ইরানের বন্ধুর ভূমি
পোস্ট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৩
ইরান হচ্ছে আল্লাহ তাআলার দেয়া অগাধ সম্পদ ও অপরিসীম সৌন্দর্যের আধারসমৃদ্ধ একটি দেশ। তবে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যে কেবল সবুজ শ্যামলিমা ও হরেক রঙের ফুল দ্বারা শোভিত চিত্রাঙ্কন করা হয়েছে, তা নয়; বরং রঙিন মাটি ও পাহাড়-পর্বত ইরানের যেকোন প্রান্তকেই রঙিন করে রেখেছে।
এ থেকেই বুঝা যাচ্ছে, ইরান কোনো সমভূমি নয়; বরং একটি বন্ধুর ভূমি। ইরানের পাহাড়-পর্বতগুলো দক্ষিণ ইউরোপ ও এশিয়ার পাহাড়-পর্বতগুলো সৃষ্টি হওয়ার সম-সময়ে সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশিষ্ট বিজ্ঞানিগণের অনুমান। অর্থাৎ এখন থেকে ৫৭ কোটি বছর আগে তৃতীয় ভূতাত্ত্বিক যুগের শেষ দিকে ভূগর্ভস্থ গাতিশীলতা ও প্রকম্পনের ফলে এ সব পাহাড়-পর্বত তৈরি হয়েছে। তখন পাললিক শিলার ফাঁকে ফাঁকে গ্রানাইট পাথর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। বফাক, যানজন ও গোলপায়গানে এবং তাবাস ও ইয়ায্দের পথে সাদা ও গোলাপি গ্রানাইট পাথর এখনো মাথা উঁচু করে আছে।
ভূমির বন্ধুরতার দৃষ্টান্ত ইরানের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। অনেক জায়গাই দেখা যাবে বিশাল এলাকা জুড়ে সুউচ্চ পর্বতমালা, ঢালু পাদদেশ এবং সঙ্কীর্ণ উপত্যকা ও গিরিপথ, আবার অদূরেই সমভূমি ও মরুময় অঞ্চল। প্রকৃতপক্ষে ইরান ভূখণ্ডের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা পাহাড়-পর্বতে ঢেকে আছে। শত শত কিলোমিটার জুড়ে আলবোর্য পর্বতমালার অবস্থান যেন ইরানের উত্তরাংশে একটি সুউচ্চ দেয়াল তৈরি করে দিয়েছে। কেবল সুউচ্চ ও দুর্গম গিরিপথ হয়ে তা অতিক্রম করা যেতে পারে। তেমনি যগ্রোস্ পর্বতমালায় রয়েছে বহু উঁচু ও সমান্তরাল পাহাড়- যার মাঝে রয়েছে অত্যন্ত নিচু ও খাদসঙ্কুল উপত্যকা ও ঢালু পাদদেশ। এভাবে যগরোস্ পর্বতমালা ইরানের ভিতরকার এলাকাগুলোকে পারস্য উপসাগরের উপকূল থেকে আলাদা করে রেখেছে। কেবল আঁকাবাঁকা উপত্যকাসমূহ এবং লক্ষ লক্ষ বছরে সৃষ্ট পার্বত্য নদীসমূহের মধ্য দিয়েই এসব পাহাড়-পবর্ত অতিক্রম করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় ভূতাত্ত্বিক যুগে ইরানের বিশাল অংশই বিশাল বিস্তৃত বনজঙ্গল, হ্রদ ও জলাভূমিতে আবৃত ছিল। এ বৃক্ষরাজির আচ্ছাদনের পরিণতিতেই বিশাল বিশাল কয়লার খনি তৈরি হয়েছে। আলবোর্যের যীর্অব্, তাম্শাক্ ও এলিকা এলাকা এবং কেরমানের হেজ্দাক পব্দনা ও কদামু এলাকায় এখনো তা বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। তেমনি একই ভূতাত্ত্বিক যুগে ভূপৃষ্ঠে ফাটল সৃষ্টির মাধ্যমে আল্পাই পর্বতমালা সৃষ্টি হয় এবং গ্রানাইট পাথর ওপরে উঠে আসে। ইয়ায্দেহ শীরকুহ্ পর্বত এবং হামেদানের আল্ভান্দ পর্বত এধরনের গ্রানাইট পাথরে গড়া।
