের ভাবতেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও এটাই দাবি করে যে, তিনি স্বয়ং নিজেই সমাজের ব্যথা-বেদনাগুলো নিয়ে এমনিভাবে কাজ করেছেন মনে হয় যেনতিনি একজন অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর ন্যায় সমাজের মানসিক যাতনা ও ব্যাথা-বেদনাগুলোকে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছেন। শাহরিয়ার কাব্য রচনার ক্ষেত্রে এসব বিষয়কে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় রেখেছেন। কবি হিসাবে এবং সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে সমাজের নানাবিধ বাস্তব ঘটনাসমূহ তাঁর কবিতা ও গানে স্থান দিয়েছেন। ফলে তিনি সমাজ সচেতন কবিদের সারিতে নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর এ ভাবনাগুলোকে ভাবনার মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং তা বহুলাংশে কাজেও পরিণত করেছেন। যদিও শাহরিয়ারকে তাঁর গজলের কারণে একজন প্রেমবন্ধনার কবি হিসাবে অনেকে জানেন; কিন্তু তাঁর চিন্তাধারার ভিত্তিমূল ছিল জবধষরংস বা বাস্তববাদ। সমাজেবিরাজমান নানা অসংগতিগুলো তাঁর মন-মানসকে এ বাস্তবতার পথে প্রলুব্ধ করেছে। বর্তমান সমাজের প্রতি আক্ষেপ করে তিনি তাঁর এক কবিতায় বলেন:
خود نشناسیم و خدا نیز هم
ورده که جمعیم و جدا نیز هم
شرط اخوت نه ستم¬کاری است
حق برادر همه غم¬خواری است
شرط بود با همه یک¬رو شدن
درد بشر دیدن و دارو شدن
گر کسی از تنگی نان، جان سپرد
قاتل او، جامعه باید شمرد
نوع بشر یک سره مسئول اوست
ذمّۀ مردم همه مشغول اوست
ای که نگیری ز دل افتاده دست
گر بشری، نقص وجودیت هست
নিজেকেতো চিনিই না, এমনকি খোদাকেও নয়,
নয়তো কী করে যে সমাজে থাকি তা থেকে আমি পৃথক হয়ে গেছি।
ভ্রাতৃত্বের শর্ত অত্যাচারের মধ্যে নিহিত নেই,
ভাইয়ের অধিকারতো নিহিত রয়েছে সমবেদনা আর সহানুভূতির মাঝে।
কথা ছিল(চিন্তার জগতে) সবারসমশ্রেণিভুক্ত হবার,
মানবের ব্যথায় উপশমকারীআর সমব্যথীহবার।
যদি কেউ রুটির (খাদ্য) অভাবে মারা যায়,
তবে সে সমাজ পরিগণিত হয় তার হত্যাকারী হিসাবে।
তার (হত্যার) পুরোপুরি দায়ী হয় গোটা মানব সমাজ,
তার ব্যাপারে মানুষের দায়বদ্ধতা রয়েছে অপরিসীম।
ওহে! যদি তুমি ব্যথিতের হাত সহায়তার জন্য নাই বা ধর,
যদিও তুমি মানুষ, তবে তোমার অস্তিত্বের মাঝে ত্রুটি রয়েছে।
শাহরিয়ার বর্তমান নৈতিকতা-বিবর্জিত ও আধ্যাত্মিকতাশূন্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির ব্যাপারে অত্যধিক উদ্বিগ্ন ছিলেন। কারণ, আত্মিক প্রেরণা ও নৈতিকতা অধুনাসভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তিনি এই নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা-বিবর্জিত সভ্যতা ও সংস্কৃতির কারণে যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা অপনোদনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন :‘নৈতিকতাবিহীন জ্ঞান ও সভ্যতা হলো অজ্ঞতারই নামান্তর। ’শাহরিয়ারবর্তমান সভ্যতাকে জাতির হত্যাযজ্ঞ আর লুণ্ঠন ছাড়া কিছুই মনে করেন না। কারণ, তাঁর যৌবনে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দু’টি ধ্বংসাত্মক বিশ^যুদ্ধ তাঁকে এ বিষয়ে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কবির ভাষায়:
آدمی تا عرش اعلی پر زدی زین بال علم
گر تمدن متکی بر پایۀ اخلاق بود
সভ্যতা-সংস্কৃতি যদি নৈতিকতার ওপর ভিত্তিশীল হতো
তবে মানুষ জ্ঞানের ডানায় চড়ে আরশের সুউচ্চ আসনে সমাসীন হতো।
তিনি অন্যত্র বলেন:
کو معنویتی که جهانی رها کند
از دست معرفت کم و صنعت زیادها
কোথায় সে আধ্যাত্মিকতা ও আত্মিক প্রেরণা যা বিশ^কে মুক্তি দেয়
মারেফাতের সংকট আর শিল্পের আধিক্য থেকে।
শাহরিয়ার একজন প্রতিশ্রুতিশীল ও স্বদেশপ্রেমী কবি ছিলেন।তিনি দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের চেতনা লালন করতেন। জনগণের মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপারেও তাঁর কবিতা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর তুর্কি ও ফারসি ভাষায় রচিত কবিতায় মানবাধিকার ও নিজ দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল তা মূর্ত হয়ে ওঠেছে। তাঁর এ প্রতিবাদ ছিল রাষ্ট্রের সেই সব প্রভু ও কর্ণধারের বিরুদ্ধে যাদের কারণে দেশের সাধারণ জনগণ নানা দুঃখ-কষ্ট ও যাতনার মধ্যে দিনাতিপাত করছিল এবং যাদের কারণে সমাজের সর্বস্তরেঅপকর্ম ও বিপর্যয় বিস্তার লাভ করেছিল।
তিনি বলেন :
این عبادت ها به عادت می کنی
خدمت ار کردی، عبادت می کنی
……………………….
کیمیاخانه بگو مجلس شورا، که وکیل
مس و تس می رود آن جا و طلا می آید
حزب هم دایر و کابینۀ تشریفاتی
گه ্রعلیগ্ধ می رود و گاه ্রعلاগ্ধ می آید
من به حیرت که خدا یا شب و باران رحیل
کی خرِ ما به در از این گِل ولا می آید
এই সেই এবাদতসমূহ যা তুমি অভ্যাসে পরিণত করেছ
সেবার মাঝে লিপ্ত হও, তা-ও তোমার এবাদত হিসাবে গণ্য।
———–
পরশমণির৩ধারক তুমি মাজলিসে শুরাকে বল, হে ওয়াকিল
সেখানে তো তামা যায় আর তদস্থলেফিরে আসে স্বর্ণ।
গঠিত হয় দল আর কেবিনেট হয় আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ
কখনো সেখানে আলী (ব্যক্তির নাম) যায়,ফিরে আসে সে আলা হয়ে।৪
হে খোদা! আমি ভীত ও বিস্মিত,রাতে বৃষ্টি আসবে, কাফেলাও চলে যাবে
কিন্তু আমাদের অবস্থার পরিবর্তন কবে হবে…?
এছাড়া ইরানের গৌরব উজ্জ্বল প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস তাঁর মন-প্রাণকে সব সময়ই আন্দোলিত করত। দেশাত্মবোধের চেতনায় তিনি যেমনি নিজে উজ্জীবিত ছিলেন তেমনিপরবর্তী প্রজন্মকেও সে চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে তিনি ইরানের বহু উচ্চমার্গীয় মনীষীর জগৎজোড়া কীর্তিগাথার কথা তাঁর কবিতায় তুলে ধরেন। তিনি বলেন :
سال ‌ها مشعل‌ ما پیشرو دنیا بود
چشم‌ دنیا همه‌ روشن‌ به‌ چراغ‌ ما بود
درج‌ دارو همه‌ در حكم‌ حكیم‌ ্রرازی‌্র
برج‌ حكمت‌ همه‌ با্রبوعلی‌ سیناগ্ধبود
قرن‌ها مكتب‌ ্রقانون‌গ্ধ و ্রشفاগ্ধی‌ ্রسیناগ্ধ
با حكیمان‌ جهان‌ مشق‌ خطی‌ خوانا بود
عطر عرفان‌ همه‌ با نسخه‌ی‌ شعر্রعطارগ্ধ
اوج‌ فكرت‌ همه‌ با ্রمثنوی‌ ملاগ্ধ بود
داستان‌های‌ حماسی‌ به‌ سرود و به ‌سزا
خاص‌ ্রفردوسی‌গ্ধ و آن‌ همت‌ بی‌همتا بود
پند ্রسعدی‌গ্ধ كلمات‌ ملك‌العرش‌ علا
