শনিবার, ৯ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব -৯ (আশুরা)

পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ৮, ২০২২ 

news-image

ইমাম হুসাইনের নেতৃত্বে আশুরার মহাবিপ্লব হচ্ছে তরবারির ওপর রক্তের বিজয়ের আদর্শকে চিরন্তন মহিমা দেয়ার বিপ্লব। ইমাম হুসাইনের নেতৃত্বে সংঘটিত এ মহাবিপ্লব ইসলামের পরিপূর্ণ চিত্রেরই প্রতিচ্ছবি।  তাই এ মহাবিপ্লব ইসলামেরই সব দিককে জানার এবং সততা, মানবতা, ত্যাগ ও বীরত্বসহ সবগুলো মহৎ গুণ চর্চার কেন্দ্র-বিন্দু। আশুরা আমাদের শেখায় জালিম শাসকদের প্রতি আপোষহীন হওয়ার পাশাপাশি শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও সত্যের প্রতি খোদাদ্রোহী শত্রুকেও আকৃষ্ট করার ব্যাপারে দরদী মন নিয়ে আশাবাদী হতে, তৃষ্ণার্ত শত্রু সেনাদেরও ও এমনকি তাদের পশুদেরও পানি দিতে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আগ বেড়ে প্রাণঘাতী শত্রুর ওপর হামলা না চালানোর ইসলামী নীতি মেনে চলতে, হাবিব মাজাহেরের মত বৃদ্ধ বয়সেও যুবকের মত উদ্দামতা নিয়ে জিহাদে অবিচল থাকতে, খাঁটি ইমামের প্রতি কিংবদন্তীতুল্য আনুগত্য দেখাতে এবং সর্বোপরি ইমাম হুসাইনের ভাষায়, নিজের পছন্দ নয়, বরং আল্লাহর পছন্দের পথকেই পছন্দ করতে!

জালিম ও দুরাচারী পাপিষ্ঠ ইয়াজিদকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করায় নবী পরিবারের প্রায় সব পুরুষ সদস্যসহ ইমাম হুসাইনের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং নবী-পরিবারের প্রেমিক একদল মুমিন মুসলমানকে নৃশংসভাবে শহীদ করা হয়েছিল কারবালায়। ইয়াজিদের আনুগত্য করতে  ইমামের অস্বীকৃতির  খবর জানার পর কুফার প্রায় এক লাখ নাগরিক চিঠি ও প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল ইমাম (আ.)-কে যাতে তারা প্রকৃত ইসলামী শাসনের স্বাদ পেতে পারে এবং মুক্ত হয় ইয়াজিদের কলঙ্কিত  শাসনের নাগপাশ থেকে।  তাই ইমাম (আ.)ও মক্কা থেকে রওনা হয়েছিলেন কুফার উদ্দেশ্যে যাতে তাদের সহযোগিতায় গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। কিন্তু ইয়াজিদের গভর্নর ও প্রশাসনের নানা ধরনের ভয়-ভীতি এবং প্রলোভনের মুখে কুফায় ইমামপন্থী জনগণ ইমামের প্রতিনিধি মুসলিম ইবনে আকিলকে সহায়তা না দেয়ায় তিনি নির্মমভাবে শহীদ হন।

এ অবস্থায় ইমাম হুসাইন কুফার জনগণের সহায়তার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেলেও প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য  কুফার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখেন যাতে কেউ তাকে ভীতু, কাপুরুষ ও আপোসকামী বলে অভিযোগ করতে না পারেন এবং শাহাদাতের মাধ্যমে মৃতপ্রায় ইসলামকে জীবিত করতে পারেন। তাঁর একদল সঙ্গীও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার তথা শাহাদতের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ইমাম দূরদর্শিতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন যে নবী-পরিবারের রক্তদান বৃথা যাবে না এবং একদিন জনগণ জেগে উঠবে।

কুফায় পৌঁছার আগেই কারবালায় ইমামকে তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গীসহ ঘেরাও করে ইয়াজিদ-বাহিনী। হয় ইয়াজিদের আনুগত্য নতুবা মৃত্যু –এ দুয়ের যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে বলা হয়েছিল তাঁদেরকে। কিন্তু তাঁরা বীরোচিতভাবে লড়াই করে শহীদ হওয়ার পথই বেছে নিয়েছিলেন।  শাহাদত-ভিত্তিক বিপ্লবের জন্যই তিনি তাঁর পরিবারের শিশু ও নারীদেরও সঙ্গে  নিয়ে এসেছিলেন।

১০ মহররম যুদ্ধ যখন অনিবার্য তখনও ইমাম (আ.) ইয়াজিদ বাহিনীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তারা এক অন্যায় যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে নবী-পরিবারের নিষ্পাপ সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু অর্থ-লোভী ও হারাম খাদ্য খেতে অভ্যস্ত ইয়াজিদ বাহিনীর নেতা-কর্মীদের মনে কোনো উপদেশই প্রভাব ফেলছিল না। অবশ্য  হোর ইবনে ইয়াজিদ (রা.) নামক ইয়াজিদ বাহিনীর একজন জেনারেল  তাঁর ভুল বুঝতে পেরে কয়েকজন আত্মীয় ও সঙ্গীসহ ইমামের শিবিরে যোগ দেন ও বীরত্বপূর্ণ লড়ায়ের পর শহীদ হন।

উল্লেখ্য প্রায় ত্রিশ জন ইয়াজিদি সেনা ইমাম (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের ভাষণে প্রভাবিত হয়ে যুদ্ধ শুরুর আগেই ইমামের শিবিরে যোগ দেন। এটাও এক বিস্ময়কর সাফল্য। ইমামের শিবিরে যোগ দেয়া মানেই যে অসম লড়াইয়ের পরিণতিতে নির্ঘাত মৃত্যু তথা শাহাদাত তা জেনেও ওই ব্যক্তিরা ইমামের শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। এখানে নৈতিকতা ও ইমানের বিজয়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আশুরার দিন হুর ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর কাছে চলে এসে তওবা করলেন। ইমাম (আঃ) বললেন,ঘোড়া থেকে নেমে এসো। হুর বললেন,না,হুজুর,অনুমতি দিন,আমি আপনার পথে আমার রক্ত ঢেলে দেবো। তখন ইমাম তাঁকে অনুমতি দেন। ইমাম হুসাইন (আঃ) আশুরার দিনকে যে রং দিয়ে রঞ্জিত করতে চাচ্ছিলেন তা ছিলো রক্তের রং। কারণ, ইতিহাসে এই রংই সবচেয়ে বেশী স্থায়ী। আশুরার দিন প্রথম দিকে মল্ল যুদ্ধে বেশ কয়েকজন ইয়াজিদি সেনা ইমামের বাহিনীর কয়েকজন বীর যোদ্ধার হাতে নিহত হয়। মল্ল যুদ্ধ চলতে থাকলে অত্যন্ত উচ্চ মনোবলের অধিকারী ইমাম-বাহিনীর ৭২ জনের হাতে ত্রিশহাজার ইয়াজিদি সেনার সবাই বা বেশিরভাগই নিহত হত। আর এটা বুঝতে পেরেই ইয়াজিদি সেনাপতি ওমর সাদ সম্মিলিত হামলার কাপুরুষোচিত নির্দেশ দেয়।

ইমামের জন্য জান-কুরবান করতে প্রস্তুত পুরুষ সঙ্গীদের প্রায় সবাই ত্রিশ হাজার মুনাফিক সেনার বিরুদ্ধে মহাবীরের মত লড়াই করে বহু মুনাফিক সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে একে-একে শহীদ হন। ইমামের সুদর্শন যুবক পুত্র হযরত আলী আকবর (আ.) বহু মুনাফিককে জাহান্নামে পাঠিয়ে শহীদ হন। তিনি ছিলেন দেখতে এবং আচার-আচরণে অবিকল রাসূল-সা. সদৃশ। এমনকি তাঁর কণ্ঠও ছিল রাসূল সা.-এর কণ্ঠের অনুরূপ। কারবালা ময়দানে তাঁর আজান শুনে অনেক বয়স্ক  শত্রুও চমকে উঠেছিল। একইভাবে শহীদ হন ইমাম হাসান (আ.)’র পুত্র হযরত কাসিম (আ.)। সম্মুখ যুদ্ধে তাঁদের সঙ্গে কেউই পারছিলেন না। শত্রুরা যখন দেখত যে ইমাম শিবিরের প্রত্যেক পিপাসার্ত বীর সেনা তাদের বহু সেনাকে হত্যা করতে সক্ষম হচ্ছেন তখন তারা ওই বীর সেনাকে ঘেরাও করে দূর থেকে বহু তীর বা বর্শা নিক্ষেপ করে কাবু করে ফেলত।

ফোরাতের পানি ইমাম শিবিরের জন্য কয়েকদিন ধরে নিষিদ্ধ থাকায় নবী-পরিবারের সদস্যরাসহ ইমাম শিবিরের সবাই ছিলেন পিপাসায় কাতর। প্রচণ্ড গরমে শিশুদের অবস্থা হয়ে পড়ে শোচনীয়।  ইমাম প্রবল তৃষ্ণায় কাতর  তাঁর দুধের শিশু আলী আসগর (রা.)’র জন্য শত্রুদের কাছে পানি চাইলে ওই নিষ্পাপ শিশুর গলায় তীর নিক্ষেপ করে তাঁকে শহীদ করে ইয়াজিদ বাহিনীর এক পাষণ্ড। শিশু আলী আসগর শহীদ হলে ইমাম তাঁর হাতে ওই শিশুর রক্তের কিছু অংশ নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দেন ও ওই রক্ত আর জমিনে ফেরত আসেনি।

শিশুদের জন্য পানি আনতে গিয়ে বীরের মত লড়াই করে ও দুই হাত হারিয়ে নির্মমভাবে শহীদ হন ইমামের সৎ ভাই হযরত আবুল ফজল আব্বাস (আ.)। তিনি ছিলেন ইমাম বাহিনীর পতাকাবাহী সেনাপতি এবং বহু শত্রুকে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন। নবী পরিবারের কয়েকজন শিশুও বীরের মত লড়াই করে শহীদ হয়েছিলেন। নবী (সা.)’র পরিবারের সদস্যরা বাহ্যিক ও আত্মিক সৌন্দর্যে ছিলেন অনন্য।

সন্তান, ভাই, ভাতিজা ও সঙ্গীরা সবাই শহীদ হওয়ার পর যুদ্ধে নামেন আল্লাহর সিংহ হযরত আলী (আ.)’র পুত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)।  তাঁর আগে তিনি যদিও জানতেন যে  তাঁর ডাকে সাড়া দেয়ার  মত কেউ নেই। তবুও তিনি বলেন, কেউ কি আছ আমাকে সাহায্য করার?  -এ কথা তিনি চার বার বলেছিলেন। আসলে কিয়ামত পর্যন্ত তিনি তাঁর আদর্শের পথে সহায়তা করতেই মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ওই আহ্বানের মাধ্যমে। তিনি একাই বেশকিছু মুনাফিক সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আঘাতে আহত হয়েছিল আরও বেশি সংখ্যক মুনাফিক। কিন্তু এক সময় তিনিও চরম পিপাসায় ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়লে তাঁকে ঘিরে ফেলে মুনাফিক সেনারা।তারা পাথর ও অনেক বিষাক্ত তীর মারে  বেহেশতী যুবকদের অন্যতম সর্দারের গায়ে। একটি তীর ছিল তিন শাখা-বিশিষ্ট। এরপর এক নরাধম মারে একটি বর্শা। ফলে অশ্বারোহী ইমাম (আ.) ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান। এরপর আরেক নরাধম শিমার অথবা সিনান জীবন্ত অবস্থায় ইমামের মস্তক মুবারক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এই নরাধমদের উপর ঝরুক অনন্তকাল ধরে আল্লাহর অভিশাপ।

ইমামের গায়ে বর্শা, তীর ও তরবারির অন্তত তিনশ ষাটটি আঘাত ছিল। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী আঘাতের সংখ্যা ছিল এক হাজার তিনশ। সেদিন ছিল শুক্রবার এবং ইমামের বয়স ছিল ৫৭ বছর।

ইমামের মাথা মুবারক বর্শার আগায় বিদ্ধ করেছিল নরাধমরা। শুধু তাই নয় ইমামের লাশসহ শহীদদের লাশগুলোর ওপর ঘোড়া চালিয়ে পবিত্র লাশগুলোকে  দলিত-মথিত করেছিল নরপিশাচরা। বলা হয় শাহাদতের সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল আল্লাহর দিদার ও শাহাদত-প্রেমিক ইমামের চেহারা ততই উজ্জ্বল বা নূরানি হচ্ছিল স্বর্গীয় আনন্দে।  যোহর ও আসরের নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁকে শহীদ করা হয়।

ইয়াজিদি সেনাবাহিনী যখন একত্রে এগিয়ে আসে হুসাইন (আ.)-এর তাঁবু লুট করার জন্য এবং নারীদের কাঁধ থেকে চাদর ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তখন রাসূলুল্লাহর (সা.) পরিবারের কন্যারা এবং তাঁর আহলুল বাইত একত্রে বিলাপ শুরু করলেন ও কাঁদলেন তাদের সাথী ও বন্ধুদের হারিয়ে।

ইমামের বোন হযরত যাইনাব ( সা.আ.)- শোকে অধীর হয়ে বলেছিলেন, “হে মুহাম্মাদ, আকাশের ফেরেশতাদের সালাম আপনার উপর, এ হলো হুসাইন, যে নিহত হয়েছে, যার শরীর রক্তে ভিজে গেছে এবং তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে এবং আপনার কন্যারা বন্দী হয়েছে। …. এ হলো হুসাইন, যে মরুভূমিতে গড়িয়ে পড়েছে এবং বাতাস তার জন্য শ্বাসকষ্ট পাচ্ছে … হে মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথীরা, আসুন ও দেখুন মুস্তাফা (সা.)-এর বংশকে কিভাবে কয়েদীদের মতো বন্দী করা হয়েছে।”

বলা হয় যে পাষণ্ড (শিমার অথবা সিনান) ইমাম হুসাইনের দেহ থেকে মস্তক ছিন্ন করেছিল তাঁর জীবন্ত অবস্থায় জবাই করার মাধ্যমে, সে এ কাজের পর কাঁপতে থাকলে তার সঙ্গীরা বিস্মিত হয়ে বলে, তুমি তো আসল কাজ করেই ফেলেছ, এখন কাঁপছ কেন ভয়ে! সে বলছিল: আমি একজন নারীর (হযরত ফাতিমার) বিলাপ শুনছি যিনি বলছেন: হায় আমার পুত্র! এর আগে হত্যাকারী আশপাশে থাকা তার সঙ্গীদের লক্ষ্য করে বলছিল: তোমরা সবাই সাক্ষী থাকো আমি এমন মা-বাবার পুত্রের মাথা কাটছি যারা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও তাঁদের সমতুল্য কেউ নেই! –

ইসলাম-পূর্ব জাহেলি যুগেও আরবরা মহররম মাসে যুদ্ধ ও বিবাদ করতো না! কিন্তু রাসুলের উম্মতের নামধারী বনি উমাইয়্যা ও তাদের সহযোগীরা রাসুলেরই সন্তান ও পরিবারের সদস্যদেরকে এবং এমনকি এ পরিবারের দুধের শিশুকেও নৃশংসভাবে শহীদ করতে কুণ্ঠিত হয়নি মহররম মাসেই! সেই আলী আকবর, সেই আব্বাস  ও সেই কিশোর কাসেমের মত বীর ও পবিত্র ব্যক্তিদের পৃথিবীতে আর কখনও কোনো মা জন্ম দিতে সক্ষম নন। সেই পবিত্র ইমামের গলায় ছুরি চালিয়ে জীবন্ত অবস্থায় তাঁর মস্তক বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে যার মুখে ও গলায় হাজারো বার চুমো খেয়েছেন মহানবী-সা.। শুধু তাই নয় মহানবী (সা) জানতেন তাঁর শরীরের কোন্ কোন্ স্থানে জালিম ঘাতকের শত শত তীর ও বর্ষা আর তরবারি আঘাত হানবে! তাই শিশু হুসাইনকে কোলে নিয়ে তাঁর শরীরের সেইসব স্থানেও চুমো খেতেন মহানবী (সা)! তিনি বলতেন, আমি শুধু আঘাতের স্থানগুলোতেই চুমু খাচ্ছি! তথ্যসূত্র: পার্সটুডে