ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা ও বাণী
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮
মো. মুনীর হোসেন খান : ‘যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর নিদর্শনাদির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে তাহলে তা তো হবে তার হৃদয়ের তাকওয়া প্রভূত।’ (সূরা হজ্ব : ৩২)
‘নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়াহ আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম।’
(সূরা বাকারাহ্ : ১৫৮)
وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَالكُم مِنْ شَعَائِرِ اللهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ
‘এবং কাবার জন্য উৎসর্গীকৃত উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে।’
(সূরা হজ্ব : ৩৬)
নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। তার প্রমাণ প্রাগুক্ত আয়াতসমূহ। যেখানে সাফা-মারওয়াহ্ পাহাড়দ্বয় এবং হজ্বের কুরবানির উটকে মহান আল্লাহর নিদর্শন বলে ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মহান আম্বিয়া ও আউলিয়ায়ে কেরাম বিশেষ করে নূরনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন (شَعَائِرَائِر)। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইমাম হোসাইন (আ.) মহান আল্লাহ পাকের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনাদির অন্যতম। আর তাঁকে সম্মান করা পবিত্র কুরআনের ভাষায় অন্তরের তাক্ওয়াস্বরূপ। তাঁর শাহাদাতের মাসে তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর মহান ত্যাগ ও কর্মকা- আলোচনা করে তা থেকে শিক্ষা নেয়া, অনুপ্রাণিত হওয়া, কারবালার মরুপ্রান্তরে পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ, ইবনে যিয়াদের বাহিনীর হাতে তাঁর ও তাঁর সংগী-সাথীদের হৃদয় বিদারক শাহাদাতবরণ ও নির্যাতনের কথা স্মরণ, তাঁদের পুণ্য স্মৃতিকে চিরজাগরুক ও অম্লান রাখার জন্য শোকানুষ্ঠান পালন, কান্না-কাটি ও অশ্রুপাত করা আসলে তাঁকে অর্থাৎ আল্লাহর নিদর্শনাদির প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তা অন্তরের তাকওয়াপ্রসূত। আর তাঁর শোকে শোকাভিভূত না হয়ে হাসি-আনন্দ প্রকাশ করাই যে শয়তান, ইয়াযীদ ও ইয়াযীদীনের অনুসরণ এবং তাক্ওয়াবিরোধী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব ও আন্দোলন সংক্রান্ত আলোচনার পূর্বে তাঁর কতিপয় ফযিলত বা গুণ আলোচনা করা প্রয়োজন। কারণ, এর ফলে আমরা তাঁর সুমহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা লাভ করতে পারব। আর এটা তাঁর আন্দোলনের স্বরূপ ও প্রকৃতি এবং তাৎপর্য অনুধাবনে সহায়ক হবে।
ইমাম হোসাইন (আ.) মহানবীর আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য। অগণিত হাদীস বিশেষ করে প্রসিদ্ধ হাদীসে কিসার মাধ্যমে প্রমাণিত যে, স্বয়ং মহানবী (সা.), হযরত ফাতেমা, হযরত আলী, হযরত হাসান ও হযরত হোসাইনকে নিয়ে মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত বা নবী পরিবার- যাঁদেরকে মহান আল্লাহ সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে মাসূম বা সকল প্রকার পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র (নিষ্পাপ) বলে ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহ্ বলেন :
‘হে (নবীর) আহলে বাইত! নিশ্চয় মহান আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে সকল অপবিত্রতা ও পাপ-পঙ্কিলতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’
(সূরা আহযাব : ৩৩)
অতএব, প্রমাণিত হয় যে, ইমাম হোসাইন (আ.) আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হওয়ার কারণে সকল প্রকার পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র (মাসূম)।
এ কারণেই মহানবী (সা.) ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন সম্পর্কে বলেছেন :
الحَسَنُ وَ الْحُسَيْنُ سَيْدَا شَبَابِ أَهْلِ الْجَنَّةِ
‘হাসান ও হোসাইন উভয়েই বেহেশতের যুবকদের নেতা।’
(জামে আত্ তিরমিযী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩৫০)
সহীহ্ তিরমিযীতে ইয়ালা ইবনে মুয়রা থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন :
حُسَيْنُ مِنِّي وَانَا مِنْ حُسَيْنِ اَحَبَّ اللهُ مَنْ اَحَبَّ حُسَيْنًا, حُسَيْنُ سِبْطٌ مِنَ ا لاَسْبَاطِ
‘হোসাইন আমার থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে। যে ব্যক্তি হোসাইনকে ভালোবাসে আল্লাহ্ তাকে ভালোবাসেন। নাতিদের মধ্যে একজন হলো হোসাইন।’ (৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩৫৪)
সালমান ফার্সী (রা.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত : মহানবী (সা.) বলেছেন :
اَلْحَسَنُ وَ الْحُسَيْنُ ابْنَايَ مَنْ اَحَبَّهُمَا اَحَبَّنِى وَمَنْ اَحَبّنِـى اَحَبَّـهُ اللهُ وَمَنْ أَحبَّـهُ اللهَ أَدْخَلَـهُ اللهُ الجَنَّـةَ ومَنْ أَبْغَضَهُمَا اَبغَضَنِى وَمَنْ أَبْغَضَنِى اَبْغَضَـهُ اللهُ وَ مَنْ اَبْغَضَـهُ اللهُ أَدْخَلَهُ النَّارَ عَلَى وَجْهِهِ
‘হাসান ও হোসাইন আমার দুই পুত্র (নাতি)। যে তাদেরকে ভালোবাসে সে আমাকেই ভালোবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে মহান আল্লাহ্ তাকে ভালোবাসেন। আর যাকে মহান আল্লাহ্ ভালোবাসেন তাকে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে তাদেরকে ঘৃণা করে সে আমাকেই ঘৃণা করে, আর যে আমাকে ঘৃণা করে মহান আল্লাহ্ তাকে ঘৃণা করেন। আর যাকে মহান আল্লাহ ঘৃণা করেন তাকে তিনি জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।’ (আলামুল ওয়ারা, পৃ ২১৯)
৪র্থ হিজরীর ৩ শা’বান ইমাম হুসাইনের জন্মগ্রহণ করার সুসংবাদ মহানবীকে দেয়া হলে তিনি দ্রুত হযরত আলী ও হযরত ফাতেমার ঘরে চলে যান এবং আসমা বিনতে উমাইসকে বলেন : ‘হে আসমা! আমার সন্তানকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ আসমা বিনতে উমাইস সদ্য ভূমিষ্ঠ হোসাইনকে একটি সাদা কাপড়ে জড়িয়ে মহানবীর কাছে আনলেন। মহানবী (সা.) হোসাইনকে নিজের কাছে টেনে নিলেন, তাঁর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামাত দিলেন। তারপর তিনি হোসাইনকে কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তখন আসমা বিনতে উমাইস জিজ্ঞাসা করলেন : ‘আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আপনি কোনো কাঁদছেন?’
