বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইসলামি বিপ্লবের ৪৩ বছর, অবরোধ সত্ত্বেও যেভাবে এগিয়ে চলেছে ইরান

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৬, ২০২২ 

সাইদুল ইসলাম
গত ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে পালিত হলো ইসলামি বিপ্লবের ৪৩তম বিজয় বার্ষিকী। এ উপলক্ষে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দশদিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করে। ঐতিহাসিক এই বিপ্লবের ৪ দশকের সাফল্য আজ বিশ্বের সকল মুসলিম ও স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য একটি রোল মডেল। বহু বিশ্লেষকের মতে এ বিপ্লব বিগত এক হাজার বছরের সেরা আদর্শিক বিপ্লব, যা ইরানি জাতির জন্য ফিরিয়ে আনে প্রকৃত স্বাধীনতা, সম্মান ও উন্নয়নের বিরতিহীন অগ্রযাত্রার সেই গৌরবের ধারা। এ বিপ্লবের ফলে দিশেহারা হয়ে পড়া মার্কিন পরাশক্তি ও তার মিত্রদের দশকের পর দশক ধরে চলমান নানা ষড়যন্ত্র ও কঠিন অবরোধের মধ্যেও বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে দেশটি। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরান বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে শক্তিশালী অবস্থান বলে দিচ্ছে দেশটি কতটা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। শিক্ষা, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন নেতৃস্থানীয় দেশের তালিকায় রয়েছে ইরান।
আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বর্তমানে ইরানের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। ন্যানো প্রযুক্তিতে দেশটির অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। সামরিক শক্তির দিক থেকে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ, সাবমেরিন বা ডুবো জাহাজ শিল্পে ষষ্ঠ, অ্যারোস্পেস, সামরিক ও বেসামরিক বিমান শিল্প, কৃত্রিম উপগ্রহ ও মহাকাশ সংক্রান্ত প্রযুক্তিতে অষ্টম, চিকিৎসা খাতে দশম, কৃষিতে দশম, খেলাধুলায় ১৩তম এবং শিল্প খাতে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ১৯তম।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও বিপ্লবী ইরানি জাতি অর্থনৈতিক খাতসহ কোনো কোনো খাতে বাইরের শত্রুর নজিরবিহীন বাধা আর নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশ অসুবিধা ও হয়রানির শিকার হলেও এসব কিছুই ইসলামি ইরানের দুর্বার অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারেনি মোটেও। বরং এসব বাধা ও নিষেধাজ্ঞা ইরানের জন্য শাপে বরে পরিণত হচ্ছে এবং যেসব খাতেই বাধা আসছে ইসলামি ইরান সেসব খাতেই হয়ে উঠছে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
উল্লেখ্য, পাশ্চাত্যের ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের তেল রপ্তানির আয় কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও বা রপ্তানি আয়ের অর্থের প্রবাহ দেশে আসতে দেরি হলেও ইরান পণ্যের বিনিময়ে পণ্য প্রদান ব্যবস্থা বা বার্টার সিস্টেমসহ নানা ধরনের বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করে এই সমস্যা সমাধান করছে। এ ছাড়াও পেট্রোকেমিক্যাল পণ্যসহ তেল-বহির্ভূত নানা পণ্যের রপ্তানি বাড়িয়ে দিয়ে ইসলামি ইরান তার অর্থনীতিকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের নির্ভরতা থেকে অনেকাংশেই বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে। আগামী অল্প কিছুকালের মধ্যেই ইরানের অর্থনীতির সিংহভাগই জ্বালানি তেল বিক্রির নির্ভরতা থেকে মুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এভাবে পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি হয়ে উঠছে বহুমুখী, বিচিত্রময় ও স্বনির্ভর।
ইসলামি বিপ্লবের ৪৩তম বিজয় বার্ষিকীকে সামনে রেখে দেশটিতে এবার অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি গত ৬ ফেব্রুয়ারি এক ভিডিও কনফারেন্সে সারা দেশে ১৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগসহ ৪৮টি বড় শিল্প প্রকল্প শুরু করার নির্দেশ দেন। প্রকল্পগুলো দেশের বিভিন্ন প্রদেশের ২৭টি শহরে বাস্তবায়িত হতে চলেছে। এছাড়াও দেশব্যাপী ৪৬৮টি শিল্প ও খনি প্রকল্প, ৪৮৪টি পরিবহন প্রকল্প, ২ হাজার ৯৫০টি শিক্ষামূলক প্রকল্প এবং অসংখ্য বন্দর উন্নয়ন, সামুদ্রিক এবং পরিবহন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি, সমরনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং অন্য অনেক খাতে বিপ্লবী ইরানের বিস্ময়কর সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ হলো এই বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতার সময়োপযোগী, বিপ্লবী ও ইসলামসম্মত দিক-নির্দেশনা এবং জনগণ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে এই মহান নেতার প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য।
সম্প্রতি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সফলভাবে মহাকাশে আরো একটি গবেষণাধর্মী স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আহমাদ হোসেইনি জানান নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি স্যাটেলাইট বহনকারী সী-মোর্গ নামের রকেটে করে তিনটি গবেষণাধর্মী ডিভাইস মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। আহমাদ হোসেইনি বলেন, মহাকাশ গবেষণার এই মিশনে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে তিনটি ডিভাইস পাঠানো হয়েছে। এসব ডিভাইস মহাকাশের কক্ষপথে ৪৭০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থান করবে এবং রকেটের গতি ছিল প্রতি সেকেন্ডে ৭.৩৫০ কিলোমিটার। ইরানের এ কর্মকর্তা জানান, ‘রকেট উৎক্ষেপণের সময় মহাকাশ কেন্দ্রের সবকিছুই নিখুঁতভাবে কাজ করেছে এবং পরিকল্পনা মতো স্যাটেলাইট বহনকারী রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে মহাকাশ গবেষণা পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জিত হলো।’ এ নিয়ে ইরান এ পর্যন্ত মহাকাশে ৮টি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে। দেশটির দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ত্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এখন লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। বিজ্ঞান-গবেষণায় ইসলামি ইরান এখন বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি দেশের অন্যতম। এই নিবন্ধে ইসলামি বিপ্লবের পর গত ৪৩ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সার্বিক উন্নয়নের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো :
শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন
একটি দেশ তথা জাতির উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে জাতি যত বেশি এগিয়ে সে জাতি তত উন্নত। বলা হয়ে থাকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোনো জাতি যেকোনো সময় যে কোনো কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম। আর এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার নির্দেশে দেশটির বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির চেয়ে ১১ গুণ দ্রুততর (ঋধংঃবংঃ)। সব দেশের বৈজ্ঞানিক অবস্থান বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সায়েন্স-মেট্রিক্স এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, বৈশ্বিক পরিম-লে ইরানের বাস্তবিক এই উন্নতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দেশটিকে দ্রুতবর্ধনশীল দেশ হিসেবে পরিণত করেছে। বিশ্বের সকল দেশের বৈজ্ঞানিক অবস্থানের তুলনামূলক বিভিন্ন পরিসংখ্যানে ইরানের অগ্রগতি সু¯পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
এক কথায় বলতে গেলে ইসলামি বিপ্লবের গত ৪৩ বছরে ইরান বায়োপ্রযুক্তি, ন্যানোপ্রযুক্তি, ওষুধ শিল্পসহ বিজ্ঞানের প্রায় সব ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। দেশটি এখন মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি নির্মাণকারী দেশ। পরিবহন খাতে বিরাট উন্নতি ঘটিয়েছে। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে ইরান হচ্ছে নির্মাণ, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন, অস্ত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোকেমিক্যাল উৎপাদনে সবচেয়ে অগ্রগামী দেশ। ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘সাফির’ নামে একটি রকেট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ইরান সর্বপ্রথম কক্ষপথে তার কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনে সাফল্য অর্জন করে। নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি স্যাটেলাইট ও দেশে নির্মিত লাঞ্চারের মাধ্যমে রকেট উৎক্ষেপণে বিশ্বে যে সাতটি দেশ সক্ষম ইরান এখন তার একটি। এছাড়া, ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড উৎপাদন ও পুরো ‘পরমাণু জ্বালানি চক্র’ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এলিট ক্লাবের সদস্য দেশ ইরান।
মহাকাশ প্রযুক্তির জ্ঞানের দিক দিয়ে ইরান বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে এবং মহাকাশবিজ্ঞানের দিক থেকে রয়েছে ১১তম স্থানে। অন্যদিকে, মহাকাশবিজ্ঞানে অঞ্চলে শীর্ষস্থানে রয়েছে দেশটি। মহাশূন্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম এবং মহাকাশযানে প্রাণী পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপ্লেস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিশ্বে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ১৩তম স্থানে রয়েছে ইরান। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলা বিজ্ঞানীদের তালিকায় শীর্ষ দুই শতাংশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন আট ইরানি বিজ্ঞানী। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং বৈশ্বিক সূচকে এই চিত্র উঠে এসেছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের লক্ষাধিক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর তথ্য উপস্থাপনার জন্য একটি ডাটাবেজ তৈরি করেছে। এতে বিজ্ঞানের ২২টি ক্ষেত্র ও ১৭৬টি উপশাখায় কাজ করা বিজ্ঞানীদের তথ্য তুলে ধরা হয়।
