ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট এবং প্রভাব
পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৬, ২০২২
সিরাজুল ইসলাম
বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে বিশ্বে যে মহাবিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছিল তার নাম ইরানের ইলামি বিপ্লব। যখন সারা বিশ্ব রুশ-মার্কিন দুই শিবিরে বিভক্ত, বিশ্ববাসী যখন মার্কিন পুঁজিবাদ ও সোভিয়েত কমিউনিজমের যাঁতাকলে পিষ্ট, তখন ‘না পশ্চিম, না পূর্ব’ এই স্লোগানকে বুকে ধারণ করে একদল ‘জানবাজ যোদ্ধা’ ইরানে এই অত্যাশ্চর্যজনক ঘটনার জন্ম দেন। আধুনিক বিশ্বের সেই নজিরবিহীন বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিলেন ইরানের সিংহপুরুষ সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম হযরত আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেইনী। কী এক ঐশী ক্ষমতা দিয়ে তিনি পুরো ইরানি জাতিকে উন্মত্ত সাগরের ন্যায় জাগিয়ে তুললেন যার ফল হিসেবে ফেনিল তটে গোড়াপত্তন হলো ইসলামি বিপ্লবের। বহু জীবন আর রক্তের বিনিময়ে ইতিহাসের ইরান পেল সত্যিকারের স্বাধীনতা, সাম্রাজ্যবাদকে ‘না’ বলে দেওয়ার দুর্দমনীয় সাহস। যে শুভক্ষণে পাহাড়, সাগর আর জঙ্গলাকীর্ণ ইরানের ভূখ- বিপ্লবের সোনালি আভায় উদ্ভাসিত হলো সেই শুভক্ষণটি হলো ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে, পতন ঘটে পাহলভি রাজবংশের শেষ শাসক মোহাম্মাদ রেজা খানের। ইরানে প্রতিষ্ঠা হয় জনগণের অংশগ্রহণে ইসলামি সরকার ব্যবস্থা।
রেজা শাহ ইরানের শাসন ক্ষমতায় বসেছিলেন ১৯৪১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি ১৯৬৭ সালের ২৬ অক্টোবর জন্মদিনে নিজেকে ‘শাহানশাহ’ বা ‘রাজাদের রাজা’ বলে ঘোষণা দেন। রেজা শাহ ছিলেন একজন সেক্যুলার ব্যক্তি। ক্ষমতায় বসে তিনি বিদেশি শাসক বিশেষ করে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইসরাইলকে খুশি করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এর কারণ মূলত তাদের কৃপায় তিনি নিজ পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। দেশ শাসনের যোগ্যতা না যতটা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল পরাশক্তির আনুকূল্য। ফলে দেশের মান্ুেষর সুবিধা-অসুবিধাগুলো নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। নিজের গদি ঠিক রেখে যা খুশি তাই করার চিন্তাই ছিল প্রখর। এ কারণে ধীরে ধীরে তিনি জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন বিশেষ করে ইরানের শিয়া আলেমদের কাছ থেকে তিনি একেবারেই ছিটকে পড়েন। এছাড়া, শ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষও তাকে পছন্দ করতেন না। তার বিরুদ্ধে লাগামহীন দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। দুর্নীতিতে তার আশপাশের লোকজন জড়িত ছিলেন; জড়িত ছিলেন তার পরিবারের লোকজন। প্রশাসনের এলিটরাও একইভাবে দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। ফলে তার সরকার ইসলামি গণবিপ্লব সফল হওয়ার বেশ আগেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল। এছাড়া, রাজনৈতিক কিছু কর্মকা- যেমন কমিউনিস্ট ‘তুদেহ পার্টি’কে নিষিদ্ধ করা, ইসরাইলের সঙ্গে অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, বিরোধী রাজনীতিকদেরকে গুপ্ত পুলিশ বাহিনী সাভাক দিয়ে নির্যাতন তার পতনের জন্য অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে। সরকারি হিসাব মতে ১৯৭৮ সালে ইরানে রাজনৈতিক বন্দির সংখ্যা ছিল ২,২০০ এর মতো, কিন্তু গণবিপ্লবের সময় সেই সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায়। ফলে ১৯৭৯ সালে দেশে গণ-অশান্তি বিপ্লবে রূপ নেয় এবং চূড়ান্তভাবে রেজা শাহের পতন ঘটে। ১১ ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সফল হওয়ার আগে ১৭ জানুয়ারি তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। জনশ্রুতি রয়েছে, রেজা শাহ নারীর বেশে দেশ থেকে পালিয়ে যান। দেশে ফিরে এলে মৃত্যুদ-ের আশংকা ছিল। সে ভয়ে রেজা শাহ দেশে ফিরে আসেন নি; অনেকটা নিঃসঙ্গ অবস্থায় মিশরে তার মৃত্যু হয় এবং রাজধানী কায়রোয় তাকে দাফন করা হয়। সেখানেই দাফন করা হয়েছিল তার বাবাকেও।
ইরানের এই ভয়াবহ ক্ষমতাধর রেজা শাহের জীবন ছিল ভোগ বিলাসে ভরা। এর ছোট্ট নমুনা পাওয়া যাবে একটি ঘটনা উল্লেখ করলে। ১৯৭১ সালে দেশে ইরানি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আড়াই হাজার বছর পূর্তি পালন করেন রেজা খান। সে সময় মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ রিপোর্ট করেছিল ইরানি রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বছর পূর্তিতে রেজা শাহ পাহলভি তখনকার দিনে ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ডলার খরচ করেছিলেন। ইরানের প্রাচীন ও সুবিখ্যাত পার্সেপোলিস গেইটের কাছে ১৬০ একর জমিতে ‘তাঁবুর শহর’ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশমতো বিশালাকারের তিনটি রাজকীয় তাঁবু এবং ৫৯টি লেজার দিয়ে তাঁবুর শহর প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারার আকৃতিতে সাজানো হয় তাঁবুর শহরকে। ফ্রান্সের বিখ্যাত ম্যাক্সিম থেকে বাবুর্চি আনা হয় এবং এসব বাবুর্চি রাজ পরিবারের সদস্য ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা রাজকীয় মেহমানদের জন্য খাবার তৈরি করে। তাঁবুর শহর সাজানোর কাজ করে মাইসন জ্যানসেন কোম্পানি যারা জ্যাকুইলিন কেনেডির জন্য হোয়াইট হাউজের ডেকোরেশনের কাজ করেছিল। মেহমানদের খাবার-দাবার পরিবেশন করা হয়েছিল ফ্রান্সে তৈরি অভিজাত বাসনকোসনে। এছাড়া মদপানের আয়োজন করা হয়েছিল বাকারা ক্রিস্টাল গ্লাসে।
যেখানে এই মহাসাড়ম্বরের সঙ্গে উৎসব আয়োজন করা হয়েছিল তার পাশেই ছিল ইরানের অংসখ্য গরিব লোকের বসবাস। তাদেরকে অভুক্ত রেখে রাজপরিবারের সদস্য আর বিদেশী মেহমান নিয়ে বিশাল রাজকীয় ভোজ উৎসবের আয়োজন মারাত্মক কেলেংকারির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেউ রেজা শাহের এই রাজকীয় ভোজ উৎসবকে পছন্দ করেন নি। এর প্রতিবাদে ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধর্মঘট করেছিল।
রেজা শাহের ব্যক্তিগত জীবন যেমন ছিল ভোগবিলাসে পূর্ণ, তেমনি যৌন-উন্মত্ততাও ছিল লাগামহীন। তার চরিত্রের এসব অন্ধকার দিকই ইসলামি বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুতে সাহায্য করে, বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে। জনগণকে বঞ্চিত রেখে নিজের ও পরিবারের কিংবা কাছের লোকজনের ভোগবিলাস আর সম্পদ লুণ্ঠন এবং আমেরিকা, ইসরাইল ও ব্রিটেনের মতো বিদেশী শক্তির তোষণনীতি বিপ্লবের বারুদে পেট্রোল ঢালার মতো ঘটনা হিসেবে কাজ করেছে। বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা ইমাম খোমেইনীকে বার বার নির্বাসনে পাঠিয়েও শেষ রক্ষা হয় নি। রেজা শাহরে পতন হয়েছে ঠিকই এবং ইরানের জনগণ তাদের অধিকার ফিরে পেয়েছে। একাজে বীর ইরানি জাতি লক্ষাধিক প্রাণ কুরবানি দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই ইরানে ব্যাপক