বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইমাম খোমেইনী (র.) ও ইরানের ইসলামি বিপ্লব

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১৬, ২০২২ 

মো. আশিফুর রহমান

আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর আগে ১৯০১ সালের ২৩ অক্টোবর (১৩২০ হিজরির ২০ জমাদিউস সানি) ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ২২৫ কি.মি. দক্ষিণে খোমেইন শহরে জন্মগ্রহণ করেন এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, যাঁর নাম রুহুল্লাহ মুসাভী খোমেইনী, যিনি পরবর্তীকালে ইমাম খোমেইনী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান। তাঁর পিতা আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ মুস্তাফা মুসাভী একজন বিশিষ্ট মুজতাহিদ আলেম ছিলেন। ইমামের শিশুকালেই তাঁর পিতা শাহাদাতবরণ করেন। ভূ-স্বামীদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে ইমাম খোমেইনীর পিতাকে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে ইমাম খোমেইনী তাঁর ফুফু ও বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকেন। তাঁর বড় ভাই আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ মুর্তাজাও একজন প্রাজ্ঞ ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন।
ইমাম খোমেইনী ছিলেন প্রচ- ধীসম্পন্ন। মাত্র সাত বছর বয়সে সম্পূর্ণ কোরআন পড়া শেষ করে আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। এরপর বড় ভাইয়ের কাছে তিনি যুক্তিবিদ্যা, আরবি ব্যাকরণ শিক্ষালাভ করেন। ১৯ বছর বয়সে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য আরাকে গমন করেন। সেখানে স্বনামধন্য আলেমদের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর পর ইরানের ধর্মীয় নগরী কোমে চলে আসেন। সেখানে ১৫ বছর তিনি আয়াতুল্লাহ্ হায়েরীর দারসে খারেযে (মুজতাহিদ হওয়ার পড়াশুনা) যোগ দেন। এরপর তিনি আয়াতুল্লাহ্ বোরুজেরদীর ক্লাসে যোগ দেন। তিনি আয়াতুল্লাহ্ আলী আকবর ইয়াযদীর কাছে জ্যোতির্বিদ্যা এবং মরহুম শায়খ মুহাম্মদ আলী শাহবাদীর কাছে দর্শন ও রহস্যজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষালাভ করেন।
এভাবে অল্প সময়েই মধ্যেই তিনি ধর্মতত্ত্ব, ইসলামি আইন, হাদীস ও তাফসীর শাস্ত্র, রহস্যজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে একজন আসামান্য প-িত হয়ে ওঠেন। বিশ্বে প্রচলিত অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানেও তিনি বেশ পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি এসবের পাশাপাশি আধ্যাত্মিকতার চর্চা করেন। এসময়কালে তিনি নিজেও বিভিন্ন বিষয়, যেমন আইনশাস্ত্র, ইরফান, দর্শন ইত্যাদি শিক্ষাদান করতেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ইমাম খোমেইনী দর্শনের অধ্যাপক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন।
তৎকালীন ইরানের অবস্থা
ইমাম খোমেইনী যখন জ্ঞান অন্বেষণে ব্যস্ত সেসময়ে ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান ছিল পুরোপুরি ইসলামি আদর্শের বিপরীতে। মদপানের জন্য বার, নাইটক্লাব ইত্যাদি সবখানে ছড়িয়ে পড়েছিল। নারীদেরকে বেপর্দায় চলাফেরায় বাধ্য করা হতো। সমাজের সর্বত্র ইসলামি মূল্যবোধের পরিবর্তে পাশ্চাত্য মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছিল। অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আমেরিকা-ব্রিটেনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তেলসম্পদের বিরাট লভ্যাংশ ব্রিটেন ও মার্কিন তেল কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ইরানের সশস্ত্র বাহিনী মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞদের দ্বারাই পরিচালিত হতো।
