বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইরান ভ্রমণ স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা ও কবিতা পাঠ অনুষ্ঠিত

পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ২২, ২০১৮ 

 

গত ১৮ আগস্ট ২০১৮ ঢাকাস্থ মিরপুর লালকুঠি দরবার শরীফ মিলনায়তনে লালকুঠি সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং লালকুঠি সাহিত্য পরিষদ সভাপতি শাহ সূফি হযরত মাওলানা অধ্যাপক আহসানুল হাদীর মাসব্যাপী ইরান সফর এবং ইতিপূর্বে আরো যাঁরা ইরান সফল করেছেন তাঁদের স্মৃতিচারণমূলক বিষয় নিয়ে ‘কবিতার দেশে বিপ্লবের দেশে পারস্যের পথে প্রান্তরে’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও লালকুঠি সাহিত্য পরিষদ-এর নিয়মিত সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের শেকড় সন্ধানী কবি নজরুল গবেষক সাংবাদিক কবি আবদুল হাই শিকদার। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইতিহাসবিদ আশরাফুল ইসলাম ও চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলার অধ্যাপক কবি মুহিবুর রহিম। আলোচনায় অংশ নেন নজরুল-ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি লেখক গবেষক এমদাদুল হক চৌধুরী, ক্বারী আলমগীর হোসেন মোল্লা, রেডিও তেহরানের সাবেক সংবাদ পাঠক, মর্সিয়া লেখক ও ছড়াকার কবি শাহ নওয়াজ তাবীব। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি আমিন আল আসাদ। পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওয়াত করেন শিল্পী ক্বারী হাবিবুর রহমান। নাতে রাসূল (সা.) পেশ করেন লালকুঠি দরবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কবি মুক্তিযোদ্ধা হাজী রফিক মিয়া। কবিতা পাঠে অংশ নেন মুহিবুর রহিম, তাজ ইসলাম, ক্বারী ওবায়দুল্লাহ, আমিন আল আসাদ, শাহ নওয়াজ তাবিব, রহমান মাজিদ, নাসিমা আক্তার নিঝুম, আলমগীর হোসেন জোয়ারদার, হুমায়ূন কবির, জয়নাল আবেদীন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান আলোচক জনাব আহসানুল হাদী তাঁর সাম্প্রতিক ইরান সফরের স্মৃতিচারণ করে বলেন, বর্তমান সফরটি ছিল একটি অ্যাকাডেমিক সফর যার আয়োজক ছিল ‘বুনিয়াদে সাদী’ নামে একটি সংস্থা যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্প্রসারণের জন্য কাজ করা এবং বিশ্বময় ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিনিত্বশীল যোগ্যতাস¤পন্ন লোক তৈরি করা। এই সংস্থাটি ইরানের শিক্ষা ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আওতাধীন। তারা একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করে। আমার সঙ্গে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের আরো দু’জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহায়তায় আমি সেই সফরে অংশগ্রহণ করি। ১৪টি দেশের শিক্ষকবৃন্দ সেখানে অংশগ্রহণ করেন। শুধু মুসলিম দেশ নয়, অমুসলিম দেশের প্রতিনিধিত্বও ছিল সেখানে। আমি সেখানে বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য রাখি এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করি।
জনাব হাদী ইরানের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নগরী কোম সফরেরও স্মৃতি বর্ণনা করেন। বর্ণনা দেন বোস্তাম নগরীতে অবস্থিত হয়রত বায়েজিদ বোস্তামীর মাযার যিয়ারতের। ইতিপূর্বে আরো তিনবার তিনি ইরান সফর করেছেন। ২০০৮ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে কবি মোহন রায়হান, কবি আহমদ কায়সার, কবি রোকন জহুর, কবি আমিন আল আসাদ, কবি মোস্তাফিজ মামুন সহ ইরান সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেই সফরে আমরা ইরানের আরেক আধ্যাত্মিক শহর মাশহাদ গমন করি, যেটি খোরাসান প্রদেশে অবস্থিত। সেখানে নবীবংশের ৮ম ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করি। এই প্রদেশের তূস নগরীতে রয়েছে মহাকবি ফেরদৌসির মাযার।
জনাব আহসানুল হাদী বলেন, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিস্তারে ইরানের ইসলামি সরকারের ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, ইরান যে আসলেই একটি আধ্যাত্মিক চেতনায় পরিপূর্ণ দেশ, আপনি ইরানে গিয়ে স্বচক্ষে অবলোকন করলে সেটির প্রমাণ পাবেন। তাবে সে চোখ আপনার থাকতে হবে। সেদেশের আলেমরা শুধু মসজিদের সাধারণ মোল্লাই নন। তাঁরা আসলেই পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন লোক। আমি যতবার ইরানে গিয়েছি ততবারই আমার অন্তর সমৃদ্ধ হয়েছে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব না হলে তাদের জাতীয় চেতনা ও ধর্মীয় অধ্যাত্মবোধকে বিশ্বময় সম্প্রসারণ করা কিছুতেই সম্ভব হতো না। কিন্তু কিছু জনগণকে লক্ষ্যভ্রষ্ট ও ধৈর্য্যচ্যুত করার জন্য বাহির থেকে সা¤্রাজ্যবাদের অনুচররা অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। অবরোধের পর অবরোধের ফলে জাগতিকভাবে ইরান একটু সমস্যায় পড়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। সেকারণে বদর, ওহুদ, খন্দক ও কারবালার চেতনায় জনগণকে ধৈর্য ধরতে হবে ও সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মনোবল বৃদ্ধি করতে হবে। ভোগবাদী আরব দেশগুলোর মতো তেলসম্পদ বিক্রি আর ভোগবিলাসে জীবন পার করে দেয়ার নাম জীবন নয়। এই তেল সম্পদ ফুড়িয়ে যাবে। কিন্তু জ্ঞানের শক্তি টিকে থাকবে। টিকে থাকবে ঈমানের শক্তি। এই জ্ঞানশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে ইরানি জাতি আজ পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন জাতি হয়েছে। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ইরান অনেক আগেই এবং অনেকবার উড়িয়েছে। নিজের উদ্যোগে এবং নিজেরই প্রযুক্তির সহায়তায়। ইরানে এখনো দরিদ্র মানুষ নেই এমন নয়, তবে তা শাহের আমল থেকে বেশি নয়। ইরান শিক্ষা-দীক্ষায় ও বিজ্ঞানচর্চায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে পারস্যের কবিদের গুলবাগিচায় ‘ইরান বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলনে আমি অংশগ্রহণ করি এবং সিরাজ ও ইসফাহান ভ্রমণ করি। কবি হাফিজের ওপর একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করি। আমার সঙ্গে ছিলেন শিল্পী ও ডকুমেন্টারি প্রডিউসার ফরিদী নূমান। বিটিভিতে আমার পরিচালিত ‘কথামালা’ অনুষ্ঠানে ইরান ভ্রমণের ওপর তিনটি প্রতিবেদন প্রদর্শন করি। সেই ভ্রমণে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আমাদেরকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করে। বিশেষ করে তৎকালীন কালচারাল কাউন্সেলর জনাব আলী আভারসাজীর সহযোগিতার কথা স্মরণ করতেই হবে। ইরান নিজের সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তারে এবং অন্যের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে ও আত্মস্থ করতে কতটা আন্তরিক তা উক্ত সম্মেলন থেকেই বোঝা যায়। নজরুলকে ভালো করে আত্মস্থ করেছেন বলেই ইরানের সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘নজরুল আমাদেরই সম্পদ। প্রচ- ঝড়ো হাওয়া নজরুলকে আমাদের মাঝখান থেকে বাংলাদেশের কাদামটিতে ফেলে দিয়েছে।’
ইরান তার জাতীয় মেধা ও ব্যক্তিত্বগুলোকে সঠিকভাবে দুনিয়ার বুকে পেশ করতে পেরেছে এবং তাদের সংস্কৃতির সঠিক প্রতিনিধিত্ব তাঁরা করছে বলেই জাতিসংঘের সদর দরজায় শেখ সাদী ও রুমীর কবিতা উৎকীর্ণ থাকে। শেখ সাদীর কবিতার একটি বাক্য সেখনে লেখা রয়েছে যে, ‘গোটা মানব সমাজ একটি দেহের মতো/এর যে কোন স্থান আঘাতপ্রাপ্ত হয় সমস্ত দেহে তা অনুভূত হয়’। জার্মান কবি গ্যাটে ইরানের কবি হাফিজের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, ‘যে হাফিজ পড়ে নি তার জীবনই বৃথা’। হাফিজ এবং ফেরদৌসি দুইজনের পার্থক্য বোঝাতে কবি শিকদার বলেন, ফেরদৌসি ছিলেন বোহেমিয়ান। তিনি দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর হাফিজ ছিলেন ঘরমুখী কবি। তিনি তাঁর প্রিয় নদী রুকনাবাদের তীর ছেড়ে কোথাও যান নি। ইরানি জাতি তাদের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদেরকে যেভাবে ফোকাস করেছে ও করছে আমরা আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ফররুখকে সেভাবে বিশ^ময় ফোকাস করতে পারি নি।
প্রসঙ্গক্রমে কবি শিকদার বলেন, শিয়া-সুন্নি বিভেদ ভুলে যেতে হবে এবং ইরান-তুরান এক হয়ে কাজ করতে হবে। আমাকে ইরানে শিয়া-সুন্নি বিষয়ে প্রশ্ন করলে আমি বলেছিলাম, আমি মুসলমান। আমি শিয়া-সুন্নি ঐক্যের বিষয়ে ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সেই বাণী উল্লেখ করে বলেছিলাম, ‘যারা শিয়া ও সুন্নিদের মাঝে বিরোধ তৈরি করে তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়, তারা স¤্রাজ্যবাদীদের দালাল।’ আমি বলেছিলাম, যে কোন মূল্যে এ বিভেদ দূর করতে হবে। আহলে বাইতকে শিয়া-সুন্নি উভয়েই মহব্বত করে। কেবল কারবালার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গ্রুপটি ছাড়া। শিয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের মানুষ মিলেই মোঘলরা ভারতবর্ষ শাসন করেছে। শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে আগে বৈবাহিক ও সামাজিক সম্পর্কও ছিল। সে সম্পর্ক আবার গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, শিয়া-সুন্নি ঐক্য ভঙ্গের জন্য সা¤্রাজ্যবাদীরা নানা কূটকৌশল হাতে নিয়েছে। তারা পাকিস্তানে শিয়া মসজিদে বোমা হামলা করে পাকিস্তান ও ইরানের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে চায়। আবার তুরস্কের সঙ্গে ইরানের বিরোধ তৈরি করার জন্য রাজনৈতিক চাল চালতে থাকে।
তিনি বলেন, ফারসি ভাষা বাংলার সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে, একে আর পৃথক করার সুযোগ নেই। ফারসি শিক্ষার গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি ঢাকাস্থ ইরানের কালচারাল সেন্টারের প্রতি গণমুখী ফারসি অ্যাকাডেমী চালু করার আহ্বান জানান এবং লালকুঠি দরবারে একটি ফারর্সি চর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলা যায় কিনা সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা ব্যাপারে দরবারের পীর সাহেবের কাছে আবেদন রাখেন। তিনি বলেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ওপর ডকুমেন্টারি করতে ভারতে গিয়ে মুর্শিদাবাদে বিশাল লাইব্রেরি দেখতে পাই যার অধিকাংশ বই ফারসি ভাষায় রচিত। ফারসি ভাষা না জানার কারণে এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারি নি, বইগুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করেছি মাত্র।
ইতিহাসবিদ জনাব আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইতিহাস, ধর্মীয় আচার-আচরণের সাথে আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সাথে ইরান ও ফারসি ভাষা মিশে গেছে অকৃত্রিমভাবে। আমাদের রক্তে, অস্থি-মজ্জায় তা একাকার হয়ে মিশে গেছে। কারবালা ট্রাজেডির শোকাবহতা এবং নবী-পরিবারের প্রতি ভক্তি আমাদের চেতনার অবিনাশী অংশ। এখানে শিয়া-সুন্নির কোন বিষয় নেই। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে বিশাল একটি কারবালার মাঠ আছে। আমাদের দেশের মুহররম মিছিলে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করে। কারবালার ইতিহাস চর্চায় ও কারবালার পুঁথি পাঠে অংশগ্রহণ করে গ্রামে কাঁদে না এমন লোক নেই। আমাদের গ্রামে দশদিনব্যাপী মুহররমের জারি গান হয়। মর্সিয়া পাঠ হয়। হয় ওয়াজ-নসিহতও।
তিনি একটি গ্রাম্যছড়ার দুইটি লাইন আবৃত্তি করে ফারসি ও বাংলার সম্পর্ক বোঝান এভাবে যে, ‘যগাই মাধাই দুইজনে/ মসনবী পড়ে নলবনে’। যগাই মাধাই দুইজন বাঙালি হিন্দু, অথচ তারা নলবনে বসে ‘মসনবী’ পড়ছে। ইরানি সংস্কৃতির কতটা শক্তিশালী প্রভাব থাকলে বাঙালি হিন্দুও মুসলমানী সাহিত্য ‘মসনবী’ পাঠে মনোযোগী হয় তা এই ছড়ায় বোঝা যায়। তিনি বলেন, এটাই আমাদের বাংলাদেশ।
তিনি ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশে ও বাংলার সাথে পারস্যের সাংস্কৃতিক আত্মীয়তা জোরদার করতে ইরান দূতাবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে আরো গণমুখী হওয়ার আহ্ববান জানান। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্বিবৃত্তিক পরিম-লে এটি সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
বিশেষ অতিথি অধ্যাপক কবি মুহিবুর রহিম স্মৃতিচারণ করে বলেন, ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত ‘নিউজলেটার’-এ একসময় নিয়মিত লিখতাম। রেডিও তেহরানের শুরুর দিকে যখন মরহুম ফরিদ উদ্দিন খান পরিচালক ছিলেন তখন আমার অনেক কথিকা তেহরান বেতারে প্রচারিত হয়েছে। আমাদের সময় রেডিওর খবরের ওপর নির্ভরশীল ছিল গ্রামবাংলার মানুষ। আমি রেডিও তেহরানের নিয়মিত শ্রোতা ছিলাম। ঢাকায় অবস্থানকালে বাংলাদেশে ইরানের ধর্মীয় প্রতিনিধি আয়াতুল্লাহ শাহরুখী খুররমাবাদী (র.)-এর সাথে প্রেসক্লাব ভিআইপি লাউন্সে আমাদের একটি বৈঠক হয়। তাঁর সাথে আমাদের নানা বিষয়ে মতবিনিময় হয়। রেডিও তেহরানের বাংলাদেশী বন্ধুরা একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন বের করতেন ‘দীগ্দর্শন’ নামেÑ সেখানে আমার কবিতা ছাপা হয়েছে ‘ইমাম খোমেনী (র)’ নামে। ইরানের সাথে আমাদের বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই সমর্থন করেছে। মাযহাবী বিভেদ নয়, বিশ্ব-মুসলমান এক হয়েই কাজ করতে হবে। সা¤্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। ‘ইসলামের আদর্শিক বিপ্লব ও নৈতিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া মানবজাতির মুক্তি নেই’Ñ মাওলানা আবদুর রহীম (র.) এ কথাটি অনেক আগেই জাতিকে শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমেরিকার মানুষও যদি মুক্তি চায় তাহলে ইসলামি নৈতিকতার কাছেই তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
জনাব এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, নজরুল ও ফররুখ আহমদের কবিতায় অনেক ফারসি শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। ইরানের সাথে আমাদের শেকড়ের সম্পর্ক আছে, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। মুসলমান দেশগুলো মিলেমিশে শক্তিশালী উম্মাহ গঠন করতে হবে। কুরবানি তথা ত্যাগের শিক্ষায় মুসলমানদের উদ্দীপ্ত হতে হবে এবং পরস্পর ছাড় দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।
ক্বারী আলমগীর হোসেন মোল্লা তাঁর ইরান ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘শুরায়ে এহইয়ায়ে যাবা’ন ও আদাবিয়া’তে ফারসি’ সংস্থার দাওয়াতে আমরা ইরান যাই। বর্তমানে এই সংস্থার নাম ‘বুনিয়াদে সাদী’Ñ যা অনুষ্ঠানের সভাপতি জনাব আহসানুল হাদী উল্লেখ করেছেন। আমাদের সাথে ছিলেন ড. আবদুস সবুর খান, ড. তারিক সিরাজী ও ড. মুহাম্মদ শাহজালাল প্রমুখ। আমি ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বহুদিন যাবৎ চাকুরি করছি। এখানে চাকুরি করার আগে এবং ইরান গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসার পূর্বে ইরানের শিয়া মাযহাবের মানুষ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা ছিল। একটি সমাজে নানা রকমের মানুষ থাকে। কোন সাধারণ মানুষের কোন কাজ বা কথার দ্বারা যেমন আসল ঘটনা না জেনে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় তেমনি স্বচক্ষে দেখার আগে ও বোঝার আগে সকল ধারণা মনে বদ্ধমূল করা ঠিক নয়। আমরা জেনেছিলাম, শিয়ারা হযরত আলীকে নবী মানে ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে বড় করে দেখে। তারা অন্য কোরআন মানে। অথচ আমি এগুলোর কোন বিষয়েরই সত্যতা পাই নি। বরং আমরা দেখলাম, সালমান রুশদী যখন মহানবী (সা.) ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক বই ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লিখলো তখন ইমাম খোমেইনীই সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে বিশ্বময় আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ইরানের মানুষদের থেকে পেয়েছি মায়া-মমতা, আথিতেয়তা। বাসে উঠলেই এমনভাবে ‘সালামুন আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে সালাম দেয়, মনে হয় যেন অনেক দিনের চেনা, কিন্তু জীবনে কোনদিনই দেখা হয় নি। মাশহাদে ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করেছি। ইবনে সীনার মাযারে গিয়েছি। অনেক আনন্দময় ছিল সেই ভ্রমণ।
জনাব শাহ নওয়াজ তাবিব বলেন, তেহরান রেডিওতে থাকাকালীন ইরানের পথে প্রান্তরে অনেক ঘুরেছি। অনেক স্মৃতি ইরানকে নিয়ে। তাদের আচার-ব্যবহার বদান্যতায় পরিপূর্ণ। কথায় কথায় ‘সালামুন আলাকুম, হালে সোমা’ খুবে’Ñ সালাম, কেমন আছেন। উত্তরে বলবে, ‘খোদা’ রা’ শোক্র’Ñ আল্লাহকে ধন্যবাদ। ‘খুবাম’ অর্থাৎ ভাল আছি। ‘শোমা’ চেতুরে’Ñ তুমি কেমন আছ। কথায় কথায় ‘মুতাশাক্কেরাম’, ‘খেইলী মামনুন’ ইত্যাদি তো আছেই। যার অর্থ ধন্যবাদ। কোন কিছুর সহযোগিত চাইলে আপনি যদি তাকে সহযোগিতা করেন তবে সেই সহযোগিতা নিতে নিতে বলবে, ‘দাস্তে শোমা’ দারদ না কোনে’Ñ তোমার হাতে ব্যথা না হোক! সবজি, ফল ইত্যাদি কিনতে গেলেও কথায় কথায় তারা দোয়া করবে। এই ফল ও সবজি তোমার দেহের উপকার করুক! রোগ মুক্তি দান করুক! শক্তি বৃদ্ধি করুক! ইত্যাদি। কারো সাথে ঝগড়া লাগলে তৃতীয় জন এসে সাথে সাথে দরূদ পড়ে বলবে, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ। অর্থাৎ ‘রাসূল (সা.)-এর প্রতি এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি সালাম। সঙ্গে সঙ্গে ঝগড়া শেষ। ইরানে দেখলাম রাসূল (সা.) ও তাঁর পরিবারের প্রতি অগাধ ভক্তি। কেউ একজন দরূদ পড়লেই সমস্বরে পুরো মজলিশ দরূদ পড়বে। যারা বলে ইরানের শিয়ারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে নবী মানে না তাদের কাছে প্রশ্ন হলো তাহলে এত দরূদ কারা পড়ে? আর তারা রাসূলের আহালে বাইতের শানে দরূদ পড়ে আর কান্নাকাটি করে। একটি কথা রয়েছে যে, মুমিনের চোখের জলে জাহান্নামের আগুন নেভে। পাপ দূরীভূত হয় তওবা আর ক্রন্দনের মাঝে। ইরানিদের চোখে যেন পানি এসেই থাকে। যে কোন দোয়া-দরূদ পড়েই তারা আল্লাহর কাছে নাজাত চেয়ে সমস্বরে কাঁদতে থাকে।
জনাব তাবিব ইরানে থাকাকালীন আযাদী স্কোয়ার, ময়দানে ইনকিলাব, বেহেশতে যাহরা, তালেঘানী এভিনিউ, ময়দানে আরজেনটাইন ইত্যাদি স্থানে নিয়মিত যাতায়াতের স্মৃতিচারণ করেন।
কবি আমিন আল আসাদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, আমার রচিত ‘ইমাম খোমেনী (র.) ও ইসলামী বিপ্লব’ শীর্ষক বইয়ের নিমিত্তে ২০০৮ সালে ইরান সফরে যাই। লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব জনাব আহসানুল হাদী, কবি মোহন রায়হান, কবি রোকন জহুর, কবি মুস্তাফিজ মামুন, কবি আহমেদ কায়সার, মাওলানা সাবির রেজা, গবেষক রাশেদুজ্জামান সহ দশ বারোজন। প্রিয় নেতা ইমাম খোমেইনীর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর মাযার যিয়ারতের সৌভাগ্য হয়। মাশহাদ গিয়েছি এবং ঘুরেছি তেহরানের পথে প্রান্তরে। ময়দানে ইনকিলাব, ময়দানে ফেরদৌসি, বেহশতে যাহরাসহ বেশ কয়েক স্থানে। ইমাম খোমেইনী (র)-এর বাড়িটি দেখেছি। মাশহাদে গিয়েছি ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারতে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব সারা দুুনিয়াকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেয়া এক আলোকের বিস্ফোরণÑ যা মুসলমানসহ নির্যাতিত জাতিসমূহের ঘুম ভাঙাতে সহায়ক হয়েছিল। এই বিপ্লবের বিরুদ্ধে অঙ্কুরেই একে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে, এখনো সেই ষড়যন্ত্র চলছে। দল-মত-মাযহাব-তরিকা নির্বিশেষে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আমিন আল আসাদ