ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৬
নাম : আলী
উপাধি : যায়নুল আবেদীন।
ডাকনাম : আবু মোহাম্মদ।
পিতার নাম : আল-হোসাইন সাইয়্যেদুশ্ শোহাদা।
মাতার নাম : শাহর বানু। তিনি ছিলেন পারস্যের সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদেগেরদ এর কন্যা।
জন্ম : মদীনা মুনাওওয়ারাহ, ৫ শাবান, বৃহস্পতিবার মতান্তরে ১৫ জামাদিউল আউয়াল, শনিবার, ৩৬ হিজরি।
মৃত্যু : ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। উমাইয়্যা বংশের খলীফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে। এর ফলে ২৫ মুহররম ৯৫ হিজরিতে মদীনায় শাহাদত বরণ করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় মদীনার জান্নাতুল বাকী গোরস্তানে।
ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন (আ.) ছিলেন চতুর্থ মা’সুম ইমাম। তাঁর ডাক নাম ছিল আবু মোহাম্মদ। তবে সকলের কাছে তিনি ‘ইমাম যায়নুল আবেদীন’ নামেই সুপরিচিত ছিলেন।
শিশু ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর জীবনের প্রথম দু’বছর কাটে দাদা হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর সাহচর্যে। তারপর দীর্ঘ বারো বছর চাচা হয়রত হাসান (আ.)-এর তত্ত্বাবধানে জীবন অতিবাহিত করেন। ৬১ হিজরিতে কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার সময় কিশোর ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ঐতিহাসিক কারবালার প্রান্তরে পবিত্র ইমাম বংশ ও তাঁর অনুসারীদের ওপর যে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল তা ইতিহাসে আজো নজিরবিহীন ঘটনা হিসাবে চিত্রিত। এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় কিশোর ইমাম একে একে তাঁর পিতা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.), চাচা, ভাই, ভাইপো এবং ইমাম বংশের অন্যান্য অনুসারীর শাহাদাত স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। অসুস্থতার কারণে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তারপরও তিনি রেহাই পাননি। ইয়াযীদের বর্বর নিষ্ঠুর বাহিনীর হাতে তিনি লাঞ্ছনার শিকার হন ও বন্দি জীবনযাপন করেন।
শাহাদতের আগে ইমাম হোসাইন (আ.) শেষ বারের মতো যখন নিজ তাঁবুতে পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে বিদায় নিতে আসেন তখন হযরত যায়নুল আবেদীন (আ.) রোগশয্যায় শায়িত। এই অবস্থাতেই ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর শেষ বিদায় লগ্নে পুত্র যায়নুল আবেদীনকে পরবতী ইমাম হিসাবে নিযুক্ত করে যান।
ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে পবিত্র পিতার শাহাদাত বরণের পর ইমাম যায়নুল আবেদীন মোট চৌত্রিশ বছর জীবিত ছিলেন। এই সময়টুকু তিনি শুধু ইবাদত-বন্দেগি এবং তাঁর মহান পিতার স্মৃতিচারণ করেই কাটিয়েছিলেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, পরবর্তীকালে তিনি ইমাম ‘আল-সাজ্জাদ’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
এই পবিত্র ইমামের জ্ঞান এবং খোদাভীরুতা ছিল অসাধারণ। যুহরী, ওয়াকিদী ইবনে উয়াইনাহ প্রমুখ হাদিসবেত্তা ও ঐতিহাসিকদের মতে ইমাম যায়নুল আবেদীনের মতো পরহেজগার ও খোদাভীরু তাঁর সময়ে আর কেউ ছিল না। তিনি এত বেশি আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকতেন যে, ওযু করার সময় তাঁর চেহারায় পরিবর্তন ঘটত, নামাযে দাঁড়ালে আল্লাহর ভয়ে তাঁর গোটা অবয়বে কম্পন শুরু হতো। এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাব দিতেন : ‘তোমরা কি জান না, কার সামনে আমি নামাযে দাঁড়াই? কার সাথে কথা বলি?’
