ইসলামে নারী অধিকারের স্বরূপ
পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ১২, ২০২১
শাহনাজ আরফিন –
নারী ও পুরুষকে নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণকারী দুটি গ্রহের সাথে তুলনা করা যায়। আর নারী-পুরষের সৌভাগ্য তথা মানব সমাজের পূর্ণতা ও কল্যাণ, নারী ও পুরুষের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন বা নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে নারীকে কালের পরিক্রমায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন ও নানা বাধা-বিঘ্ন সহ্য করতে হয়েছে। আর অধিকাংশ সমাজেই নারী হয়েছে নানা বঞ্চনা ও শোষণের শিকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আজকের আধুনিক ও প্রগতিশীল সমাজেও নারীর অধিকার নানাভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং নারীরা বিভিন্নভাবে শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, মানব সমাজে বিরাজমান নানা বিষয় নারী অধিকারের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং বিভিন্ন সমাজে বিরাজমান প্রথা-সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
আজকের আধুনিক সমাজে নারী অধিকারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। আর এ কারণে নারী-অধিকার নিয়ে নানা মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিরও জন্ম হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক মতাদর্শ আবার অপর মতাদর্শের পরিপন্থী। নারীবিষয়ক নানা মতাদর্শের মধ্যে ‘নারীবাদী’ বা ‘ফেমিনিস্ট আন্দোলন’ অন্যতম। নারীবাদ (Feminism) প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য একটি অস্বাভাবিক, কৃত্রিম ও উদ্দেশ্যমূলক আন্দোলনের ফসল। এর লক্ষ্য হলো সকল অদৃশ্য বিশ্বাস, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করা।
এ মতাদর্শে বিশ্বাসীরা নারী অধিকারের ব্যাপারে উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। তারা নারীকে পুরুষের গুণাবলি ও অধিকার অর্জনে উৎসাহিত করে এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা অর্জনের জন্য সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন বা বিপ্লব সাধনে বিশ্বাসী। আর এক্ষেত্রে তারা ধর্ম, সহজাত প্রকৃতি, প্রথা ও পরিবারের ভূমিকাকে গুরুত্বহীন বলে মনে করে। আর এভাবে নারীবাদীরা নারী ও পুরুষের বিশেষ প্রকৃতি, চাহিদা ও অধিকারকে অগ্রাহ্য করে তাদের মধ্যে এক ধরনের কৃত্রিম সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
অতীতে যেমন পুরুষতন্ত্র ও নারীবিদ্বেষ, মানব সমাজ বিশেষ করে নারী জাতির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে, তেমনিভাবে নারী অধিকার নিয়ে নারীবাদীদের চরমপন্থা ও বাড়াবাড়ি নারী-পুরুষ তথা মানব সমাজের জন্যই অকল্যাণ বয়ে আনবে। ঐশী গ্রন্থ পবিত্র কোরআন নারী –পুরুষের অধিকার সম্পর্কে কোন ধরনের বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দেয় না। পবিত্র কোরআনের মতে, নারী-পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন সহজাত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মানবিকতার দিক দিয়ে উভয়েই সমান। ইসলামের আলোকে ‘নারী ও পুরুষের সাম্য’ কথাটি গোলাপ ও বেলীর গুণাগুণ সমান বলার মতোই একটি অযৌক্তিক কথা। কারণ, এ দুটি ফুলেরই রয়েছে পৃথক পৃথক ঘ্রাণ, বর্ণ, আকৃতি ও সৌন্দর্য।
তেমনিভাবে নারী-পুরুষও এক নয়। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন গঠন প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য। মহিলারা যেমন হতে পারে না পুরুষের সমান, তেমনি পুরুষরাও হতে পারে না মহিলাদের সমান। তাই ইসলাম এদের উভয়কে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় না করিয়ে একে অপরের সহযোগী হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। নিজস্ব গঠনপ্রকৃতি অনুযায়ী এদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে পৃথক পৃথক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
পুরুষের যেহেতু বহু গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজ সম্পাদন করতে হয়; তাই তাকে কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের মতো কিছু সামাজিক প্রাধান্য ও সুবিধা ভোগের সুযোগ দেয়া হয়।
প্রথমত, তাকে অর্থনৈতিক গুরু দায়িত্ব বহন করতে হয়। কেননা, পরিবারের সার্বিক ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব পুরুষের। অপরদিকে স্ত্রী যদি ধনী হন, কিংবা তিনি যদি আর্থিকভাবে স্বাধীন হয়েও থাকেন, তবুও তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর। আদর্শবাদী মুসলিম সমাজে নারীকে জীবিকার জন্য কোন দুঃশ্চিন্তা করতে হয় না।
দ্বিতীয়ত, একজন মুসলিম নারী,স্বামী খুঁজে পাওয়া কিংবা না-পাওয়ার ভয়াবহ দুঃশ্চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। নারীর স্বাভাবিক চারিত্রিক দাবি অনুযায়ী তার পিতা-মাতা বা অভিভাবকগণ তার জন্য কোন উপযুক্ত বর খুঁজে না আনা পর্যন্ত সে গৃহেই অবস্থান করে থাকে। এ ধরনের বিবাহই হচ্ছে প্রকৃত ধর্মসম্মত বিবাহ এবং এতেই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন স্থায়িত্ব পায়।
তৃতীয়ত, প্রয়োজন ছাড়া মুসলিম মহিলারা রক্তাক্ত যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে মুক্ত। এটাকে অনেকের কাছে একটি বঞ্চনা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু নারী প্রকৃতির আলোকে বিচার করলে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ নারীর পক্ষেই এ ধরনের কাজে অংশগ্রহণ খুবই ভারী ও কঠিন বলে প্রমাণিত। এমনকি আধুনিক যে সকল সমাজে ‘সাম্যবাদী’ পদ্ধতিতে নারী ও পুরুষকে সমান করার প্রক্রিয়া চলছে সে সকল সমাজেও চরম কোন অবস্থা না দেখা দেয়া পর্যন্ত মহিলাদেরকে সামরিক বাহিনী বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে দূরে রাখা হচ্ছে।
ইসলাম নারী ও পুরুষের প্রকৃতি অনুযায়ী তাদেরকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সমাজে তাদের কর্ম ও অবস্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইসলাম পুরুষকে সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য প্রদান করেছে এ জন্য যে, পুরুষদেরকে পরিবারের সকল দায়-দায়িত্ব বহন করতে হয়। এছাড়া তাদেরকেই পারিবারিক বিভিন্ন সংকট, আর্থিক, সামাজিক ও অন্য সকল চাপ থেকে পরিবারের সদস্যদেরকে রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়।
পবিত্র কোরআনে সূরা ইয়াসীনের ৪০ নম্বর আয়াতে এসেছে :
لَا الشَّمْسُ يَنْبَغِي لَهَا أَنْ تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ
অর্থাৎ সূর্য চন্দ্রের নাগাল পায় না, রাত দিনকে অতিক্রম করে না এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষ পথে পরিভ্রমণ করে।
নারী-পুরুষও ভিন্ন ভিন্ন গ্রহের মতো এবং তাদের উচিত নিজ নিজ গতি পথে পরিভ্রমণ করা।
স্বাধীনতা এবং সাম্য তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন তারা নিজস্ব গতি ও প্রকৃতির উপর অটল থাকবে। এর অন্যথায় সামাজিক স্থিতি ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট হতে বাধ্য। ইসলামে নারী অধিকারের সমালোচকদের অনেকেই প্রশ্ন করেন, যদি ইসলাম ধর্মে নারীকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হতো তাহলে কি এ ধর্মে নারী-পুরুষের জন্য সম অধিকার নিশ্চিত করা হতো না?
এ প্রশ্ন বা সমালোচনার জবাব দিতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, মানবিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা বলতে কি তাদের অধিকারের সাদৃশ্য বোঝায়, না কি সমতা ও সাদৃশ্য দুটি ভিন্ন বিষয়?
ইরানের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক মুর্তাজা মোতাহহারী এ সম্পর্কে লিখেছেন, সমতা ও সাদৃশ্য দুটি ভিন্ন জিনিস। সমতা বলতে সাম্য বা সমান ভাগ বোঝায়। আর সাদৃশ্য হচ্ছে অনুরূপতা। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোন পিতা তার সন্তানদের মধ্যে সহায় সম্পতি বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে সাদৃশ্য নাও থাকতে পারে। যেমন ধরুন, পিতা কোন সন্তানকে তাঁর কৃষি জমি দিলেন, কাউকে দিলেন তাঁর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আবার কাউকে দিলেন তাঁর দোকান-পাট দেখাশোনার দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে পিতা তাঁর সন্তানদের ক্ষমতা ও যোগ্যতার প্রতি লক্ষ্য রেখে সমভাবেই এ বণ্টনের কাজটি সমাধা করতে চেয়েছেন, কাউকে কারো ওপর প্রাধান্য দেয়া বা বৈষম্য করতে চাননি।
পবিত্র কোরআনে নারীকে কোমলতা, প্রশান্তি ও দয়ার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে সূরা আরাফের ১৮৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا
‘তিনিই তোমাদের এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়।’
ইসলাম-পূর্ব যুগে যখন নারীরা ছিল চরম অবহেলা ও বঞ্চনার স্বীকার, কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো এবং নারীর কোন মূল্যায়নই করা হতো না, তখন ইসলাম দিয়েছে নারীর মুক্তি ও নিরাপত্তা। কন্যাসন্তানের জন্মকে বলা হলো ‘সুসংবাদ’।
কোরআন মজীদের সূরা আন নাহলের ( ৫৮-৫৯) নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
“তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের ‘সুসংবাদ’ দেয়া হয় তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে নিজ সম্প্রদায় থেকে লুকিয়ে বেড়ায় (এবং চিন্তা করে) হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। কত নিকৃষ্ট ছিল তাদের সিদ্ধান্ত।”
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা নিসা নামে পূর্ণাঙ্গ একটি সূরা নাযিল করেছেন কেবল নারীর যাবতীয় স্বাধীনতা ও অধিকারের বার্তা নিয়ে। পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারার ২২৮ নম্বর আয়াতে নারী অধিকারের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন : ‘নারীদের (পুরুষদের উপর) তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে যেমনি রয়েছে নারীদের উপর পুরুষদের।’
এ আয়াতে যেমন সুস্পষ্টভাবে নারীদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, অন্য কোনো ধর্মে এভাবে নারীর অধিকারের কথা বলা হয়নি।
এছাড়া হাদীসে এসেছে : ‘নারীকে সযত্নে লালন পালনকারী পিতামাতার অবস্থান হবে জান্নাতে।’
বিশ্বনবী (সা.) বিশ্ব মানবতার অনন্য আদর্শ হিসেবে নারীর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় কোন ধরনের কার্পণ্য করেননি। তিনি নিজ কন্যা ফাতেমা যাহরা (সা. আ.)-এর হাতে চুমু খেতেন, তাঁর সম্মানে নিজ জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন।
নবীজির বিখ্যাত একটি উক্তি হচ্ছে এরকম : ‘তোমাদের মধ্যে সেই পুরুষ সবচেয়ে ভালো যে তার স্ত্রীর কাছে ভালো।’
পরিশেষে বলা যায়, ইসলাম নারীজাতীকে যে সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে অন্য কোন ধর্মে তা দেয়া হয়নি। বিশ্বের নারী সমাজ যত বেশি চিন্তা ও গবেষণা করবেন তত দ্রুত তাঁরা এ সত্যকে অনুধাবন করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
শাহনাজ আরফিন : লেখক ও গবেষক