উক্ত ভূতাত্ত্বিক যুগের শেষে কেন্দ্রীয় ইরানের অনেক জায়গা, আলবোর্য পর্বতমালার অনেক পর্বত পানির নিচে চলে যায় এবং ইরানের কেন্দ্রীয় এলাকায় বহু বিশালায়তনের ফাটল ও ভঙ্গিল অবস্থা সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় ভূতাত্ত্বিক যুগে সেডিমেন্টের সাথে সালফেট পাথর মিশ্রিত হয়ে যায় এবং একটি রঙিন মিশ্রণের সৃষ্টি করে যা অর্থনৈতিক বিচারে খুবই গুরুত্বের অধিকারী। তৃতীয় ভূতাত্ত্বিক যুগের মাঝামাঝি সময়ে যগ্রোস্ পর্বতমালার সেডিমেন্টেশন থেকে ইরানে তামা ও দস্তার খনি তৈরি হয়। ইরানে অগ্নিগিরির লাভার এখনো যে মওজুদ রয়েছে তা থেকে জানা যায় যে, চতুর্থ ভূতাত্ত্বিক যুগে ইরানে অনেকগুলো অগ্নিগিরি ছিল।
ইরানের বন্ধুরতার বিভাগ
উচ্চতা এবং অঞ্চল ও পরিবেশের বিশেষ অবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে ইরানের বন্ধুর ভূমিকে নিম্নোক্ত কয়েকভাগে ভাগ করা যেতে পারে :
১. উত্তরের পর্বতমালা : এতে আলবোর্য পর্বতমালা, আযারবাইজানের পর্বতমালা এবং খোরাসানের পর্বতমালা অন্তর্ভুক্ত।
২. পশ্চিম ও দক্ষিণে পর্বতমালা। এতে যগরোস পর্বতমালা এবং উপকূলবর্তী এলাকার কম উচ্চতাবিশিষ্ট পাহাড়-পর্বত অন্তর্ভুক্ত।
৩. পূর্বাঞ্চলের পাহাড়-পর্বত।
৪. কেন্দ্রীয় অঞ্চলের পর্বত।
৫. উপকূলীয় সমভূমিসমূহ।
৬. ভূখণ্ডের ভিতরকার নিচু জায়গাসমূহ (হ্রদ ও জলাভূমিসমূহ)।
ইরানের পাহাড়-পর্বতসমূহ বিস্ময়কর ধরনের উঁচু। ইরানকে সাধারণত একটি মালভূমি বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু ইরানে মালভূমির ধারণা মালভূমি সম্বন্ধে ইউরোপীয় ধারণা থেকে স্বতন্ত্র।
তেহরানের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১২০০ হতে ১৭০০ মিটার পর্যন্ত। হামেদানের উচ্চতা ১৮২০ মিটার, কেরমান শাহ্র উচ্চতা ১৬৩০ মিটার, শীরাযের উচ্চতা ১৬০০ মিটার এবং ইসফাহানের উচ্চতা ১৪৩০ মিটার। যাহেদান্ ও তাবরীয্ এবং আরো দশটি শহরের উচ্চতা ১৪০০ মিটার। এ দৃষ্টিকোণ থেকে, ভূগোলবিদগণ যে ইরানকে একটি উচুঁ মালভূমি বলে অভিহিত করেছেন তা সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ, ইরানের মালভূমি একটি সমতল মালভূমি নয়। ইরানের দিগন্তে যে পাহাড়-পর্বত মাথা উঁচু করে আছে তা এক বিস্ময়কর ধরনের চমৎকার দৃশ্যের অবতারণা করেছে। এখানে এবড়ো থেবড়ো ও ভগ্ন গিরিশৃঙ্গ ফাটল ধরা সুউচ্চ পাহাড়, ধারালো পাথরের ফলা এবং ক্ষয়ে যাওয়া গম্বুজসদৃশ চূড়া প্রচুর সংখ্যায় চোখে পড়ে।