মহানবী (সা.) বললেন : ‘আমি আমার এ পুত্রকে দেখে কাঁদছি।’
আসমা জিজ্ঞাসা করলেন : ‘এতো এই মাত্র ভূমিষ্ঠ হয়েছে।’
মহানবী (সা.) তখন আসমাকে বললেন : ‘হে আসমা! আমার পর একদল খোদাদ্রোহী তাকে হত্যা করবে। আমি তাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহর কাছে শাফায়াত করব না।’ এরপর তিনি বললেন : ‘হে আসমা! তুমি ফাতেমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলো না। কারণ, সে সবেমাত্র সন্তান প্রসব করেছে।’
তারপর আল্লাহ মহানবী (সা.)-কে তাঁর নাতির নাম রাখার জন্য নির্দেশ দিলে তিনি আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন : ‘এর নাম রাখ হোসাইন।’ (আল্লামা তাবারসী প্রণীত আলামুল ওয়ারা বি আ’লামিল হুদা, পৃ. ২১৭)
হাদীসে সাকালাইন
যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে গেলাম যা তোমরা মজবুতভাবে ধারণ (অনুসরণ) করলে আমার পর কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তার একটি অপরটির চাইতে অধিক মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ : আল্লাহর কিতাব যা আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত প্রসারিত এবং আমার ইতরাৎ (বংশধর ও সন্তান) আমার আহলে বাইত। এ দু’টি কখনও বিছিন্ন হবে না হাউযে কাওসারে আমার কাছে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত। অতএব, তোমরা লক্ষ্য কর আমার পরে এতদুভয়ের সাথে তোমরা কীরূপ আচরণ কর।’ (জামে আত্-তিরমিযী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩৬০, হাদীস নং ৩৭২৬)
যেহেতু ইমাম হোসাইন (আ.) মহানবীর ইতরাৎ অর্থাৎ সন্তান এবং আহলে বাইত তাই তাঁর সাথে পবিত্র কুরআনের সম্পর্ক যে অবিচ্ছেদ্য তা এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়।
মুবাহিলার আয়াত
‘অতঃপর তোমার নিকট সত্য জ্ঞান এসে যাওয়ার পর যদি এ ব্যাপারে তোমার সাথে কেউ বিবাদ করে, তাহলে বল : এসো, আমরা ডাকি আমাদের পুত্রদের এবং (তোমরা) তোমাদের পুত্রদেরকে (ডাক), (আমরা ডাকি) আমাদের নারীদেরকে (তোমরা ডাক) তোমাদের নারীদেরকে, এবং (আমরা ডাকি) আমাদের নিজ সত্তাদেরকে (আমাদের একান্ত আপন লোকদেরকে) তোমরা (ডাক) তোমাদের নিজ সত্তাদেরকে (তোমাদের একান্ত আপন ব্যক্তিদেরকে)। আর তারপর চল আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত (লা’নত) করি।’ (সূরা আলে ইমরান : ৬১)
এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মহানবী (সা.) নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদলকে মুবাহালার আহ্বান জানান যারা হযরত ঈসা (আ.)-কে উপাস্য প্রতিপন্ন করার জন্য মহানবীর সাথে বাদানুবাদ করছিল। মহানবী (সা.) হযরত ফাতেমা, হযরত আলী, ইমাম হাসান এবং ইমাম হোসাইনকে সাথে নিয়ে মুবাহালার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসেন। এ আত্মবিশ্বাস দেখে নাজরানের খ্রিস্টান পাদ্রী সাথীদেরকে বলতে থাকেন : ‘তোমরা জান যে, তিনি আল্লাহর নবী। আল্লাহ্র নবীর সাথে মুবাহালা করলে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য। তাই মুক্তির কোনো পথ খোঁজ।’ সংগীরা বলল : ‘আপনার মতে মুক্তির উপায় কী?’ তিনি বললেন : ‘আমার মতে নবীর শর্তানুযায়ী সন্ধি করাই উত্তম উপায়।’ এরপর এ ব্যাপারে প্রতিনিধিদল সম্মত হয় এবং মহানবী (সা.) তাদের ওপর জিযিয়া কর ধার্য করে মীমাংসায় উপনীত হন। (ইবনে কাসীরের তাফসীর, ১ম খণ্ড)
মহানবী (সা.) হাসান, হোসাইন, ফাতেমা ও আলীকে নিয়ে মুবাহালার উদ্দেশে বের হওয়ার সময় ‘হে (নবীর) আহলে বাইত! নিশ্চয় মহান আল্লাহ চান তোমাদের থেকে সকল পাপ-পঙ্কিলতা ও অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের পূর্ণরূপে পবিত্র করতে’-এ আয়াত পাঠ করে বললেন, ‘এরাই আমার আহলে বাইত।’ আর মুবাহালা করতে যাওয়ার সময় মহানবী (সা.) মুসলমানদেরকে মুবাহালার স্থান থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
মুবাহালার ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মহানবীর নবুওয়াতের সত্যতার অন্যতম সাক্ষ্যদাতা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)। মহান আল্লাহ যাঁকে বেহেশতের যুবকদের নেতা করেছেন তাঁকেই তিনি তাঁর নবীর নবুওয়াতের সত্যতার সাক্ষী করেছেন।
সমগ্র মুসলিম উম্মাহ মহানবীর যুগ থেকে নামাযে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর বংশধরদের ওপরই কেবল দরূদ পড়ে আসছে; আর এরই অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন। এ দুর্লভ মর্যাদা ও সম্মান আর কেউ পাননি। দরূদটি নিম্নরূপ :
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلىَ مَحَمَّدٍ وَ عَلَى اَلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى اِبْرَاهِيمَ وَ عَلى اَلِ اِبْرَاهِيْمَ اِنَّكَ حَمِيدٌ مَّجِيدُ اَللَّهُمَّ بَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى اِبْرَاهِيْمَ وَ عَلَى اَلِ اِبْرَاهِيْمَ اِنَّكَ حَمِيدٌ مَّجِيدُ
আয়াতুল মাওয়াদ্দাহ্ :
قُلْ لاَ أَسْألُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلاَّ الْمَوَدَّةَ فِى الْقُرْبَى
‘বলুন, আমি আমার রিসালাতের দায়িত্ব পালন ও দাওয়াতের জন্য তোমাদের কাছে একমাত্র আমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য (মাওয়াদ্দাহ্) ব্যতীত আর কোনো পারিশ্রমিক চাই না।’ (সূরা-শূরা : ২৩)
অগণিত রেওয়ায়েত অনুসারে এবং অনেক মুফাস্সিরের মতে উপরিউক্ত আয়াতটি আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইনের শানে অবতীর্ণ হয়েছে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ‘ফাযায়েলুস সাহাবা’ গ্রন্থে আমেরের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, ‘উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হলে সাহাবাগণ মহানবী (সা.)-কে বললেন : ‘আপনার নিকটাত্মীয় কারা যাঁদের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা আমাদের ওপর ওয়াজিব করা হয়েছে?’ মহানবী (সা.) তাঁদেরকে বললেন : ‘আলী, ফাতেমা এবং তাদের দু’পুত্র। এ কথা তিনি তিনবার বললেন।
ইমাম শাফেয়ী যথার্থ বলেছেন :
ياَ اَلِ بَيْتِ رَسُـولِ اللهِ حُـبُّكُمْ * فَرْضٌ مِنْ اللهِ فِي الْقُرْاَنِ اَنْزَلَهُ
كَفَاكم مِنْ عَظِيـمِ الْفَخْرِ اَنَّكُمْ * مَنْ لَمْ يُصَلِّ عَلَيْكُمْ لاَ صلاَةَ لَهُ
‘হে রাসূলুল্লাহ্র আহলে বাইত! তোমাদের ভালোবাসা
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয এবং তা তিনি পবিত্র কুরআনে অবতীর্ণ করেছেন
তোমাদের গর্বের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে,
যে ব্যক্তি তোমাদের ওপর দরূদ পড়বে না তার নামাযই হবে না।’
ওপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন পূত-পবিত্র চরিত্র ও বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক অসাধারণ মহাপুরুষ যিনি মহানবীর আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য, মহানবীর নবুওয়াতের সাক্ষ্যদাতা, বেহেশতের যুবকদের নেতা। মহান আল্লাহ তাঁকে এ সুমহান মর্যাদার অধিকারী করেছেন। তাঁর রয়েছে পবিত্র কুরআনের সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তিনি সত্যের মূর্ত প্রতীক। তিনি মহানবী থেকে এবং মহানবীও তাঁর থেকে। কুরআনের নির্দেশে তাঁকে ভালোবাসা মুসলিম উম্মাহ্ ওপর ফরয। ইমাম হোসাইন (আ.) সংক্রান্ত এ সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদেরকে তাঁর সুমহান আন্দোলন, চরম আত্মত্যাগ এবং তাঁর শাহাদাতের সঠিক মূল্যায়ন করতে সাহায্য করবে। তবে এখানে একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুবই প্রয়োজন। আর তা হলো : মহানবী (সা.)-এর ওফাতের মাত্র ৫০ বছর পর উমাইয়্যা বংশের লম্পট, পথভ্রষ্ট শাসক ইয়াযীদ ও তার সহযোগী বনী উমাইয়্যা (উবাদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদ ও তার অনুচরগণ) কীভাবে মুসলিম উম্মাহ্ চোখের সামনে মহানবীর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র বেহেশতের যুবকদের নেতা আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমাম হোসাইনকে কারবালার মরুপ্রান্তরে সপরিবারে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে যা বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসাবে স্থান করে নিয়েছে? উম্মত কীভাবে এ রকম বিচ্যুতির শিকার হলো? কী ভয়ানক ও জঘন্য অপরাধ ও বিদ্আতের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেল মুসলিম উম্মাহ্? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হলে কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সন্ধান করতে হবে।
বনী হাশেম ও বনী উমাইয়্যার মধ্যকার দ্বন্দ্ব সুপ্রাচীন এবং তার উদ্ভব মহামতি হাশেম ও তদীয় ভ্রাতুষ্পুত্র উমাইয়্যা ইবনে আবদে শামসের মধ্যকার দ্বন্দ্ব থেকে। হাশেম ছিলেন মহানবীর প্রপিতামহ। তিনি উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং জ্ঞানী-গুণী হওয়ার কারণে মক্কার ধর্মীয় কর্তৃত্ব, পবিত্র কাবার দেখাশোনা ও বাৎসরিক হজ্ব উদ্যাপন ও এর সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব লাভ করেন। এর ফলে হাশেমের সুখ্যাতি ও প্রভাব মক্কা ও তার আশে-পাশে, এমনকি সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়ে যা উমাইয়্যা ইবনে আবদে শামসের তীব্র মর্মজ্বালা, হিংসা ও বিদ্বেষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরশ্রীকাতর উমাইয়্যা চাচার সুখ্যাতি ও প্রভাব সহ্য করতে না পেরে চাচার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। স্মর্তব্য যে, উমাইয়্যা কেবল ধনাঢ্য পুঁজিপতিই ছিল তবে তার কোনো নৈতিক চরিত্র ছিল না। তার চিন্তাধারা ছিল সে সময়ে প্রচলিত সংকীর্ণ জাহেলী চিন্তাধারা থেকেই উৎসারিত। কালক্রমে এ দ্বন্দ্ব বনী উমাইয়্যা ও বনী হাশেমের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে হাশেমের পর হাশেমের পুত্র আবদুল মুত্তালিব এবং তাঁর পর তাঁর পুত্র আবু তালিব পবিত্র মক্কা নগরীর সার্বিক ধর্মীয় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করেন তাঁদের উন্নত চরিত্র ও মহানুভবতার কারণেই। কিন্তু বনী উমাইয়্যা বিস্তর বিত্ত-বিভবের অধিকারী হয়েও আরবের বুকে নেতৃত্ব ও দুর্লভ সম্মান লাভ করতে পারেনি তাদের হীনমন্যতা, দুর্নীতি, অনৈতিকতা, অসৎ চরিত্র এবং লাম্পট্যেরই কারণে। হযরত আবু তালিবের সময় মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বিশ্বমানবতার মুক্তির জন্য সত্যধর্ম ইসলাম নিয়ে আবির্ভূত হন। সাথে সাথে তিনি পিতৃব্য আবু তালিব ও স্বীয় গোত্র বনী হাশেমের অকুণ্ঠ নৈতিক সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আর মক্কার মুশরিক কুরাইশদের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হন। হাশেমী হওয়ার কারণে মহানবী (সা.) ও বনী হাশেমের প্রতি বনী উমাইয়্যার ক্ষক্ষাভ, হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা চরম আকার ধারণ করে। আমরা দেখতে পাই, মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর ১৩ বছর ধরে বনী উমাইয়্যা মক্কার অন্যান্য কুরাইশ শাখা ও উপগোত্রের সাথে সম্মিলিতভাবে মহানবী (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের ওপর অবর্ণনীয় দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছে। মহানবী (সা.) ও বনী হাশেমকে তিন বছর সামাজিকভাবে পূর্ণ বয়কট ও শে’বে আবু তালিবে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল। এ সব জুলুম ও অপকর্ম আঞ্জাম দেয়ার প্রথম সারিতেই ছিল বনী উমাইয়্যার অবস্থান।
অপরদিকে দেখতে পাই বনী হাশেম, বিশেষ করে আবু তালিব নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কুরাইশদের ষড়যন্ত্র ও নাশকতামূলক কাজ থেকে মহানবীকে রক্ষা করেছেন । মৃত্যুকালে আবু তালিব নিজ পুত্রদের ও বনী হাশেমকে মহানবীর প্রতি সমর্থন ও তাঁকে কুরাইশদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি নেন এবং তাঁদেরকে বুঝিয়ে দেন যে, তাঁদের সার্বিক সাফল্য নিহিত রয়েছে মহানবী ও তাঁর আনীত ধর্মে। হযরত আবু তালিব ও হযরত খাদিজার মৃত্যুর পর মহানবী (সা.) ও মুসলমানদের ওপর মক্কার কুরাইশদের অত্যাচার তীব্র আকার ধারণ করে। তারা এমনকি মহানবীর প্রাণনাশ করার সিদ্ধান্ত নিলে মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি আলীকে তাঁর গৃহে রেখে মদীনায় হিজরত করেন। হিজরতের রাতে হযরত আলীর অপার আত্মত্যাগ ও চরম ঝুঁকি নেয়ার কারণে মহানবী (সা.) নিরাপদে মক্কানগরী ত্যাগ করেন। মদীনায় আগমনের পর মহানবী (সা.) সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করলেন। তারপর থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর মক্কার কুরাইশ বহুবার মহানবী ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। আর এসব যুদ্ধে বনী উমাইয়্যা সক্রিয় অংশগ্রহণ তো করেছেই; বরং মক্কা বিজয়ের পূর্বে শেষের চার-পাঁচ বছরে যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে আবু সুফিয়ান বিন্ হার্ব্ বিন্ উমাইয়্যা মহানবী ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐ সব যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। মক্কা বিজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মক্কার কুরাইশ ও বনী উমাইয়্যা সর্বাত্মকভাবে ইসলাম ও মহানবীর বিরুদ্ধাচরণ ও শত্রুতা করেছে।
অবশেষে মক্কা বিজয়ের দিবসে যখন প্রতিরোধের সব পথ মুশরিক কুরাইশ ও বনী উমাইয়্যার সামনে রুদ্ধ হয়ে যায় তখনই তারা নিরুপায় হয়ে মহানবী (সা.) কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা লাভ করে জীবন বাঁচানোর তাগিদে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। আম্মার ইবনে ইয়াসিরের ভাষায়-
اِسْتَسْلَمُوْا وَلَمْ يُسْلِمُوا
‘তারা (ইসলাম গ্রহণের ভান করে) আত্মসমর্পণ করেছে মাত্র তবে ইসলাম কবুল করেনি।’
এরা তুলাকা (طُلَقَاءُطُلَقَاءُ) ও মুয়াল্লাফাতুল্ কুলূব অর্থাৎ সাধারণ ক্ষমাপ্রাপ্ত ও বৈষয়িক সুবিধা ও সাহায্য প্রাপ্তির কারণে ইসলাম গ্রহণকারী বলে ইতিহাসে খ্যাত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ান ইবন্ হার্ব ও তার পুত্র মু’আবিয়া মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম গ্রহণ করে। মহানবী (সা.) ছিলেন দয়ার নবী-রহমতের নবী। তিনি চাইতেন তাঁর চরম শত্রুও ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে মুক্তি পাক। তাই মক্কা বিজয়ের পর তিনি বিগত বছরগুলোর শত্রুতা, অত্যাচার ও নির্যাতনের প্রতিশোধ না নিয়ে বরং তাদের ক্ষমা করে ইসলামের কল্যাণ লাভ করার সুবর্ণ সুযোগ দেন। তবে তিনি তাদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হয়েও তাদের ওপর সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতেন এবং তাদের পূর্ববর্তী কার্যকলাপের জন্য ন্যায়সঙ্গত কারণেই তাদেরকে কোনো প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদ দেননি। কিন্তু আফসোস! এসব তুলাকা ও মুয়াল্লাফাতুল কুলূব এবং বনী উমাইয়্যা মহানবীর এ ধরনের আচরণ থেকে আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও ঈমানীভাবে যে বিন্দুমাত্র উপকৃত হয়নি তার যথার্থ প্রমাণ মেলে মহানবী (সা.)-এর ওফাতের ২৫ বছর পর সিফ্ফীনে সুপথপ্রাপ্ত খলিফা হযরত আলীর বিরুদ্ধে সিরিয়ার বিদ্রোহী আমীর মু’আবিয়া কর্তৃক পরিচালিত যুদ্ধে। এ যুদ্ধে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির বিদ্রোহী আমীর মু’আবিয়া ও তাঁর দলের হাতে শাহাদাত বরণ করেন যার সংবাদ দিয়েছিলেন মহানবী (সা.) বহু বছর আগেই। মহানবী (সা.) আম্মারকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন : ‘হায় আম্মার! বিদ্রোহী দলটি তাকে হত্যা করবে; তাদেরকে সে জান্নাতের দিকে আহ্বান করবে, আর তারা তাকে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করবে।’ [সহীহ বুখারী, আবু সাঈদ খুদ্রী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত মসজিদে নববীর নির্মাণ সম্পর্কিত হাদীস।]