এমনকি আশুরার দিনে কারবালার সেই চরম বিভীষিকার সময়ও ইমাম যায়নুল আবেদীন মহান প্রভু আল্লাহর ইবাদতে মশগুল ছিলেন। কারবালার যুদ্ধের পর ইয়াযীদের যালিম সৈন্যরা অসুস্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন ও ইমাম শিবিরের অন্যান্য নারীকে বন্দি করে দামেশকে নিয়ে গিয়েছিল। হাতে পায়ে বেড়ী পরিয়ে অত্যন্ত অবমাননাকর অবস্থায় পাথুরে মরুভূমির ওপর দিয়ে টেনেহিঁচড়ে বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই নিদারুণ কষ্টের মাঝেও ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের স্মরণ থেকে এতটুকুও অমনোযোগী হননি। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর দানশীলতা ছিল অসাধারণ। তিনি গোপনে দান করতেই ভালোবাসতেন। তাঁর শাহাদাতের পর জনশ্রুতি ছিল যে, ইমাম সাজ্জাদের ইন্তেকালের পর গোপন দানেরও অবসান হয়েছে। পিতামহ ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর মতোই ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) রাতের বেলা ঘুরে ঘুরে গরীর-দুঃখীদের খোঁজ-খবর নিতেন এবং নিজের পিঠে করে আটার বস্তা ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে তাদেরকে সাহায্য করতেন। এমনকি তিনি নিজের শত্রুদেরও প্রয়োজনের মহূর্তে সাহায্য করতে দ্বিধাবোধ করতেন না; শত্রুদের সদুপদেশ দানে কখনো বিরত হতেন না।
ইমাম যায়নুল আবেদীন আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্যের সাথেই একটি কঠিন সময় অতিবাহিত করেছেন। তাঁদের সময়ে বর্বর তাগুতী শাসকদের স্বৈরাচার চরমে উঠেছিল। চারদিকে ছিল শোষণ-নিপীড়ন, হত্যা ও রাহাজানির রাজত্ব। উমাইয়্যাদের গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ আহলে বাইতের সদস্যদের প্রতি সীমাহীন অত্যাচার চালায়। কোন ব্যক্তি আহলে বাইতের অনুসরণ করলে বা তাঁদেরকে সমর্থন জানালে সেই ব্যক্তির ওপর নেমে আসত চরম হুমকি আর নির্যাতন। আহলে বাইতের ভক্ত এমন কাউকে ধরতে পারলে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হতো। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর ইসলামী আন্দোলন নিষিদ্ধ ছিল। লোকজনের সাথে তাঁকে সভা ও বৈঠক করতে দেয়া হতো না। আহলে বাইতের অনুসারীদের খুঁজে বের করার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হতো। এমনকি উমাইয়্যারা প্রতিটি বাড়িঘরেও তল্লাশি চালাতো এবং তাদের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখত।
ইমাম যায়নুল আবেদীনকে নির্বিঘ্নে কোন ইবাদত-বন্দেগিও করতে দেয়া হতো না। জনসমাবেশে কোন ভাষণ দেয়াও তাঁর জন্য নিষিদ্ধ ছিল। তখন এই মহান ইমাম নিরিবিলিতে আল্লাহ তাআলার ধ্যানে আত্মনিয়োগ করেন। এই সময়ে তিনি তাঁর অনুসারীদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য উন্নত প্রজ্ঞা ও যুক্তিসম্বলিত সর্বোৎকৃষ্ট কিছু মুনাজাত বা প্রার্থনা ‘আস-সহিফা আল-কামিলা’ বা ‘আস-সহিফা আস-সাজ্জদিয়া’ নামে পরিচিত। এই অনন্যসাধারণ প্রার্থনা সংকলনকে অনেকে আবার ‘যাবুরে আলে মুহাম্মাদ’ অর্থাৎ আহলে মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রার্থনা সংগীতও বলে থাকেন। অত্যন্ত জ্ঞানদীপ্ত এবং প্রাঞ্জল ভাষায় এগুলো রচিত। গোটা মুসলিম জাতির কাছে এই দোয়ার ভা-ার নবীবংশের অমূল্য স্মৃতি হিসাবে আজো বিদ্যমান। যুগে যুগে এই দোয়াসমূহের অসাধারণ কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। এই প্রার্থনাসমূহের মাধ্যমে ইমাম যায়নুল আবেদীন তাঁর নির্জনবাসকালীন সকল মুমিন-মুসলমানের জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশ ও নিদের্শাবলি দিয়ে গেছেন।
৯৫ হিজরির ২৫ মুহররম এই মহান ইমামের জীবনাবসান ঘটে। অনেকের মতে উমাইয়্যা খলীফা আল-ওয়ালিদ কর্তৃক বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে ইমাম শাহাদাত বরণ করেন। এ সময় ইমাম যায়নুল আবেদীনের বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) সম্পর্কে আল্লামা তাবাতাবাঈ বলেন : ‘ইমাম আল সাজ্জাদ ছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর একমাত্র জীবিত পুত্রসন্তান। তাঁর অন্য তিন ভাই আলী আকবর (২৫ বছর বয়স্ক), পাঁচ বছরের জাফর এবং দুগ্ধপোষ্য শিশু আলী আসগর (ডাকনাম আবদুল্লাহ) কারবালার যুদ্ধেই শাহাদাত বরণ করেন। যুদ্ধের সময় মারাত্মক অসুস্থতার কারণে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। সেই কারণে হত্যার হাত থেকে রেহাই পান। নারীদের সাথে তাঁকেও বন্দি করে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে জনমত বিগড়ে যাবার ভয়ে ইয়াযীদ ইমাম বংশ ও তাঁর অনুসারীদের সসম্মানে মদীনায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। একবার উমাইয়্যা খলীফা আবদুল মালিকের নির্দেশে ইমাম সাজ্জাদকে পুনরায় বন্দি করে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে আবার ইমামকে মদীনায় ফেরত পাঠানো হয়।
মদীনায় ফিরে আসার পর ইমাম স্বেচ্ছায় নির্জনবাস অবলম্বন করেন। নির্জনে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়েন। সর্বসাধারণের সাথে মেলামেশা তিনি বন্ধ করে দেন। শুধু কতিপয় আলেমের সাথে তিনি যোগাযোগ বজায় রাখতেন এবং তাঁদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করতেন। যে সকল প্রতিনিধির সাথে তিনি যোগাযোগ রাখতেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন আবু হামযা শুমালী, আবু খালিদ কাবুলী প্রমুখ। এঁরা ইমামের কাছ থেকে ধর্মীয় জ্ঞান এবং প্রয়োজনীয় পর্থনির্দেশ লাভ করতেন এবং ইমামের অনুসারীদের মাঝে তা প্রচার করতেন। ইমাম সাজ্জাদের অন্যতম গ্রন্থে ৫৭টি মূল্যবান দোয়া রয়েছে। এতে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি সর্বোৎকৃষ্ট আনুগত্যের মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর পবিত্র ইমামতের দায়িত্ব পালনের পর চতুর্থ ইমাম ৯৫ হিজরিতে (৭১২ খ্রিস্টাব্দে) শাহাদাত বরণ করেন।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর দু’টি উপদেশবাণী : ‘ছোট হোক, বড় হোক, কিংবা ঠাট্টা করেই হোক বা গুরুত্ব সহকারেই হোক, সকল অবস্থাতেই সকল প্রকার মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকবে। কারণ, হালকা ব্যাপারে যে মিথ্যা বলা শুরু করবে পরে খুব শীঘ্রই বড় কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সে মিথ্যা বলার সাহস পাবে।’
‘নিজের গুনাহের কারণে আল্লাহকে ভয় পাওয়া উচিত, অন্য কোন কারণে নয়। আল্লাহর ওপরই ভরসা রাখা উচিত। কারো যদি কোন বিষয় জানা না থাকে তাহলে সেই বিষয় জেনে নেয়াতে লজ্জার কিছু নেই। শরীরের যেমন সহ্যের প্রয়োজন, ঈমানেরও তেমন ধৈর্যের প্রয়োজন। যার ধৈর্য নেই তার ঈমানের অভাব রয়েছে।’