ইরান পরিচিতি: হামাদান
পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ১৯, ২০১৬
কামাল মাহমুদ
ইরান তথা পৃথিবীর প্রাচীনতম নগরীগুলোর অন্যতম হলো হামাদান। গ্রীক ঐতিহাসিক হিরোডোটাসের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে এ শহরের উৎপত্তি এবং তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ শতকে এটি মেডেস এর রাজধানী ছিল। পরবর্তীকালেও এটি রাজধানী শহরের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। বাইবেলের ‘ইজরা’ নামক গ্রন্থে হামাদান ও এর প্রাচীন নাম ইকোবানা শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। দারিউশ জেরুজালেমে একটি উপসানালয় পুনঃনির্মাণ করতে গিয়ে একটি মুদ্রার সন্ধান পান যে মুদ্রায় ‘হামাদান’ শব্দটি মুদ্রিত ছিল। হামাদানের প্রাচীন নাম ইকবাতানা, হ্যামাংতানা অর্থ হলো মিলিত হবার স্থান। পার্থিয়ান যুগে হামাদান ছিল তাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। সাসানী স¤্রাটরাও হামাদানে গ্রীষ্মকালে অবস্থানের জন্য তাঁদের আবাসস্থল নির্মাণ করেছিলেন। ৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে নহবন্দের যুদ্ধে আরব মুসলমানদের আওতাধীনে চলে যায় হামাদান। বুয়াহিদ সা¤্রাজ্যকালে এ নগরী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। ১১ শতকে সেলজুক স¤্রাটরা হামাদান থেকে রাজধানী বাগদাদে স্থানান্তর করেন। সময়ের বিবর্তনে হামাদানের অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে। তৈমুরীয় শাসনামলে এ শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়, কিন্তু সাফাভী আমলে এ শহর ব্যাপক উন্নতি লাভ করে। ১৮ শতকে হামাদান অটোমানদের নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু নাদির শাহ আফসার এর সময়কালে ইরান ও অটোমান সা¤্রাজ্যের মধ্যে চুক্তির ফলে হামাদান ইরানের অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি রাশিয়া ও তুর্ক-জার্মান বাহিনীর দখলে চলে যায় এবং পরবর্তীকালে ১৯১৮ সালে যুদ্ধ অবসানের পরে হামাদান আবার ইরানের অধীনে চলে আসে।
অবস্থান ও জনসংখ্যা : হামাদানের আয়তন ১৯৫৪৬ বর্গকিলোমিটার। ইরানের মধ্য-পশ্চিম দিকে এবং সমুদ্র উপকূল থেকে ১৮৫০ মিটার উচ্চতায় জাগরোস পর্বতের নিকটে হামাদানের অবস্থান। শহরটি সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী লোকসংখ্যা ২০,৫৮,২৬৮ জন। পরিবার সংখ্যা ২,৫৪,৪১২টি। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ইরানের ১৪তম নগরী। এটি তেহরান থেকে ৩৬০ কিলোমিটার বা ২২৪ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
আবহাওয়া : হামাদানের আবহাওয়া বিভিন্ন প্রকৃতির। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে গ্রীষ্ম, বসন্ত ও শীত ঋতু পরিলক্ষিত হয়। কখনো কখনো প্রচুর বৃষ্টিপাতও হয়। পশ্চিম ও পূর্র্ব দিকে বছরের অধিকাংশ সময় গ্রীষ্ম ও শরৎ ঋতু থাকে। বার্ষিক সর্বোচ্চ তাপমাত্র ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। গড় তাপমাত্রা ১৯.২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনি¤œ তাপমাত্রা মাইনাস ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বছরে গড়ে ৮৫ দিন বৃষ্টিপাত হয়, বরফ পড়ে বছরে গড়ে ২৯ দিন (১৯৬১-১৯৯০ পর্যন্ত গড় হিসেব অনুযায়ী)। এটি ইরানের অন্যতম শীতপ্রধান শহর। এ শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে সারা বছর পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকে এ শহর, বিশেষত গ্রীষ্ম ও বসন্তকালে। এ শহরের প্রতীক হলো পাথরে খোদাই করা অভিলিখন যা ‘গাঞ্জনামে’ হিসেবে প্রসিদ্ধ।
ভাষা : এ অঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকাংশই ফারসি ভাষায় কথা বলে। তবে কিছুসংখ্যক অধিবাসী কুর্দি, লোরী, আযারবাইজানী ভাষায় কথা বলে।
পেশা ও শিল্প : এখানকার অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি, ব্যবসা ও চাকুরি। সাম্প্রতিককালে হামাদান ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে পরিগণিত হয়েছে। হামাদান হ্যান্ডিক্রাফট, চামড়া শিল্প, সিরামিক ও কার্পেটের জন্য বিখ্যাত।
দর্শনীয় স্থান : হামাদানে ২০৭টি ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। বাবেলিক চসমার ও তার ভাই মোরদেচাই এর সমাধিক্ষেত্র, বিখ্যাত গণিতজ্ঞ আবু আলী সীনার সমাধিক্ষেত্র, মাকামাত এর লেখক বদিউজ্জমান হামাদানীর মাযার রয়েছে এখানে। দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে বাবা তাহের মিউজিয়ামে রক্ষিত কানুন অব মেডিসিন এর হস্তলিখিত কপি, ইমামযাদে আবদুল্লাহ মসজিদ, কোরবান টাওয়ার, আলী সদর গুহা, হামাদানের পাথরের সিংহ, দারাউশের সময়কার লেখা গাঞ্জনামে, আব্বাসাবাদ জঙ্গল, এরাম পার্ক, ইমাম স্কয়ার, আবু আলী সীনার মনুমেন্ট, হাফ্ত বেসার (সাত দেয়াল)- যেখানে এক হাজারের মত কক্ষ রয়েছে। এটিকে হামাদানের ব্যবিলন টাওয়ার হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে।
খেলাধুলা : হামাদানে খেলাধুলার জন্য রয়েছে কুদ্স স্টেডিয়াম, শহীদ মোফাত্তেহ স্টেডিয়াম, তাকী ক্রীড়া কমপ্লেক্স, হামাদান জাতীয় স্টেডিয়াম প্রভৃতি। ফুটবল ক্লাবের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত পাস হামাদান এফসি ও আলীতাজ হামাদান এফসি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : হামাদান দীঘকাল ধরে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য খ্যাত হয়ে আছে। এখানে আধুনিক স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়গুলোর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। হামাদানের প্রথম আধুনিক স্কুলের নাম মোজাফফারীয়ে স্কুল। এছাড়া দেশি-বিদেশিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অনেক স্কুল-কলেজ রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে হামাদান প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, হামাদান মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়, ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটি হামাদান, পায়ামে নূর বিশ^বিদ্যালয় হামাদান, মালায়ের বিশ^বিদ্যালয় প্রভৃতি।
ব্যক্তিত্ব : হামাদানের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে রয়েছেন ২০০৩ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী শিরিন এবাদী, ফজলুল্লাহ জাহেদী, বিখ্যাত কবি মীর সাইয়্যেদ আলী হামাদানী, ফখরুদ্দিন এরাকী, বাবা তাহের উরিয়ানী, মীর যাদে এশকী, বিপ্লবের পর প্রথম প্রেসিডেন্ট আব্দুল হাসান বনি সদর, আমীর নুসরাতুল্লাহ বালাখান লু, আমীর সাহান বাজারীয়ান, আল কোজাত হামাদানী, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইরানিকার সংকলক এহসান ইয়ার প্রমুখ।