আকারে তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় যার মালিক ছিল ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো। ঠিক এই সময়টিতে ১৯৫১ সালে ইরানে গণতান্ত্রিকভাবে প্রথম নির্বাচিত হয় মোহাম্মাদ মোসাদ্দেকের ন্যাশনাল ফ্রন্টের সরকার। ইরানিরা কেবল লাভের ২০ শতাংশই পেতো। ফলে প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক দেশের সব তেল সম্পদ জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ব্রিটেনে তখন উইনস্টন চার্চিল ক্ষমতায় আর আমেরিকায় হেনরি ট্রুম্যান। মোসাদ্দেকের জয়লাভের ফলে দুই ক্ষমতাশালীর মাথায় বাজ পড়ল। শুরু হলো মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করার নীল নকশা। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসআইএস’ লন্ডনে বসে যৌথ পরিকল্পনা করল। প্রেসিডেন্ট থিউডর রুজভেল্টের নাতি কার্মিট রুজভেল্ট তখন সিআইএ প্রধান। তিনি উড়ে এলেন লন্ডনে। প্রণীত হলো অপারেশন ‘অ্যাজাক্স’ এর নীল নকশা। পরিকল্পনা মতে- ইরানি সেনাবাহিনীতে ঘটানো হলো অভ্যুত্থান। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ মোসাদ্দেক ক্ষমতাচ্যুত হলেন। তার স্থানে আজ্ঞাবহ জেনারেল ফজলুল্লাহ জাহেদিকে নিয়োগ দেয়া হলো। কিন্তু মূল ক্ষমতা রাখা হলো ইঙ্গো-মার্কিন সাম্রাজ্যের অনুগত মোহাম্মদ রেজা শাহের হাতে। এই ঘটনার একদিনের মাথায় সেনাবাহিনীতে একটি কাউন্টার অভ্যুত্থান হলো। অভ্যুত্থানকারীরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে উদ্ধার করলেন। অন্যদিকে শাহ পালিয়ে গেলেন বাগদাদে এবং তারপর ইতালিতে। কিন্তু এর দুই দিন পর আরো একটি রক্তাক্ত পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানো হয় সেনাবাহিনীতে। ফলে মার্কিন-ব্রিটেনের নীল-নকশায় অপারেশন অ্যাজাক্স সফল হয় শতভাগ। পরবর্তীতে শাহ ইরানে ফিরে আসে চটজলদি।
এসব ঘটনা ঘটে ১৯৫৩ সালে। পতনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৭৯ সালের ১৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছিল শাহের হাতে। তার ইঙ্গো-মার্কিন মদদদাতারা অনবরত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল তাকে। ফলে তার পুলিশ ও সেনাবাহিনী প্রতিদিন রাজপথে শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যা করছিল।
১৯৫৩ সালের হস্তক্ষেপটি শুধু ইরানিদেরই তিক্ত অপমান, বিশ্বাসঘাতকতা এবং নিপীড়নের আঘাত দেয় নি; বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এর ব্যাপক প্রভাব রেখেছে।
১৯৫৩ সালের পর থেকে ইরানে বড় রকমের উন্নতি হয়েছিল এবং তাতে জনগণের খুশি বা সন্তুষ্ট থাকার কথা ছিল কিন্তু তারা তা ছিল না। শাহের কতিপয় ব্যক্তিগত আচরণ, অভ্যাস আর পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রচলন দেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এই বিক্ষোভই অগ্নিগর্ভে রূপ নেয় ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে। তেহরান শহরে কোনো পাবলিক বাসে কোনো ধর্মীয় লেবাসধারী মানুষ উঠলেই কন্ট্রাক্টর টিটকারি করে বলতÑ ‘আমরা আলেম আর পতিতাদের বাসে চড়াই না।’ রাস্তায় রাস্তায় গড়ে উঠেছিল মদের দোকান। শহর ও শহরতলীতে শত শত নাইটক্লাবে চলত সারারাত ধরে ডিস্কো পার্টির নামে মদপান, জুয়া আর অবাধ যৌনাচার।
রেজা শাহ নিজেও ছিলেন পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। তার স্ত্রী, সন্তানরাও পশ্চিমা ধাঁচে চলতেন। শাহ এবং তার স্ত্রী সকল রাজকীয় অনুষ্ঠান এবং দেশী-বিদেশী সরকারি অনুষ্ঠানসমূহে পশ্চিমাদের পোশাক পরতেন। এসব কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা দিনকে দিন ফুঁসে উঠতে থাকে।
১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৭৭, এই সময়ে ইরানের বিকাশের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবেÑ- কী সাংঘাতিকভাবে রেজা শাহ মার্কিনদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। মার্কিনীদের প্রচেষ্টানুযায়ী এই সময়কালে ইরানি সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ, ইরানি সমাজব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে নির্মাণ করেন শাহ, যাকে তিনি ‘শ্বেত বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেন। যদিও তার অর্থনৈতিক কর্মসূচি ইরানে সমৃদ্ধি ও শিল্পায়ন এনেছিল এবং শিক্ষাগত উদ্যোগের ফলে সাক্ষরতার হার বেড়েছিল, কিন্তু এসবই ছিল বিশাল ব্যয়বহুল কর্মকা-। সম্পদ সমানভাবে বণ্টন করা হয় নি, কৃষকদের মধ্যে নগরায়নের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল, এমনকি ভিন্নমত পোষণকারীদের রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক দমনপীড়ন করা হয়েছিল। ধর্মীয় আলেমরা পশ্চিমা জীবনধারা তাদের ওপর চাপানো হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তারা বুঝতে ও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে, ইসলামকে সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
১৯৬৩ সালের ১৫ খোরদার যে বিক্ষোভ হয় তাতে ইমাম খোমেইনী সুস্পষ্ট ভূমিকা পালন করেন। ফলস্বরূপ তিনি দেশ থেকে নির্বাসিত হন। নির্বাসিত জীবনে ইমাম খোমেইনী বিপ্লবের জন্য আরো বেশি কাজের সুযোগ পেলেন। শাহকে খোলাখুলিভাবে সমালোচনা করে রেকর্ডকৃত বক্তব্য পাঠাতে লাগলেন দেশে এবং সেসব রেকর্ড ইরানে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে।
ঔপনিবেশিক পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামকে সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলে ইমাম খোমেইনী যুক্তি দেন। কুরআনের ওপর ভিত্তি করে ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এবং উদাহরণস্বরূপ তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর কর্মকা-ের বর্ণনা দেন।
ইমাম খোমেইনীর বক্তব্য দিন দিন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠল এবং পরিস্থিতি ক্রমেই শাহ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। এ অবস্থায় রেজা শাহ বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনীকে ইরাক থেকে ফ্রান্সে নির্বাসনে পাঠান। সেখানে গিয়েও ইমাম খোমেইনী তার তৎপরতা অব্যাহত রাখলেন। তার রেকর্ডকৃত বক্তৃতার ক্যাসেটগুলো জনগণের মাঝে এতটাই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলো যে, ইমাম খোমেইনীর অনুসারীরা চূড়ান্ত মাত্রায় উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন এবং বিক্ষোভগুলো ইরানের প্রধান প্রধান শহরে ছড়িয়ে পড়ল। ব্যাপক হত্যা, গুম ও ধরপাকড়ের পরেও জনগণকে ঠেকিয়ে রাখা গেল না।
১৯৭৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। শাহের বাহিনী তেহরানের বিশাল জনসমাবেশের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। আপাতত লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় কিন্তু দিবসটি ইরানের ইতিহাসে কুখ্যাত ‘ব্লাক ফ্রাইডে’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। ব্লাক ফ্রাইডের পর তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত সিআইএ এজেন্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে সিআইএ হেড কোয়াটারে রিপোর্ট করেনÑ ৮ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর শাহের শাসন ক্ষমতা এতটাই সূদৃঢ় হয়েছে যে আগামি ১০ বছরে বিরোধী পক্ষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। অথচ এর মাত্র ৩ মাসের কিছু সময় পর অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে মাত্র একদিনের গণ অভ্যুত্থানে শাহের পতন হয়। অবশষে ১৯৭৯ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি ফ্রান্স থেকে নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে ইমাম খোমেইনী বিজয়ীর বেশে ইরানে ফিরে আসেন এবং বিপ্লব চূড়ান্তভাবে সফল হয়।
বিপ্লবের প্রভাব: ইরানের ইসলামি বিপ্লব প্রায় ১৪০০ বছর ধরে চলে আসা খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলামের ধারায় সূচিত সংগ্রামগুলোরই অনন্য ধারাবাহিকতার ফসল। আর যে বিপ্লবের ভিত্তিগুলো যত বেশি মজবুত সেই বিপ্লবের স্থায়িত্বও হয় তত বেশি। আল্লাহু আকবার ও লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-ভিত্তিক আদর্শের পুনরুজ্জীবন যে বিপ্লবের লক্ষ্য, সেই বিপ্লব মাত্র ৪০ বছরেই বুড়িয়ে যায় না, ঝিমিয়ে পড়ে না; বরং ৪০ বছর তার প্রাণবন্ত যৌবনের সূচনা মাত্র।
রাজনৈতিক ইসলামের পুনরুত্থানের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে ইরানি বিপ্লবের প্রভাব দেখা যায়। ইরানের সফলতা দেখায় যে, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শুধু একটি স্বপ্ন নয়। পশ্চিমা ও তাদের সহযোগী সম্রাট ও স্বৈরশাসকদের ওপর জয় লাভ করা যে সম্ভব তাও ইরান প্রমাণ করেছে। ১৯৮০ ও ৯০’র দশকে পুরো মুসলিম বিশ্বেই ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো ইরানের ইসলামি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার মডেল অগ্রগতি এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে, এক্ষেত্রে ইসলামি মডেল একমাত্র বিকল্প। দেশে দেশে রাজনৈতিক দলগুলো উদাহরণ হিসেবে ইরানের বিপ্লবের কথাই তুলে ধরত।
সা¤্রাজ্যবাদী বিশ্বে ইউরোপের পরে মার্কিন সরকারগুলোর সঙ্গে শত্রুতা করে কোনো দেশই শক্তভাবে টিকে থাকতে পারে নি কিন্তু ইরান এ ক্ষেত্রে ভিন্ন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান এমন এক মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে যারা বিগত ৪০ বছর ধরে মার্কিন আগ্রাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে টিকে আছে।
গণবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর তা ব্যর্থ করার জন্য ইসলামি এই দেশটির বিরুদ্ধে ইরাকের সাদ্দামকে ব্যবহার করেছে মার্কিন সরকার। ইরানের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোর সামরিক শক্তি ব্যবহারের নীতি গ্রহণ করেছিল ওয়াশিংটন। আর এজন্য ইরাক ও সৌদি আরবকে উসকে দিয়েছিল হোয়াইট হাউজ। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেজনস্কি এ কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মার্কিন সরকারের উৎসাহ পেয়েই রাজতান্ত্রিক আরব দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে অর্থ সাহায্য দিত। মার্কিন সরকারের উস্কানি বা উৎসাহ পেয়েই সৌদি সরকার তেলের দাম কমিয়ে দিত যাতে ইরানের তেলের দামও কমে যায়। এর ফলে তেহরান যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়।’ ব্রেজনস্কি আরো বলেছেন, ‘বর্তমানে ইরানের তেল ও গ্যাস বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা সেই একই নীতি অনুসরণ করছে।’
ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরাকের প্রতি মার্কিন ও আরব দেশগুলোর, এমনকি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রায় সব শক্তির সর্বাত্মক সহায়তা সত্ত্বেও বিপ্লবী ইরানি জাতির প্রতিরোধের ফলে ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে ধ্বংস করা বা দুর্বল করার মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। এই যে ইরানি জাতির টিকে থাকার অদম্য শক্তি, এই শক্তির মূলমন্ত্র হলো ইসলামি বিপ্লব।
ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান যেমন সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিকে সরাসরি ‘না’ বলে দিতে শিখেছে তেমনি ইরানকে দেখে বিশ্বের বহু দেশ পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। বিপ্লবের পর মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিকে যেমন ইরান ‘বড় শয়তান’ বলে আখ্যা দিয়েছে তেমনি ব্রিটেন ও ইসরাইলকেও ইরান শত্রুর তালিকায় ফেলেছে। ইরানে বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইসরাইল যেভাবে প্রতিরোধ ও সংগ্রামী চেতনার মুখে পড়ছে, এই অবৈধ শক্তিটি আগে কখনই তা দেখে নি।
প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের দুর্বার শক্তি হয়ে উঠেছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসলামি জিহাদ আন্দোলন। যে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসি-কে ইরানের বিপ্লব ধ্বংস করার জন্য জোট শক্তি হিসেবে গঠন করা হয়েছিল সেই জিসিসির অন্যতম প্রধান সদস্য কাতার তারই মিত্রদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াল, কুয়েত এবং ওমানের মতো দেশ আমেরিকার প্রধান মিত্র সৌদির একান্ত অনুগত আর নেই। তারা নিজেদের মতো করে অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যে দারিদ্রপীড়িত ইয়েমেনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল মার্কিন মদদপুষ্ট সৌদি জোট সেই ইয়েমেন এখন সিংহবিক্রমে লড়ছে মার্কিন অস্ত্র ও প্রযুক্তির বিরুদ্ধে। পারস্য উপসাগর ছিল ইঙ্গো-মার্কিন মিত্রদের স্বর্গরাজ্য। সেই পারস্য উপসাগরে এখন ইরানের সদর্প পদচারণা। অনেকটা ইরানি অনুকম্পা নিয়ে সেখানে থাকতে হচ্ছে মার্কিন বাহিনীকে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মর্কিন সেনাদের। বিপ্লবের আগে যেখান ইরানের সরকার ছিল নিতান্তই নতজানু ও পরনির্ভরশীল সরকার, সেখানে ইরান এখন সামরিক, কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে দিব্যি বিশ্বের বড় বড় শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। ইরানি ক্ষুরধার কূটনীতির কাছে প্রতিনিয়ত নাকানি-চুবানি খাচ্ছে পশ্চিমা শক্তি বিশেষ করে আমেরিকা। ইসলামি বিপ্লব ইরানকে কতটা শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে তার চূড়ান্ত নজির হচ্ছে ইরাকে মার্কিন ঘঁটিতে ঘোষণা দিয়ে ইরানি সামরিক বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একমাত্র ইরানের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। ইরানের এই সক্ষমতায় বহু বন্ধুদেশ নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চায়, তারাও বুঝতে শিখেছে কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। এই প্রচেষ্টা মোটেই অসম্ভব নয় বরং এখন বাস্তবতা। এর সবই সম্ভব হয়েছে ইরানের মহান ইসলামি বিপ্লবের কারণে।
লেখক : সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক