ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে মুসলিম জাতিসমূহের প্রতি প্রেসিডেন্ট রুহানির আহ্বান
পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ১৫, ২০১৮
কুদ্সের প্রতিরক্ষা ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের লক্ষ্যে পারস্পরিক মতপার্থক্য পরিহার করুন
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন ড. হাসান রুহানি ইসলামের প্রথম কিবলা আল্-কুদ্সের প্রতিরক্ষা ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে পারস্পরিক মতপার্থক্য পরিহার করার জন্য মুসলিম জাতি সমূহের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট রুহানি গত ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র শীর্ষ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে এ আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্ট রুহানি তাঁর ভাষণে বলেন, আমরা মুসলিম উম্মাহ্র এমন একটি হৃদয় বিদারক বিয়োগান্তক ঘটনা ও পুরনো ক্ষত সম্পর্কে মত বিনিময়ের জন্য সমবেত হয়েছি যা একশ’ বছর আগে বেলর্ফো ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে পবিত্র কুদ্স্ নগরীতে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের ভ্রান্ত ও অবৈধ প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে এক নতুন অধ্যায়ের অভিজ্ঞতার অধিকারী হচ্ছে।
ড. রুহানি বলেন, আজকে আমরা পবিত্র কুদ্স্ নিয়ে কথা বলছি যা মুসলমানদের প্রথম কিবলা ও ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম শহর এবং যা ফিলিস্তিনের পরিচিতি ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে। তিনি বলেন, সৌভাগ্যবশত পবিত্র কুদ্স্ নগরী সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের এ ভূমিকা সম্পর্কে মুসলিম রাষ্ট্র সমূহ দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। আর এই শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠান মুসলমানদের পক্ষ থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভুল কাজের সঠিক ব্যাখ্যারই নিদর্শন বহন করছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, আমাদেরকে পরস্পর হাতে হাত মিলিয়ে সম্ভাব্য যে কোনো উপায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের নির্বুদ্ধিতামূলক কাজের বাস্তবায়ন প্রতিহত করতে হবে। অবশ্য সেই সাথে আমাদেরকে এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে যে, কোন্ কোন্ কারক ও কোন্ কোন্ কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ ধরনের একটি রূঢ় ও অবমাননাকর সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করেছে।
ড. হাসান রুহানি বলেন, আমার মনে হয় যে, অন্য সকল কারণের চেয়ে বড় যে কারণটি এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণকে উস্কে দিয়েছে তা হচ্ছে কতক দেশ কর্তৃক যায়নবাদী সরকারের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার, এমনকি তার সাথে আলোচনা ও সমন্বয়ের প্রচেষ্টা চালানো।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, আজ এটা আর কোনো গোপন বিষয় নয় যে, মুসলমানরা ও আরবরা ইহুদিদের সবচেয়ে বড় দুশমন নয়, বরং যায়নবাদের বিপজ্জনক পরিকল্পনাই হচ্ছে তাদের সবচেয়ে বড় দুশমন। তিনি বলেন, আমরা মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিরা এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক মালিক। অন্যদিকে যায়নবাদীরা হচ্ছে এখানে বহিরাগত এবং তারা নিজেদেরকে এ অঞ্চলের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিগত শতাব্দীর প্রথম দিককার বছরগুলো থেকেই যায়নবাদীরা এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতার বীজ বপন করে আসছে। বিশেষ করে বিগত কয়েক দশক যাবত ফিলিস্তিনি জনগণকে হত্যা ও তাদের ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদের জন্য যায়নবাদী সরকারই দায়ী এবং সেই সাথে তারা ফিলিস্তিনে ইসলামের দৃষ্টিতে যা কিছু পবিত্র সেসবের অবমাননা করে আসছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্বীয় ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে হত্যাসহ এসব অপরাধ সংঘটনে যায়নবাদীদেরকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যায়নবাদী সরকারকে সকল ধরনের মারণাস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো প্রচেষ্টা থেকেই বিরত থাকে নি। তিনি বলেন, কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এতদসত্ত্বেও বহু বছর যাবত এতদসংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে অথবা এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাওয়া হয়েছে এবং মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে তার ওপরে নির্ভর করা হয়েছে।
জনাব রুহানি বলেন, ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে একটি ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা করছিলেন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন প্রশাসন তাঁদের সামনে একটি বিষয় সুস্পষ্ট করে দিয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু যায়নবাদীদের জন্য সর্বোচ্চ স্বার্থ আদায় করতে চাচ্ছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ দাবি সমূহের প্রতি কোনো ধরনের সম্মানবোধই পোষণ করে না।
মার্কিন প্রশাসন কুদ্স্কে যায়নবাদী সরকারের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এবং তার দূতাবাস কুদ্সে স্থানান্তরিত করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনের পক্ষ থেকে তার নিন্দা করার প্রয়োজনীয়তার ওপর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলিম জাহানের জন্য যায়নবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। তিনি বলেন, কতগুলো সমস্যার ব্যাপারে যদি আমাদের মধ্যে পারস্পরিক মতপার্থক্য থেকেও থাকে তথাপি পবিত্র কুদ্সের প্রতিরক্ষা ও ফিলিস্তিন সমস্যার ক্ষেত্রে আমাদের কিছুতেই বিভক্ত থাকা উচিত হবে না।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, মুসলিম জাহানের সমস্ত সমস্যাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু ইসলামি উম্মাহ্র অধিকার সমূহের প্রতি এবং পবিত্র আল্-কুদ্সের প্রতি কেবল ইসলামি ঐক্যের মাধ্যমেই সর্বোত্তম সহায়তা প্রদান করা সম্ভবপর।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে বলেন, মার্কিন প্রশাসনের এ বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার যে, ফিলিস্তিন ও পবিত্র কুদ্সের ভাগ্যের ব্যাপারে ইসলামি জাহান মোটেই উদাসীন থাকবে না। তেমনি ফিলিস্তিন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমর্থনের ও প্রায় সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতের প্রতি বিদ্রƒপ করা হলে সে জন্য যথাযথ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হবে এবং মূল্য দিতে হবে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি তাঁর ভাষণে কুদ্সে দূতাবাস স্থানান্তর সংক্রান্ত মার্কিন প্রশাসনের সিদ্ধান্তের মোকাবিলায় মুসলিম দেশসমূহের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেন, আমেরিকার অংশীদারদের সাথে, বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে মুসলিম দেশ সমূহের যে কোনো আলোচনায় সাম্প্রতিক মার্কিন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রতিবাদ জানানো এবং এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা অপরিহার্য। তিনি বলেন, ফিলিস্তিন সমস্যাকে পুনরায় মুসলিম জাহানের সমস্যাবলির ও আলোচ্য বিষয়াদির সর্বশীর্ষে স্থান দিতে হবে।
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন জনাব রুহানি বলেন, ইরাক ও সিরিয়ায় দায়েশের পরাজয় এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তার কারণে আমাদের জন্য যায়নবাদী সরকাররূপ বিপদের কথা, বিশেষ করে তার কাছে যেসব পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছেÑ যা সারা দুনিয়ার জন্য হুমকি, তার কথা ভুলে যাওয়া কিছুতেই উচিত হবে না।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে এর নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক মার্কিন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে নিজ নিজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। এছাড়া মুসলিম দেশ সমূহের জাতিসংঘস্থ মিশনগুলোর জন্য আলোচনায় অংশগ্রহণ করাও জরুরি।
ড. রুহানি তাঁর ভাষণের শেষ পর্যায়ে বলেন, যায়নবাদী সরকারের সকল তৎপরতার প্রতি অনবরত দৃষ্টি রাখতে হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে যে কোনো উপযোগী স্থানে মন্ত্রী পর্যায়ে বা রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান পর্যায়ে ওআইসি-র অধিবেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন ড. হাসান রুহানি পবিত্র কুদ্সের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ব্যতিরেকে যে কোনো মুসলিম দেশের সাথে নিঃশর্তভাবে সহযোগিতার জন্য ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রস্তুতি ঘোষণার মাধ্যমে স্বীয় ভাষণের সমাপ্তি টানেন।