বৈজ্ঞানিক বিকাশের ক্ষেত্রে ইরান বিশ্বে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক উৎপাদনে ইরানের অবস্থান ১৫তম। বিজ্ঞান উৎপাদনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ ওয়েব সায়েন্সের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সূচকে ৩৮২ স্কোর নিয়ে ইরান বিশ্বে ১৫তম স্থানে রয়েছে। যা নিবন্ধিত ইরানি নিবন্ধগুলোর গুণমান নির্দেশ করে। নিউরোসায়েন্স এবং কগনিটিভ নিউরোলজির ক্ষেত্রে অঞ্চলে প্রথম স্থানে রয়েছে ইরান। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পরিচালিত অধ্যয়ন এবং মূল্যায়নের ভিত্তিতে ইরান এই অঞ্চলে নিউরোসায়েন্স এবং জ্ঞানীয় নিউরোলজিতে প্রথম স্থানে রয়েছে। এছাড়া ইরান বর্তমানে নিউরোসায়েন্সের ক্ষেত্রে বিশ্বে ১৯তম, আচরণগত নিউরোসায়েন্সে ১৩তম, সেলুলার ও আণবিক ক্ষেত্রে ১৭তম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্নায়ুবিজ্ঞানে ১২তম স্থানে রয়েছে।
ন্যানো প্রযুক্তিতে ইরান বিশে^ তৃতীয়
কারিগরি ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে এখন ন্যানোপ্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রায় সকল বিভাগেই এই ন্যানো প্রযুক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। এই প্রযুক্তিতে বিশ্বে ইরানের অবস্থান তৃতীয়। মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যালস, পশু চিকিৎসা, পরিবেশবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মলিকিউল, এমনকি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও এই প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়। চলতি ইরানি বছরের প্রথম ছয় মাসে (২১ মার্চ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর) ইরানে মোট ৭৮৩টি ন্যানো পণ্য ও সরঞ্জাম তৈরি হয়েছে এবং এসব পণ্য ন্যানোস্কেল সার্টিফিকেটও লাভ করেছে। এর আগে গত বছর দেশটিতে মোট ৭৫০টি ন্যানো পণ্য ও সরঞ্জাম তৈরি হয়। ৭৮৩টি পণ্যের মধ্যে ৫৬৬টি ন্যানো পণ্য সংশ্লিষ্ট ও ২১৭টি ন্যানো সরঞ্জাম সংশ্লিষ্ট।
অন্যদিকে, চলতি ইরানি বছরের (যা ২১ মার্চ শেষ হবে) শেষ নাগাদ ন্যানো প্রযুক্তি পণ্য থেকে ইরানের রাজস্ব আয় প্রায় ৭২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। ন্যানোটেকনোলজি ইনোভেশন কাউন্সিলের সেক্রেটারি সাইদ সরকার এই প্রত্যাশা করে বলেন, গত ২০ বছরে ২৫টি শিল্প খাত থেকে ৮৫০টি ন্যানো পণ্য বাজারে প্রবেশ করেছে।
গবেষণাগারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, শিল্প সরঞ্জাম, টেক্সটাইল সরঞ্জাম, লন্ড্রি বা ডিজারজেন্ট পণ্য সামগ্রী, কৃষি ও ভবন নির্মাণ সরঞ্জাম ইত্যাদি ন্যানো প্রযুক্তিজাত পণ্যের অন্তর্ভুক্ত। টেক্সটাইল শিল্প পণ্যের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ব্যবহৃত বেডশিটের কথা বলা যেতে পারে। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার করে নির্মিত এইসব বেডশিট অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল মানে কোনোরকম ব্যাকটেরিয়া এসব চাদরে আক্রমণ করতে পারবে না। শিশুদের জামা-কাপড়ও এই ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। স্যাটেলাইট-রশ্মি, মাইক্রোওয়েভ রশ্মি প্রতিরোধক কাপড়ও ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। বায়ুম-লীয় ঠা-া প্লাজমা শিল্প মেশিনের কথা না বললেই নয়। এই শিল্পে এখন তাঁত শিল্পসহ খাবার, চিকিৎসা, প্যাকেজিং এবং স্টেরিলাইজ করা হয়। এমনকি পরিবেশবিজ্ঞানেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

শিক্ষা খাতে ইরানের উন্নয়ন
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪৩ বছরে ইরানে শিক্ষা খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে দেশটির শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ শিক্ষিত। ইসলামি শিক্ষা-দর্শনের ভিত্তিতে দেশের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশটির অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে ইরানের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১৫৪টি, পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫৮টি, বেসরকারি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৬৭টি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৩৫৪টি। টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিং ২০২২ এ বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে ইরানের ৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৩টি সূচকের ভিত্তিতে চারটি ক্ষেত্রে পারফরমেন্সের ভিত্তিতে এই র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করা হয়। ক্ষেত্রগুলো হলো পাঠদান, গবেষণা, জ্ঞান হস্তান্তর ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালে এই তালিকায় ইরান থেকে মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছিল। এদিকে, বিশ্বের ৩০ হাজার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পেয়েছে ইরানের ৬৯৪টি প্রতিষ্ঠান। ওয়েবমেট্রিক্স র‌্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ২০২২-এ এই চিত্র দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবমেট্রিক্স র‌্যাঙ্কিং একটি যৌগিক সূচকের উপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়। ওয়েবমেট্রিক্স র‌্যাঙ্কিং ২০০৪ সালে চালু করা হয় এবং প্রতি বছর জানুয়ারি এবং জুলাই মাসে র‌্যাঙ্কিং আপডেট করা হয়। ২০২১ সালে এটি বিশ্বব্যাপী ৩১ হাজারের অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ওয়েব সূচক প্রকাশ করে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে ইরানের উন্নয়ন
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪৩ বছরে চিকিৎসাখাতে ইরানের উন্নয়ন যেকারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। বিপ্লবের আগে যে দেশটির অনেক শহরে ইরানি ডাক্তার খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল সে ইরানের নাম এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায়। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইরানের অবস্থান বিশে^ দশম। দেশটি বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ নিজেই তৈরি করে এবং চাহিদার শতকরা ১০০ ভাগ ওষুধ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে দেশটি। বর্তমানে বিশ্বের ৫৪টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে ইরানি কোম্পানিগুলোর তৈরি মেডিকেল সরঞ্জাম। বৈশ্বিকভাবে ৫ লাখ মেডিকেল সরঞ্জাম আইটেমের মধ্যে ৫৬ শতাংশ ইরানি ভার্সন আন্তর্জাতিক বাজারে পাওয়া যায়। ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক দপ্তরের তথ্যমতে, দেশব্যাপী স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে মোট ২২৭টি বিজ্ঞানভিত্তিক কোম্পানি মেডিকেল সরঞ্জাম সরবরাহ করে। সম্প্রতি রাশিয়া, জার্মানি এবং ইকুয়েডরে ‘ব্রেন সার্জারি নেভিগেশন সিস্টেম’ রপ্তানি শুরু করছে ইরান। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের এসব জটিল উপকরণ বর্তমানে ইরানের ৮০টি হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে। উপকরণগুলো কৌশলগত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মস্তিষ্কের বিভিন্ন ধরনের জটিল অস্ত্রোপচারে এধরনের উপকরণ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এধরনের ডিভাইস সার্জনকে অস্ত্রোপচারের সময় প্রয়োজনীয় সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে সক্ষম। টিউমার, সাইনাস ও মাথার খুলি, এমনকি স্পাইনাল কর্ড বা মেরুদ- অপারেশনে এসব ডিভাইস খুবই উপযোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক আহমেদ আল-মানদারি বলেছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ইরান হচ্ছে রোল মডেল। মানদারি বলেন, বিগত চার দশক ধরে ইরানের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক জনগণের সময়মতো সাশ্রয়ী মূল্যে, গ্রহণযোগ্য ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিতের লক্ষে কাজ করছে। তিনি বলেন, এসব নতুন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের আওতা বাড়াতে সাহায্য করবে এবং শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ইরানের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ৬৫টি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে। ওয়েবমেট্রিক্স র‌্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি জানুয়ারি ২০২২-এ এই চিত্র দেখা গেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, ইরান ২০১৯ সালে হাসপাতালের সংখ্যা ও মানের দিক দিয়ে বিশ্বে ২১তম স্থান অর্জন করে। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের দিক দিয়ে ইরান বিশ্বে দ্বিতীয় দেশের স্বীকৃত লাভ করে।
এদিকে, ইরানের চিকিৎসা খাতে ব্যবহৃত জৈব পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি সংস্থার পরিচালক জানিয়েছেন, ইরান কেবল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে তা-ই নয়, একই সাথে দেশটি জৈব ওষুধ প্রস্তুত সংক্রান্ত প্রযুক্তি এবং অভিজ্ঞতাও রপ্তানি করছে। এ জাতীয় প্রযুক্তি রপ্তানির মধ্য দিয়ে ইরানের জৈব ওষুধ উৎপাদনের উচ্চ সক্ষমতাই ফুটে উঠেছে। বর্তমানে ইরান এ জাতীয় ওষুধ নির্মাণের প্রযুক্তি তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরাক, আর্মেনিয়া, কাযাখস্তান এবং রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। এ ছাড়াও ইরানি বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী মৌলিক কোষ তৈরি করতে সক্ষম হওয়ায় ইরান এ ক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা ৫টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী মৌলিক কোষ নির্মাণে ইরানের সাফল্যের কথা স্বীকার করেছে। ফলে ইরান এক্ষেত্রে বিশ্ব অঙ্গনে জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীনের পরই নিজের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে সক্ষম হয়।
ক্যান্সার চিকিৎসায়ও ইরানি বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। তেহরানের কে এন তূসি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন একটি যৌগ আবিষ্কার করেছেন যার সাহায্যে মানবদেহে ক্যান্সার চিহ্নিত করা যাবে। এধরনের যৌগ উৎপাদন করা যাবে বেশ সস্তায় এবং এতে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা স¤পন্ন করা যাবে। হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও ইরানি চিকিৎসকদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরান হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ও হৃদরোগ চিকিৎসায় শীর্ষে অবস্থান করছে।
এদিকে, বিশ^ব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ও আক্রান্তদের চিকিৎসায় উল্লেখ্যযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে ইরান। এরই মধ্যে ইরান করোনাভাইরাসের বেশ কয়েকটি টিকাও তৈরি করেছে। বর্তমানে দেশটি করোনার টিকা প্রস্তুতকারী বিশ্বের ছয়টি দেশের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। দেশটি এখন নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও করোনার টিকা রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মেডিক্যাল ট্যুরিজম
মেডিক্যাল ট্যুরিজম শিল্পে ইরান এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। এখন সারা বছর জুড়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য ইরানে আসছেন। বেশিরভাগ রোগী হলেন ব্রিটেন, সুইডেনসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য নীতিতে চিকিৎসা ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ইরানে যেকোনো অপারেশনের ব্যয় তুরস্ক, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক চতুর্থাংশের মতো। তবে চিকিৎসার গুণগত অবস্থা বিশ্বমানের। সেজন্যই বিদেশী রোগীরা ইরানের চিকিৎসার মানের ব্যাপারে সন্তুষ্ট। ইরানের উন্নত চিকিৎসাসেবা বিশ্বের চিকিৎসকগণকেও আকৃষ্ট করছে। দেশটিতে ওপেন হার্ট সার্জারিসহ বহু জটিল ও মারাত্মক রোগের চিকিৎসা এখন উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে করা হচ্ছে।
রপ্তানি খাত
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো রপ্তানি খাত। এই খাতে যে দেশ যত বেশি শক্তিশালী সেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত বেশি সমৃদ্ধ। আর এক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান উদীয়মান অর্থনীতির সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির ইতিবাচক গতিধারায়। তেলের ওপর নির্ভরতাই ছিল এক সময় দেশটির অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কিন্তু সেই তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে দেশটি। ইসলামি বিপ্লবের পর বিগত ৪৩ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোও পাল্টে যাচ্ছে। ক্রমশ শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতের বিকাশ ঘটছে। এর ফলে দেশটির অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। ইরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নিষ্ঠুর অবরোধ সত্ত্বেও চলতি ফারসি বছরের প্রথম নয় মাসে দেশটিতে বৈদেশিক বাণিজ্য ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। ইরানের শুল্ক প্রশাসনের (আইআরআইসিএ) প্রধান আলিরেজা মোগাদাসি এ তথ্য জানিয়েছেন। মোগাদাসি জানান, ফারসি ১৪০০ সালের প্রথম ৯ মাসে ইরান এবং অন্যান্য দেশের মধ্যে ৭২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ১২ কোটি ২৫ লাখ টন পণ্য বিনিময় হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ওজনের দিক দিয়ে ১১ শতাংশ এবং মূল্যের দিক দিয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি। মোগাাদাসি আরও বলেন, বাণিজ্য সম্পর্ক একই গতিতে চলতে থাকলে বছরের শেষ নাগাদ দেশের মোট বাণিজ্য ৯৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
বছরের প্রথম নয় মাসে ওই মোট বাণিজ্যের মধ্যে ৩ কোটি ৫১ লাখ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ৯ কোটি ২৩ হাজার টন পণ্য ছিল রপ্তানি সংশ্লিষ্ট। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ওজনের দিক দিয়ে ৮ শতাংশ এবং মূল্যের দিক দিয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। এদিকে, ইরানের শুল্ক প্রশাসনের (আইআরআইসিএ) উপপ্রধান ফোরুদ আসগারি জানিয়েছেন, চলতি ফারসি বছরের শেষ নাগাদ ইরানের তেল-বহির্ভূত রপ্তানির পরিমাণ ৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। জনাব আসগারি বলেন, ষষ্ঠ ইরানি ক্যালেন্ডার মাস (যা ২২ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছে) শাহরিভার থেকে তেল-বহির্ভূত পণ্য রপ্তানি ত্বরান্বিত হয়েছে। তাই আশা করা হচ্ছে চলতি বছরের শেষে এই পরিমাণ ৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে।
চলতি ফারসি বছরে দেশটির প্রথম নয় মাসে খনিজ রপ্তানি বেড়েছে ৯০ শতাংশ। এই সময়ে দেশটি ৯ দশমিক ৪৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই রপ্তানি ৯০ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। অপর একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২১ মার্চ থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশটি থেকে ২৮০ দশমিক ৬৩০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ইস্পাত ও ইস্পাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। খনি ও খনিজ খাতের সর্বোচ্চ ৫৫ দশমিক ৬ শতাংশ রপ্তানি অংশ ছিল ইস্পাত ও ইস্পাত পণ্যের। ইরানে তেল-বহির্ভূত পণ্য রপ্তানির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, জৈব রাসায়নিক পণ্যসামগ্রী, আকরিকসহ ধাতব দ্রব্যসমূহ, ফলমূল ও বাদাম। এছাড়া দেশটির রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে আয়রন ও স্টিল, কপার, সার, লবণ, সালফার, পাথর ও সিমেন্ট, পেট্রোকেমিক্যাল, কৃষিপণ্য, খাদ্যপণ্য, খনিজ ও ওষধি পণ্য উল্লেখযোগ্য।
কৃষি উন্নয়ন
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪৩ বছরে কৃষি খাতে ইরানের অগ্রগতির চিত্র রীতিমত বিস্ময়কর। কৃষি পণ্যের বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে ইরান বিশে^ তৃতীয় অবস্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে। আর ইরানের তুলনামূলক রপ্তানি সম্ভাবনাময় খাতগুলোর তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে দেশটির কৃষি খাত। ইরানের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা (টিপিও) প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এই চিত্র পাওয়া গেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা ফাওর তথ্য মতে, ইরান হচ্ছে বিশ্বের প্রধান পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি যে দেশটি কমলা, মাল্টা ও লেবুজাতীয় ফল উৎপাদনে সেরা অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া শশা, ক্ষীরা, খেজুর, বেগুন, ডুমুর, পেস্তা, নাশপাতি, আখরোট ও তরমুজ উৎপাদনে বিশ্বের সেরা পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া কঠিন অবরোধের মধ্যেও চলতি ফারসি বছরের প্রথম চার মাসে (২১ মার্চ থেকে ২২ জুলাই) মূল্যের দিক দিয়ে ইরানের কৃষি পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ৯ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এই রপ্তানি বেড়েছে। ইরানের শুল্ক প্রশাসনের (আইআরআইসিএ) উপপ্রধান মেহরদাদ জামাল অরুনাকি এই তথ্য জানান। আইআরআইসিএ এর কারিগরিবিষয়ক উপপ্রধান বলেন, চার মাসে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ২৫ লাখ টন কৃষি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। উল্লিখিত সময়ে রপ্তানি হওয়া প্রধান প্রধান খাদ্যদ্রব্য এবং কৃষি পণ্য ছিল টমেটো, পেস্তা, তরমুজ, টমেটো পেস্ট, পনির, আপেল, আলু, খেজুর ও বিভিন্ন মিষ্টি। রপ্তানি গন্তব্যের শীর্ষে ছিল ইরাক, চীন, আফগানিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
সামরিক শক্তি
ইরান সারা বিশ্বে এখন যেসব কারণে বিশেষ আলোচিত তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর সামরিক শক্তি। এ ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ। সামরিক শক্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, ইরানের রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সক্রিয় সেনা সদস্য। এছাড়া আছে সাড়ে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী বাসিজ, যার সদস্য সংখ্যা দশ লাখের বেশি। এতে পুরুষের পাশাপাশি নারী সদস্যও রয়েছে। সব মিলিয়ে ইরান যেকোনো সময় দশ লাখের বেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা মোবিলাইজ করতে পারে এবং এ সুবিধা বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশের রয়েছে। ইরানের হাতে রয়েছে নিজস্ব সামরিক শিল্প-কারখানা যেখানে ট্যাংক, আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার, গাইডেড মিসাইল, সাবমেরিন, সামরিক নৌযান, গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, রাডার সিস্টেম, হেলিকপ্টার এবং জঙ্গিবিমান তৈরি করা হয়। এছাড়া ইরানের কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে হুত, কাউসার, জেলযাল, ফতেহ-১১০, শাহাব-৩ ও সিজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র এবং নানা ধরনের ড্রোন।
পর্যটন শিল্প
আনন্দ, ভালোলাগা আর রূপময় স্বপ্নিল পৃথিবীর অজানা কোনো সৌন্দর্যের হাতছানিতে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যেতে মন ছুটে চলে পাহাড়, নদী, সাগর ও অরণ্যে। কখনও মন চায় কোনো শিল্পকর্মের সুনিপুণ কারুকার্যে মন রাঙাতে। আর সে মনের খোরাক জোগাতেই দূর থেকে দূরে ছুটে চলা। সে চলার পথের গন্তব্য যদি হয় ইতিহাস, ঐত্যিহ্যে সমৃদ্ধ কোনো দেশ তাহলে যে একজন ভ্রমণপিপাসুর মনের ষোলকলা পূর্ণ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঠিক এমনই এক দেশের নাম হলো ইরান। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের দেশ এটি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মিডিয়া সিএনএন এর সিনিয়র প্রডিউসার ব্যারি নিল্ড ইরানের পর্যটন স¤পর্কে তাঁর প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছেন, ‘থার্টি ফোর ইনক্রেডিবল বিউটিফুল রিজন্স টু ভিজিট ইরান’। অর্থাৎ ইরান সফরের ৩৪টি অবিশ্বাস্য সুন্দর কারণ। ইরানের ৩৪টি আকর্ষণীয় নিদর্শনের বর্ণনা দিয়ে এই প্রতিবেদনটি লেখা হয়। এমন একটি দেশে ইসলামি বিপ্লবের গত ৪৩ বছরে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ দেশটিকে বিশ্বপর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। বর্তমানে ইরান বিশ্বের সেরা ১০ পর্যটন গন্তব্যের অন্যতম।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে ইরানের ২৬টি নিদর্শন। এই তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। গত ২৭ জুলাই ইরানের উরামানাত সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানসমূহের তালিকায় যুক্ত করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো। ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর ভূখ-ের উরামানাতে কয়েকশ’ গ্রাম রয়েছে। এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে আরও ৩ লাখ ৩ হাজার হেক্টরের দৃষ্টিনন্দন এলাকা। একই মাসে এক হাজার চারশ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্স-ইরানিয়ান রেলপথকেও বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে ইউনেস্কো। রেলপথটি ইরানের ব্যাপক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বলতে গেলে দেশটিতে যেমন রয়েছে পাহাড় আর সাগর, তেমনি রয়েছে বিশাল মরুভূমি, কোথাও নদ-নদী, আবার কোথাও সুবিস্তৃত সমতল ভূমি। ভূমি-বৈচিত্র্যের মতো এখানকার আবহাওয়াতেও রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। সারা ইরানে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীতÑ এই চারটি ঋতু রয়েছে। রাজধানী তেহরানসহ বিশাল এলাকাজুড়ে যখন প্রচ- শীত কিংবা তুষারাবৃত তখন দক্ষিণে (পারস্য উপসাগর সংলগ্ন) দিব্যি বসন্তের হাওয়া। পাহাড়, সাগর, নদ-নদী আর জঙ্গলাকীর্ণ বৈচিত্র্যময় ভূমি এবং আবহাওয়ার কারণে ইরানে পর্যটকের ভিড়ও লেগে থাকে সারা বছর।

গ্রামীণ উন্নয়ন
আট কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানের ৭৪ শতাংশ মানুষ শহরে এবং ২৬ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। তবে শহরের মতো গ্রামের মানুষও সকল মৌলিক নাগরিক সুবিধা ভোগ করছে। স্বল্প আয়ের জনগণ কম খরচে ও ঋণসুবিধা পেয়ে বাড়ির মালিক হচ্ছে। ইসলামি বিপ্লবের পর পরই প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানি, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল-ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে তাৎক্ষণিক নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এখন ইরানের গ্রামের মানুষও স্বাস্থ্যবিমার আওতায় চলে এসেছে।
সামাজিক নিরাপত্তা
যে কোনো দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির বিষয়টি অনেকাংশই নির্ভর করে সেই দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার ওপর। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাই তো সারা বিশ্বের নজর আজ শান্ত ও স্থিতিশীল ইরানের দিকে, দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার দিকে। যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষ সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয় অস্ত্র বহন করতে, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চরম নৈতিক অবক্ষয়, গভীর পারিবারিক সংকট, তালাক প্রভৃতি যেখানে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার সেখানে ইরানে বিরাজ করছে উল্টো চিত্র। এখানে নেই কোনো মারামারি, নেই চুরি-ছিনতাই, গোলাগুলি-অস্ত্রবাজি। প্রতিদিনের পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনের খবরে খুন-হত্যাকা-ের খবর ‘মাস্ট আইটেম’ হিসেবে থাকে নাÑ যা অনেক উন্নত দেশেও কল্পনা করা যায় না। এখানে মানুষ অনেক বেশি নিরাপদে পথ চলে। সেই নিরাপত্তা দিনে-রাতে একই রকম। রাতের আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ভয় নেমে আসে না। নিশ্চিন্তে পথ চলা যায় একাকী। ভাবতেও হয় নাÑ ‘কেউ জানতে চাইবে কাছে কী আছে!’ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই নিরাপত্তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই সমান। একজন নারী কিংবা তরুণী যদি একাকী রাতের বেলায় পথে হেঁটে যায় তাকেও আলাদা করে ভাবতে হয় না নিরাপত্তার কথা। পথ চলতে গেলে ডাকাত-ছিনতাইকারীর সামনে পড়ার ভয় নেই। রাস্তায় নেই কোনো উটকো মাস্তানি। কেউ পথ আগলে দাঁড়াবে না, কেউ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করবে না বা শিস দেবে না। এ এক অন্যরকম সমাজ; সামাজিক নিরাপত্তাই যার বড় বৈশিষ্ট্য। সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আসলে ইরানকে নিয়ে গেছে অন্যরকম উচ্চতায়।
চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন
চলচ্চিত্র একটি সৃজনশীল গণমাধ্যম। এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান। যে দেশে তা নির্মিত হয় সে দেশেরই জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলচ্চিত্রটি। শিল্পকলার প্রভাবশালী মাধ্যম, শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম এবং শিক্ষার অন্যতম সেরা উপকরণ হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে চলচ্চিত্রের। গণযোগাযোগ বা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি খুব সহজে পৌঁছার ক্ষেত্রেও চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। আবার সৃষ্টিশীল মানুষ ও আলোকিত সমাজ উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রেও এর রয়েছে জাদুকরি প্রভাব। আর এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির চলচ্চিত্র এখন বিশ্বমানের। অসংখ্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি সিনেমার হৃদয়¯পর্শী ও প্রভাবশালী উপস্থিতি বিশ্বে ইরানি সংস্কৃতি ও শিল্পের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে। ১৯০০ সালে শুরু হয় ইরানি চলচ্চিত্রের পথচলা। বর্তমানে দেশটিতে প্রতি বছর প্রায় ২০০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। শক্তিশালী চিত্রনাট্য, অসাধারণ ও অভূতপূর্ব অভিনয়, কলাকুশলির মনকাড়া আবেদন ছাড়াও বিশ্বমানের কারিগরি কৌশলের কারণে বিশ্বের সর্বত্র আজ ইরানি সিনেমা ব্যাপকভাবে দর্শক সমাদৃত হচ্ছে। সেই সাথে পুরস্কৃত হচ্ছে শীর্ষ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলে নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি। অস্কারের ৮৯তম আসরে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার জিতে নেয় ইরানি ছবি ‘দ্য সেল্্সম্যান’। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার অস্কার জিতলেন ছবিটির পরিচালক আসগর ফারহাদি। এর আগে ‘অ্যা সেপারেশন’ তাঁকে এনে দেয় এই সম্মাননা।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসব কান চলচ্চিত্র এই উৎসবের ৭০তম আসরে সিনেফন্ডেশন পুরস্কার জিতেছে ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘অ্যানিমল’। ৭১তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনও হয়েছে ইরানি চলচ্চিত্র দিয়ে এবং এই উৎসবের শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কারও জিতে নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি।
ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৪তম আসরে দুই অ্যাওয়ার্ড জয় করে ইরানি চলচ্চিত্র ‘নো ডেট, নো সিগনেচার’। ছবিটির জন্য সেরা পরিচালকের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এর পরিচালক চলচ্চিত্রকার ভাহিদ জলিলভান্দ এবং সেরা অভিনেতার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন নাভিদ মোহাম্মাদজাদেহ।
চলতি বছর ২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও তিনটি পুরস্কার পেয়েছে ইরান। সেরা তথ্যচিত্রের পুরস্কার পেয়েছে ইরানি তথ্যচিত্র হলি ব্রেড। আর ইরানি অভিনেত্রী সুসান পারভার পেয়েছেন উৎসবের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। ওমেন ফিল্ম সেকশনে সেরা সিনেমা হয়েছে ইরানের ‘লেডি অব দ্য সিটি’। এক কথায় বলতে গেলে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে সর্বত্র ইরানি চলচ্চিত্রের জয়জয়কার।
আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য
নারীর উন্নয়নে বিশ্বের যে দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তাদের অন্যতম। জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। ফারসি ১৩৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানে সাক্ষরতার হার ৯৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ নারী। দেশটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মানুষের সংখ্যা ১১ মিলিয়ন। যার ৫০ শতাংশই নারী। বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী বিজ্ঞানীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিপক্ষদের বহুদূর ছাড়িয়ে গেছেন দেশটির নারীরা। এক হিসাব মতে, বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা স¤পন্ন করেন ইরানের অর্ধেকেরও বেশি নারী। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (সংক্ষেপে এসটিইএম) বিষয়ে ¯œাতক স¤পন্ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। যা বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় শতাংশে অনেক বেশি। লেখিকা সাদিয়া জাহিদি তাঁর নতুন বই ‘ফিফটি মিলিয়ন রাইজিং’-এ এসব তথ্য তুলে ধরেন। কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের রয়েছে সরব উপস্থিতি।
দেশটিতে প্রায় ৬০ শতাংশ নারী কার্যনির্বাহী ও প্রশাসনিক কর্মী হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন। ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ ইরানি নারী শিল্প ক্ষেত্রে কাজ করছেন। দেশজুড়ে ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন চাকরি ক্ষেত্রের ১ লাখ কর্মচারীর ওপর জরিপ পরিচালনা করে এই তথ্য দেওয়া হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইরানের সাফল্য
যেকোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। শিল্প, কলকারখানা, কৃষিকাজ, মানব স¤পদ উন্নয়ন, আধুনিক জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, ক¤িপউটার প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে শুরু করে উন্নয়নের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বিদ্যুৎ। বাস্তবতার নিরিখে এ সকল উপলব্ধি থেকে বিদ্যুৎ খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এরই মধ্যে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। দেশটি বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ খাতে কেবল পুরোপুরি স্বয়ংস¤পূর্ণতা অর্জন করেছে তাই নয়, একই সাথে দেশটিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে ইরানের উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ৮৪ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে। ২০১৫ সালে দেশটিতে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার মেগাওয়াট সেখানে ২০২১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ হাজার ২১৫ মেগাওয়াটে। এর মধ্য দিয়ে ইরান বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে এক নম্বর স্থানে রয়েছে।
এছাড়া আরও অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছে যা এই সীমিত পরিসরে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তবে যে কথা না বললেই নয় তা হচ্ছে, শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরি ও ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ আল উজমা খামেনেয়ীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ইরানি জাতি কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে উন্নয়নের ধারায় যেভাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে দেশটি একদিন বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে অবস্থান করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।