উম্মত যাতে তাঁর অবর্তমানে ভবিষ্যতে বিভ্রান্ত না হয় সেজন্য মহানবী (সা.) উপযুক্ত বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ভবিষ্যতে উম্মতের হেদায়াত, ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু এবং বিভক্তির হাত থেকে রক্ষাকবচস্বরূপ তিনি তাঁর মহান আহলে বাইতকে তাঁর ওফাতের বহু আগেই বিভিন্ন উপলক্ষে উম্মতের কাছে পরিচিত করিয়েছেন। যেমন আয়াতুত্ তাত্হীরের শানে নুযূল সংক্রান্ত অগণিত হাদীস, হাদীসে কিসা, হাদীসে সাকালাইন ইত্যাদি।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের মধ্যে মহানবীর উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করা সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতিগুলো বাস্তবসম্মত না হওয়ার কারণে মহানবীর ওফাতের ৩০ বছরের মধ্যেই মুসলিম উম্মাহ্ শাসন কর্তৃত্ব ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বনী উমাইয়্যার হাতে চলে যায় এবং ইসলামে প্রথম রাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন হয় স্বয়ং মু’আবিয়া ও বনী উমাইয়্যার হাতে।
মহানবীর ওফাতের পরে প্রথম খলিফার আমলেই ইসলাম ও মহানবীর বিরুদ্ধাচারী আবু সুফিয়ান পরিবার শামের (সিরিয়ার) শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে। আল্লামা সূয়ূতী তাঁর ‘তারীখুল খুলাফা’ (খলিফাদের ইতিহাস) গ্রন্থে লিখেছেন :
ولما بعث ابوبكر الجيوش الـى الشام سـار مـعاوية مع اخيه يزيد بن ابـى سفيان فلما مات يزيد استخلفه علـى دمشق فأقره عمر ثم اقره عثمان وجمع له الشام كله فاقام أميرا عشرين سنة وخليفة عشرين سنة
‘যখন খলিফা আবু বকর শামে সেনাবাহিনী প্রেরণ করলেন তখন মু’আবিয়া তাঁর ভ্রাতা ইয়াযীদ ইবনে আবু সুফিয়ানের সাথে শাম গমন করেন। অতঃপর ইয়াযীদের মৃত্যু হলে খলিফা আবু বকর মু’আবিয়াকে শামের শাসক (গভর্নর) নিযুক্ত করেন। এরপর দ্বিতীয় খলিফা উমর এবং তারপর তৃতীয় খলিফা উসমান তাঁকে শামের গভর্নর পদে বহাল রাখেন। সমগ্র শাম তার শাসনাধীনে দেয়া হয়। মু’আবিয়া ২০ বৎসর আমীর (গভর্নর) এবং ২০ বছর খলিফা ছিলেন।’’ (তারীখুল খুলাফা. পৃ. ১৯৪, দারুল কালাম আল আরাবী, সিরিয়া কর্তৃক মুদ্রিত)
খলিফা হওয়ার আগে আমীর মু’আবিয়া ২০ বছর শামের গভর্নর ছিলেন। এ ২০ বছর নেহায়েৎ কম সময় নয়। হযরত উমরের আমলে আমীর মু’আবিয়া শামের রাজধানী দামেস্কে এক বিরাট জমকালো প্রাসাদ নির্মাণ করেন যা ইতিহাসে ‘সবুজ প্রাসাদ’ (القصر الاخضرالاخضر) বলে খ্যাতি লাভ করেছে। তাঁর রাজকীয় চাল-চলনের কারণে খলিফা উমর তাঁকে كسرى العرب বা ‘আরবের খসরু’ বলে অভিহিত করতেন। হযরত উসমানের শাসনামল থেকেই এক রকম স্বাধীনভাবে শামের শাসন পরিচালনা করতে থাকেন আমীর মু’আবিয়া।
তৃতীয় খলিফার আমলে বনী উমাইয়্যা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে ও বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরের পদে নিযুক্ত হওয়ার ফলে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারী হয়ে যায়। তারা তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য প্রশাসন যন্ত্র, খেলাফত ও বাইতুল মাল অন্যায়ভাবে ব্যবহার করতে থাকে। তাদের দুঃশাসন, অপকীর্তি ও দুর্নীতির কারণে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে চরম বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, বিদ্রোহ এবং অসন্তোষ দেখা দেয় যা সরলমতি তৃতীয় খলিফা সমাধান করতে এবং জ্ঞাতি উমাইয়্যা বংশীয়দের দমন ও অপকর্ম করা থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হন। যে মারওয়ান ও তার পিতা হাকাম মহানবী (সা.) কর্তৃক মদীনা থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল এবং পূর্ববর্তী দুই খলিফার আমলেও মদীনায় প্রত্যাবর্তনের অনুমতি পায়নি হযরত উসমান খলিফা হয়েই তাদেরকে মদীনায় পুনর্বাসিত করেন। শুধু তা-ই নয়, লম্পট মারওয়ান খলিফার ব্যক্তিগত সচিবের পদও লাভ করে। এ পদ লাভ করেই মারওয়ান তৃতীয় খলিফার সিলমোহর জাল করে কত যে অপকর্ম সংঘটিত করেছে তার হিসাব নেই। অবশেষে বনী উমাইয়্যার দুর্নীতি এবং মারওয়ানের অপকর্মের ফলে তৃতীয় খলিফা নিহত হন। হযরত উসমানের খিলাফত লাভ করার পর বনী উমাইয়্যা, বিশেষ করে আমীর মু’আবিয়া খলিফা হওয়া এবং বংশানুক্রমিক ও রাজতান্ত্রিক উপায়ে খেলাফত কুক্ষিগত করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তৃতীয় খলিফার হত্যাকাণ্ড মু’আবিয়ার কাছে লালিত আশা পূরণ করার দুর্লভ সুযোগ এনে দেয়। খলিফা উসমান হত্যার বদৌলতে বনী উমাইয়্যা, বিশেষ করে মু’আবিয়া রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির পাশাপাশি নিজেদের গায়ে ধর্মের লেবেল এটে ধার্মিক সাজারও মোক্ষম সুযোগ লাভ করে। আমীর মু’আবিয়া উদ্ভূত এ পরিস্থিতি সুকৌশলে ব্যবহার করে রাতারাতি খলিফা উসমানের ওপর নির্যাতনের (মাযলূমীয়াত) ও তাঁর রক্তের প্রতিশোধের দাবিদার হয়ে যান এবং শাম ও অন্যান্য এলাকার জনমনে ব্যাপক প্রভাব ফেলার চেষ্টা করেন। হযরত আলী এ ধরনের এক ক্রান্তিকালে মুসলিম জাহানের খলিফা হন।
পক্ষান্তরে মহানবীর আহলে বাইতের সদস্যগণ এবং বনী হাশেম বরাবরই সব দিক থেকে উপেক্ষিত থাকেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মক্কা বিজয়ের দিনে কৌশলগত কারণে ইসলাম গ্রহণকারী কুরাইশ ও বনী উমাইয়্যা মহানবীর ওফাতের পরপরই ক্ষমতা ও শক্তির কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়ায় বনী হাশেম, বিশেষ করে নবীর আহলে বাইতের ওপর যুগ যুগ ধরে লালিত শত্রুতা, হিংসা-দ্বেষ এবং প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবণতার লেলিহান শিখা তাদের অন্তরে আবার প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে এবং মরণ আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। খলিফা উসমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রহেলিকাময় পরিস্থিতিতে হযরত আলী খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করলে বনী উমাইয়্যার ধৈর্যের বাঁধ যেন ভেঙে যায়। আমীর মু’আবিয়ার দুষ্কর্মের জন্য হযরত আলী খলিফা হয়েই তাঁকে বরখাস্ত করলে তিনি বিদ্রোহ করেন। ইতোমধ্যে মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ ‘জঙ্গে জামাল’-এর কারণে আমীর মু’আবিয়া হযরত আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহী ও সাহসী হন। হযরত আলীর বিরুদ্ধে আমীর মু’আবিয়া সিফ্ফীনে নাহক যুদ্ধে লিপ্ত হন। এ যুদ্ধে আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) হযরত আলীর পক্ষে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তাঁর শাহাদাতের মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয় এবং প্রমাণিত হয়ে যায় যে, আমীর মু’আবিয়া ও তাঁর দলবল ছিল সেই ‘বিদ্রোহী গোষ্ঠী’ এবং হযরত আলী সত্যপন্থী। অথচ আফসোস্! সেদিনের জনগণ মোটেও এ সত্য উপলব্ধি করতে পারেনি। যুদ্ধে পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমর ইবনুল আস ও মু’আবিয়া যে ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছিলো তার ফলে সিফ্ফীনের ময়দানে আরেকটি নতুন ফিতনার জন্ম হয় যা ‘খারেজী ফিতনা’ নামে পরিচিত।
যা হোক খারেজী ফিতনার কারণে ইসলামের ৪র্থ খলিফা হযরত আলীকে শাহাদাত বরণ করতে হলো। তাঁর শাহাদাত বরণের মাধ্যমে আমীর মু’আবিয়া খিলাফত হস্তগত করার অপূর্ব সুযোগ পেয়ে গেলেন। তিনি হযরত আলী কর্তৃক মনোনীত খলিফা ইমাম হাসানের বিরুদ্ধে ব্যাপক শক্তি নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন। দীর্ঘদিন শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সুবাদে আমীর মু’আবিয়া এবং বনী উমাইয়্যা শাসন ক্ষমতা, অর্থবল ও লোকবলের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ্ এক বিরাট অংশের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল আর খলিফা উসমানের হত্যাকাণ্ড, সিফ্ফীনের যুদ্ধ এবং দাওমাতুল জুন্দলের সালিশীর ফলাফল, খারেজী ফিতনার উদ্ভব, হযরত আলীর শাহাদাত ইত্যাদি কারণে আমীর মু’আবিয়া প্রভাব-প্রতিপত্তি আরো বৃদ্ধি পায়। এদিকে দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ও প্রশাসনিক ক্ষমতা থেকে দূরে থাকার কারণে আহলে বাইত ও বনী হাশেম কার্যত নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তখনকার মুসলিম উম্মাহও প্রকৃতপক্ষে নিঃসঙ্গ আহলে বাইতের পাশে এসে দাঁড়ায়নি, তাঁদের নীতি অবস্থানকে সমর্থন করেনি। ফলে ইমাম হাসান খিলাফতের পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন এবং আমীর মু’আবিয়ার অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হল। তিনি ইসলামী বিশ্বের খলিফা হয়ে গেলো। তাঁর খিলাফতকাল সুদীর্ঘ ২০ বছর স্থায়ী হয়। যুগের পর যুগ ধরে বনী উমাইয়্যা যে হিংসা-দ্বেষ বনী হাশেমের প্রতি পোষণ করে আসছিল এবং মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে যার আপতত সমাপ্তি ঘটেছিল তা নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং আমীর মু’আবিয়ার খিলাফতকালে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং মু’আবিয়া পাপিষ্ঠ ইয়াযীদের খলিফা হওয়ার মধ্য দিয়ে যার বিকাশ সংঘটিত হয় এবং এ পাপিষ্ঠের আমলে কারবালায় ইমাম হোসাইনের নির্মম শাহাদাতের মাধ্যমে এর চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বস্তুত বনী হাশেম ও বনী উমাইয়্যার মধ্যকার দ্বন্দ্ব সত্য, ন্যায়পরায়ণ, সততা ও সাধুতার সাথে মিথ্যা, দূরাচার, অন্যায়, জুলুম ও দুর্নীতির দ্বন্দ্ব। আর এ দ্বন্দ্বেরই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনায়।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সুমহান-মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব এবং কারবালার ঘটনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ইমাম হোসাইনের কিয়াম ও আন্দোলনের স্বরূপ যথার্থভাবে উপলদ্ধি করতে সাহায্য করবে। ইমাম হোসাইনের আন্দোলন ও শাহাদত কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। বরং তা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত একটি বিপ্লব যার রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর পুণ্যবান আহলে বাইত। তাই এটাকে নিছক বিদ্রোহ এবং অপরিকল্পিত আন্দোলন যা ব্যর্থ হয়েছে বা মুসলিম উম্মাহ্ বা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলা মোটেও সমীচীন হবে না।
ইমাম হোসাইনের আন্দোলন ছিল একটি ঐশী আধ্যাত্মিক আন্দোলন- ইসলাম ধর্মকে বিকৃতির হাত থেকে মুসলিম উম্মাহকে ও পথভ্রষ্টতার হাত থেকে রক্ষা করা এবং মযলূমকে যালিমের হাত থেকে উদ্ধার করার আন্দোলন। ইমাম হোসাইনের আন্দোলন ছিল সত্যের প্রতিষ্ঠা ও মিথ্যার মূলোৎপাটনের আন্দোলন। মোটকথা এটি একটি পূর্ণ আন্দোলন। একটি সফল আদর্শ আন্দোলনের সমুদয় দিক- নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের আধ্যাত্মিক ও তাত্ত্বিক দিকও এ আন্দোলনে রয়েছে। মানবীয় সুকুমার চরিত্রের পূর্ণমাত্রার বিকাশও পরিলক্ষিত হয় এ আন্দোলনে। আর তা হতেই হবে। কারণ, এ আন্দোলনের রূপকার মহান আল্লাহর রাসূল নিজে এবং এর নেতৃত্বে ছিলেন বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হোসাইন। মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময় তাঁর উম্মতকে এ আন্দোলন সম্পর্কে-কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা সম্পর্কে বহুবার অবহিত করেছেন। সাবধান করেছেন যাতে তারা সত্য পক্ষ অবলম্বন করতে পারে- প্রহেলিকাময় প্রচার-প্রপাগান্ডার ধূম্রজালে আবদ্ধ হয়ে সত্য চিনতে ভুল না করে। তারা যেন সে সময় তাঁর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের সাথে থেকে বিচ্যুতির হাত থেকে রেহাই পায়। [আল্লামাহ্ ইবনে হাজার আসাকালানী প্রণীত তাহ্যীবুত্ তাহযীব : আল হোসাইন ইবন আলী ইবন আবি তালিব সংক্রান্ত বিবরণ (পৃ. ৩৪৫-৩৪৯)]
ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের উপাদানসমূহ
ক. বাইআত প্রসঙ্গ;
খ. কুফাবাসীর দাওয়াত প্রসঙ্গ এবং
গ. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ।
বাইআত প্রসঙ্গ
নিঃসন্দেহে দুশ্চরিত্র পুত্র ইয়াযীদকে খিলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনীত করার মাধ্যমে ইসলামী খিলাফতকে বংশীয় রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত করেন আমীর মু’আবিয়া। আর এটা ছিল ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ্ ওপর আপতিত অন্যতম বড় মুসিবত। ইমাম হোসাইন (আ.) এ জঘন্য বিদআতকে মূলোৎপাটন করার জন্য নিজ সঙ্গী-সাথীসহ কারবালায় অত্যন্ত নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। ইয়াযীদের প্রতি বাইআত প্রত্যাখ্যান করে ইমাম হোসাইন (আ.) মদীনার গভর্নর ওয়ালীদ বিন উত্বার কাছে ইয়াযীদের জঘন্য চরিত্র উন্মোচিত করে বলেছিলেন : ‘নিঃসন্দেহে ইয়াযীদ ইবনে মু’আবিয়া একজন ফাসেক মদ্যপ ব্যক্তি। সে সম্মানিত প্রাণের হত্যাকারী, প্রকাশ্যে কুকর্ম ও ব্যভিচারে লিপ্ত ও লম্পট। আমার মতো কোনো ব্যক্তি ইয়াযীদের মতো ব্যক্তির বাইআত করবে না। (হায়াতুল ইমাম আল্-হোসাইন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৫৫)
মুন্যির্ ইবনে যুবাইর বলেছেন : ‘খোদার শপথ, ইয়াযীদ মদপানকারী। খোদার শপথ, নামায তরক করা পর্যন্ত সে মাতাল থাকে। (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮ম খণ্ড, পৃ. ২১৬ এবং ইবনে আসীর প্রণীত আল-কামেল ফীত্ তারীখ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৫)
ইয়াযীদ থেকে বর্ণিত কুফ্রী কবিতার পঙ্ক্তি :
‘আহমদের ধর্মে যদি নিষিদ্ধ হয়
তাহলে ঈসা মসীহ্’র ধর্মের ভিত্তিতে মদপান কর।’
(তাতিম্মাতুল্ মুন্তাহা, পৃ. ১৩)
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইয়াযীদ ছিল দুশ্চরিত্র ও লম্পট এবং ইসলামী খিলাফতের সম্পূর্ণ অযোগ্য।