উত্তর ইরানে আল্বোর্য পর্বতমালা কাস্পিয়ান সাগরের তীরে সুউচ্চ দেয়াল তৈরি করেছে। কেবল তিনটি গিরিপথ দিয়ে কোন মতে এ পর্বতমালা অতিক্রম করা চলে। আলবোর্য পর্বতমালার সর্বোচ্চ স্থান হচ্ছে দামাভান্দ। দামাভান্দ হচ্ছে একটি মৃত অগ্নিগিরি। এর বরফাবৃত চূড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৬৭১ মিটার উঁচু। আলবোর্য পর্বতমালায় আরো বেশ কয়েকটি চার হাজার মিটার উঁচু চূড়া রয়েছে। তেহরানের নিকটবর্তী কুহে তুচল্ (তুচল পর্বত) প্রায় এ পরিমাণেই উঁচু। আলবোর্য পর্বতমালার পর্বতসমূহ দেশের উত্তর-পশ্চিম অভিমুখে এগিয়ে গিয়েছে এবং অরারাত পর্বতের মাধ্যমে আযারবাইজানের পর্বতসমূহের সাথে যুক্ত হয়েছে। অরারাত পর্বতের উচ্চতা সমূদ্র পৃষ্ঠ থেকে পাঁচ হাজার মিটার। বলা হয় যে, হযরত নূহ (আ.)-এর কিস্তি এ পর্বতের উপরেই স্থির হয় ও পানি নেমে যাওয়ার পর এর ওপরই আটকে যায়। আলবোর্য পর্বতমালা পূর্বদিকে খোরাসান পর্বতমালার সাথে মিলিত হয়েছে। খোরাসান পর্বতমালার উচ্চতা অপেক্ষাকৃত কম এবং এতে আরোহণ করা সহজতর। যগরোস্ পর্বতমালা পশ্চিম ইরানে অবস্থিত; এর উচ্চতা আলবোর্য পর্বতমালার তুলনায় কম। যগরোস্ পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গসমূহের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে চার থেকে সাড়ে চার হাজার মিটার।
যগরোস্ পর্বতমালার পর্বতগুলোর অবস্থান এমন যে, এগুলোর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা খুবই কঠিন কাজ। এ পর্বতমালার দুই পাশে অবস্থিত আরাক ও শীরায শহরের মধ্যে যাতায়াতের জন্য কোনো সরাসরি ও সোজা পথ নেই। এ কারণে এ দুই পাহাড়ের মধ্যকার ৫৫০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য হয় বিমানযোগে যাতায়াত করতে হবে, নয়তো ইসফাহান হয়ে আসা-যাওয়া করতে হবে।
পারস্য উপ-সাগর ও ওমান সাগরের তীরবর্তী পর্বতগুলো সমান্তরাল এবং ক্রমান্বয়ে ঢালু হয়ে এক বিরাট উচ্চ মরুভূমির প্রান্তে এসে মিশেছে।
বিমান থেকে দেখলে দেখা যাবে ইরানের দৃশ্য খুবই সুন্দর ও মনোলোভা, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইতিহাসের সুদীর্ঘকালে সব সময়ই ইরানের ভিতরকার পথসমূহ অত্যন্ত দুর্গম ও দুরতিক্রম্য ছিল। সুখের বিষয় বর্তমানে ইরানের অভ্যন্তরে বহু নতুন সুপ্রশস্ত মহাসড়ক তৈরি করা হয়েছে। ফলে ইরানের সকল এলাকায়ই খুব সহজেই যাতায়াত করা যেতে পারে।
ইরানের মাঝ বরাবর আরেকটি পর্বতমালা রয়েছে যা আলবোর্য পর্বতমালার সমান্তরাল। এ পর্বতমালাটি ‘কুহ্হয়ে মারকাযী’ (কেন্দ্রীয় পর্বতমালা) নামে সুপরিচিত। এ পর্বতমালার দৈর্ঘ্য প্রায় এক হাজার কিলোমিটার যা যান্জান্ থেকে শুরু করে কেরমান্ পর্যন্ত বিলম্বিত। এ পর্বতমালায় অগ্নিগিরিসৃষ্ট বহু পর্বত রয়েছে। এসব পর্বতের গঠনপ্রকৃতি অপেক্ষাকৃত জটিলতর। এসব পর্বতের বেশির ভাগেরই উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে চার হাজার মিটার।
