ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার ও পারিবারিক জীবনের তাৎপর্য
পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ৯, ২০২১
শাহনাজ আরফিন –
মানব জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই জগতে কোন না কোনভাবে পারিবারিক ব্যবস্থা চালু ছিল। পৃথিবীর প্রথম পরিবার গড়ে ওঠে হযরত আদম (আ.) ও তাঁর স্ত্রী হাওয়ার মাধ্যমে। পরিবারের সদস্য প্রথমত তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজন ছিলেন। সৃষ্টির পর মহান আল্লাহ এ পরিবারকে জান্নাতে বসবাস করতে দেন।
আল্লাহ পাক সূরা বাকারার ৩৫ নং আয়াতে বলেন : ‘হে আদম! তুমি আর তোমার স্ত্রী দুজনে জান্নাতে বসবাস কর।’ পরবর্তীকালে তাঁরা পৃথিবীতে আগমন করলেন এবং তাঁদের থেকে জন্ম নেয় তাঁদের সন্তান-সন্ততি। এভাবে পৃথিবীতে পরিবার ও পারিবারিক ব্যবস্থার সূচনা হয়।
অতীতের সব নবী ও রাসূলের জীবনে ও সময়কালে পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর পরিবারের জন্য দোয়া করেছিলেন। সূরা বাকারার ১২৮ নং আয়াতে এসেছে : ‘হে পরওয়ারদিগার! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ করো এবং আমাদের বংশধরদের থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করো। নিশ্চয়ই তুমি তওবা কবুলকারী, দয়ালু।’
নিঃসন্দেহে, পরিবার হচ্ছে মানুষের বেড়ে ওঠার অন্যতম কেন্দ্র। মানুষের উন্নতি কিংবা তার অধঃপতন পরিবারের সুস্থতা ও পরিশুদ্ধতার ওপর নির্ভরশীল। আর সমাজের সুস্থতার জন্য পরিবারের বিকল্প নেই। কোরআনে সূরা নাহলের ৭২ নং আয়াতে এসেছে : ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য তোমাদের স্বজাতীয় জোড়া বানিয়ে দিয়েছেন আর তোমাদের জোড়া থেকে তোমাদের দান করেছেন পুত্র ও পৌত্র।’
কোরআন মজীদে ‘বাইত’ শব্দটি পরিবার অর্থে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। কোরআনের এ আয়াতগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, মানবতার ধর্ম ইসলাম পরিবার ও পারিবারিক জীবনের ওপর যথেষ্ট তাগিদ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে পরিবারের অপরিহার্যতার দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
এখন আমরা পবিত্র কোরআনে পরিবারের গুরুত্ব নিয়ে খানিকটা আলোচনা করব।
প্রশান্তির স্থান : পরিবার তথা গৃহের অন্যতম কাজ হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করা। পরিবারের ক্ষুদ্র গণ্ডি ও নিরাপদ আলয়ে মানুষ তার আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে এবং তার সহজাত কামনা-বাসনা এবং দৈহিক ও আত্মিক চাহিদাগুলোর নির্বৃিত্ত করতে সক্ষম হয়। মহান স্রষ্টা নিজেকে এই প্রশান্তি ও নিরাপত্তার উৎস হিসেবে উল্লেখ করে বলেন :
وَاللّهُ جَعَلَ لَكُم مِّن بُيُوتِكُمْ سَكَنًا
অর্থাৎ ‘আল্লাহ করে দিয়েছেন তোমাদের গৃহকে অবস্থানের জায়গা’। (সূরা নাহল : ৮০)
আরবি ‘সাকানা’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে যার মাধ্যমে মানুষ প্রশান্তি ও তৃপ্তি লাভ করে।
(১) মানুষ গৃহে তার শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজন মেটাবার পাশাপাশি আত্মিক ও মানসিক উপশমের জন্য সামাজিক বিধিনিষেধের গণ্ডি এড়িয়ে একান্তে নিজ আলয়ে বিশ্রাম এবং নিজ স্রষ্টার সাথে ভাব বিনিময় তথা প্রার্থনার প্রয়োজন অনুভব করে। পরিবার যদি তার এ চাহিদা মেটাতে না পারে তাহলে তা শান্তির নীড় হতে পারে না।
স্রষ্টার স্মরণ ও যিকিরের স্থান : সূরা আহযাবের ৩৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ وَالْحِكْمَةِ
অর্থ : আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানগর্ভ কথা, যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয় তোমরা সেগুলো স্মরণ করবে।
এ আয়াতটি নবী করিম (সা.)-এর স্ত্রীদের প্রতি সম্বোধন করে নাযিল করা হয়েছে। এ আয়াতে লক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :
প্রথমত, গৃহ বা পরিবার থেকে মানুষ যে মূল্যবোধ অর্জন করে তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং একে পুরো জীবনের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পরিবার হচ্ছে বিশ্বের সব পরিবারের জন্য উত্তম আদর্শ। কাজেই আল্লাহর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
তৃতীয়ত, গৃহের নিবিড় ও শান্ত পরিবেশ যদি স্রষ্টার আনুগত্য ও তাঁর স্মরণের স্থানে পরিণত হয় তখন স্রষ্টা নিজেই সেই গৃহের মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দেন। সূরা নূরের ৩৬ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন :
فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ
অর্থ : আল্লাহ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।
আল্লামা তাবাতাবায়ী তাঁর ‘তাফসীরে আল মীযান’ গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন, যে আবাস পাক-পবিত্র ও নিষ্কলুষ সেটি স্রষ্টার ইবাদত ও স্মরণের স্থানে পরিণত হবে। তখন তা আর নি®প্রাণ চার দেয়ালের সাধারণ গৃহ থাকবে না; বরং ঐশী রং এ রঙিন হয়ে আধ্যাত্মিক এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করবে। এর ঐশী দিক যতটা জোরালো ও গাঢ় হবে গৃহের মর্যাদা ততই বাড়বে।
‘বায়তুল্লাহ’ বা কাবা ঘর হচ্ছে এর বাস্তব নিদর্শন।(১)
ঐশী বন্ধনের স্থান : সূরা নূরের ৬১ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
فَإِذَا دَخَلْتُم بُيُوتًا فَسَلِّمُ طَ وا عَلَى أَنفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِّنْ عِندِ اللَّهِ مُبَارَكَةً يِّبَةً
অর্থ : অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ কর তখন তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এটা আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র দোয়া।
এ আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে ‘সালাম’ ও শুভ কামনার মাধ্যমে এবং আল্লাহর স্মরণ ও খোদাভীতি তাদের মধ্যে থাকতে হবে। পরিবারে এ ধরনের পবিত্র আবহ বিরাজ করলে নিঃসন্দেহে তা সমাজেও ছড়িয়ে পড়বে। কাজেই সালামের তাৎপর্য হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, আস্থা ও ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়া।
গৃহের মান ও সম্ভ্রম রক্ষা : পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পরিবারের মর্যাদার ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছেন। আর তাই এ ঐশী গ্রন্থের একাধিক আয়াতে পরিবার সুরক্ষার নানা দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সূরা নূরের ২৭ নং আয়াতে রয়েছে :
أَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَدْخُلُوا۟ بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّىٰ تَسْتَأْنِسُوا۟ وَتُسَلِّمُوا۟ عَلَىٰٓ أَهْلِهَا ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُون
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য গৃহে প্রবেশ করো না, যে পর্যন্ত আলাপ-পরিচয় না কর এবং গৃহবাসীদেরকে সালাম না কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যাতে তোমরা স্মরণ রাখ।’
এ আয়াতে আল্লাহ পাক অনুমতি ও সালাম ব্যতীত অন্যের গৃহে প্রবেশ নিষিধ করেছেন এবং পরিবারের মান ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য এ ধরনের বিধি-নিষেধ মেনে চলাকে জরুরি বলে উল্লেখ করেছেন।
‘সালাম’ শব্দটির মধ্যে রয়েছে পরিবারের সদস্যদের প্রতি শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা এবং তাদের প্রতি আন্তরিকতা ও শান্তির ঘোষণা দেয়া।
আদী ইবনে সেবাত থেকে বর্ণিত হয়েছে, একবার আনসার গোত্রের এক মহিলা রাসূলে খোদা (সা.)-এর নিকট আগমন করে বলেন, ‘আমি নিজ গৃহে অনেক সময় একান্তে থাকতে চাই এবং পরিবারের অপরাপর সদস্যদের কেউ-আমার পিতা, সন্তান কিংবা অন্য কোন পুরুষ আত্মীয়-যদি গৃহে প্রবেশ করেন, তখন কী করব?’ মহিলার এ প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। এ আয়াতের আলোকে বলা যায়, অপরের গৃহে প্রবেশের ক্ষেত্রে গৃহকর্তার অনুমতি ছাড়া গৃহের ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না।
এ ছাড়া সূরা আহযাবের ৫৩ নং আয়াতে নবী করিম (সা.)-এর গৃহে প্রবেশের ক্ষেত্রেও অনুমতি নেবার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কোরআনের দৃষ্টিতে পরিবারের সংজ্ঞা : পবিত্র কোরআনের আলোকে ‘পরিবার’ হচ্ছে এমন একটি সংগঠন যার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে এর সদস্যদের, যেমন : স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা ও সন্তানদের আত্মিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা এবং তাদেরকে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত করা।
সূরা ফোরকানের ৭৪ নং আয়াতে এসেছে :
وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
অর্থ : এবং যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য আদর্শস্বরূপ কর।
এ আয়াতে একটি আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য পরিবারের গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি একটি সুস্থ ও আদর্শ পারিবারিক আবহ যে ঈমানদারদের পরম কাঙ্ক্ষিত তা উল্লেখ করা হয়েছে।
একটি আদর্শ পরিবারের ভিত্তি গৃহের সদস্যদের মধ্যকার আন্তরিক ও নিবিড় সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। পরস্পরের প্রতি দায়িত্বানুভূতি পরিবারের বন্ধনকে দৃঢ় ও অটুট রাখে। পরিবারের সদস্যরা যদি স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহার করে নিজেদের মধ্যকার বন্ধনকে ধরে রাখতে পারে তবে মানবীয় উৎকর্ষতা ও পূর্ণতা অর্জন সহজতর হয়।
সূরা রূমের ২১ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন :
وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ
يَتَفَكَّرُون
অর্থ : এবং তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে আর এক নিদর্শন (হচ্ছে) : তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন; নিশ্চয় চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন আছে।
এ আয়াতের লক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :
প্রথমত, (مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا) ‘তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন’
পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, গৃহে পরিবারের সদস্যদের প্রকৃত রূপ ফুটে ওঠে। প্রত্যেকের চরিত্রের ভালো ও মন্দ দিক, চারিত্রিক গুণ বা দুর্বলতা সবই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ফলে পরিবারই হচ্ছে নিজেকে গড়ার তথা সংশোধনের অন্যতম পীঠস্থান। সন্তানের প্রতি মা-বাবার স্নেহ, দয়া-মমতা এবং মা-বাবার প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, আস্থা-বিশ্বাস ও ত্যাগের মাধ্যমে প্রত্যেকেই নিজেদের চারিত্রিক ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের বাহ্যিক পরিশীলতার চেয়ে আত্মিক শুদ্ধতা ও পবিত্রতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর গৃহের আন্তরিক ও নিবিড় পরিবেশে ভালোবাসা ও মমতার ছোঁয়ায় মানুষের আত্মগঠন ও সংশোধনের প্রক্রিয়া সহজ হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, (وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّة ) ‘তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন’
মহান আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা মানুষের চিরন্তন প্রকৃতিজাত করে দিয়েছেন।
এসব গুণ ও অনুভূতির মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী আত্মিক পরিশুদ্ধতার পাশাপাশি নিজ স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে অপার সুখ ও প্রশান্তি অর্জন করতে পারে।
তৃতীয়ত, (لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا ) ‘যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও’
প্রশান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন পারিবারিক জীবনের অপর একটি অন্যতম লক্ষ্য। পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী এবং পরবর্তীকালে সন্তানদের দায়িত্ব হচ্ছে এ লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়া।
চতুর্থত, ( وَرَحْمَةً ) ‘তিনি তোমাদের মধ্যে রহমত ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন’
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মায়া, মমতা ও সহানুভূতি পরিবারে শান্তি ও নিরাপত্তার অনুভূতি ছড়িয়ে দিতে পারে। শান্তিপূর্ণ ও সুস্থ পারিবারিক আবহে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে তৈরি হয় ভালোবাসা ও হৃদ্যতা।এ ধরনের পরিবেশে প্রতিপালিত ও বেড়ে ওঠা সন্তানরাই একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজের ভিত্তি নির্মাণ করতে পারে।
ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার হলো একটি শিশুর জীবন গড়ার প্রাথমিক পাঠশালা ও প্রধান পাঠাগার। এ পাঠশালার ওপর শিশুর জীবনের ভিত রচিত হয়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসবাসের মধ্য দিয়েই শিশুরা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার গুণাগুণের পরিচয় লাভ করতে শুরু করে। এ জন্য পরিবারের প্রধান দুজন সদস্য বাবা-মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। মাতা-পিতার কারণে শিশু পৃথিবীর মুখ দেখতে পেরেছে। মমতাময়ী মায়ের কারণেই সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য হয় এবং নিরাপদে বেড়ে ওঠে। সন্তান গর্ভে ধারণ, প্রসববেদনার কষ্ট এবং দুধপান করানো প্রভৃতি মা একাই বহন করে
থাকেন। এরপর বাবা লালন-পালনের কাজে মায়ের সঙ্গে অংশীদার হয়ে থাকেন। এর বাহ্যিক প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ তাআলা সন্তানের প্রতি তার মাতা-পিতার সঙ্গে সদয় ও সদ্ব্যবহারকে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য এবং ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
সূরা বনী ইসরাইলের ২৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا
تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا
অর্থ তোমার রব ফায়সালা করে দিয়েছেন : তোমরা তাঁর ইবাদত ছাড়া অন্য কারোর ইবাদত কর না, পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার কর। যদি তোমাদের কাছে তাদের কোনো একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদেরকে ‘উহ্’ পর্যন্তও বল না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মান ও মর্যাদার সাথে কথা বল।
পিতা-মাতার দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানদের লালন-পালন করা, তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। রাসূলে খোদা (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী, সন্তান হচ্ছে পিতা-মাতার কাছে আল্লার আমানতস্বরূপ। তাই তাদেরকে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি অবশ্যই নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি শিক্ষা দিতে হবে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হয় তখন তাদের নামাজের প্রশিক্ষণ দাও।’ অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে : ‘সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে উত্তম আর কিছুই পিতা-মাতা সন্তানদের দান করতে পারে না।’
বিশ্বনবী(সা.) পারিবারিক জীবনের সুস্থতার ওপরে ভীষণ গুরুত্ব প্রদান করেছেন, যা আমাদের অনুসরণযোগ্য। হাদিসে এসেছে যে, রাসূলে খোদা (সা.) একবার তাঁর মেয়ে ফাতেমা (সা. আ.), তাঁর স্বামী হযরত আলী ও হাসান-হোসাইনকে এক চাদরের নিচে রেখে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন : ‘হে আল্লাহ! এরা হচ্ছে আমার আহলে বাইত (পরিবার)।’
পরিবারের সদস্যদের সাথে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ মর্যাদায় উচ্চ স্তরে পৌঁছে। অপর একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘মুমিনের মধ্যে ঐ ব্যক্তির ঈমান সবচেয়ে পরিপূর্ণ, যে চরিত্রের সৌন্দর্যে উন্নত এবং নিজের পরিবার-পরিজনের প্রতি সর্বাপেক্ষা সদয় ও নম্র ব্যবহার করে।’
স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, ভাই-বোন প্রভৃতি নিয়ে গঠিত হয় পরিবার। তাই সুস্থ পরিবার গঠনে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দিতে হবে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, জীবনের অন্য সকল দিকের মতো পরিবার ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কেও ইসলামের রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। একটি পুরুষ ও নারী কিভাবে দাম্পত্য জীবন শুরু করবে, তাদের একের প্রতি অন্যের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ ও বিসম্বাদ দেখা দিলে কীভাবে তার সমাধান করবে সব বিষয়েই ইসলাম দিয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ইসলামের সেসব নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসৃত না হওয়ার আজ বিশ্বের মুসলিম সমাজ ভুগছে নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে।
জাতিসংঘ প্রতি বছর ১৫ মে ‘আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস’ পালন করে। তারা পরিবার বিষয়ে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা এবং শান্তিময় জীবন লাভের স্বপ্ন নিয়ে এ দিবসের নানা আয়োজন করে।
অথচ আমাদের প্রাণের ধর্ম ইসলাম শান্তিময় জীবন ও পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য শেখানোর জন্য দিয়েছে ‘পরিবার ব্যবস্থা’। কোরআনের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করলেই কেবল আদর্শ পরিবার গঠন করা সম্ভব। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর নির্দেশিত পথে আমাদের পরিবারগুলো গঠন করার তওফিক দিন।
শাহনাজ আরফিন : লেখক ও গবেষক