ইয়াযীদের খলিফা হওয়ার সাথে সাথে মুসলিম উম্মাহ্ জীবন থেকে ইসলাম ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ ও এর নাম-নিশানা মিটিয়ে ফেলার অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র চরমাকার ধারণ করে। যাতে এ ষড়যন্ত্র সফল হয় সেজন্য ইয়াযীদ খিলাফতের মসনদে বসেই মদীনার গভর্নরকে বল প্রয়োগ করে ইমাম হোসাইনের বাইআত গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়। ইয়াযীদকে মেনে নেয়া ও তার হাতে বাইআত করার অর্থই হলো বনী উমাইয়ার, দুষ্কর্ম, কুকর্ম ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের অনুমোদন এবং ইসলাম, পবিত্র কুরান ও মহানবীর পবিত্র সুন্নাহকে জলাঞ্জলি দেয়া। তাই ইমাম হোসাইন পূর্ণ সাহসিকতার সাথে ইয়াযীদের আনুগত্য ও বাইআতকে প্রত্যাখ্যান করে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের পথ বেছে নেন। ইমাম বলেছিলেন : ‘যখন উম্মাহ্ ইয়াযীদের মতো কোনো শাসকের খপ্পড়ে পড়বে তখন ইসলামকে বিদায় সম্ভাষণসূচক সালাম জানাতে হবে।’
কুফাবাসীর দাওয়াত প্রসঙ্গ
বাইআত প্রত্যাখ্যান করার তিন দিন পরে ইমাম হোসাইন (আ.) সপরিবারে মহান বিপ্লবকে সফল করার জন্য মদীনা ত্যাগ করে পবিত্র মক্কায় চলে আসেন। মক্কায় তিনি তাঁর বৈপ্লবিক আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং ইয়াযীদ ও বনী উমাইয়্যার প্রকৃত চেহারা তুলে ধরেন মক্কাবাসী ও সেখানে আগত মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা ও জনপদের অধিবাসীদের কাছে। এ সময় তিনি কুফাবাসীর দাওয়াত পান। কুফা ছিল তখন জনবহুল এবং সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী শহর। এ শহরটি দ্বিতীয় খলিফার আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় কেবল কুফাই পারতো বনী উমাইয়্যা প্রভাবিত শাম ও দামেস্কের মোকাবিলা করতে। এক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের আর কোনো নগর, জনপদ কুফা নগরীর সমকক্ষ ছিল না।
হযরত আলী ও হযরত হাসানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের ফলে যখন উমাইয়্যা কুশাসন কুফাবাসীর ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসল তখন তাদের বোধোদয় হল। তারা এ অবস্থার অবসান ঘটাতে চাইল। যখন তারা শুনল যে, ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযীদের হাতে বাইআত না করে মক্কায় চলে এসেছেন তখন তারা আরো উৎসাহী হল। তারা পত্রের পর পত্র পাঠিয়ে ইমাম হোসাইনকে কুফায় আসার দাওয়াত দিল এবং জানাল যে, তারা তাঁর নেতৃত্বে ইয়াযিদী শাসনের নাগপাশ থেকে কুফা মুক্ত করে আবার সেখানে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করবে। পরবর্তী পর্যায়ে তারা সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে ইয়াযীদ ও বনী উমাইয়্যার শাসন থেকে মুক্ত করে প্রকৃত ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করবে। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে : কুফাবাসীর পক্ষ থেকে ১৮,০০০-এর অধিক পত্র ইমামের কাছে প্রেরিত হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এটা ছিল এক মহা আহ্বান যা কোনো সত্যাশ্রয়ী নেতার পক্ষে উপেক্ষা করা অশোভন এবং অনুচিত। তাই ইমাম তাদের আহবানে ইতিবাচক সাড়া দিলেন তবে যথাযথ সতর্কতাও অবলম্বন করলেন। কারণ, তিনি কুফাবাসীর অস্থিরচিত্ততা ও বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে বেশ ভালোভাবে জানতেন। সেজন্য তিনি তাঁর পিতৃব্যপুত্র মুসলিম ইবনে আকীলকে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে কুফায় প্রেরণ করলেন। মুসলিম ইবনে আকীল যখন কুফার সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ইমামের কাছে ইতিবাচক বিবরণ পাঠিয়ে তাঁকে কুফায় আসার আমন্ত্রণ জানালেন তখনই ইমাম হোসাইন কুফায় যাওয়া ও সেখানকার অধিবাসীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে সেখান থেকে তাঁর আন্দোলন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এদিকে ইয়াযীদের গুপ্তঘাতকদের আনাগোনা ও মক্কায় হজ্ব চলাকালীন তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের কথা যখন ইমাম হোসাইন জানতে পেলেন তখন তিনি হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা ত্যাগ করে কুফা অভিমুখে সপরিবারে যাত্রা করলেন। কারণ, তিনি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইয়াযীদের হাতে বাইআত না করে যেখানেই তিনি যান না কেনো ইয়াযীদের গুপ্তঘাতক বাহিনী তাঁর পিছু ছাড়বে না এবং তাঁকে হত্যা করবেই। তিনি যদি ইয়াযীদের গুপ্তঘাতকদের হাতে প্রাণ হারান তাহলে এভাবে নিহত হওয়ায় বনী উমাইয়্যা ও ইয়াযীদের কোনো ক্ষতি হবে না বরং তারা এ থেকে লাভবান এবং মুসলিম উম্মাহ্ও ইমাম হোসাইনের শহীদ হওয়ার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বুঝতে পারবে না। ফলে ইমাম হোসাইন যে বিপ্লব ও আন্দোলনের দিকে সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছেন তা ব্যর্থ হয়ে যাবে এবং এর ফলে দীন ইসলাম হুমকির সম্মুখীন হবে। তাই তিনি কুফায় যাওয়ার প্রাক্কালে অনেক শুভাকাঙক্ষীর কুফায় না যাওয়ার উপদেশ, মক্কায় থাকা বা মক্কা ছেড়ে অন্য কোনো সুরক্ষিত নিরাপদ এলাকা, যেমন ইয়েমেনে আশ্রয় নেয়া বা কুফায় যেতে হলে সপরিবারে না গিয়ে একাকী যাওয়ার পরামর্শ বিনম্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইমাম হোসাইন এ ব্যাপারে সত্যিকার দূরদর্শী নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যদি কুফাবাসীর আহবানে সাড়া না দিয়ে মক্কায় থেকে যেতেন বা অন্যত্র চলে যেতেন তাহলে পরবর্তীকালে যে সব ঐতিহাসিক তাঁর কুফা গমনকে অদূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক ভুল বলে আখ্যায়িত করেছেন তাঁরাই তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে বলতো তিনি কুফাবাসীর আহবানে কেনো সাড়া দিলেন না? যদিও কুফাবাসী বিশ্বাসঘাতক ও চঞ্চলমতি তবুও যদি তিনি তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে কুফায় যেতেন তাহলে হয়তোবা কুফাবাসী এ দফায় তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করত না এবং তাঁর নেতৃত্বে বিপ্লবে অংশ নিয়ে স্বৈরাচারী ইয়াযিদী-উমাইয়্যা শাসনকে উৎখাত করে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারত। অথচ ইমাম এ সম্ভাবনাময় গণজাগরণের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করলেন না।’ এভাবে তাঁকে দোষারোপ এবং তাঁর আন্দোলন ও নীতি-অবস্থানের সমালোচনা ও অবমূল্যায়ন করা হতো। যদি কুফাবাসীর এ আহ্বান বা দাওয়াত না থাকত তাহলে তিনি হয়তো অন্য জায়গায় চলে যেতেন যেখান থেকে তিনি তাঁর আন্দোলন চালিয়ে যেতেন। কুফাবাসীর আহবানের কারণে তিনি কুফাকে তাঁর আন্দোলন পরিচালনা করার কেন্দ্র হিসাবে বেছে নিলেন মাত্র। কুফার স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব এবং দামেশ্ককে মোকাবিলা করার ক্ষমতা সম্পর্কে ইমাম পূর্ব হতেই জ্ঞাত ছিলেন। তাই ইমামের সপরিবারে কুফা গমন আসলে সম্পূর্ণ সময়োপযোগী পদক্ষেপই ছিল- কোনো রাজনৈতিক ভুল বা অদূরদর্শিতা ছিল না।
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ
তবে তাৎক্ষণিক ও খণ্ডকালীন (সামরিক) গুরুত্ব ও প্রভাব থাকলেও ইয়াযীদের বাইআতের, চাপ ও কুফাবাসীর দাওয়াতের কোনোটি হোসাইনী আন্দোলনের মূল উপাদান বা কারণ ছিল না। বরং এ আন্দোলনের মূল উপাদান ও কারণটি ছিল আল্-আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ।
ইসলামে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের প্রকৃত তাৎপর্য, গুরুত্ব ও স্থান যদি পরিষ্কার হয়ে যায় তাহলে হোসাইনী আন্দোলন যা হচ্ছে খাঁটি তৌহিদী ইসলামেরই বহিঃপ্রকাশ তাতে এর মৌলিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রতিভাত হবে।