উক্ত পর্বতমালার মাঝে একটি বিশালায়তন খোলা জায়গা রয়েছে। এর উত্তরাংশকে দাশ্তে কাভীর্ (মরুপ্রান্তর বা লবণ মরু) বলা হয়। আগে এ জায়গাটি লোনা পানিপূর্ণ জলাভূমি ছিল। এটি হচ্ছে পাথর, বালি ও লবণে পরিপূর্ণ একটি মরুপ্রান্তর। এর দক্ষিণ অংশের নাম দাশ্তে লূত’ (লূত মরুভূমি)। এটিকে বালির মহাসমুদ্র বললে অত্যুক্তি হবে না।
ইরানের অভ্যন্তরস্থ মরুভূমিসমূহের মোট আয়তন ৩ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার যা ইরানের মোট আয়তনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। এ মরুপ্রান্তরসমূহ আলবোর্য পর্বতমালা, খোরাসান পর্বতমালা, কেন্দ্রীয় পর্বতমালা ও পূর্বাঞ্চলীয় পর্বতমালার মাঝখানে অবস্থিত।
লূত মরুভূমিতে যেসব তৃণ, আগাছা ও উদ্ভিদ জন্মে তা খুবই পরিবর্তনশীল এবং এর বেশির ভাগ অংশেই কোনোরূপ উদ্ভিদ জন্মে না।
লবণ মরু (কাভীরে নামাক) বালি ও পাথরে পরিপূর্ণ। এটি হচ্ছে ইরানের সর্বাধিক শুষ্ক অঞ্চল।
বছরের বিভিন্ন সময়ে ও দিনে-রাতে ইরানের বিভিন্ন অংশের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেক। ইরানের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সত্তর ডিগ্রী ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রীর বহু নিচে।
দামাভান্দ : ইরানের রূপকথার পর্বত
উত্তর ইরানের আলবোর্য পর্বতমালার সর্বাধিক সুন্দর ও মনোহর গিরিশৃঙ্গ দামাভান্দ। দামাভান্দ হচ্ছে এমন একটি পর্বত যা সর্বদাই তুষারে আবৃত থাকে এবং সারা বছরই সেখানে শীতকালের অবস্থা বিরাজ করে। বনু ইরানী রূপকথায় এবং মানব জাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম বীরত্ব কাহিনী সম্বলিত মহাকাব্য ‘শাহ্নামা’য় (ফারসি উচ্চারণ ‘শাহ্নমে’) দামাভান্দ পর্বত বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ঢালূ হয়ে ক্রমান্বয়ে ওপরে উঠে যাওয়া, অনেকটা গোলাকার ধরনের ও সুবিন্যস্ত পর্বত দামাভান্দের উচ্চতা সমুদ্রপ্রষ্ঠ থেকে ৫৭৭১ মিটার। গোটা ইতিহাসে দামাভান্দ ইরানীদের দৃঢ়তা ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসাবে গণ্য করেছে। ফারসি সাহিত্যে এ পর্বতের রয়েছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান।