غزل‌ ্রخواجه‌গ্ধ سرود ملاء اعلا بود
বহুকাল ধরে আমাদের আলোকবর্তিকা বিশ^ নেতৃত্বে প্রজ¦লিত হয়েছিল,
আমাদের প্রদীপের আলোতেই জগৎ আলোকিত হয়েছিল একদিন।
হাকিম ‘রাযি’র আবিষ্কৃত ঔষধ চিকিৎসা পদ্ধতিতে সন্নিবেশিত হয়েছিল,
‘বুআলি সিনা’র সর্বপ্রজ্ঞা ছিলসুউচ্চ মিনারসম।
যুগ যুগ ধরে ‘সিনা’রদর্শনশাস্ত্রীয় শাফা ও চিকিৎসাশাস্ত্রীয়কানুন গ্রন্থ
জগতের মনীষিগণের চর্চার প্রতিপাদ্য বিষয়ে পরিগণিত হয়েছিল।
‘আত্তার’ অধ্যাত্মবাদের সুবাস ছড়িয়ে দিয়ে ছিলেন তাঁর কাব্যের মাধ্যমে,
চিন্তা জগতেরচরম পরাকাষ্ঠা প্রকাশ পেয়েছিল‘মোল্লা’র মাসনাভির মাধ্যমে।
বিশেষভাবে বীরত্বের কাহিনীগুলো যথাযথ গেয়েছিলেন ‘ফেরদৌসি’
যা ছিল তাঁর বিরলউদ্যম ও প্রচেষ্টারই ফসল।
‘সাদি’র উপদেশ বাণী ছিলসুউচ্চ আরশের কথা তুল্য
আর ‘খাজা’র গজল ছিলউচ্চমার্গীয় ও সর্বজনীন গীতিময় কবিতা।
কবি হোসাইন শাহরিয়ার বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো তেহরানের মেহের হাসপাতালে কাটান এবং ১৯৮৮ সালে ৮৩ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী তাঁকে তাবরিযের ‘মাকবারাতুশ শোয়ারা’ তথা কবিদের কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী আজিজে আব্দে খালেকি এবং শাহারযাদ ও মারইয়াম নামে দুই কন্যা ও হাদি নামে এক ছেলে সন্তান রেখে গেছেন।
ফারসি সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে তাবরিয বিশ^বিদ্যালয়ের কলা ও সাহিত্য অনুষদের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এই শক্তিধর সাহিত্য-মহীরুহর স্মরণে প্রতি বছর ২৮ মেহের (সৌরবর্ষ) ‘কবিতা ও ফারসি সাহিত্য দিবস’ হিসাবে দিবসটি ইরানের সর্বত্র পালিত হয়।
পরিশেষষে বলা যায় যে, সমকালীন যুগে এসে হোসাইন শাহরিয়ার এমন কিছু স্বতন্ত্র ধারায় কবিতা রচনা করে সাহিত্যামোদীদের মনে এমনি জায়গা সৃষ্টি করেছেন যা যুগ যুগ ধরে দেদীপ্যমান থাকবে। তাঁর সাহিত্যকর্মগুলো অমর কীর্তি হিসাবে প্রজন্ম পরম্পরায় বেঁচে থাকুক এই প্রত্যাশাই রইল।

টীকা-টিপ্পনী
১ ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ইরানে শাহ ছিলেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি বিধিবিধানের ঊর্ধ্বে থেকে দেশ ও জনগণের মালিক হতেন। এর বিপরীতে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে এ দেশের শাসনকার্য কতিপয় বিধিবিধানের আওতায় নিয়ে আসা এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে পার্লামেন্ট গঠনের নিমিত্ত এক ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হয় যার নাম দেয়া হয় ‘ইনকিলাবে মাশরুতিয়াত’। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এই ইনকিলাবে মাশরুতিয়াত তথা সাংবিধানিক বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে সর্ব প্রথম স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থার আন্দোলন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই বিপ্লবের প্রধান লক্ষ্য ছিলশাহের ক্ষমতা হ্রাস এবং গণভিত্তিক ও সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সাংবিধানিক বিপ্লব যখন সাফল্যমণ্ডিত হয় তখন ইরানে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বহুলাংশে রহিত হয়।
২ কারুন ইরানের দীর্ঘ ও প্রশস্ত নদীগুলোর অন্যতম। এটি ৯৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এ নদীটি ইরানের অন্যতম নৌপথ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এটির উৎপত্তিস্থল হলো বাখতিয়ারি জেলার র্যাদকুহ পর্বতমালাÑ যা শাতিল আরব নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পারস্য উপসাগরে এসে মিলিত হয়েছে। এ নদীর পানি সুপেয় ও কৃষি কাজের জন্য উপযোগী হিসাবে বিবেচিত।
৩ শাব্দিক অর্থে কিমিয়া খা’নে তথা পরশমণি বা রসায়নের ভা-ার; যে স্থানে কাল্পনিক প্রস্তর বা তা¤্রবিশেষের স্পর্শে লোহাদি স্বর্ণে রূপান্তরিত করা হয়। এখানে শব্দটি বিদ্রƒপাত্মক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। পার্লামেন্ট বা সংসদ (মজলিসে শুরা) মনে হয় যেনো পরশমণির ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। এর প্রতিনিধিগণ হলেন তামার ন্যায়, যখন তাঁরা সেখানে যান স্বর্ণের ন্যায় ফিরে আসেন অর্থাৎ মজলিসে শুরা বা পার্লামেন্টতাঁদেরকে স্বর্ণে পরিণত করে। এখানে যৌগিক শব্দটি (কিমিয়া খা’নে ) রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ তাঁরাপ্রতিনিধি হওয়ার মাধ্যমে দরিদ্র থেকে ধনীতে পরিণত হচ্ছে।
৪ এখানে কবি ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করে বলেছেন যে, ‘আলী’ নামের সাধারণ ব্যক্তি পার্লামেন্টে (মজলিসে শুরা) যেয়ে ‘আলা’ তথা মন্ত্রী রূপে ফিরে আসে।
তথ্যসূত্র
১. আহমাদ তামীমদারী ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাস(অনূদিত গ্রন্থ), আলহুদা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা, ইরান, ২০০৭ খ্রি.।
২. ইসমাইল হাকেমি, আদাবিয়্যা’তে মোয়া’সেরে ইরা’ন (ইরানের সমকালীন সাহিত্য), আসাতির প্রকাশনী, তেহরান, ইরান।
৩. পারভিন শাকিবা, শেরে ফারসি আয অ’গায তা ইমরুয (ফারসি কবিতার সূচনা থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত), হেইরান্দ প্রকাশনী, তেহরান, ইরান।
৪. মানজের ইমাম, আদাবিয়্যা’তে জাদিদে ইরা’ন (ইরানের আধুনিক সাহিত্য), মোজাফ্ফারপুর, ভারত।
৫. মুহাম্মদ জাফর ইয়াহাকি, চুন সাবুয়ে তেশনেয়ে আদাবিয়্যা’তে মোয়া’সের (সমকালীন ফারসি সাহিত্যের পর্যালোচনামূলক গ্রন্থ), জামী প্রকাশনী ইরান।
৬. সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ বাকের বারকায়েই, সুখানভারা’ন না’মেয়ে মোয়া’সেরে ইরা’ন (ইরানের সমকালীন কথা শিল্পীগণ), খুররম প্রকাশনী, ইরান, ১৩৭৩ (সৌরবর্ষ)।
৭. সাফার দার অ’ইনে (সমকালীন সাহিত্য সমালোচনা ও পর্যালোচনা শীর্ষক প্রবন্ধ সংকলন; সংকলন ও সম্পাদনায়: আব্বাস আলী ওফায়ী), সোখান প্রকাশনী, তেহরান, ইরান, ১৩৮৭ সৌরবর্ষ
৮. নিউজ লেটার, ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মুখপত্র, ১৯৯৬ সনের ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে ও ১৯৯৯ সালের মার্চ-এপ্রিল সংখ্যা।
*লেখক: অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়