নিঃসন্দেহে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ ইসলাম ও ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি। মুসলিম উম্মাহ্ ঐক্য (যা সর্বশ্রেষ্ঠ সৎ কাজ) রক্ষা, বিচ্যুতির হাত থেকে উম্মাহ্, ইসলাম এবং ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রকে সংরক্ষণ, ইসলামী বিধি-বিধানের সফল ও সঠিক প্রয়োগের নিশ্চয়তা, শির্ক, কুফ্র ও সকল প্রকার অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার, দুষ্কর্ম ও দুর্নীতির উচ্ছেদ এবং মুসলিম উম্মাহ্ ও ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রের উত্তরোত্তর উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি কখনোই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ ব্যতীত সম্ভব নয়। তাই সত্যিকার ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রে এ বিষয়টি সব সময় সজীব ও প্রাণবন্ত থাকবে। আসলেই এর কোনো বিকল্প নেই। কোনো মুমিন ব্যক্তিই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধে যথাযথ আমল করা ব্যতীত ঈমান, নৈতিকতা, মারেফত (খোদা-পরিচিতি) ও আধ্যাত্মিকতার শীর্ষে কখনোই পৌঁছতে পারবে না। পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হওয়ার পূর্বশর্তই হচ্ছে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ। বলা হচ্ছে :
‘হে মুসলমানগণ! তোমরাই হলে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি বা উম্মাহ্ তোমাদেরকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে।’ (সূরা আলে-ইমরান : ১১০)
পবিত্র কুরআনে বলা হচ্ছে :
‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি গোষ্ঠী থাকবে যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে। সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং তারাই হবে সফলকাম।’
(সূরা আলে-ইমরান : ১০৪)
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে। আয়াতটিতে যে গোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে তাঁদের মধ্যে যাবতীয় পূর্বশর্ত পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং সর্বোত্তম উপায়ে তাঁরা সমাজে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করেন। আর পরিণামে এরাই হবে সফলকাম। তাঁরা যেমন নিজেদেরকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান তেমনিভাবে গোটা সমাজকেও সাফল্যের পথে নিয়ে যাবেন সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ-এ মূলনীতি পালন করার মাধ্যমে। এর পূর্বশর্তসমূহ সূরা তওবার ১১২ নং আয়াতে বিধৃত হয়েছে :
‘তাঁরা তওবাকারী, ইবাদাতকারী, আল্লাহ্র প্রশংসাকারী, সিয়াম পালনকারী, রুকু ও সিজদাকারী, সৎ কাজের আদেশদাতা ও অসৎ কাজের বাধাদানকারী এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা রক্ষণকারী; এই মুমিনদেরকে সুসংবাদ দাও।’ (সূরা তওবা : ১১২)
অর্থাৎ, ‘যাঁরা তওবাকারী, ইবাদাতকারী, আল্লাহ্র প্রশংসাকারী, সিয়াম পালনকারী, রুকু ও সিজদাকারী, সৎ কাজের আদেশদাতা ও অসৎ কাজের বাধাদানকারী, তাঁরা আলোকোজ্জ্বল চিন্তা, ঈমান, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করেছেন এবং এরপর তিনি সমাজের সংস্কার ও সংশোধনের কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। অর্থাৎ এক কথায় তিনি (সৎ কাজের আদেশ দাতা ও অসৎ কাজের বাধাদানকারী) একজন সমাজ সংস্কারক ও সংশোধক। (আয়াতুল্লাহ মোতাহ্হারী প্রণীত হামাসায়ে হোসাইনী।)
এ আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, ইসলাম ও ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, অগ্রগতি ও বিকাশ আমর বিল্ মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকারের মধ্যেই নিহিত। অতএব, নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, হোসাইনী আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি এবং মূল উপাদানই হচ্ছে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ আন্দোলনের অপর দু’টি কারণ (বাইআত্ ও দাওয়াত) গৌণ। তাই এ দু’টি কারণ যদি বিদ্যমান নাও থাকত তারপরও ইমাম হোসাইন (আ.) সৎ কাজের আদেশ দানকারী ও অসৎ কাজে বাধাদানকারী অর্থাৎ একজন সংস্কারক ও সংশোধক হিসাবে আপাদমস্তক পাপপঙ্কিলতায় নিমজ্জিত সমাজকে সংশোধন করার জন্য অনৈসলামী ইয়াযিদী প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবশ্যই বিদ্রোহ করতেন। ইমাম হোসাইন নিজেই নবীর সুন্নাহ্র অবমাননা ও বিদ্আতের প্রচলন সম্পর্কে বসরার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলেছিলেন :
‘আমি আপনাদেরকে আল-কুরআন ও মহানবীর সুন্নাতের দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ, নবীর পবিত্র সুন্নাহ্র ধ্বংস সাধন করা হয়েছে এবং বিদ্আতের পুনরুজ্জীবন, প্রচার ও প্রচলন করা হয়েছে।’
মুসলিম ইবনে আকীলকে কুফায় পাঠানোর সময় কুফাবাসীর উদ্দেশে প্রেরিত পত্রে ইমাম হোসাইন উল্লেখ করেছিলেন :
‘আমার জীবনের কসম, ইমাম কে? ইমাম হচ্ছে সেই যে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী আমল করে, সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে, সত্য ধর্মাবলম্বী ও মহান আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ থেকে নিজকে বাঁচিয়ে রাখে।’
ইমাম হোসাইন মুহম্মদ ইবনে হানাফিয়ার কাছে লিখিত অসিয়তে মক্কা থেকে কুফাপানে যাওয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন :
اِنِّى لَمْ أَخْرُجْ أَشرًا وَ لاَ بَطِرًا وَ لاَ ظِالِمًا وَاِنَّمَا خَرَجْتُ لِطَلَبِ الإصلاحِ فِي اُمَّةِ جَدِّي أُرِيدُ اَنْ آمُرَ بِالْمَعْرُوفِ وَأَنْهَى عَنِ الْمُنْكَرِ وَاسيرَ بِسِيرَهِ جَدِّيْ وَأَبِى عَلِي بِنْ اَبِي طَالِبٍ فَمَنْ قَبِلَنِى بِقُبُوْلِ الْحَقِّ فَاللهُ أَولَى بِالْحَقِّ وَمَنْ رَدَّ عَلَى هَذَا أَصبِرُ
‘আমি প্রবৃত্তির তাড়নার বশবর্তী হয়ে বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার উদ্দেশে বা যালিম হিসাবে (মক্কা থেকে) বের হইনি। আমি তো বের হয়েছি আমার নানার উম্মতকে সংশোধন করার জন্য। আমি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে চাই এবং আমি আমার নানা ও পিতা আলী ইবনে আবু তালিবের জীবন পদ্ধতির ওপর চলতে চাই। অতএব, যে কেউ সত্য গ্রহণ করার মতো আমাকে গ্রহণ করবে মহান আল্লাহই হচ্ছেন সত্যিকারভাবে আমার ও তার জন্য সবচেয়ে উত্তম। আর যদি কেউ এ ব্যাপারে আমাকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে আমি ধৈর্য ধারণ করব (ধৈর্যের সাথে আমি একাই আমার দায়িত্ব পালন করব)।’
কুফার পথে হুর ইবনে ইয়াযীদ রিয়াহীর সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার সময় এক ভাষণে ইমাম হোসাইন বলেছিলেন :
‘হে লোকসকল! মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘‘যে ব্যক্তি কোনো অত্যাচারী, আল্লাহর হারামকে হালাল (বৈধ) কারী, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী এবং রাসূলের সুন্নাতবিরোধী কোনো শাসককে প্রত্যক্ষ করবে যে আল্লাহর বান্দাদের মাঝে পাপাচার এবং আল্লাহর সাথে শত্রুতামূলক মনোবৃত্তি পোষণ করে, সে যদি কথা বা কাজের দ্বারা ঐ শাসককে বাধা না দেয় তাহলে এ ব্যক্তিকে জাহান্নামে ঐ শাসকের ঠিকানায় প্রবেশ করানো মহান আল্লাহ্র জন্য হক বা অধিকার হয়ে যাবে।’’