আকাশে যখন মেঘ না থাকে তখন দামাভান্দকে অনেক দূর থেকে দেখা যায়। ইমামযাদা হাশেম নামক পাহাড়সমষ্টির যেখানে পানি জমে আছে তার পানিসীমা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে দামাভান্দের প্রধান অগ্নিগিরির মুখ। দামাভান্দের মধ্যকার সবচেয়ে বড় গিরিপথ পোলভার নোওতল রেখা বরাবর চলে গেছে যার দৈর্ঘ্য ২৮ কিলোমিটার। দামাভান্দের সবগুলো গিরিপথের মোট আয়তন ৪০০ বর্গ কিলোমিটার।
আকাশে যখন মেঘ না থাকে তখন দামাভান্দ চূড়াকে ঘিরে এক অনবদ্য দৃশ্যের অবতারণা হয়। দামাভান্দের চূড়া থেকে মোটামুটি পাঁচ-ছয়’শ মিটার নিচে গিরিশৃঙ্গকে ঘিরে একটি জলীয় বাষ্পের বলয় তৈরি হয় যা পরিষ্কার আকাশে বহুদূর থেকে চোখ পড়ে। এ জলীয় বাষ্প দেখতে অনেকটা মেঘের মতো মনে হয়। এছাড়া দামাভান্দ শৃঙ্গের চতুর্দিকে হলুদ রং দেখা যায়। এ হলুদ রঙের কারণ দামাভান্দ পর্বতের গঠনে গন্ধক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
দামাভান্দের চতুষ্পার্শ হতে বেশ কয়েকটি খনিজ পানির ফোয়ারা বেরিয়ে ঝরনার আকারে প্রবাহিত হয়েছে। এসব খনিজ পানির ঝরনার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে লরিজন, গ্বালিআতুরা, মোহাম্মাদাবাদ, এমারাত্ ও আসাক্ এর ঝরনাসমূহ। এসব ঝরনার পানিতে সালফার ও ম্যাগনেসিয়াম মিশ্রিত রয়েছে, যে কারণে এ পানিতে গোসল করা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল, বিশেষ করে চর্মরোগে উপকারী।
এক নজরে প্রকৃতি
পাহাড়-পর্বত ও মরুভূমি ছাড়াও এক নজরে ইরানের প্রাকৃতিক দৃশ্য হচ্ছে রঙিন, আকর্ষণীয় ও মনোহারী। ইরান সফরকারীদের জন্য সম্ভবত সর্বাধিক আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন উচ্চভূমি ও টিলার মধ্য দিয়ে গমনাগমন। উঁচু-নিচু অসমান ভূমি এবং বিভিন্ন রঙের মরুভূমি ও পাহাড়-পর্বতের মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে, বিশেষ করে চলার পথে কিছুক্ষণ পর পরই রঙের পরিবর্তন ক্লান্তিকে পর্যটকের কাছে ঘেঁষতেই দেয় না।
উপত্যকার ঢাল বেয়ে নামতে গিয়ে পর্যটক তার চোখের সামনে বিভিন্ন রঙের মাটি ও বিভিন্ন রঙের মিশ্রণযুক্ত মাটি দেখতে পান। তার চোখের সামনে দিগন্তে ভেসে ওঠে একের পর এক সবুজ ও লাল পাহাড় অথবা লালাভ সবুজের সমারোহ। সহসাই এসবের মধ্য থেকে সফেদ ফেননিভ তুষারের সমুদ্র বেরিয়ে পড়ে অথবা আকাশ ফুড়ে কালো রঙের গিরিশৃঙ্গ বেরিয়ে আসে। পর্যটকের চোখের সামনে এমন সব রং ভেসে ওঠে যা থেকে মনে হতে পারে যে, এ হয়তো স্বপ্ন, এ রং হয়তো কাল্পনিক; মোলায়েম ক্রীম রং দেখে তার কাছে মনে হতে পারে যে, তার সামনে হয়তো কেউ একটি বিশালায়তন হরিণের চামড়া বিছিয়ে রেখেছে। এসব রং এবং মাটির উপাদানের সমন্বয়ের মধ্যে পাস্পারিক সম্পর্ক রয়েছে। যেসব পাহাড়ে চূড়া নেই বা পাথর নেই সেগুলো দেখতে সাধারণত মখমলের ন্যায়, যেমন- লোরেস্তানের পাহাড়সমূহ। এসব পাহাড়ের বাইরের দিকে রয়েছে বালু; কোনো কোনোটি মোটা বালুতে এবং কোনো কোনোটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম নরম বালুতে আবৃত। পাহাড়ের বক্র পিঠে আলো পড়ে তা প্রতিফলিত হয়ে ঝলমল করতে থাকে। এ চোখ ধাঁধানো আলোক প্রতিফলনের এক অনবদ্য ফলশ্রুতি এই যে, এসব জায়গায় কোনো কিছুর ছায়া পড়ে না। বায়ু প্রবাহিত হলে পাহাড় গাত্রের প্রচুর বালি বাতাসের সাথে ওপরে উঠে যায় এবং আকাশে ধূলিকণা মেঘের মত তৈরি হয়, অতঃপর নিচে বালির রঙের পল্লি এলাকার ওপর ছড়িয়ে পড়ে। এসব পাহাড় যথেষ্ট উঁচু একারণে এসব পাহাড়ের গায়ে গাছপালা খুব কমই দেখা যায় এবং এসব পাহাড়ের তীব্র শীতে খুব কমসংখ্যক উদ্ভিদ প্রজাতির পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব।
ইরানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে কোথাও কোথাও সেফিদর (হোয়াইট পপ্লার) গাছের সমারোহ। এসব গাছ দেখতে খুবই সুন্দর; এর গা রূপালি এবং পাতা আলো ঝলমলে। এসব গাছ সাধারণত ছোট ঘন বন আকারে দেখা যায় অথবা বাগানের চারদিকে বেড়া আকারে লাগানো হয়। সেফিদর গাছ সংশ্লিষ্ট সুউচ্চ পার্বত্য পল্লিসমূহকে বিশেষ ধরনের সজীবতা প্রদান করেছে। এ গাছের কাঠও বেশ দামী। মাটি ও খড়পাতা দিয়ে তৈরি গৃহে খুঁটি ও আড়া হিসেবে সেফিদর গাছ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের হাতল কৃষি উপকরণ ও ঘোড়া বা গরুর গাড়ি তৈরিতে এ কাঠ ব্যবহৃত হয়। পতাকা স্ট্যান্ড হিসেবেও সেফিদর গাছের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। দামী সেফিদর গাছের কাঠ কখনোই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। ইরানের ছোট ছোট পল্লি এবং ছোট ছোট জলাভূমির চারদিক সাধারণত সেফিদর গাছের দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। ইরানের ‘বীশেয় সেফিদরের’ (ঝোঁপ বা মরুদ্যান) কথাটি ব্যপকভাবে প্রচলিত আছে; পর্যটকদের কাছে এটা অদ্ভুত মনে হলেও এ পরিভাষাটির ব্যাপক ব্যবহার একান্তই যুক্তিযুক্ত। এ কথাটির ব্যবহারিক অর্থ হচ্ছে ছায়াময় গাছের দ্বারা ঘেরাও করা সবুজ গাছপালার দ্বীপ। প্রকৃতপক্ষে মরু এলাকায় এবং আরবের মরুদ্যানসমূহে খেজুর গাছের যে অবস্থা ইরানে সেফিদর গাছের অবস্থান প্রায় তদ্রূপ। আরবি ভাষায় এ দু’ধরনের গাছের ঝোঁপ বা মরুদ্যানকেই ‘ওয়াহাহ্’ বলা হয় যার মানে মরুভূমির মধ্যস্থ ছোট আবাদী। এ ধরনের আবাদী হচ্ছে রুক্ষ প্রকৃতির মোকাবিলায় বহুসংখ্যক গাছের একত্র সমাবেশের দৃষ্টান্ত। মানুষ প্রকৃতির সর্বোত্তম ব্যবহারের লক্ষ্যে এসব মরুদ্যানে বসতি স্থাপন করেছে।
সূত্র : ড. মোহাম্মাদ মাহ্দী তাওয়াসসোলী প্রণীত আজকের ইরান, জনাব নূর হোসেন মজিদী কর্তৃক অনূদিত।