সোমবার, ৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

উৎসবের সামাজিক গুরুত্ব ও মুসলিম সমাজ

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৬, ২০২২ 

news-image

মুজতাহিদ ফারুকী –

বাংলাদেশে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব মাত্র দুটি। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এর বাইরে এমন আর কোনও উৎসব নেই যেখানে মত পথ, রাজনীতি, শিক্ষা, নির্বিশেষে সব শ্রেণির বা ঘরানার মুসলমান এক হয়ে আনন্দ উদ্যাপন করতে পারেন। শবে বরাতের মতো ধর্মীয় সামাজিক উৎসব এখন আর সেভাবে পালিত হয় না। অতি ধর্মীয় শুদ্ধতার দিকে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে আমরা এই দিবস পালন নিরুৎসাহিত করেছি। কিন্তু আমরা খেয়াল করিনি, এই উৎসব পালনের দিনে মহল্লার প্রতিটি ঘরে রুটি-হালুয়া বা রুটি-গোশত বিতরণের মধ্যে যে সামাজিক বন্ধন, সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হতো, গরীবের জন্য যে দান-ধ্যানের সুযোগটা ছিল তার সবই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার সারা রাত ইবাদত করা ও ফজরের নামাজের পর আখেরি মোনাজাত, সিরনি বিতরণ এই সংস্কৃতিগুলো আমরা হারিয়ে ফেলতে বসেছি। সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি হারিয়েছে সেটি হলো, মুসলমান সমাজের একটি সর্বজনীন উৎসবের আমেজ। এই আমেজটি দুই ঈদের ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের ভেতর ঠিক যেন পাওয়া যায় না।

উৎসবের আমেজের লোভেই মুসলিম ছেলেমেয়েরা অন্য ধর্মের উৎসবে যোগ দিতে যায়। এজন্যই প্রয়োজন শবে বরাতের মতো উৎসবের প্রয়োজন ছিল। এটি বন্ধ হওয়ায় কী ক্ষতি হয়েছে, যারা বুঝতে অক্ষম তাদের সঙ্গে তর্কে যাব না। তবে এটুকু বলা দরকার মনে করি যে, ধর্মকে অবলম্বন করে যে কোনও উৎসব আয়োজন করা হয় পরিচ্ছন্ন বিনোদন ও সাংস্কৃতিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য। এটাকে আক্ষরিক অর্থে ইবাদত হিসেবে গণ্য করার আবশ্যকতাও নেই। পরিচ্ছন্ন বিনোদন ও সংস্কৃতির উপস্থিতি না থাকলে সমাজে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে দেখি, উৎসবের সামাজিক গুরুত্ব কী?

উৎসব হলো যে কোনও জাতির বা জনগোষ্ঠীর গৌরবময় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রচলিত রীতিপ্রথার সামষ্টিক উদ্যাপনের একটি সরব উপায়। পরস্পরের চিন্তা-চেতনাকে একটি বিশেষ আনন্দের উৎসের সঙ্গে একাত্ম করে তোলার মাধ্যমে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার মুহূর্ত নিয়ে আসে উৎসব। এক অর্থে যে কোনও সমাজের সব উৎসবই হলো কোনও না কোনওভাবে সাংস্কৃতিক উৎসবই। উৎসবের অর্থনৈতিক গুরুত্বও বিপুল।

উৎসব সামাজিক সংহতি সুদৃঢ় করে, সমাজে প্রতিটি ব্যক্তির নিজের একটি অবস্থান আছে এই বোধ নিশ্চিত করে। বিনোদনের পাশাপাশি এটি জনগণের সামষ্টিক আচরণের একটি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য স্থান চিহ্নিত করে দেয়। প্রতিটি উৎসবের সময় সমাজের সবার মধ্যে একটি ইতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়। বৈরিতা ভুলে পরস্পরকে আলিঙ্গনের আবহ তৈরি হয়। এতে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে ওঠে, শুভেচ্ছা বিনিময়ের ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের একটি চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। উৎসব মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য, তার উৎস বা শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার এবং সেটি ধরে রাখার বিপুল অনুপ্রেরণা যোগায়। দৈনন্দিন জীবনের সব রকম চাপ ও একঘেয়েমি থেকে মুক্ত করে, মানুষকে কিছু সময়ের জন্য স্বস্তিকর এক নির্মল আনন্দে মেতে থাকার সুযোগ করে দেয় যা তার কর্মজীবনে ইতিবাচক ফল দেয়। আমরা যখন পরিবার, বন্ধু বা সমাজের সদস্য হিসাবে একত্রিত হই, আনন্দময় সময় কাটাই তখন আমাদের মধ্যে ঐক্যবোধের জন্ম হয়। আর এই ঐক্য বা সংহতি হলো জীবনের, বলা যায়, সমাজের বা রাষ্ট্রের যে কোন সঙ্কট মোকাবেলা করার ও তা কাটিয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