সাবধান সাবধান, এরা শয়তানের আনুগত্য ওয়াজিব করে নিয়েছে। মহান আল্লাহ্র আনুগত্য থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছে, প্রকাশ্যে ফাসাদ ও দুর্নীতিতে লিপ্ত, মহান আল্লাহ্র দণ্ডবিধি বাতিল করেছে। ফাই্ বা খোদার সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। আল্লাহ্র হারামকে হালাল এবং তাঁর হালালকে হারাম করেছে। আর আমি রাসূলের সাথে আমার নিকটাত্মীয়তার কারণে এ খিলাফতের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত (হকদার)।’
তিনি হুর ইবনে ইয়াযীদ রিয়াহীর সেনাবাহিনীর উদ্দেশে প্রদত্ত অপর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন :
‘হে লোকসকল! তোমরা যদি মহান আল্লাহকে ভয় কর এবং হক বা অধিকারের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের হক বা অধিকার চিনতে পার তাহলে তা হবে তোমাদের জন্য মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উপায়। আমরা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহলে বাইত। এ খিলাফতের জন্য সকলের চেয়ে বেশি হকদার। খিলাফতের এ সকল মিথ্যা দাবিদার থেকে তোমাদের উচিত পৃথক হয়ে যাওয়া। তাদের কোনো অধিকারই নেই। তারা তোমাদের সাথে শত্রুতায় লিপ্ত।’
ইমাম হোসাইন এসব বক্তব্যে তাঁর কিয়াম বা বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং অন্তর্নিহিত বাণী সম্পর্কে চমৎকারভাবে জনগণকে অবহিত করেছেন।
উম্মতের ইসলাহ্ বা সংস্কার এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইমাম হোসাইন নিজের ও সঙ্গী-সাথীদের জীবন এর জন্য উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের বাধা দান করতে গিয়ে পুণ্যাত্মা হোসাইন ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের জীবনও যদি উৎসর্গ করতে হয় এবং এর ফলে যদি ইসলাম ধর্ম বিকৃতি ও বিচ্যুতির হাত থেকে রক্ষা পায় তাহলে সেটাই হবে ফরয (অবশ্য পালনীয়)। তাই ইমাম হোসাইন (আ.) পাপিষ্ঠ ইয়াযিদী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব করে নিজ ও সঙ্গী-সাথীদের জীবন উৎসর্গ করে ইসলামকে রক্ষা করে গেছেন।
হুর ইবনে ইয়াযীদের সেনাদলের সামনে সমসাময়িক পরিস্থিতি, সরকার ও জনগণের অবস্থা বর্ণনা করে তিনি বলেছেন :
‘তোমরা কি দেখতে পাও না যে, সত্যানুযায়ী কাজ করা হচ্ছে না এবং অসত্যকে বাধা দেয়া হচ্ছে না যাতে মুমিন তার প্রভুর সাথে সত্যি-সত্যি সাক্ষাৎ করতে উদ্বুদ্ধ না হয়। অতএব, এ পরিস্থিতিতে আমি মৃত্যুকে সৌভাগ্য ছাড়া আর কিছুই ভাবি না এবং অত্যাচারীদের সাথে জীবন যাপনকে অবমাননাকর ও গ্লানিময় মনে করি।’
হাদীস ও রেওয়ায়েতভিত্তিক অগণিত ঐতিহাসিক দলিল বিদ্যমান যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম হোসাইনের শাহাদাত তাঁর আন্দোলনের তো কোনো ক্ষতি করেনি বরং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সর্বোত্তমভাব সংরক্ষণ করেছে। তাঁর শাহাদাতের কারণে তদানীন্তন মুসলিম উম্মাহ্ বোধোদয় হয়েছে। তারা জাগ্রত হয়েছে এবং বুঝতে পেরেছে যে, তারা কোন্ সরকারের অধীনে বসবাস করছে, তাদের ওপর কোন্ শ্রেণীর শাসক শাসন কর্তৃত্ব চালাচ্ছে যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যে কোনো ধরনের পাপাচার করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এতটুকু জাগরণই ইসলামের ইতিহাসে অসংখ্য স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়েছে। আর সমকালীন বিশ্বে এর সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইরানে সফল ইসলামী বিপ্লব। এ বিপ্লব সম্পূর্ণভাবে হোসাইনী আদর্শ ও চিন্তাধারা থেকে উৎসারিত। এ বিপ্লবের নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী যথার্থ বলেছেন : ‘আমরা যা কিছু পেয়েছি তা মুহররম ও সফর মাস থেকে পেয়েছি। মুহররম ও সফরই ইসলামকে জীবিত ও প্রাণবন্ত রেখেছে।’ ভারতের স্বাধীনতা ও ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি তাঁর আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ইমাম হোসাইনের অপার আত্মত্যাগ থেকেই পেয়েছেন।
আহলে বাইতের অগণিত রেওয়ায়েতে এ কারণেই শহীদ সম্রাট ইমাম হোসাইনের জন্য আযাদারী ও শোকানুষ্ঠান পালনের এত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ, এর মাধ্যমে যুগে যুগে সত্যাশ্রয়ী মানুষের সামনে ইমাম হোসাইনের আন্দোলন চিরভাস্বর হয়ে থাকবে এবং তাদেরকে পথ দেখাবে।
এটা সত্য যে, যদি ইমাম হোসাইন (আ.) আন্দোলন না করতেন এবং মযলুমভাবে শহীদ না হতেন তাহলে বনী উমাইয়্যা এবং ইয়াযীদ ইসলামের নাম-নিশানা মিটিয়ে দিত। ইসলামের আর কিছুই বিদ্যমান থাকত না। তাই তো মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর বলেছেন :
‘কাতলে হোসাইন আস্ল মার্গে ইয়াযীদ হ্যাঁয়
ইসলাম যিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বা’দ্।’
অর্থাৎ হোসাইনের হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই ইয়াযীদের মৃত্যু
(আর) প্রতিটি কারবালার পরই ইসলাম জীবিত হয়।
ইমাম হোসাইনের শাহাদাত ছিল বস্তুত লম্পট ইয়াযীদ ও বনী উমাইয়্যা প্রশাসনের ওপর রক্তের বিজয়। এখানে তরবারির ওপর রক্ত বিজয়ী হয়েছে। ইমাম হোসাইনের আন্দোলন না ছিল নিছক হুকুমত বা শাসন কর্তৃত্ব লাভের জন্য, না ছিল তা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য। বরং এটা ছিল ইসলামে বনী উমাইয়্যা কর্তৃক যে বিচ্যুতির ধারা সৃষ্টি হয়েছিল সেটার বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বক্তব্যে ‘ইয়াযীদের মতো’, ‘আমার মতো’ এসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আমার ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান অথবা ইয়াযীদের ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান আলোচ্য বিষয় নয়। বরং আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, যে কেউ আমার মতো হবে সে যখনই ইয়াযীদের সরকারের মতো কোনো সরকারের সম্মুখীন হবে তখন সে এ সরকারের বাইআত করবে না। (আর এ কাজটাই করেছেন বর্তমান শতাব্দীতে হযরত ইমাম খোমেইনী)। আর যখন ইয়াযীদের মতো শাসক জনগণের ওপর হুকুমত করবে তখন অবশ্যই ইসলামকে বিদায় জানাতে হবে।
কোনো কোনো ঐতিহাসিক ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের আরো অনেক কারণ বর্ণনা করেছেন। এসব কারণ আসলে তৃতীয় কারণের অন্তর্গত হওয়ায় কেবল সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো :
১. ইয়াযীদ ও উমাইয়্যাদের হাতে বিপন্ন হওয়া থেকে ইসলাম ও ইসলামী খেলাফতকে রক্ষা করা;
২. জনগণকে চিন্তাগত স্বাধীনতা প্রদান;
৩. বনী উমাইয়্যার হাত থেকে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং মুসলিম উম্মাহ্ বায়তুলমাল লুণ্ঠন রোধ করা;
৪. মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের নাম-নিশানা মুছে দেয়ার অশুভ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া;
৫. বনী উমাইয়্যা কর্তৃক প্রবর্তিত বিদআত্সমূহের মূলোৎপাটন ও নবীর সুন্নাতসমূহ পুনরুজ্জীবিত করা;
৬. সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং
৭. ইসলামী বিধি-বিধান সর্বক্ষেত্রে প্রবর্তন করা।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিপ্লব একটি পূর্ণাঙ্গ সফল ইসলামী বিপ্লব। এ বিপ্লবে রয়েছে ইসলামের যাবতীয় নীতি এবং সুউচ্চ মানবিক গুণ, যেমন চরম আত্মত্যাগ, দৃঢ়তা, সাহস ও সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে অবিচল থাকা ইত্যাদি। তাই এ বিপ্লব একই সাথে আধ্যাত্মিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক।