বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইসলামি বিপ্লবের নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর প্রদত্ত ভাষণের পূর্ণ বিবরণ

পোস্ট হয়েছে: জুলাই ২৫, ২০১৯ 

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (র)-এর ত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তেহরানের উপকণ্ঠে ইমাম খোমেইনীর মাযার এলাকায় অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশে ইসলামি বিপ্লবের নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর প্রদত্ত ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
بسم الله الرّحمن الرّحیم
الحمدلله ربّ العالمین و الصّلاة و السّلام علی سیّدنا و نبیّنا ابی‌القاسم المصطفی محمّد و علی آله الاطیبین الاطهرین المنتجبین المعصومین الهداة المهدیّین سیّما بقیّةالله فی الارضین.

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আর দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের সর্দার ও আমাদের নবী আবুল কাসেম মুহাম্মদ এর প্রতি এবং তাঁর পবিত্র নির্বাচিত ও নিষ্পাপ বংশধরগণের ওপর, যাঁরা হোদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং হেদায়তের ঝা-াবাহী, বিশেষ করে পৃথিবীতে আল্লাহর আমানত বাকিয়্যাতুল্লাহ (ইমাম মাহদী আ.) এর প্রতি।
আজকের দিনে সেই তিক্ত ইতিহাসের ঠিক ত্রিশটি বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে, আমাদের প্রিয়তম ও মহান ইমামের সাথে বিরহের ত্রিশ বছর। ঐতিহাসিক চিরবিদায় এবং জনগণ তাদের ইমাম ও নজিরবিহীন মহান নেতাকে অত্যন্ত প্রাণঢালা হৃদয়ের আবেগ উজাড় করা চিরবিদায় দানের ত্রিশটি বছর।
এই ত্রিশ বছরে অনেক চেষ্টা তদবীর করা হয়েছে, যাতে ইমামের স্মরণ, ইমামের নাম ও ইমামের সুনাম-সুখ্যাতিকে খাটো করা যায়। ইমামের অনুসৃত মূলনীতি, ইমামের চিন্তা ও আদর্শ এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে পরিচালনার ক্ষেত্রে ইমামের অনুসৃত পথকে উপেক্ষা করা যায়। আমাদের মহান ইমামের বিশাল আকর্ষণ শক্তিকে ¤্রয়িমাণ করা ও দুর্বল করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে। ত্রিশটি বছর ধরে বিভিন্ন জাতের শত্রু ও কতক উদাসীন লোকের পক্ষ হতে এ ধরনের চেষ্টা ও তদবীর চলে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরিই বিরোধী ও দুশমনদের চাওয়া ও কামনার সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা অনুসরণ করে চলেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ইমামের আকর্ষণশক্তি আজকে যে কোনোরূপ হ্রাস পায় নি শুধু তাই নয়, বরং তার পরিধি আরো অধিক প্রলম্বিত হয়েছে। তার একটি চিহ্ন হচ্ছে আজকের এই বিশাল সমাবেশ। মহান ইমামের ইন্তিকালের ত্রিশ বছর পর এই পবিত্র মাহে রমযানে, মাহে রমযানের সন্ধ্যায় এই বিশাল স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি তীব্র গরমের মধ্যে এত প্রাণচাঞ্চল্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনা এই সমাবেশকে আলোকিত করেছে। দুনিয়ার কোথাও কি এমন নজির আছে?
ইমামের আকর্ষণশক্তি কয়দিন আগেও কুদ্স দিবসের মিছিলে আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন। সমগ্র দুনিয়া তা দেখেছে। চল্লিশ বছর আগে মহান ইমাম গুরুত্বপূর্ণ ফিলিস্তিন সমস্যার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে কুদ্স দিবস প্রবর্তন করেন। সেই থেকে চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। অথচ কুদ্স দিবস পুরোনো হয় নি। এ বছর একশ’টির বেশি দেশে মহান ইমামের স্মরণে কুদ্স দিবসে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। অথচ আমেরিকা ও আমেরিকার সাঙ্গপাঙ্গ ও লেজুড়বৃত্তিকারীদের শক্তিমদমত্ত নীতির প্রচেষ্টা ছিল তারা ফিলিস্তিন সমস্যাকে বিস্মৃতিতে তলিয়ে দেবে- সমস্যাটির অস্তিত্বই যাতে বিদ্যমান না থাকে। যেমন এ সম্পর্কে আপনারা আমেরিকানদের এসব দুষ্টামি ও কোনো কোনো আরব নেতার বিশ^াসঘাতকতা সম্পর্কিত খবরাখবর শুনতে পাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের মহান ইমামের প্রভাবের কারণে একশ’টির বেশি দেশে কুদ্স দিবস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনা ক্ষমতাসীন বা রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মুখপাত্রের মাধ্যমে নয়; বরং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পক্ষ হতে, বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষ হতে এই দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে। এটি ইমামের আকর্ষণশক্তির প্রমাণ যে, তাঁর ইন্তিকালের ত্রিশ বছর পরে এই আকর্ষণশক্তি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমান দুনিয়াতে অন্য কোনো আকর্ষণ এর সমকক্ষ হতে পারে না। অবশ্য আমি এখানে সুযোগ নিতে চাই এবং আমাদের জনগণের প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যে, তাঁরা রমযানের শেষ শুক্রবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যাপক ভিত্তিতে সারা দেশে কুদ্স দিবসের মিছিল ও সমাবেশগুলোতে অংশ নিয়ে মাঠে ময়দানের তাঁদের উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন এবং জনসাধারণ সত্যিকার অর্থেই ইমামের উপদেশ পালনে ত্রুটি করেন নি এবং করবেনও না।
এই আকর্ষণের রহস্যটা কী? ইমামের নজিরবিহীন আকর্ষণ শক্তি কোন্ জিনিস থেকে উৎসারিত হয়েছে? আমি বিষয়টির ছোট্ট একটি দিক এখানে উল্লেখ করব। এর জন্য অত্যন্ত ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন। ইমামের ছিল বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব ও খোদাপ্রদত্ত যোগ্যতা। আল্লাহ তা‘আলাই এসব বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা দিয়েছিলেন। খুব কম মানুষের জীবনেই এ ধরনের বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতার সমাবেশ দেখা যায়। ইমামের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে ছিল : তিনি ছিলেন একজন সাহসী মানুষ। তিনি ছিলেন দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন পূত চরিত্রের এবং পরহেযগার। মহান আল্লাহর সাথে ছিল তাঁর আত্মার সম্পর্ক। আল্লাহর যিকিরের প্রতি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। ইমাম ছিলেন যুলুমবিনাশী মহান ব্যক্তি। যুলুমের সাথে তিনি আপোস করেন নি। যুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। মযলুমের সাহায্যকারী ছিলেন। শক্তিমদমত্তদের বিরুদ্ধে ছিলেন খড়গহস্ত। ইমাম ছিলেন ইনসাফকামী একজন মানুষ। মযলুমদের সাহায্যকারী ও সমর্থক। সততার পক্ষে ছিল তাঁর অবস্থান। জনগণের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল সততার ভিত্তিতে। মানুষের সাথে সেই ভাষায় কথা বলতেন, যা তাঁর অন্তরের মধ্যে ছিল। মানুষের প্রতি অন্তরের দরদ ছিল। মানুষের সাথে আচরণ করতেন সততার ভিত্তিতে। আল্লাহর রাস্তায় কৃচ্ছ্রতা সাধন করতেন। রেয়াযতকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্রামহীন। অবিরাম চেষ্টা ও সাধনায় নিরত ছিলেন। তিনি ছিলেন এই আয়াতের প্রতিপাদ্য :
فَاِذا فَرَغتَ فَانصَب * وَ اِلیٰ رَبِّکَ فَارغَب
‘যখন আপনি অবসর হবেন দ-ায়মান হবেন এবং আপন প্রভুর দিকে প্রবল আগ্রহী হয়ে রুজু হবেন।’ (সূরা ইনশিরাহ, আয়াত-৭ ও ৮)
তিনি একটি বড় কাজ থেকে অবসর হওয়ার সাথে সাথে আরেকটি বড় কাজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেন। সেই কাজের পেছনে সময় ব্যয় করতেন। আল্লাহর রাস্তায় মুজাহাদা ও কৃচ্ছ্রসাধনায় নিরত থাকতেন। এগুলো ছিল ইমামের আকর্ষণশক্তির উপাদান। এসব বৈশিষ্ট্য ইমামের মধ্যে সমাবিষ্ট হয়েছিল। যার মধ্যেই এসব বৈশিষ্ট্য থাকে অন্তরসমূহ তার দিকে আকৃষ্ট হবেই। এগুলো হচ্ছে সেই আমলে সালেহ, সৎকর্ম, যে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ الَّذینَ ءامَنوا وَ عَمِلُوا الصّالِحاتِ سَیَجعَلُ لَهُمُ الرَّحمانُ وُدًّا؛
‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে, শীঘ্রই আল্লাহ তাদের জন্য (মানুষের অন্তরে অন্তরে) ভালোবাসা সৃষ্টি করবেন।’ (সূরা মারইয়াম : ৯৭)
এ হচ্ছে আল্লাহর ওয়াদা। এসব ভালোবাসাও হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ হতে ভালোবাসা। প্রচার নির্ভর, চাপিয়ে দেয়া বা শিখিয়ে দেয়া মহব্বত নয়। আল্লাহর কাজ, এখানে আল্লাহর হাত সক্রিয়।
হ্যাঁ, হযরত ইমামের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মাঝে একটি বৈশিষ্ট্য আছে, যে ব্যাপারে আমি আজকে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। সেই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুকাবেমাত বা প্রতিরোধ। প্রতিরোধ, রুখে দাঁড়ানো। এটি এমন এক বৈশিষ্ট্য, যা ইমামকে একটি প্রতিষ্ঠান, একটি আদর্শ, একটি স্বতন্ত্র চিন্তাধারা ও একটি চলার পথ হিসেবে তাঁর সময়ে এবং ইতিহাসের পাতায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। রুখে দাঁড়ানো, প্রতিরোধ করার বৈশিষ্ট্য মানে সমস্যাবলির মোকাবিলায় আত্মসমর্পণ না করা। তাগুতদের মোকাবিলায় কীভাবে রুখে দাঁড়াতে হয় ইমাম তা দুনিয়ার সামনে দেখিয়ে দিয়েছেন। সেই তাগুত দেশের অভ্যন্তরে হোক, যেমন বিপ্লবী আন্দোলন চলাকালে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে গেছেন। অনেকেই সম্পূর্ণ নিরাশ হতাশ হয়ে গেছেন। কিন্তু ইমাম অবিচল রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ইমাম বিন্দু পরিমাণ পশ্চাদপসরণ না করে সংগ্রামের পথে অবিচল ছিলেন। এই অবস্থাটা ছিল ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পূর্বেকার অধ্যায়ে। ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভের পরও একের পর এক চাপ ভিন্নভাবে এবং আরো বেশি সর্বাত্মকভাবে ইমামের সামনে উপস্থিত হয়। কিন্তু ইমাম তারপরও প্রতিরোধের মূলনীতি, রুখে দাঁড়ানোর কর্মপন্থা হাতছাড়া করেন নি। তিনি প্রতিরোধ করে গেছেন। এই অধম যখন ইমামের চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যটির দিকে তাকাই এবং কুরআন মজীদের আয়াতগুলো সামনে আনি তখন দেখি যে, সত্যিকার অর্থেই কুরআনের বহু আয়াতের, তিনি তাঁর এই অবিচলতা ও রুখে দাঁড়ানোর বাস্তব পদক্ষেপ দিয়ে অর্থ করেছেন। ধরুন যে, কুরআন বলছে,
فَلِذالِکَ فَادعُ وَاستَقِم کَما اُمِرتَ وَ لا تَتَّبِع اَهواءَهُم
‘অতএব আপনি দাওয়াত দিতে থাকুন। আর যেভাবে আদেশ দেয়া হয়েছে অবিচলতা প্রদর্শন করুন। আর তাদের কামনা বাসনার অনুসরণ অনুগমন করবেন না।’ (সূরা শূরা : আয়াত-১৫ এর অংশবিশেষ)
ইমামের ওপর হুমকি বা প্রলোভন কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি। এমন নয় যে, ইমামকে হুমকি দেয়া হয় নি বা প্রলোভন দেখানো হয় নি। কিংবা ধোঁকা প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয় নি। কেন? কিন্তু ইমামের ওপর এসবের মোটেও প্রভাব পড়ে নি। তাঁর প্রতিরোধকে বিক্ষত করে নি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দুশমনের চেষ্টা, দুশমনের হুমকি ধমকি ইমামের হিসাব কিতাবের যন্ত্রকে বিকল করতে পারে নি। যেহেতু দুশমনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটাই। দুশমন যখন তোমার মুখোমুখি হয়, তোমার উদ্দেশ্য তো তার জানা আছে, তোমার সিদ্ধান্ত কী তার হিসাব তো তার কাছে আছে, তাই এমন কোনো কাজ করার পদক্ষেপ নেয়, যা তোমার হিসাব নিকাশ উল্টে দিতে পারে। তোমার হিসাব নিকাশের যন্ত্রটি বিকল করে দেয়াই তার লক্ষ্য হয়। বিভিন্ন আঙ্গিনায় দুশমনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটিই হয়ে থাকে। কাজেই দুশমন ইমামের হিসাব নিকাশের যন্ত্র, যা পবিত্র ইসলামের সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তার মধ্যে কোনো গোলযোগ ঘটাতে পারে নি।
প্রতিরোধ বলতে কী বুঝায়? প্রতিরোধ বলতে বুঝায়, মানুষকে এমন একটি পথ বেছে নিতে হবে যে পথকে সে সত্য বলে জানে। সঠিক পথ বলে বিশ^াস করে। আর এই পথে পথচলা শুরু করে। এই পথে তাকে কোনো বাধাই তার গতিরোধ করতে পারে না। ধরুন, কেউ কোনো এক সময় কোনো রাস্তায় কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়, একটি বিরাট গর্ত দেখে। বিরাট কোনো পাথর পথরোধ করেছে দেখতে পায় যখন এই পাথর বা প্রতিবন্ধকতা কিংবা চোর বা নেকড়ের সামনে পড়ে যায় ফিরে আসে, পথচলা ক্ষান্ত দেয়। এক শ্রেণির মানুষ এমন আছে। কিন্তু কিছুসংখ্যক লোক আছে, না। তারা দেখে বিরাট পাথর ডিঙ্গিয়ে পার হওয়ার কোনো বিকল্প রাস্তা আছে কিনা। এই বাধার মোকাবিলা করার উপায় আছে কিনা। সেই পথ তারা খুঁজে নেয়। হয়ত বাধা দূর করে কিংবা বুদ্ধিমত্তার সাথে তা অতিক্রম করার উপায় বের করে। সেভাবে অগ্রসর হয়। প্রতিরোধ বলতে এটিই বুঝায়। ইমাম (খোমেইনী) এ রকমই ছিলেন। তিনি একটি চলার পথ বেছে নিয়েছিলেন। সে পথ ধরে অগ্রসর হয়েছেন। সেই পথ কী ছিল? আসলে ইমামের বক্তব্য কী ছিল যে, তার জন্য তিনি প্রতিরোধ করেছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং জোরালো চেষ্টা চালিয়েছেন। ইমামের কথা ছিল মুসলমানদের সমাজে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে আল্লাহর দ্বীন ও আদর্শের শাসন। এটিই ছিল ইমামের বক্তব্য। তিনি যখন প্রতিবন্ধকতাসমূহ জয় করার এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থা বলবৎ করার সামর্থ্য অর্জন করলেন তখন তিনি ঘোষণা দিলেন যে, আমরা যুলুম যেমন করব না, তেমনি কারো যুলুম সহ্যও করব না। যুলুম করব না, যুলুমের বোঝাও বহন করব না। যালিমের সাথে আপোস করব না। মযলুমদের সমর্থন ও সহায়তা দিয়ে যাব। এটিই ছিল ইমামের কথা।
হ্যাঁ, এই কথা তাঁর নিজের নয়, দ্বীনের বিরাট পাঠশালা থেকে তা চয়ন করেছেন। কুরআনের ভাষা থেকে তা পেয়েছেন। কুরআন মজিদে এ কথা বর্ণিত হওয়া ছাড়াও মানুষের সুস্থ বুদ্ধিও এ কথা সমর্থন করে। যুলুমের মোকাবিলা করার কথা বলে। মযলুমদেরকে সহায়তা দানের কথা বলে। যুলুমের সাথে সহযোগিতা না করা বা আপোস না করা এমন একটি বিষয়, দুনিয়ার সকল জ্ঞানী ব্যক্তিই তা পছন্দ করেন। ইমাম এ কথার ওপর অবিচল ছিলেন। হ্যাঁ, এ কথাও পরিষ্কার যে, এই বক্তব্য এবং এই চলার পথের জন্য বিশে^ বড় বড় দুশমনও আছে। বিশে^র শক্তিমদমত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যালিম। ইমাম যখন এই বিশাল আন্দোলন শুরু করেন, তার আগে দুইশ’ বছরেরও অধিক কাল ধরে দুনিয়ার আনাচে কানাচে, এশিয়ায় আফ্রিকায় বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা দেশগুলো বিভিন্ন জাতির ওপর বহুমুখি যুলুম চাপিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজরা ভারত এবং এখানকার অন্যান্য দেশে, ফরাসিরা আফ্রিকায়, আলজেরিয়ায় ও আরো অনেক দেশে, এ ছাড়া কতিপয় ইউরোপীয় দেশ বিভিন্ন দেশে প্রকাশ্যে রাখঢাক না রেখে যুলুমের স্টীমরোলার চালাচ্ছিল। কাজেই এটাই পরিষ্কার যে, এরা ইমামের এই সেøাগানে অসন্তুষ্ট হবে। এই যে একটি সরকার এশিয়ার বক্ষস্থলে এমন একটি স্পর্শকাতর অঞ্চলে ইরানে আত্মপ্রকাশ করবে, যার সেøাগান হবে ‘যুলুমের সাথে আপোস করব না, যুলুম মেনে নেব না, যালেমের সাথে সহযোগিতা করব না, মযলুমদের সাহায্য করব’, এটা জানা কথা যে, এদের জন্য তা খুবই কঠিন এবং অসহনীয় ছিল। এ কারণে সেই প্রথম দিন থেকে একের পর এক দুশমনি শুরু করে।
তারাই দুশমনি শুরু করে, যারা ছিল যালেম। যারা ছিল আগ্রাসী। এরা জিম্মি করে পণ আদায়ের পক্ষপাতি ছিল। এরা ইমাম খোমেইনীর বার্তার যে আবেদন অর্থাৎ ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থা, স্বভাবতই এর সাথে তারা খাপ খাওয়াতে পারে নি। ফলে সেই প্রথম দিন থেকেই শত্রুতা শুরু করেছিল। বিপ্লবের প্রথম দশকে- ইমামের মোবারক জীবনকালে একভাবে, ইমামের ইন্তিকালের পরেও- গত দুই তিন দশকে আরেকভাবে। ইমাম এসব কাপুরুষোচিত ও দুরাচারপূর্ণ আগ্রাসনের মোকাবিলায় প্রথম থেকেই প্রতিরোধের চিন্তা, রুখে দাঁড়ানোর চিন্তা ও পথ না হারানোর চিন্তার ভিত্তি রচনা করেন। তিনি একটি সবক, পথের একটি শিরোনাম হিসেবে আমাদের জন্য, ইরানি জাতির জন্য, সংগ্রামীদের জন্য, দেশের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলবর্গের জন্য এই পথটি পরিষ্কার করে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর আমাদেরকে সেই পথ ধরে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
এই প্রতিরোধ ক্রমান্বয়ে ইরানের সীমানার বাইরে চলে যায়। এর অর্থ এটা নয় যে, আমরা প্রতিরোধের চিন্তা বা প্রতিরোধকে ইরানের বাইরে রপ্তানি করতে চাই। যেটি কোনো কোনো রাজনীতিবিদ বা অন্যরা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আপত্তি করে থাকে যে, তোমরা কেন বিপ্লব রপ্তানি করতে চাও। আমরা বিপ্লব রপ্তানি করছি না। বিপ্লব হলো একটি চিন্তা, একটি চিন্তাধারা, একটি পথ, কোনো জাতির কাছে যদি এটিই পছন্দনীয় হয়, তাহলে সে জাতি নিজে থেকে তা গ্রহণ করবে। আমরা কি এ বছর এসব দেশকে বলেছি যে, আপনারা আসুন, মিছিল করুন? তাঁরা নিজেরাই করেছেন। তাঁরা নিজেরাই চেয়েছেন। প্রতিরোধের চিন্তাধারাটিও বিভিন্ন জাতি নিজ থেকে গ্রহণ করেছে। বর্তমানে আমাদের অঞ্চলে, পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে বিভিন্ন জাতির একটি অভিন্ন ভাষা হচ্ছে প্রতিরোধ। সবাই প্রতিরোধের ধারণাটি গ্রহণ করেছেন। তবে কেউ কেউ সাহস করে যে, প্রতিরোধের ময়দানে অবতীর্ণ হবে, কেউ কেউ সেই সাহস করে না। তবে যারা সাহস করে তাদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। এই যে পরাজয়গুলো গেল কয় বছরে আমেরিকানরা ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন, ফিলিস্তিন এবং আরো অন্যান্য অঞ্চলে বরণ করেছে, তা প্রতিরোধ গ্রুপগুলোর প্রতিরোধেরই ফলশ্রুতি। প্রতিরোধ ফ্রন্ট বর্তমানে একটি শক্তিশালী ফ্রন্ট।
অবশ্য আমরা এ কথা অস্বীকার করি না যে, যেহেতু আমরা ইরানি জাতি প্রতিরোধকে সুদৃঢ় হাতে ধারণ করেছি, অগ্রসর হয়েছি ও সফলকাম হয়েছি সেহেতু অন্যরাও প্রতিরোধে উৎসাহিত হয়েছেন। এ কথাটি ইরানের বাইরের তথ্যাভিজ্ঞ মহল, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অভিজ্ঞজনেরা বলেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একজন বিশ্লেষক, যিনি আমেরিকানও বটেন, সবাই তাঁর নাম শুনেছেন, তিনি বলেছেন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাথে আমেরিকার দুশমনির অন্যতম কারণ হচ্ছে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিরোধের পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে এবং সফলকামও হয়েছে। প্রতিবন্ধকতাগুলো অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছে। এটিই হচ্ছে শত্রুতার অন্যতম কারণ। তারা চায়, আমরা যেন পরাজিত হই। তারা চায়, আমরা ফিরে আসি। তারা চায়, আত্মসমর্পণের প্রমাণস্বরূপ আমরা দুই হাত উঁচু করি। যেহেতু তা করি না, তাই শত্রুতা করে।
লক্ষ্য করুন। আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কথা এখানে বলতে চাই। বস্তুত ইমাম প্রতিরোধের পথ বাছাই করে নেন। গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হচ্ছে, ইমাম প্রতিরোধের নীতিটি উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে গ্রহণ করেন নি। ক্ষণস্থায়ী আবেগ দ্বারা চালিত হয়ে করেন নি। আমাদের মহান ইমামের পক্ষ হতে প্রতিরোধের নীতি গ্রহণের প্রেক্ষাপটটি একটি যুক্তিপূর্ণ প্রেক্ষাপট। একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপট। জ্ঞানগত প্রেক্ষিত। ইমামের রুখে দাঁড়ানো, ইমামের প্রতিরোধ এর পশ্চাতে অবশ্যই ধর্মীয় ও যৌক্তিক প্রেক্ষাপট বিদ্যমান রয়েছে। আমি এখানে এর কয়েকটি দিক তুলে ধরতে চাই।
এই যুক্তিদর্শনের একটি অংশ হচ্ছে, শক্তির দাপট ও চাপ প্রয়োগের মোকাবিলায় প্রতিরোধ করা হচ্ছে যে কোনো স্বাধীনচেতা, মর্যাদা সচেতন জাতির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এর জন্য অন্য কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো জাতি নিজের মর্যাদার জন্য, নিজের আত্মপরিচয়ের জন্য, নিজের মানবতার জন্য মূল্যমান স্বীকার করবে, সে জাতি যখন দেখে যে, কোনো একটি জিনিস তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন সে প্রতিরোধ করে, তাতে বাধা দেয়। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এটিই একটি স্বতন্ত্র ও সন্তোষজনক প্রমাণ। এ গেল একটি।
দ্বিতীয় হলো, প্রতিরোধ করা হলে তা দুশমনের পশ্চাদপসরণের কারণ হয়। এটি আত্মসমর্পণের বিপরীত। যখন দুশমন তোমার সাথে শক্তির দাপট দেখায়, তখন যদি আপনি এক পা পেছনে সরে যান সে সামনে আসবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দুশমন যাতে সামনে না আসে তার জন্য পথ হলো তোমাকে প্রতিরোধ করতে হবে। দুশমনের বাড়তি দাবি, দুশমনের শক্তির দাপট, দুশমনের মুক্তিপণ দাবির মোকাবিলায় সে যাতে সামনে এগিয়ে না আসে তার জন্য আগাম ব্যবস্থা হল প্রতিরোধ করা। কাজেই প্রতিরোধের মধ্যেই লাভের অঙ্ক বেশি। আমরা নিজেরাও এ রকমই। ইসলামি প্রজাতন্ত্রে আমাদের অভিজ্ঞতাও এ কথাই বলে। আমার অবশ্য এ মুহূর্তে অনেক বিষয় মনের মধ্যে আছে। সব খুলে বলতে চাই না। উদাহরণ দিয়ে বলতে চাই। সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি। যেখানেই আমরা প্রতিরোধ করেছি, রুখে দাঁড়িয়েছি, সেখানেই আমরা অগ্রসর হতে পেরেছি। যেখানে আত্মসমর্পণ করেছি, প্রতিপক্ষের মর্জি মতো তৎপরতা চালিয়েছি সেখানে আঘাত খেয়েছি। এর পক্ষে অনেক পরিষ্কার উদাহরণ দেয়ার মতো আছে। যারা বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের চল্লিশ বছরের ইতিহাস থেকে তার উদাহরণ সহজে খুঁজে নিতে পারেন। এটিও হচ্ছে ঐ যুক্তির আরেকটি অংশ।
প্রতিরোধের যুক্তিদর্শনের তৃতীয় অংশটি হচ্ছে, যা আমি দুই তিন বছর আগে এই সভায় (ইমাম খোমেইনীর আটাশতম ওফাত বার্ষিকীতে) বলেছিলাম। তা হচ্ছে প্রতিরোধ করতে হলে অবশ্যই খরচ আছে। খরচবিহীন নয়। তবে দুশমনের সামনে প্রতিরোধ যে মাশুল দিতে হবে তার অংক প্রতিরোধের খরচের চেয়ে বেশি। আপনি যখন দুশমনের মোকাবিলায় আত্মসমর্পণ করবেন তখনও আপনাকে খরচ দিতে হবে। পাহলভী সরকার আমেরিকার সামনে নতজানু ছিল। অনেক সময় অশান্তিতেও ছিল। রাজি ছিল না। কিন্তু আমেরিকার সামনে আত্মসমর্পিত ছিল। তেল দিচ্ছিল। অর্থও দিচ্ছিল। ডলারও দিচ্ছিল। মাথায় মুষ্ঠাঘাতও খাচ্ছিল। আজকের দিনে সৌদি সরকারের অবস্থাও এরূপ। অর্থও দেয়। তেলও দেয়। আমেরিকার ইচ্ছানুযায়ী নীতি অবস্থানও গ্রহণ করে। তার সম্পর্কে বলা হয় যে, দুধেল গাভী। আপোস করার খরচ, আত্মসমর্পণের খরচ, প্রতিরোধ না করার খরচের পরিমাণ প্রতিরোধের খরচের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। বৈষয়িক খরচ যেমন আছে তেমনি নৈতিক খরচও আছে। (জনতার সেøাগান : আপোস নয়, আত্মসমর্পণ নয়, আমেরিকার সাথে লড়াই)
দেখুন, আপনার আমার দিকে লক্ষ্য রাখুন। আমি এখন যুদ্ধের কোনো আলোচনা করছি না। প্রতিরোধের কথা আলোচনা করছি। লড়াইয়ের বিষয়ে কথা আলাদা। আমি রুখে দাঁড়ানো, প্রতিরোধ ও পশ্চাদপদ না হওয়ার বিষয়ে বলছি। ভালোভাবে বুঝবার চেষ্টা করুন।
মহান ইমাম ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থায় যে প্রতিরোধ দর্শনের গোড়া পত্তন করেছেন তার চতুর্থ অংশ ও চার নম্বর উপাদান হচ্ছে, কুরআন মজীদের ঘোষণা ও আল্লাহর ওয়াদার কথা। আল্লাহ পাক কুরআন মজীদের আয়াতসমূহে বহুবার এই ঘোষণা দিয়েছেন যে, সত্যপন্থী, যারা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকবে তারা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে। কুরআন মজীদের বহু আয়াত হতে এই ভাবধারা প্রতীয়মান হয়। হয়ত কুরবানি দিতে হবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করতে হবে না। এরাই এই ময়দানে বিজয়ী, সফলকাম। কুরবানি তাঁরা দেন; কিন্তু ব্যর্থতা তাঁদের নেই। কুরআন মজীদের বিভিন্ন উদাহরণের মধ্য হতে আমি এখানে দু’তিনটি উল্লেখ করছি। আমাদের যুবকরা যারা কুরআন নিয়ে আছে তোমরা এ বিষয়গুলো মিলিয়ে দেখবে। এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে। আল্লাহ পাক বলেন, اَم یُریدونَ کَیدًا فَالَّذینَ کَفَروا هُمُ المَکیدون ‘অথবা তারা চায় যে, প্রতারণার কূটকৌশল করবে; কিন্তু যারা কাফের তারাই প্রতারণার শিকার হয়েছে।’ (সূরা তূর : ৪২) তারা মনে করে যে, তারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, হকের ফ্রণ্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র পাকায়। কিন্তু বুঝতে পারে না যে, তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এটি হয় আল্লাহর শাশ^ত নীতি ও প্রাকৃতিক নিয়মে। আরেকটি আয়াত হচ্ছে ্রوَ نُریدُ اَن نَمُنَّ عَلَی الَّذینَ استُضعِفوا فِی الاَرضِ ‘আমি ইচ্ছা করলাম যারা এই পৃথিবীতে হীনবল ছিল তাদের ওপর অনুগ্রহ করতে।’ (সূরা কাসাস : আয়াত-৫ এর অংশবিশেষ) আয়াতের শেষ পর্যন্ত। আরো একটি আয়াত اِن تَنصُرُوا اللهَ یَنصُرکُم وَ یُثَبِّت اَقدامَکُم (যদি আল্লাহকে সাহায্য কর তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদক্ষেপসমূহকে সুদৃঢ় করবেন।’ (সূরা মুহাম্মাদ : আয়াত-৭ এর অংশবিশেষ) وَ لَیَنصُرَنَّ‌ اللهُ مَن یَنصُرُه. (নিশ্চয়ই আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে সাহায্য করবেন যে তার দ্বীনকে সাহায্য করবে।’ (সূরা হজ : আয়াত-৪০ এর অংশবিশেষ) কুরআনের প্রচুর আয়াত একই পরিণতির সুসংবাদ দেয় যারা প্রতিরোধের পথে আছে তাদেরকে। ইমামের যৌক্তিক ও শক্ত প্রমাণ ও জীবন দর্শনের একটি অংশ এসব আয়াত। অসংখ্য আয়াত আছে কুরআন মজীদের। এখানে মাত্র তিন চারটি আয়াত তেলাওয়াত করেছি।
প্রতিরোধ দর্শনের পক্ষে পাঁচ নম্বর সূক্ষ্ম বিষয়টি হলো, একটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে এবং ইমামও বিবেচনায় রাখতেন, আর আমরাও তা জানি এবং বুঝি ও হিসাব নিকাশ করে দেখেছি যে, প্রতিরোধ কাজটা কিন্তু করা সম্ভব। এটি সেই চিন্তাধারার ঠিক বিপরীত যে চিন্তাধারা কিছুসংখ্যক লোক পোষণ করেন ও প্রচার করেন যে, না জনাব। লাভ নেই। কীভাবে প্রতিরোধ করতে চান? প্রতিপক্ষ তো ঘাড় মোটা। প্রতিপক্ষ অনেক শক্তিশালী। বড় ভুলটা কিন্তু এখানেই। বড় রকমের ভুল হচ্ছে, কেউ এই চিন্তা করা যে, দুনিয়ার ঘাড় মোটাদেরকে মোকাবিলা করা বা (তাদের বিরুদ্ধে) রুখে দাঁড়ানো যায় না। আমি এ বিষয়টি এখানে আরো একটু বিশদভাবে ব্যাখ্যা দিতে চাই। কারণ, বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, চালু ও পরীক্ষার সম্মুখীন। এখনও আমাদের মাঝে এমন লোক আছে যারা বুদ্ধিজীবীর পোশাক গায়ে; এ জাতীয় চিন্তাবিদগণ পত্রপত্রিকায়, বইপুস্তকে, বক্তৃতাবিবৃতিতে এখানে ওখানে এ কথাই বলতে চান যে, জনাব, লাভ হবে না। এদের সাথে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না। এদের মোকাবিলায় দাঁড়ানো যাবে না। মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। মোটকথা তাঁরা বলতে চান যে, ঠিক আছে পথ ছেড়ে দেন। আমরা দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত হই। আমি বলতে চাই যে, এই দৃষ্টিভঙ্গি যে বলা হয়, ‘আমরা পারব না’। এটিই সেই হিসাব নিকাশের ভুল থেকে সৃষ্টি হচ্ছে, যার দিকে আমরা ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করেছি। (ইতিপূর্বে কোমের সর্বস্তরের জনগণের একটি প্রতিনিধিদলের সাক্ষাতে দেয়া রাহবারের ভাষণের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে)। এটি হিসাব নিকাশের ভুল, আর কিছু নয়।
যে কোনো ইস্যুতে হিসাব নিকাশের ভুলের কারণ হচ্ছে, আমরা ইস্যুটির বিভিন্ন উপাদানকে ঠিকভাবে দেখি না। যেখানে একটি মোকাবিলার প্রসঙ্গ, দুটি ফ্রন্টের মুখোমুখি সংঘাতের প্রশ্ন যেখানে, সেখানে হিসাব নিকাশের ভুলটার উৎপত্তি হয় যখন আমরা নিজেদের পক্ষকে ভালোভাবে না চিনি। প্রতিপক্ষ ফ্রন্টকেও যখন ভালোভাবে চিনতে পারি না। হ্যাঁ যখন চিনতে পারি না তখন হিসাব নিকাশে ভুল করি। আমরা যদি সঠিকভাবে চিনতে পারতাম তাহলে আমাদের হিসাব নিকাশ অন্যরকম হতো। আমি বলতে চাই যে, বিশে^র শক্তিমদমত্তদের মোকাবিলায় প্রতিরোধের বেলায় যে হিসাব নিকাশ করব তাতে এসব শক্তিমদমত্ত সম্পর্কিত বাস্তবতাগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের নিজেদের প্রকৃত অবস্থাও ভালোভাবে জানা থাকতে হবে। এসব বাস্তবতার একটি হচ্ছে প্রতিরোধের ক্ষমতা।
লক্ষ করুন! আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাহিত্যে ‘ইমাম খোমেইনীর স্টাইলে প্রতিরোধ’, এটি একটি শিরোণাম। ফিরিঙ্গিদের পরিভাষায় যেটির প্রকাশ ঘটেছে এবং খুররম শহর মুক্ত করার ঘটনার পর এই পরিভাষাটির ব্যাপক প্রচলন হয়েছে তা হলো ইমাম খোমেইনীর প্রতিরোধের ডক্ট্রিন। তাঁরা এ বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এখন আমি এখানে একটি বাক্য নোট করেছি, বাক্যটি বিশে^র একজন প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তির। নাম বললে সবাই চিনবেন। তিনি কথাটি বলেছেন একটি প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন যে, বিশ^ আধিপত্য ক্ষেত্রে সামরিক ও অর্থনৈতিক একচেটিয়া ভূমিকার যুগ অস্তমিত হচ্ছে। এই যে, কোনো একটা দেশ অধিক সামরিক ক্ষমতার অধিকারী হবে, অর্থনৈতিক অতিরিক্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখবে এবং এ ক্ষেত্রে নিজের আধিপত্য বলবৎ রাখবে, এ অবস্থা এখন গত হতে চলেছে। দুনিয়া এখন পাল্টে গেছে। তিনি আরো লিখেছেন, অনতিদূরে আমরা এমন ওভারসিজ শক্তির উদ্বোধন দেখত পাব যারা যুদ্ধাস্ত্র, যেমন অ্যাটম বোমা কিংবা বিশ^ শিল্প জগতে উৎপাদনে অংশীদারত্বে তেমন জোরালো ক্ষমতার অধিকারী নয়। কিন্তু কোটি কোটি মানুষের ওপর প্রভাব রাখার শক্তির জোরে পাশ্চাত্যের সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করবে। এ কথাটি বলেছেন একজন পশ্চিমা ও আমেরিকান রাজনীতিবিদ। তিনি আরো বলেন, খোমেইনীর প্রতিরোধ ডক্ট্রিন সর্বশক্তি দিয়ে আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের আধিপত্যের ধমনীগুলোকে টার্গেট করেছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের স্থায়িত্বের রহস্য এগুলোর মধ্যেই নিহিত। এটি এমন এক নীতি, যা এই মহান ব্যক্তি, আল্লাহর এই নেক বান্দা আমাদের মাঝে অবশিষ্ট রেখে গেছেন। এটিই প্রতিরোধের নীতি, অবিচলতার নীতি এবং আমাদের যা আছে তার প্রতি সম্মান দেখানোর মূলনীতি।
আমি আজকে এ কথা আরয করতে চাই যে, বর্তমানে প্রতিরোধ ফ্রন্ট গত চল্লিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সুসংগঠিত অবস্থায় রয়েছে। এই অবস্থা এতদঞ্চলে, এমনকি এতদঞ্চলের বাইরের কেন্দ্রগুলোতেও বিরাজ করছে। এটি একটি বাস্তবতা। এটি বিশ^শক্তিমদমত্তদের ঠিক বিপরীত মেরু। বিশ^শক্তিমদমত্ত তথা আমেরিকার দাম্ভিক শক্তি এবং যায়নবাদী সরকারের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ও দুরাচারপূর্ণ শক্তির চল্লিশ বছরের পর থেকে নিয়ে এদিকে তুলনামূূলকভাবে অবনতি হয়েছে। তুলনামূলকভাবে নিচে নেমে গেছে। আমাদেরকে এ বিষয়গুলো নিজেদের হিসাব নিকাশের বেলায় বিবেচনা করতে হবে। এই যে আমেরিকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অথবা আমেরিকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কী ঘটেছে ও ঘটে চলেছে এগুলো আমাদের হিসাব নিকাশের মধ্যে আনতে হবে। এই কথাগুলো স্বয়ং কতিপয় আমেরিকানই বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, উই পোকার মতো অস্তায়মানতা। এ কথাটি জনৈক আমেরিকান লেখক বলেছেন। আমেরিকার শক্তিমত্তার অস্তায়মানতা সম্পর্কে বলেছেন যে, উই পোকার মতো পতন। অর্থাৎ উই পোকায় খাওয়া কাঠের মতো ভেতর দিক থেকে ফোকলা হয়ে গেছে। আমেরিকার ভেতরকার প্রতিষ্ঠানগুলোই এ কথা বলছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন এই অবস্থা, সামাজিক ক্ষেত্রেও অবস্থা তা-ই। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পরিষ্কার পরিসংখ্যানসমূহ বিদ্যমান রয়েছে যে, আমেরিকার অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং বিশ^ অর্থনীতিতে আমেরিকার অর্থনৈতিক প্রভাবের বিস্ময়করভাবে পতন ঘটেছে। তার পরিসংখ্যান এখন আছে। এ সম্পর্কে আমার কাছে নোটও আছে। তবে এ মুহূর্তে এসব নোটের খুঁটিনাটি বলার প্রয়োজন মনে করছি না। রাজনৈতিক অঙ্গনেও আমেরিকার ক্ষমতার অধঃপতন ঘটেছে।
প্রিয় ভাইয়েরা ও বোনেরা! আমি আপনাদের সামনে একটি কথা বলতে চাই। আমেরিকার রাজনৈতিক অধঃপতনের একটি প্রমাণ আমি আপনাদের বলছি, যদি অধিকতর প্রমাণ না-ও থাকে, এই একটি প্রমাণই যথেষ্ট। সেই প্রমাণটি হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো চরিত্র-বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একজন লোক দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়া। স্বয়ং এই নির্বাচনই আমেরিকার রাজনৈতিক অস্তগামিতার প্রমাণ। তিনশ’ মিলিয়নের চেয়ে আরো বেশি জনগণের ভাগ্য এই চরিত্রের একজন লোকের হাতে ন্যস্ত হওয়া আমেরিকার রাজনৈতিক অস্তগামিতার নিদর্শন। যাঁর মানসিক ভারসাম্য, তাঁর চিন্তাগত ভারসাম্য ও চারিত্রিক ভারসাম্যের ব্যাপারে স্বয়ং আমেরিকাতেই এত কথা বলা হচ্ছে। এ ধরনের একটি লোক যখন কোনো একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়, তখন সেই দেশের অস্তগামিতার প্রমাণ দেয়। রাজনৈতিক অস্তগামিতা, চারিত্রিক অস্তগামিতা। এরা যায়নবাদী সরকারের মানুষ হত্যা ও অপরাধযজ্ঞের প্রতি বরাবর সমর্থন জুুগিয়েছে, পক্ষ নিয়েছে। কয়েকটি সরকারের জোট ইয়েমেনে এবং ইয়ামেনের জনগণের ওপর যে গণহত্যা চালাচ্ছে তাকে এরা সমর্থন দিয়েছে। অপরাধের প্রতি এরা সমর্থন জ্ঞাপন করে। এর চেয়ে জঘন্য চারিত্রিক স্খলন আর কী হতে পারে?
আমেরিকার অভ্যন্তরেই সমস্যার অন্ত নেই। সেদিন আমার মনে হয় একটি সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে এ রমযানের শুরুতে আমি এ সম্পর্কে কথা বলেছি। (প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণের প্রতি ইঙ্গিত) আমেরিকার কৃষি মন্ত্রণালয় সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে যে, আমেরিকায় ৪১ মিলিয়ন লোক ক্ষুধার সমস্যায় জর্জরিত। আমেরিকার অবস্থা এরূপ। আমেরিকার অর্থনীতির অবস্থা এটিই। মার্কিন সরকার ২২০০ শত কোটি ডলারের ঋণের বোঝা টানছে- ২/২ ট্রিলিয়ন- এ তো রূপকথার মতো। আসলেই এসব পরিসংখ্যান অকল্পনীয়। এসব হচ্ছে তাদের সমস্যা ও সংকট। তারপর এই ভদ্রজন এসে ইরানের জনগণের জন্য মায়া দেখান। বলেন যে, আমরা ইরানের জনগণের সুখ চাই, সৌভাগ্য চাই, তাদের কর্মসংস্থান চাই। যাও, তুমি নিজেকে শোধরাও। যদি পার নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাও। আমেরিকা সহিংস অপরাধের দৃষ্টিতে পৃথিবীতে এক নম্বরে আছে। মাদক দ্রব্য সেবনে বিশে^ আমেরিকার অবস্থান এক নম্বরে। স্বয়ং দেশের লোকদের হত্যার ব্যাপারে এক নম্বরে আছে। আমেকিার পুলিশের হাতে মানুষ হত্যার পরিসংখ্যানে সে এক নম্বরে আছে। যেসব পরিসংখ্যান আছে তা প্রমাণ করে যে, এই গত ৮ মাসে ৮৩০ জন মার্কিন নাগরিক রাস্তাঘাটে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে। ইরানি জাতির জন্য যে সরকারটির কুম্ভিরাশ্রু ঝরানোর অন্ত নেই তার নিজের অবস্থা এমনই।
হিসাব নিকাশের একদিকে স্বয়ং আমরা নিজেরা আছি। আমাদের অবশ্যই সমস্যা আছে। আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা আছে। বহুবার আমি তা বলেছি। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারাও তাঁদের সাধ্য অনুযায়ী এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। আমাদের সমস্যা আছে। তবে অচলাবস্থায় আমরা নেই। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমরা দেশে অচলাবস্থার সম্মুখীন নই। অর্থনৈতিক বিষয়ে যেমন, তেমনি সামাজিক বিষয়ে, রাজনৈতিক বিষয়েও না। এমন সমস্যাদি আছে, তার বিভিন্ন কারণ আছে। কিন্তু দেশে অচলাবস্থা নেই। তার বিপরীতে আমাদের অগ্রগতি আছে। আমাদের দেশের বড় জিনিসের মধ্যে রয়েছে এই সম্মানিত ইরানি জাতি। এই প্রাণ উচ্ছ্বল জাতি। এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জাতি। আমাদের জাতির যদি দূরদৃষ্টি না থাকত তাহলে যেসব অঙ্গনে তাদের উপস্থিতির প্রয়োজন, সেসব অঙ্গনে তারা উপস্থিতি প্রমাণ করত না। জনতার উপস্থিতি ৯৭ ফারসি সাল (২০১৯ সালের) ২২ বাহমান (১১ ফেব্রুয়ারি) অর্থাৎ এই চার-পাঁচ মাস আগে জনতার মাঠে ময়দানে উপস্থিতি দেশের সর্বত্র সড়কগুলোতে বিশাল আকারের যেসব জনসমাবেশ হয়েছে, এর জন্য দূরদৃষ্টির প্রয়োজন। এর পেছনে মনোবল থাকতে হয়। প্রস্তুতি থাকতে হয়। কোমর বেঁধে প্রস্তুত থাকার প্রয়োজন আছে। ইরানি জাতির তা আছে। সচেতনতা আছে। দূরদৃষ্টি আছে। রুখে দাঁড়ানোর শক্তি আছে। সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আছে। এটিই হচ্ছে আমাদের দেশের শক্তিমত্তার সবচেয়ে বড় দিক। শক্তিমত্তার আরো কয়েকটি দিকও আছে। কাজেই প্রতিরোধের যে আদর্শের কথা বললাম, তা এগুলোই। ইমাম এ ধরনের একটি যৌক্তিক প্রেক্ষাপট ও পৃষ্ঠপোষকতার ভিত্তিতেই প্রতিরোধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন।
আমি কয়েকটি বিষয় নোট করে এনেছি। সময় যেহেতু অনেকখানি হয়ে গেছে তাই খুব দ্রুত বলছি। হে আমার প্রিয়জনরা! একটি বিষয় হচ্ছে, প্রতিরোধের লক্ষ্য বলতে বুঝায় প্রতিরোধ করা যায় এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হওয়া, অর্থনীতিতে যেমন, তেমনি দেশের রাজনৈতিক বিষয়াদিতেও। সামাজিক বিষয়াদিতে যেমন, তেমনি সামরিক বিষয়াদিতেও আমাদের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছতে হবে, যে পর্যায়টি প্রতিরোধবাচক হবে। অর্থাৎ নিজেকে এমনভাবে প্রদর্শন করতে হবে যা দুশমনকে সব ব্যাপারে ইরানি জাতির ওপর হস্তক্ষেপ থেকে বারণ করবে। দুশমন দেখবে যে, কোনো লাভ নেই। ইরানি জাতিকে কিছুই করা যাবে না। আমরা বর্তমানে সামরিক খাতে বেশ খানিকটা এই প্রতিরোধমূলক অবস্থায় উপনীত হয়েছি। এই যে দেখছেন, ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে ও অন্যান্য বিষয়ে ওরা এত বাড়াবাড়ি করছে তার কারণ এটাই। তারা জানে যে, আমরা প্রতিরোধ করার মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছি। স্থিতিশীল একটি অবস্থায় পৌঁছে গেছি। তারা আমাদের দেশকে এগুলো থেকে বঞ্চিত করতে চায়। অবশ্য কোনো দিনই তারা করতে পারবে না।
আমাদের সমস্যাদি ও আমাদের দুশমনদের সাথে আমাদের মোকাবিলা প্রথমেই সাহসিকতাপূর্ণ হতে হবে। প্রভাব বিস্তার ও ভয় সৃষ্টির মতো হতে হবে। দ্বিতীয়ত, তা হতে হবে আশাব্যঞ্জক। নিরাশাবাদী হবে না। তৃতীয়ত, বিজ্ঞতাপূর্ণ ও বুদ্ধিমত্তার সাথে হতে হবে। ভাসাভাসা, আবেগি ও উত্তেজনাব্যঞ্জক হবে না। চতুর্থত, তা হতে হবে সৃজনশীল। প্রতিক্রিয়াশীলতার বশবর্তী হয়ে হবে না। আমাদেরকে সৃজনশীল হতে হবে। যদি এইভাবে অগ্রসর হই, জেনে রাখবেন যে, ইরানি জাতি সকল বৃহৎ শক্তির মোকাবিলা করতে সফলকাম হবে এবং সম্মুখে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
সাফল্য লাভের জন্য আরেকটি শর্ত হলো, আমাদের প্রতিরোধী চিন্তা-চেতনাকে দুর্বল করার জন্য দুশমনের চক্রান্ত সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। লক্ষ্য করুন আমার প্রিয়জনরা! প্রতিরোধের চিন্তা হলো একটি জাতির সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। কাজেই স্বাভাবিকভাবে দুশমন আমাদের হাত থেকে এই অস্ত্র কেড়ে নিতে চায়। অতএব, প্রতিরোধ চিন্তার ওপর কুমন্ত্রণা দিতে আরম্ভ করে, সন্দেহ-সংশয় ঢুকিয়ে দিতে চায় যে, ‘জনাব কী লাভ হবে। হবে না।’ প্রতিরোধের চিন্তাধারাকে দুশমনের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করতে হবে। দুশমনের চক্রান্তে যেন এই চিন্তা ও মনোবল দুর্বল না হয়।
দুশমনের প্রতারণাও বিভিন্ন ধরন ও প্রকরণ আছে। কখনো হুমকি দেয়। কখনো প্রলোভন দেখায়। যেমন ইদানিংকার এই পাগলা বেটা, আমেরিকার এই সম্মানিত প্রেসিডেন্ট, যিনি সম্প্রতি বয়ান দিয়েছেন যে, ইরান বর্তমান নেতৃত্ব থাকা অবস্থায়ই বড় রকমের অগ্রগতির অধিকারী হতে পারবে। এর অর্থ হলো, হে ইরানের বর্তমান নেতৃবৃন্দ! আমরা আপনাদেরকে উৎখাত করতে চাই না। আপনারা মন খারাপ করবেন না। আপনাদেরকে উৎখাত করার মতলব আমাদের নেই। আমরা আপনাদেরকেও মেনে নিতে রাজি আছি। এটি ইরানের নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে এক ধরনের তথাকথিত রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি। অবশ্য এ কথা সত্য। যদি ইরানের বর্তমান নেতৃবৃন্দ, ইরানের বর্তমান দায়িত্বশীলবর্গ মনোবলকে চাঙ্গা করেন, হাতের আস্তিন ওপরে উঠান, দিনরাত যদি তফাৎ না থাকে, সাধনা করেন, সমচিন্তা ও এক মন এক ধ্যানের হন, যথাযথভাবে জনগণের সুযোগ-সুবিধার সদ্ব্যবহার করেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি অগ্রগতি অর্জিত হবে। এতে কোনো ধরনের সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে শর্ত হলো, আমেরিকানদের কাছে আসতে দেয়া যাবে না। অগ্রগতির শর্ত হলো, আমেরিকানরা কাছে আসতে পারবে না। এই ভদ্রলোকের রাজনৈতিক প্রতারণা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের প্রতারিত করবে না। জাতিকে প্রতারিত করতে সক্ষম হবে না। আমেরিকানদের কাছে আসতে দেয়া হবে না। যেখানেই আমেরিকানরা পা ঢুকিয়েছে সেখানে হয়ত যুদ্ধ হয়েছে নচেত ভ্রাতৃহত্যা হয়েছে। হয়ত গোলযোগ দেখা দিয়েছে নতুবা শোষণ হয়েছে। উপনিবেশে পরিণত হয়েছে বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে। আমেরিকানদের পদার্পণ অশুভ, অশুভ পদার্পণ। যদি কাছে না আসে তাহলে আমরা নিজেরাই জানি কীভাবে কী করতে হবে। আমাদের কী করতে হবে তা আমরা জানি। আল্লাহ তা‘আলাও আমাদেরকে ইনশাআল্লাহ তাওফীক দান করবেন।
জাতি মাঠে ময়দানে উপস্থিত আছে। এই উপস্থিতি অব্যাহত রাখতে হবে। আমার প্রিয় ভাইয়েরা ও আমার প্রিয় বোনেরা! আমি আপনাদের বলতে চাই যে, মনে রাখবেন, এই যে মাহে রমযানের শেষ শুক্রবারে মাঠে ময়দানে নেমে পড়েন তা দুশমনের সব হিসাব নিকাশ ভ-ুল করে দেয়। গোলযোগ বাধিয়ে দেয়। (জনতার সেøাগান ‘হে স্বাধীনচেতা রাহবার! আমরা প্রস্তুত আছি, প্রস্তুত।) আল্লাহ তা‘আলা ইনশাআল্লাহ তাঁর বরকত, তাঁর রহমত আপনাদের ওপর নাযিল করবেন। ইরানি জাতি সত্যিকার অর্থেই প্রস্তুত আছে।
দেশের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশেও একটি উপদেশ দিতে চাই। আসল সমস্যার ওপর কেন্দ্রীভূত গুরুত্ব দেয়া যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশের জন্য মৌলিক গুরুত্বের দাবি রাখে। কাজেই অবশ্যই এর ওপর কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দিতে হবে। বিপ্লব বিজয়ের পূর্বে আসল সমস্যা ছিল ‘তাগুতি সরকার’। ইমাম এ বিষয়টির ওপরই কেন্দ্রীভূত গুরুত্বারোপ করতে থাকেন, তাতে তিনি সফল হন। বিপ্লব বিজয়ের পর একটি পরিস্থিতিতে প্রজাতন্ত্রের স্থিতিশীলতার প্রশ্ন ছিল সবচেয়ে বড়। এক পরিস্থিতিতে দেশের ওপর সাদ্দামের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। গোটা দেশ যুদ্ধের প্রশ্নে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। আজকে আসল ও নগদ সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা। অবশ্য সাংস্কৃতিক সমস্যাদিও আছে এবং তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তার প্রশ্নও সে রকমই। তবে এসব সমস্যা ও বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে নগদ হলো অর্থনৈতিক বিষয়াদি, যা জনগণের জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কিত। দেশের সাংস্কৃতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ের ওপরও তা প্রভাব ফেলে।
অর্থনীতির বিষয়ে মৌলিক বিষয়াদি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ শিরোনামসমূহ আছে। আমি এর মধ্যে কয়েকটির কথা বলছি। একটি হচ্ছে উৎপাদনে ঔজ্জ্বল্য। একটি হচ্ছে জাতীয় মুদ্রার মূল্যমান। একটি হচ্ছে আয়-উপার্জন ও শ্রমের পরিবেশ উন্নত করা। একটি হলো অপরিশোধিত তেল বিক্রি থেকে দেশের অর্থনীতি আলাদা করার বিষয়। অপরিশোধিত তেল, অপরিশোধিত তেল বিক্রি ও অপরিশোধিত তেলের ব্যবসার সাথে দেশের বাজেট ও অর্থনীতির নাড়ির বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। এটি আমাদের অন্যতম আসল সমস্যা ও বিষয়। অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপকে সরকারের নির্দেশনা ও তদারকিতে পরিবর্তন করাও দেশের অন্যতম মৌলিক ইস্যু। অর্থনৈতিক দুর্নীতিবাজ অর্থাৎ চোরচাট্টা, অর্থনৈতিক সন্ত্রাসী ও নিষ্ঠুর চোরাকারবারীদের হাতকে অর্থনৈতিক অঙ্গন থেকে কর্তন করতে হবে। দেখুন, এগুলো হচ্ছে দেশের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ প্রধানত প্রশাসন আর তার পাশে আইন বিভাগ এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিচার বিভাগকে ঐক্যবদ্ধভাবে এসব বিষয়ে কাজ করতে হবে। এসব সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। এগুলো আমাদের মৌলিক সমস্যা। এগুলোর প্রতি আমাদের কেন্দ্রীভূত হতে হবে। শাখাগত সমস্যাবলি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হলে চলবে না। খামোখা ছুতা বের করব না। জাতীয় সংহতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত ঝগড়া এক পাশে ঠেলে রাখা বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরেকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মহান আল্লাহর সাথে আমাদের হৃদয়ের বন্ধন মজবুত করা।
এ বছরের রমযান মাস ছিল অত্যন্ত সুন্দর মাস। আমার যতটুকু জানা আছে এবং আমার কাছে নিকট যেসব রিপোর্ট দেয়া হয়েছে তাতে জানতে পেরেছি যে, এ বছর রমযান মাসে দোয়া, যিকির, মোনাজাত ও ওয়াজের মজলিস ছিল, ইসলামি জ্ঞানচর্চার ব্যাপক আয়োজন খুবই প্রাণবন্ত ছিল। এই তেহরান শহরে বিভিন্ন মহল্লায় বিরাট বিরাট সমাবেশে প্রধানত তরুণরা সমবেত হয়েছে। দোয়া মোনাজাতে অংশ নিয়েছে। কেঁদেছে। অশ্রুপাত করেছে। আহাজারি করেছে। ওসিলা দিয়ে দোয়া করেছে। এগুলো অত্যন্ত মূল্যবান জিনিস। এগুলো হচ্ছে আল্লাহর রহমত ও হেদায়াতের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী। এগুলোর মূল্য অনুধাবন করবেন। তরুণ সম্প্রদায়! তোমাদের পবিত্র অন্তরগুলো, তোমাদের নূরানি হৃদয়গুলো বড় বড় জটিলতা সমাধানের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করতে পারে। এগুলোই আল্লাহর রহমত আকর্ষণ করবে। আমি আশা করি, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তা‘আলা এই মহান ও গুরুত্বপূর্ণ রমযান মাসকে জনগণ এ বছর যেভাবে অতিবাহিত করেছে, তা আমাদের জাতির জন্য বরকতময় হোক। আজকেও হচ্ছে মাহে রমযানের শেষ দিন। এখন আমরা মাহে রমযানের শেষ মুহূর্তে অবস্থান করছি। এ মুহূর্তে কয়েকটি দোয়া করা ভালো মনে করছি।
نسئلک اللّهمّ و ندعوک باسمک العظیم الاعظم الاعزّ الاجلّ الاکرم و بحرمة محمّدٍ و آله یا الله … یا رحمان یا رحیم یا مقلّب القلوب ثبّت قلوبنا علی دینک
হে আল্লাহ! তোমার কাছে প্রার্থনা জানাই। তোমাকে ডাকছি তোমার মহান, অতি মহান অতি মর্যাদাবান, অতি সম্মানিত ও অতিশয় ইজ্জতের নাম ধরে, মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর বংশধরের সম্মানের উসিলা দিয়ে। ইয়া আল্লাহ, ইয়া আল্লাহ, ইয়া রাহমান, ইয়া রাহীম, হে অন্তরসমূহ পরিবর্তনকারী আমাদের অন্তরসমূহকে তোমার দ্বীনের ওপর স্থায়িত্ব দান কর।
হে পরওয়ারদেগার! আমাদেরকে তোমার রাস্তায় অবিচলতা দান কর। ওহে পরওয়ারদেগার! ইমামের পবিত্র রূহকে, যিনি আমাদেরকে প্রতিরোধ শিক্ষা দিয়েছেন তাঁর বন্ধুদের সাথে হাশর কর। ওহে পরওয়ারদেগার! ইমামের স্মরণ ও শহীদানের স্মরণ এর ছায়া এই জাতির মাথার ওপর থেকে সংকীর্ণ ও হ্রাস করো না। ওহে পরওয়ারদেগার! তোমার সাহায্য ইরানি জাতির ওপর অবতীর্ণ করো। ওহে পরওয়ারদেগার! মুসলিম উম্মাহর ওপর তোমার সাহায্য অবতীর্ণ কর। ওহে পরওয়ারদেগার! ইসলামি জাহানে যারা ফিতনা সৃষ্টি করছে তাদেরকে অপদস্থ, ঘৃণিত ও অপমানিত করো। ওহে পরওয়ারদেগার! মুহাম্মাদ (সা.) ও আলে মুহাম্মাদ (সা.) এর উসিলায় এই মানুষের প্রয়োজনসমূহ, যারা এই জলসাসমূহে যিকির ও দোয়া করেছে তা কবুল করো। ইরানি জাতির জন্য, উম্মতে ইসলামির জন্য পবিত্র মাহে রমযানকে মোবারক কর। ওহে পরওয়ারদেগার! আমাদেরকে তোমার দয়া, মেহেরবানি ও মাগফেরাত হতে বঞ্চিত করো না। আমাদের গুনাহসমূহ মাফ করে দাও। আমাদের ভুলত্রুটি, আমাদের বাড়াবাড়ি মাফ করে দাও। আমাদের মধ্যে যাঁরা বিদায় হয়ে গেছেন আমাদের মাতাপিতাকে মাফ করে দাও। ওহে পরওয়ারদেগার! মুহাম্মাদ ও আলে মুহাম্মাদের উসিলায় তোমার ওলী (ইমাম মাহদী) এর মকবুল দোয়া আমাদের অবস্থার সাথে সঙ্গতিশীল কর। আমাদেরকে তাঁর সৈনিক হিসেবে গ্রহণ করো। আমাদের মৃত্যুকে এ পথে শাহাদাত হিসেবে কবুল কর। মুহাম্মাদ ও আলে মুহাম্মাদের উসিলায় যা বললাম, যা শুনলাম, যা আঞ্জাম দেব, তোমার জন্য এবং তোমার পথে হিসেবে গ্রহণ কর। তোমার দয়ার উসিলায় আমাদের দোয়া কবুল কর।
ওয়াস সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।