মুসলমানদের ঈদ, খ্রিস্টানদের ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ার, ইরানিদের নওরোজ ও শবে ইয়ালদা, হিন্দুদের দুর্গা পূজা বা দিওয়ালী, নবরাত্রি ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসবই হোক আর লৌকিক ঐতিহ্যনির্ভর উৎসব অনুষ্ঠানই হোক এর সবগুলোই কিন্তু সংশ্লিষ্ট সমাজের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। কারণ, একটি দেশের বা সমাজের সব মানুষ যে কর্মকাণ্ড বছরের পর বছর ধরে অনুশীলন করে সেটাই তার সংস্কৃতি। যেভাবে সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায় পোশাক, ধর্মীয় আচার-আচরণ, কৃষি বা বাণিজ্যের মত পেশা, ভাষা এবং ভাষাভিত্তিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি। যেমন, প্রতি ভোরে নামাজ পড়ে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, ঈদে কুরবানি করা, রোজা রাখা, রাতের শেষভাগে ঘুম থেকে উঠে সেহরি ও সূর্যাস্তের সময় ইফতার খাওয়া এগুলো ধর্মীয় নির্দেশে করা হলেও হাজার বছরের অনুশীলনে মুসলমানের সামাজিক সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।

খ্রিস্টানদের ক্রিসমাস ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু এই দিনে পরস্পরকে উপহার দেওয়া, শুভেচ্ছা জানানো, টার্কি দিয়ে ডিনারের আয়োজন এগুলো সামাজিক জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। ফলে এসব এখন সংস্কৃতির অংশ, যা একইসঙ্গে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।

খ্রিস্টানদের পয়গম্বর যিশুর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর কিনা তা নিয়ে তাদেরই বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ভিন্নমত আছে। কিন্তু ভিন্নমত পোষণকারীরা এই নিয়ে কোনও যুদ্ধ-ফাসাদে লিপ্ত হয়নি। নিজের ভিন্নমত নিজের কাছে রেখে বৃহত্তর খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে উৎসব পালন করছে। একারণেই ক্রিসমাস বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ভিন্ন ধর্মের মানুষেরাও এই দিনে বন্ধুদের সঙ্গে কার্ড বিনিময় করেন, শুভেচ্ছা জানান, সামাজিক মাধ্যমে অভিনন্দন জানান। পার্টিতে যোগ দেন।

ইরানের নওরোজ উৎসবের কথা আমরা সবাই জানি। উৎসবটি দেশটিতে ইসলামি বিপ্লবের পরও সেটি নিষিদ্ধ করা হয়নি। তারা এখনও অবাধে নওরোজ উৎসব পালন করছে। নববর্ষের প্রারম্ভে তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যাতে বছরটি তাদের জীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে আনে। তারা এই প্রার্থনায় বলে থাকে : ‘হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী (মহান আল্লাহ)! আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।’ নওরোজে যে দস্তরখানা পাতা হয় সেখানেও তারা কোরআন মজীদকে স্থাপন করেছেন ধর্মীয় আবহে দিবসটি পালন করার মানসে। প্রাচীন এ উৎসবকে তারা এভাবে ইসলামের আবরণে মুড়িয়ে দিয়েছে। তারা পালন করছে ‘শবে ইয়ালদা’র মতো নিছকই লোকজ বিশ্বাসভিত্তিক প্রাচীন উৎসবও। এই উৎসবগুলোকে তারা ইসলামের রংয়ে রঙ্গিন করেছে। উৎসবগুলো ইরান ও আশেপাশের বেশ কয়েকটি দেশে এখনও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হচ্ছে।

বাংলা নববর্ষও হতে পারে একটি পরিচ্ছন্ন সাংস্কৃতিক উৎসব। যেমন- নৌকা বাইচের আয়োজন, পিঠা উৎসব, হালখাতা, সিরনি বিতরণ ইত্যাদি নানা আনুষ্ঠানিকতায় পালিত হতে পারে বর্ষবরণের আয়োজন।

উৎসবে একটি সমাজের সব মানুষের মেলামেশা ও সৌহার্দ্য বিনিময়ের সুযোগ ঘটে। ইসলামে দুটি ঈদ উৎসবের বাইরে এমন আর একটিও সুযোগ নেই যেখানে সারা দেশের মানুষ একসঙ্গে নির্মল আনন্দময় আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিতে পারে। আমরা সচেতন যে, ইসলাম মানুষকে আল্লাহর স্মরণ ভুলে গিয়ে কোনওরকম কর্মকান্ডেই বুঁদ হয়ে থাকার অনুমতি দেয়নি। এমনকি বৈষয়িকতা ভুলে কেবল খোদার অন্বেষণে বৈরাগ্য গ্রহণের সুযোগও ইসলামে নেই। বরং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণের তাগিদ দেয় ইসলাম। সুতরাং ইসলাম অনুসরণ করা মানে আনন্দ উল্লাসহীন একটি নিরানন্দ জীবন কাটানো হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এটিই যেন নির্ধারিত।

আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবেলা করা যেতে পারে কেবলই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে। আর সেই হতিয়ারটি হতে হবে প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে উন্নততর। আমরা মুসলমানরা অন্যের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়ে কম্পমান হবার পরিবর্তে নিজেরা একটু আগ্রাসী সংস্কৃতির চর্চা করতে পারি কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। আগ্রাসী সংস্কৃতি বলতে বোঝাতে চাই এমন এক সংস্কৃতি যা মুসলিম তরুণদের পাশাপাশি অন্যদেরও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে এবং আমরা সেই ‘অন্যদেরকে’ আমাদের সংস্কৃতির ভেতরে আমন্ত্রণ জানাব।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিনে যে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করা হয়ে থাকে। এই দিবসকে ঘিরে একটি আনন্দ উৎসবের, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জোয়ার সৃষ্টি করা সম্ভব। এ দিনে রাসূলের জীবন নিয়ে আলোচনা, দোয়া- মোনাজাত, খাবার বিতরণ করা যেতে পারে। করা যেতে পারে মানুষে মানুষে শুভেচ্ছা বিনিময়, কাব্যপাঠ, কাওয়ালি ও গজলের আসর বসানো, বিশ্বের সব মানুষের মঙ্গল কামনার একটি উপলক্ষ সৃষ্টি করা। কারণ, রাসূল (সা.) তো শুধু মুসলমানের সম্পদ নন। তাঁকে বলা হয়, রাহমাতুল্লিল আলামিন।

এতক্ষণ যা কিছু বলার চেষ্টা করেছি তার লক্ষ্য একটিই। আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় চেতনা সামাজিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। কাওয়ালি ইসলামি সংস্কৃতির ঐতিহ্য এমনটা সর্বাংশে ঠিক নয়। তবে এটি যে মুসলিম সংস্কৃতির অঙ্গ তাতে সন্দেহ নেই। বেদাত বা ইসলামি চেতনার সঙ্গে ঠিক যায় না, এ কথা বলে যদি সব উৎসব আনন্দ জনজীবন থেকে হটিয়ে দিই তাহলে ক্ষতিটা কোথায় আশা করি স্পষ্ট করতে পেরেছি।

আমাদের বিশ্বাস, ‘কুন ফা ইয়া কুন’ অথবা ‘তাজদারে হারাম’ এর মতো সহিহ ইসলামি ভাবাদর্শের বাহক যেসব কাওয়ালি বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে সেগুলো গেয়ে বা শুনে যে তরুণ আবিষ্ট হয়ে থাকবে, সে আর যাই হোক কখনও বিপথগামী হবে না। এই হাতিয়ারটিকে শাণিত করে তা কাজে লাগাতে হবে। আর সেটি যদি করা হয় ঈদে মিলাদুন্নবী সা. বা শবে বরাতের মতো কোনও ধর্মীয় উৎসবের অনুষঙ্গে তাহলে সেটিই হবে মোক্ষম।

যাঁরা চিন্তাশীল, যাঁরা মুসলমানদের বর্তমান করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেন এই লেখা তাঁদের উদ্দেশে। বিতর্ক সৃষ্টির কোনও ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য কোনওটাই নেই।