শুক্রবার, ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইসলামি বিপ্লবোত্তর ইরান : পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও অবস্থান

পোস্ট হয়েছে: জুন ১৫, ২০২১ 

news-image
ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান : দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি ইরানের ইতিহাসে ১৯৭৯ সাল একটি মোড় পরিবর্তনকারী সন। এ সনের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রখ্যাত মার্জায়ে তাকলিদ বিশ্বব্যাপী ইমাম খোমেইনী নামে সুপরিচিত হযরত আয়াতুল্লাহ্ আল্-উয্মা রুহুল্লাহ্ আল্-মুসাভী (রহ.)-এর প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়। মানব ইতিহাসের এ নজিরবিহীন ও অভূতপূর্ব বিপ্লবের মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদার মুহাম্মদ রেজাশাহ পাহলভী (১৯১৯-৮০ খ্রি.) ও তাঁর সরকার উৎখাত হয়। এতে কেবল পাহলভী রাজবংশ (১৯২৫-৭৯ খ্রি.) নয়; বরং আড়াই হাজার বছর ধরে চলমান রাজতন্ত্রেরও বিলুপ্তি ঘটে। স্বৈরাচারী খোদাদ্রোহী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিলুপ্তির পরপরই ইরানি জনগণ প্রায় সর্বসম্মত রায়ে ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো ইসলামি বিপ্লবের ৪২তম বর্ষপূর্তি উদযাপিত হয়েছে। বিপ্লব পরবর্তী এ চার দশকেরও বেশি সময়ে ইরানের পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং আর্থ-সামাজিক ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিখাতসহ সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ইরানের বৈশ্বিক অবস্থান সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত লিপিচিত্র অঙ্কন এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সুদৃঢ়করণ
বলা হয় যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লব ছিল হাজার বছরের সেরা আদর্শিক বিপ্লব। এ বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ ছিল অভ্যন্তরীণ স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি, বহিঃশক্তির তাঁবেদারির নাগপাশ ছিন্ন করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুনিশ্চিত করা, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইরানে পাহলভী স্বৈরতন্ত্রের অবাসন ঘটে। পাহলভী স্বৈরশাসকদের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কৃর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকারী পশ্চিমা পরাশক্তিসমূহ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনার অবসান হয়। ফলে ইরানি জনগণের বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়। তবে এ স্বাধীনতা রক্ষা করা ছিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানি বিপ্লবী সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ সুদীর্ঘ কাল ধরে ইরানের উপর যে কায়েমী স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করেছিল ইসলামি বিপ্লবের ফলে তা নস্যাৎ হওয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার মিত্র পশ্চিমা শক্তিগুলো ইরানকে পদানত ও তাদের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা ও কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য বিলিয়ন বিলয়ন ডলার ব্যয় করেছে। ইসলামি বিপ্লব ও ইরানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারযুদ্ধ চালিয়েছে। ইরানকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল করার জন্য অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধসহ সবধরনের অপচেষ্টা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের কোনো অপকৌশলই এ যাবৎ কাজে আসেনি। বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রুদের সর্বাত্মক অপপ্রচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে ইতোমধ্যে ইরানের জনগণ বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান ও নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে গ্রহণের লক্ষ্য পরিপূর্ণভাবে অর্জন করেছে। আগ্রাসী শক্তির কাছে নতজানু না হয়ে তারা নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রাখায় অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মুসলিম দেশগুলোর বেশিরভাগ যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর পশ্চিমা এবং অন্য বৃহৎশক্তির তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে, সেখানে ইরান শত প্রতিকূলতার মুখেও স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে বস্তুত ঈমানী শক্তি ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে ইসলামি বিপ্লবের অনুসারীরা একের পর এক বাধা অতিক্রম করে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে।
শাসনব্যবস্থা ও সরকার পদ্ধতি
ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য ছিল রাজতন্ত্রের পরিবর্তে একটি ইসলামি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা- যেখানে সবাই স্বাধীনভাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিপ্লব সফল হওয়ার পরপরই ঐতিহাসিক গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতিতে (৯৮.২%) ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাজতন্ত্রের পরিবর্তে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তবে একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক নয়। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবী সরকার যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল এর অধীনে ইরানে এমন একটি সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় যে সরকার ব্যবস্থায় একজন ন্যায়পরায়ণ ইসলামি ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ‘রাহবার’ বা সর্বোচ্চ নেতা সরকার ও প্রশাসনের পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করেন। ইসলামি আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি অভিভাবক পরিষদ ইসলামি মানদণ্ডের ভিত্তিতে এবং পার্লামেন্টের অনুমোদিত আইন অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। ইরানে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার চালু আছে।  জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে চার বছরের জন্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একটি কেবিনেট সরকার পরিচালনায় প্রেসিডেন্টকে সহায়তা করে। ইরানের আইন পরিষদ- ‘মজলিশে শুরা-ইয়ে-এসলামি’ এক কক্ষবিশিষ্ট এবং এর সদস্য সংখ্যা ২৯০। ইরানের সরকার পরিচালিত হয় ইসলামি শরীয়া আইন ও এর সাথে সঙ্গতি রেখে পার্লামেন্টে প্রণীত আইন দ্বারা।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান উদীয়মান অর্থনীতির এক সম্ভাবনাময় দেশ। ইরানি বিপ্লবের পর থেকে সরকারের দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্যসমূহ ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, পূর্ণ কর্মসংস্থান ও জনসাধারণের আরামদায়ক জীবনযাত্রার মান নিশ্চিতকরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় মুসলিম রাষ্ট্র ইরানের উপর নানা রকমের বিধি-নিষেধ ও বাধা-বিপত্তি আরোপ করতে থাকায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্য অর্জন অনেক কঠিন এক চ্যালেঞ্জ ছিল। এতদসত্ত্বেও গত চার দশকে অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে ইরান ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে এবং ইতোমধ্যে দেশটি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হয়েছে।
ইরানের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো খনিজ তেল ও গ্যাস। এ দুটি প্রাকৃতিক সম্পদ ইরানকে energy superpower এর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তেল (বিশ্বের ১০%) ও খনিজ গ্যাস (বিশ্বের ১৫%) ইরানের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হলেও বর্তমান বিশ^বাস্তবতা এবং সময়ের দাবি বিবেচনায় ইরান সরকার তেলনির্ভর অর্থনীতির পরিবর্তে নতুন নতুন খাত নির্ধারণ করে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে ইরানের অর্থনীতিতে ক্রমশ শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতের বিকাশ ঘটায় অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো অনেকটাই বদলে গেছে।
তেহরান স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের অন্যতম সফল স্টক এক্সচেঞ্জ। বর্তমানে এতে চল্লিশের অধিক শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইরানের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ২ হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি এবং আর্থিক প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ১২ শতাংশের উপরে। মার্কিন অবরোধ ও কোভিড মহামারি সত্ত্বেও ইরানের অর্থনীতির অগ্রগতি অব্যাহত আছে। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুক ‘ম্যানেজিং ডিভারজেন্ট রিকভারিস’ প্রতিবেদনে বলেছে গত বছরের তুলনায় ইরানের প্রবৃদ্ধি আরো এক শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। গত বছর আইএমএফ’র হিসেবে ইরানের প্রবৃদ্ধি ছিল দেড় শতাংশ। এ বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ২.৫ শতাংশে। উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যেই ইরানের প্রবৃদ্ধি পশ্চিম ও সেন্ট্রাল এশিয়ার দেশগুলোর প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে।
জাতিসংঘের অধীনস্থ বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক কর্তৃপক্ষ আঙ্কটাড ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইরানকে একটি সফল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের সেরা বাণিজ্য সম্পাদনকারী ৪০টি দেশের তালিকায় ইরান ইতোমধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো রপ্তানি খাত। এ খাতের সাফল্য একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও ইঙ্গিত দেয়। রপ্তানি খাতে ইরানের অর্জন উল্লেখ করার মতো। ইরানের রপ্তানি পণ্যের অন্যতম প্রধান হলো তেল। দেশটির কাস্টমস প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী গত ফারসি অর্থ বছরে দেশটির তেল থেকে অর্জিত রপ্তানি আয় ছিল সাড়ে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। একই সময় তেলবহির্ভূত বাণিজ্য আয় ছিল ৭৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। চলতি বছর ইতোমধ্যেই গত বছরের তুলনায় তেলবহির্ভূত রপ্তানি বেড়েছে ৪৬%। তেলবহির্ভূত যেসব পণ্য ইরান রপ্তানি করে থাকে তার মধ্যে রেয়েছে পেট্রোকেমিক্যাল, প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত পণ্য, আয়রন ও স্টিল, কপার, রাসায়নিক ও জৈব সার, বিভিন্ন রকমের কৃষি ও খাদ্যপণ্য, খনিজ, অটোশিল্প পণ্য, গালিচা ও ওষধি পণ্য ইত্যাদি। ইরানের প্রযুক্তিভিত্তিক রপ্তানিও বেড়েছে লক্ষ্যণীয় মাত্রায়। অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনার সক্ষমতাও অর্জন করেছে দেশটি। ইতোমধ্যে দেশটির পানি ও বিদ্যুৎ খাতে বড় রকমের বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পেরেছে। দেশটির অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট স্থিতিশীল বলে ইউরোপ, চীন, আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারতসহ লাতিন আমেরিকার দেশগুলো দেশটিতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। ইরানের অর্থনীতির অন্যতম উল্লেখযোগ্য খাত হলো কৃষি। কৃষিখাতে বিপ্লবোত্তর ইরানের অগ্রগতির চিত্রও রীতিমত বিস্ময়কর।
ইসলামি বিপ্লবের পর নানা প্রতিবন্ধকতা জয় করে ইরানের অর্থনীতিতে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির যে নতুন ধারা সূচিত হয়েছে এতে দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে নিজের স্থান করে নিয়েছে (২০১৮ সালে ইরানের অবস্থান ছিল ১৮ এবং বর্তমানে সম্ভবত ১৫ তম)। প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি আশা প্রকাশ করেছেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে ইরান বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির প্রধান ১০টি দেশের মধ্যে স্থান করে নেবে। ইতোমধ্যে ইরান মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফিকা অঞ্চলে অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি এ ধরনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করবে বলে গ্লোবাল রিস্ক ইনসাইটস আভাস দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা ফাও’র তথ্য মতে, ইরান হচ্ছে বিশ্বের প্রধান পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি যে দেশটি কমলা, মাল্টা ও লেবুজাতীয় ফল উৎপাদনে সেরা অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া শশা, ক্ষীরা, খেজুর, বেগুন, ডুমুর, পেস্তা, নাশপাতি, আখরোট ও তরমুজ উৎপাদনে বিশ্বের সেরা পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান। খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে অগ্রগামী দেশ ইরান।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি
ইসলামি বিপ্লবোত্তরকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে ইরান। শিক্ষা এক সময় এলিটদের ভূষণ থাকলেও বিপ্লবোত্তর ইরানে সাধারণ ও প্রান্তিক জনমানুষকে এর আওতায় নিয়ে আসা হয়। শুধু তাই নয়, ইসলামি বিপ্লবপূর্ব সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে ইসলামের চেতনায় ঐশী আলোয় আলোকিত হয়। পশ্চিমা বস্তুবাদী শিক্ষার দাপটে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ইবনে সিনা, আল-তুসী, জামী, ওমর খাইয়্যাম ও হাফিজের মতো ক্ষণজন্মা বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্টিকর্ম ইসলামি বিপ্লবের পর পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক চেষ্টা গৃহীত হয়। ইরানে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৯৬.৬ শতাংশ।
ইসলামি শিক্ষা দর্শনের ভিত্তিতে দেশের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করাসহ কিছু মৌলিক দর্শনের ভিত্তিতে ইরানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পরিচালিত হয় Ministry of Education এর তত্ত্বাবধানে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের শিক্ষা কার্যক্রম, চিকিৎসা শিক্ষা ও কমিউনিটি কলেজ শিক্ষার সমন্বয়ে গড়া ইরানের উচ্চশিক্ষা পরিচালিত হয় Ministry of Science and Technology I Ministry of Health and Medical Education এর তদারকিতে। তথ্যসূত্র মতে, শিক্ষা ইরান সরকারের অন্যতম প্রাগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত। সরকার জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ এবং বার্ষিক সরকারি ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশ এ খাতে ব্যয় করে। ইরান সরকার শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন ও সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এ কারণেই ইরানের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বদরবারে স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ইরানে ১৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৫৮টি পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, ৫৬৭টি বেসরকারি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৩৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। শাংহাই র‌্যাঙ্কিং প্রকাশিত অ্যাকাডেমিক র‌্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ (এআরডাব্লিউইউ) ২০২০-এর তথ্য অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল ও ইসলামি দেশগুলোর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যায় র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথম স্থান দখল করেছে ইরান। টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) এর ২০২০ সালের বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রকাশিত তালিকায় ইরানের ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। উচ্চশিক্ষার গুণগত মানের কারণে বর্তমানে ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২৯টি দেশের ৪০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন
টেকনোলজির উদ্ভাবন, ব্যবহার ও এর যৌক্তিক মাত্রা নির্ণয়ে বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের পশ্চাদপদতা মোটা দাগে চোখে পড়ার মতো। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় বিপ্লবোত্তর ইরানের অগ্রগতি এককথায় বিস্ময়কর। নানা রকমের বাধা-বিপত্তি, পাশ্চাত্যের অসহযোগিতা ও অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ইরানি বিজ্ঞানীরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার পরিচয় দেওয়ায় দেশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বৈপ্লবিক উন্নতি ও সাফল্য অর্জন করেছে। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির চেয়ে ১১ গুণ দ্রুততর। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্রুত অগ্রগতি বা প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইরান শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী বৈজ্ঞানিক গবেষকদের তালিকায় ১০ জনের অধিক ইরানি বিজ্ঞানীর নাম রয়েছে। অ্যারোস্পেইস সায়েন্স গবেষণায় ইরান আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রথম এবং বিশ্বে ১৫তম অবস্থানে রয়েছে। মহাশূন্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম এবং মহাকাশযানে প্রাণী পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। ইরানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্কের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০০২ সালে যেখানে মাত্র ১টি পার্ক ছিল এখন সেখানে রয়েছে ৮০টিরও বেশি।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে ইরান বিগত দু’দশকে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে লক্ষ্যণীয় উন্নতি সাধন করেছে। বর্তমানে ইরানে দেড় শতাধিক সরকারি গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দু’শতাধিক বেসরকারি সেন্টার ও কোম্পানি বায়োটেকনোলজি গবেষণা এবং উৎপাদন খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে ইরানের অবস্থান প্রথম এবং এশিয়ায় ১ম সারির ৫টি দেশের অন্যতম। Bio-tech drug উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরান প্রথম ১২টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে।
ন্যানোটেকনোলজি খাতে ইরানের অগ্রগতি বিস্ময়কর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ন্যানোপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে পাঁচ অগ্রগামী রাষ্ট্রের মধ্যে অদম্য অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে ইরান। তেহরান টাইমস এর সূত্র মতে, বিশ্বের মোট ন্যানোপ্রযুক্তি নিবন্ধে ইরানের ৬ শতাংশ অবদান রয়েছে।। বর্তমানে ইরানে ৩৭০টিরও অধিক কো¤পানি স্বাস্থ্য, নির্মাণ, কৃষি ও প্যাকেজিং, পেট্রোলিয়াম, বস্ত্র এবং যানবাহন নির্মাণ শিল্পে ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছে। স্বল্প সময়ে ন্যানোটেকনোলজি প্রয়োগ করে এসব খাতে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে।
কম্পিউটার সায়েন্স ও রোবোটিক্স খাতেও ইরানের সাফল্য উল্লেখ করার মতো। ২০১০ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব প্রযুক্তিতে Sorena-2 নামক রোবট তৈরি করে যা  কর্তৃক বিশ্বের ৫টি সর্বোচ্চ প্রযুক্তির রোবটের মাঝে স্থান পায়। একই ধারাবাহিকতায় ইরানের automotive industry দশটি রোবট তৈরি করে। ২০১৫ সালে ইরানের বিজ্ঞানীরা নিজস্ব প্রযুক্তিতে রিমোট বা টেলি সার্জারির কাজে ব্যবহৃত ইবনে সিনা নামের রোবট উন্মোচন করেছেন। ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইতোমধ্যে সুপার কম্পিউটার তৈরিতেও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে।
মোটর গাড়ি শিল্প আধুনিক বিশ্বে অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম বড় মাধ্যম। এখাতেও ইরান উল্লেখযোগ্য সফল্য অর্জন করেছে। দেশটি এখন মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি নির্মাণকারী দেশ। ইরানে নির্মিত গাড়ি ইউরোপ ও এশিয়ার নানা দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে সাফল্য
গত প্রায় চারদশকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইরানের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। বিপ্লবের আগে যে দেশটির অনেক শহরে ইরানি ডাক্তার খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল, সে ইরানের নাম এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায়। বিশ্বের সেরা ১ ভাগ চিকিৎসা গবেষকদের মধ্যে ৪০ জনের মতো জন ইরানি গবেষক স্থান করে নিয়েছেন। ইরান বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ওষুধ উৎপাদনকারী দেশের একটি। দেশটি বর্তমানে জার্মানি ও ইতালিসহ বিশ্বের ৪৪টি দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানি করছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক ও জটিল পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবহারেও ইরানি বিজ্ঞানীরা দর্শনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। ক্যান্সার চিকিৎসায়ও ইরানি বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও ইরানি চিকিৎসকদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরান হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ও হৃদরোগ চিকিৎসায় শীর্ষে অবস্থান করছে ইরান। অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও কিডনি প্রতিস্থাপনেও ইরানি চিকিৎসকদের দক্ষতা প্রশংসনীয় পর্যায়ের। স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপ্লেস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়। স্বল্প খরচে বিশ্বের আধুনিক ইনফার্টিলিটি ট্রিটমেন্ট মেথড অনুসরণের মাধ্যমে নিঃসন্তান দম্পতিদের সেবা দিচ্ছে। পারস্য উপসাগরের দেশগুলো থেকে অনেক নিঃসন্তান দম্পতি ইরানে চিকিৎসা নিতে আসছেন। ইরানি গবেষকগণ ‘কোভিরান বারেকাত’ নামক করোনাভাইরাসের একটি ভ্যাকসিন আবিস্কার করেছেন। এর মানব পর্যায়ে তৃতীয় ট্রায়াল শুরু হয়েছে।
বর্তমানে এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে মেডিক্যাল ট্যুরিজম ক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ইরানের অবস্থান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত
একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। বিদ্যুৎ সভ্যতা ও আধুনিকতার প্রধান নিয়ামক। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধিও উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সবিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং এরই মধ্যে এ খাতেও ব্যাপক সফলতা লাভ করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার দিক থেকে আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম ইরান। বর্তমানে ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৮০ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৭৫ ভাগের বেশি হয় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ইরানে কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট, হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট, জেনারেশন পাওয়ার প্লান্ট ও রিনিউবেল এনার্জি পাওয়ার প্লান্ট থেকে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরানের অবস্থান এক নম্বর। পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে পর্যায়ক্রমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে দেশটি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উল্লেখযোগ্য উৎস ফুয়েল সেল বা জ্বালানি কোষের প্রোটন বিনিময় ঝিল্লি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন ইরানি বিজ্ঞানীরা। উল্লেখ্য যে, দেশটি বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ খাতে কেবল পুরোপুরি স্বয়ংস¤পূর্ণতা অর্জন করেছে তাই নয়, একই সাথে দেশটিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
জ্বালানি খাতেও ইরানের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ইরান কয়েকটি পেট্রোকেমিক্যাল ও শোধনালয় উন্নয়ন প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্পে উৎপাদিত পরিশোধিত পেট্রোল বা বেঞ্জিন এখন বিদেশে রপ্তানি করছে। ইরান বিশ্বের প্রথম সারির চারটি দেশের মধ্যে রয়েছে যারা V 94.2 গ্যাস টারবাইন তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। তরল গ্যাস তৈরির (GTL) প্রযুক্তি অর্জনে ইরান প্রথম তিনটি দেশের মাঝে রয়েছে। ইরান দেশীয়ভাবে রিফাইনারি, তেল-ট্যাংকার, তেলকূপ খনন, Offshore platform এবং তেল উত্তোলনের ৭০ ভাগ সক্ষমতা অর্জন করেছে। গভীর পানিতে তেলকূপ খনন প্রযুক্তিতে ইরান বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশের মাঝে রয়েছে।
শিল্প ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অগ্রগতি
সংস্কৃতি হলো মানুষের জীবনবোধ বিনির্মাণের কলাকৌশল, মানব জীবনের একটি শৈল্পিক প্রকাশ। ইসলাম সুস্থ ও মানবিক চিন্তার বিকাশের পথে সাংস্কৃতিক চর্চার বিরোধী তো নয়ই, বরং সংস্কৃতির উন্নত সংস্করণ উপহার দিতে সক্ষম -এটাই প্রমাণ করেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। ইরানে বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে নওরোজসহ সকল স্থানীয় সংস্কৃতির পরিচ্ছন্ন ও জোরালো উদযাপন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
মানুষের সুকৃতি আচরণকে বিকশিত করার জন্য ইরান সকল শিল্পমাধ্যমকেই ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ইরানি চলচ্চিত্র অন্যতম। ইরানি চলচ্চিত্র আজ বিশ্বে একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। অস্কারসহ পৃথিবীর সকল ফিল্ম ফেস্টিভালে দাপটের সাথে বিচরণ করছে ইরানি চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের সকল ফেস্টিভালে ইরানি চলচ্চিত্রের সাবলীল বিচরণ দেখা যায়। বাংলায় ডাবিংকৃত ইরানি চলচ্চিত্র বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। ইরানি চলচ্চিত্রে সচরাচর ধর্মীয় কোনো নির্দেশনা বা ডায়ালগ থাকে না। তবে উপন্যাস ও চরিত্রনির্ভর প্রতিটি ফিল্ম থেকে মানুষ কিছু না কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে যা পৃথিবীর অনেক বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বকে দিতে পারেনি। শক্তিশালী চিত্রনাট্য, অসাধারণ ও অভূতপূর্ব অভিনয়, কলাকুশলির মনকাড়া আবেদন ছাড়াও বিশ্বমানের কারিগরি কৌশলের কারণে বিশ্বের সর্বত্র আজ ইরানি সিনেমা ব্যাপকভাবে দর্শক সমাদৃত হচ্ছে। সেইসাথে পুরস্কৃত হচ্ছে শীর্ষ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলে নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি।
শুধু চলচ্চিত্র নয়, পেইন্টিংস, ক্যালিগ্রাফি, ফটোগ্রাফি, মিউজিক ইত্যাদি ক্ষেত্রকেও ইরানি বিপ্লব ধারণ করেছে এবং লালন করছে। মুসলিম বিশ্বে আর্ট ও পেইন্টিং-এর যে স্বতন্ত্র ধারা চালু হয়, এর কৃতিত্ব অনেকাংশেই ইরান দাবি করতেই পারে। তাদের এ ধারা বিশেষ কোনো প্রকারে সীমাবদ্ধ নয়; বরং Classical, Traditional, Revolutionary & Modern সকল ক্ষেত্রেই সমানভাবে বিরাজমান। মানুষের সুস্থ বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম খেলাধুলা। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মানুষের সুস্থ বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে খেলাধুলাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি জনগণের ব্যাপক আগ্রহের কারণে খেলাধুলায় ইরানের খ্যাতি আজ বিশ্বজোড়া। ফুটবল থেকে শুরু করে খেলাধুলার প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে চলেছেন ইরানি খেলোয়াড়রা। আধুনিক ও বিশেষায়িত পার্র্ক ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য কীর্তি ইত্যাদির কারণে ইরান এখন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণস্থল। দেশটি এখন বিভিন্ন ফেস্টিভাল, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, এক্সপো ও আন্তর্জাতিক কার্নিভালের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরানের প্রতিরক্ষা বা সমর শিল্প ছিল পুরোপুরি পাশ্চাত্যনির্ভর। ইসলামি বিপ্লবের প্রায় দেড় বছর পর পাশ্চাত্যের ইশারায় ইরানের উপর চাপিয়ে দেয়া দীর্ঘ ৮ বছরের যুদ্ধের সময় বিকশিত হয় ইরানের প্রতিরক্ষা বা সমর শিল্প। ইরানের প্রায় ছয় লাখ সক্রিয় সেনা সদস্য ও তিন লক্ষাধিক রিজার্ভ সেনাসহ দশ লাখেরও বেশি ‘বাসিজ’ নামক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী রয়েছে। প্রচলিত সামরিক সাজ-সরঞ্জাম ও অস্ত্র-শস্ত্রে ইরান এখন পুরোপুরি স্বনির্ভর, এমনকি অপ্রচলিত বা অত্যাধুনিক অনেক সমর-সম্ভারেও প্রায় স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। ইরানের রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপক নৌযান ও রাডারসহ অনেক অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সফ্ট প্রযুক্তির অধিকারী ইরান। ইরান বিমান প্রতিরক্ষা তথা বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ও রাডার সিস্টেম খাতেও ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ইতোমধ্যে ইরান সুপারফাস্ট এন্টি সাবমেরিন তৈরি করেছে। লেজার টার্গেটিং প্রযুক্তির অস্ত্রের ক্ষেত্রে ইরান বিশ্বের পাঁচটি দেশের অন্যতম- যাদের চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) নির্মাণ সক্ষমতা রয়েছে। সম্প্রতি ইরান বড় আকারের কৌশগত ড্রোন ‘গাজা’ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে ড্রোন শক্তিতে আরও এক ধাপ এগোল। এই ড্রোন একটানা ৩৫ ঘণ্টা আকাশে উড়তে পারবে।
ইরানের আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রধান স্তম্ভ হলো অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে দেশটির অবস্থান এখন বিশ্বে চতুর্থ। ইরানের হাতে রয়েছে ‘ইমাদ’ ও ‘ফজর’ এর মতো উন্নত প্রযুক্তির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। সম্প্রতি দেশটি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘নাইন দেই’ ও রাডার ব্যবস্থা ‘কুদ্স’ উদ্বোধন করেছে। নাইন দেই শত্রুর ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান, বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বোমা এবং ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম। আর কুদ্স রাডার ব্যবস্থা সহজে মোতায়েন ও স্থানান্তরযোগ্য। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এই রাডার অত্যন্ত কার্যকরী হবে বলে সমর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম স্টিল্থ ধরনের অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান ‘কাহের-৩১৩’ সহ ইরানের নিজেদের তৈরি অনেক যুদ্ধ বিমান রয়েছে। অবরোধ ও নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে গত চার দশকের বেশি সময় ধরে ইরান প্রতিরক্ষা খাতে যে সক্ষমতা অর্জন করেছে সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তির ভালোই ধারণা রয়েছে। এ কারণেই ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে যতই আস্ফালন করুক না কেন তারা ইরানকে সরাসরি আক্রমণ করতে সাহস করেনি।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি
ইরান একটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয়। তবে ইসলামি বিপ্লবের পর মার্কিন সহায়তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলেও প্রজাতন্ত্রী সরকার এ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। ইসলামি সরকারের সম্পূর্ণ শান্তিপুর্ণ পরমাণবিক কর্মসূচির স্লোগান হলো : ‘Neuclear energy for all, Neuclear weapon for none.’ ইরান পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএই এর সদস্য হিসেবে এবং এনপিটি বা পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। জ্বালানি তৈরি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে দেশটি পারমাণবিক গবেষণা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণসহ পরমাণু রশ্মি বা শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত জাতের বীজ উদ্ভাবন ও সংস্কারের মাধ্যমে কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধি; খাদ্য সামগ্রির স্টেরিয়ালাইজেশান ও স্বাস্থ্যসম্মত করা; পশু টিকা তৈরি, সংকোচনযোগ্য পলিমারের পাইপ নির্মাণ; বিভিন্ন ধরনের লেজার রশ্মি ব্যবহার এবং হাত-পায়ের ছাপ নির্ণয়ের মতো প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছে। এ ছাড়াও আলোক-রশ্মি বা তেজস্ক্রিয় রশ্মির মতো বিভিন্ন রশ্মির মাধ্যমে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি, দেশকে বাইরের সীমান্ত থেকে আসা পারমাণবিক রশ্মির নিঃস্বরণ বা হামলা থেকে রক্ষা ইত্যাদি কাজে পরমাণু শক্তিকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে। পরমাণু ক্ষেত্রে ইরানি বিজ্ঞানীদের একের পর এক নতুন সাফল্যে দিশাহারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের দোসর ইউরোপীয় শক্তিবর্গ দেশটির বিরুদ্ধে নানা ভিত্তিহীন প্রচারণা চালিয়ে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রভাব খাটিয়ে তেহরানের উপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলছে। তবে এতদসত্ত্বেও ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে এক চুলও সরে আসেনি; বরং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অব্যাহত রাখে এবং ২০ সালা পরিকল্পনায় ২০টির বেশি নতুন পরমাণু চুল্লি নির্মাণ এবং অন্তত ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ইরান ইতোমধ্যে পারমাণবিক গলনযন্ত্র নির্মাণে সফল হয়েছে। এছাড়া, ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড উৎপাদন ও পুরো ‘পরমাণু জ্বালানি চক্র’ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এলিট ক্লাবের সদস্য দেশ ইরান।
পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে ইরানকে নিবৃত করতে ব্যর্থ হয়ে পশ্চিমা মোড়লেরা শেষ পর্যন্ত তার সাথে একটি চুক্তিতে আসতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানিকে নিয়ে গঠিত ৫+১ গ্রুপ ২০১৫ সালে জেনেভায় ইরানের সাথে এক চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে ইরানের উপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা জারি করায় এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আর ইরানও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করা হলে চুক্তির শর্ত রক্ষা বা আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানায়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরানের সাথে পরমাণু বিষয়ে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
নারীর ক্ষমতায়ন
বর্তমান বিশ্বকে বলা হয় নারীর ক্ষমতায়নের যুগ। এ যুগে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে ইরানের অবস্থান বিশ্বের অগ্রগামী দেশগুলোর মধ্যে প্রথম কাতারে রয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলাসহ সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। ইরানের প্রায় মোট জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ সাক্ষর মানুষের মধ্যে ৪৬ শতাংশ নারী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী ইরানিদের প্রায় ৫০ শতাংশই নারী। অথচ বিপ্লবপূর্ব ১৯৭৮ সালে শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে নারীর অবস্থান ৫ শতাংশের বেশি ছিল না। উচ্চশিক্ষার গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ইরানি নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষ্যণীয় পর্যায়ে বেড়েছে। ২০০০ সালে যেখানে ইরানি নারীদের অংশগ্রহণের হার ছিল ২৭ শতাংশ বর্তমানে এ হার ৪০ শতাংশেরও বেশি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিপক্ষদের বহুদূর ছাড়িয়ে গেছেন দেশটির নারীরা। বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী বিজ্ঞানীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (সংক্ষেপে এসটিইএম) বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্যও চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের রয়েছে সরব উপস্থিতি। তথ্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, ইরানে সকল পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা পদে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তিন বছর আগে ইরানে ব্যবস্থাপনা পদে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে তা প্রায় ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরকারি বেসরকারি চাকরির বাজারেও দেশটির নারীদের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন শাখায় নারী কর্মচারীদের সংখ্যাও পূর্বে তুলনায় অনেক বেড়েছে। শিল্প ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমজীবীদের প্রায় ৫০ শতাংশই নারী। কৃষি পণ্যের প্রায় ৪০ শতাংশই উৎপাদন হয় পল্লি নারীদের শ্রমে। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানি নারীদের গৃহস্থালি কাজেরও মূল্য বেড়েছে। জানা যায় যে, ইরানের বর্তমান মোট দেশীয় উৎপাদন বা জিডিপিতে গৃহিণীদের অবদান ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। উদ্যোক্তা পর্যায়েও নারীরা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।
সার্বিক দিক পর্যালোচনায় বলা যায় যে, ইরানি নারীদের জীবনমানের সূচক, জীবন প্রত্যাশা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অর্জন প্রমাণ করেছে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর দেশটির নারীদের জীবনমান ব্যাপকভাবে বেড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা যেখানে আজ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোরও এক বড় সমস্যা সেখানে ইরানে নারীর সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি নজির সৃষ্টি করেছে। একজন নারী কিংবা তরুণী যদি একাকী রাতের বেলায় পথে হেঁটে যায় তাকেও আলাদা করে ভাবতে হয় না নিরাপত্তার কথা। এটি নারীর সামগ্রিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে এক বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
সামাজিক সুরক্ষা
গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তা একটি বড় ইস্যু। যে কোনো দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির বিষয়টি অনেকাংশই নির্ভর করে সেই দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার উপর। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এক্ষেত্রে ইরানের অর্জন দৃষ্টান্তমূলক ও অন্য অনেক দেশের জন্য অনুসরণীয়। যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষ সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয় অস্ত্র বহন করতে, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চরম নৈতিক অবক্ষয়, গভীর পারিবারিক সংকট প্রভৃতি যেখানে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার, সেখানে ইরানে বিরাজ করছে উল্টো চিত্র। শিশু ও নারী নির্যাতন, লুটপাট, খুন-খারাবি ও সাইবার ক্রাইম থেকে ইরান অনেকটা মুক্ত। ইরানে বর্তমানে সামাজিক অপরাধ প্রবণতাও অনেক কম। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও ইরান সোচ্চার। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বের শান্তিপ্রয়াসী জাতিসমূহকে জাগ্রত করতে ইরান সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
শেষ কথা
আধুনিক বিশ্বে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সার্বিক উন্নয়নের এক রোল মডেল। প্রাকৃতিক সম্পদের আধার ও বিশ্বসভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকারী ইরান বিশ শতকে পাহলভী রাজবংশের শাসনামলে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে এর সম্পদ ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছিল, ঠিক তখনই ১৯৭৯ সালে ইমাম আয়াতুলাহ খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এর ফলে ইরানে তাগুতি রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটে এবং একই সাথে ইরান পশ্চিমা আধিপত্যবাদের হাত থেকে রক্ষা পায়। ইরান পরিণত হয় একটি ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। বিশ শতকের শেষ দিকে ইরানে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লব এবং এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক সরকারের স্থায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কেবল পশ্চিমাদের নয়, মুসলিম বিশ্বেরও সংশয় ছিল। বিপ্লবোত্তর ইরানকে ধ্বংস ও পঙ্গু করে দেওয়ার বিপ্লববিরোধী অভ্যন্তরীণ কুচক্রী মহল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমাদেশগুলো, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আরব বিশ্বের কোনো কোনো দেশের অব্যাহত অপপ্রয়াস, অবরোধের নামে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার অপতৎপরতা সত্ত্বেও ইরান এগিয়ে গেছে। কোনো অপচেষ্টাই ইরানের অব্যাহত অগ্রগতিকে রোধ করতে পারেনি। বর্তমান বিশ্বে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা করে সুসংবদ্ধ রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা গঠনে কেবল সফল নয়, বিপ্লবোত্তর ৪২ বছরের পথপরিক্রমায় স্বনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং পরমাণু, মহাকাশ গবেষণা, চিকিৎসা, বায়োটেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজিসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সকল শাখায় ঈর্ষণীয় উন্নতি ও সাফল্য অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের দাবিদার সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতজানু হয়ে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত সেক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। তদুপরি ইরান ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বমানবতা ও বিশ্ব-মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ করার অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব বর্তমান অর্জনের মাধ্যমে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান আজ বিশ্ব দরবারে উন্নয়নের অনন্য মডেল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়