এসব কর্মকা-ের ফলে শাহের রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা আন্দোলনও গড়ে ওঠে। ১৮৯২ সালে আলেমদের নেতৃত্বে তামাকবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মীর্যা হাসান সিরাজী তামাক বর্জনের ফতোয়া দেন। ১৯০৩ সালে কোরআন ভিত্তিক সংবিধান রচনার দাবিতে শুরু হয় শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন। ১৯৫২-৫৩ সালে তেলসম্পদ জাতীয়করণের আন্দোলন হয়। এ আন্দোলনের এক পর্যায়ে মোহাম্মদ রেজা ইরান থেকে পলায়ন করে। ব্রিটিশরা এ অবস্থায় ইরানের উপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না জেনে ইরানের ভার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দেয়। সিআইএ দ্বারা পরিচালিত সামরিক অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক সরকারের পতন ঘটে এবং মোহাম্মদ রেজা আবার ইরানে ফিরে এসে ক্ষমতা গ্রহণ করে।
এ সময়কালের মধ্যে মীর্যা হাসান সিরাজী, সাইয়্যেদ মুহাম্মদ বিহবিহানী, সাইয়্যেদ তাবতাবায়ী, শেখ ফাজলুল্লাহ্ নূরী, আয়াতুল্লাহ্ কাশানী, আয়াতুল্লাহ্ বোরুজেরদী প্রমুখ খ্যাতনামা আলেম এসব আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
ইমাম খোমেইনীর আন্দোলন
১৯৪১ সালে কাশফুল আসরার (রহস্য উন্মোচন) নামক গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে ইমাম খোমেইনী নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের যাত্রা শুরু করেন। এতে তিনি বলেন, ‘একমাত্র ধর্মই মানুষকে বিশ্বাসঘাতকতা ও অপরাধের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত যারা ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্ণধার, তারা মেকী ধর্মে বিশ্বাস করেন অথবা তাদের আদৌ কোনো ধর্মবিশ্বাস নেই।’
ইমাম খোমেইনী তাঁর ছাত্রদের আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং রূহানি শক্তি ও নৈতিকতা অর্জনের উপর গুরুত্ব দিতেন। পরবর্তীতে তিনি নীতিশাস্ত্র এবং আত্মিক জ্ঞানের ক্লাস চালু করেন। তাঁর ক্লাসে শত শত ছাত্র, এমনকি মুজতাহিদরাও যোগ দিতেন। তাঁর জনপ্রিয়তা এবং তাঁর ক্লাসে বিপুল সংখ্যক ছাত্রের উপস্থিতি রেজা খানের নিরাপত্তা পুলিশকে আতঙ্কিত করে এবং তারা লোকদেরকে এ থেকে নিবৃত্ত প্রয়াস চালায়। এমনকি ক্লাসটি বন্ধ করার জন্য হুমকি দেওয়া হয়।
কোমের ফায়জিয়া মাদ্রাসা থেকে কোমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাজী মোল্লা সাদিক মাদ্রাসায় নীতিশাস্ত্রের ক্লাসগুলো স্থানান্তরের পূর্ব পর্যন্ত পুলিশ এ চাপ অব্যাহত রাখে। রেজা শাহের পতন ও নির্বাসনের আগ পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে। এরপর আবার ফায়জিয়া মাদ্রাসায় ক্লাস চালু হয়। এসব ক্লাসের বক্তৃতা পরবর্তীতে ‘নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম’ ও ‘আল জিহাদুল আকবার’ নামে সংকলিত হয়।
ইমাম খোমেইনী শাহের ধর্মবিরোধী ও দেশবিরোধী কর্মকা-ের প্রতিবাদ জানান এবং আলেমরাও তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে ৯ জানুয়ারি শাহের সরকার ছয় দফা সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং এ কর্মসূচি অনুমোদনের জন্য গণভোটের আয়োজন করে। একে ‘শ্বেত বিপ্লব’ বা ‘শাহ ও জনতার বিপ্লব’ নাম দেওয়া হয়। বিপ্লবীরা একে শ্বেত বিপ্লব বলতেন এ অর্থে যে, তা হোয়াইট হাউসে জন্মলাভ করেছিল।
ইমাম খোমেইনী ভোট বর্জনের ডাক দেন। জনগণ ভোটদান হতে বিরত থাকে। সে বছরই ঈদুল ফিত্র উপলক্ষে ইমাম শাসকগোষ্ঠীর বেআইনি ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। ইমামের নেতৃত্বে ইরানের ইসলামি উম্মাহ্র প্রতিরোধে শাহ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে।
১৯৬৩ সালের পূর্বে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ না হওয়ার পেছনে প্রকৃত কারণ ছিল এ সময় তিনি আলেম সমাজের মধ্যে এক চিন্তাগত নীরব বিপ্লব সাধন করছিলেন। তিনি বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষক গড়ে তুলেছিলেন।
১৯৬৩ সালে আলেমরা ঘোষণা করেন যে, এ বছর সপ্তাহব্যাপী নওরোজ পালন করা উচিত নয়। কারণ, নববর্ষের ২য় দিন ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী। জনগণ এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে।
১৯৬৩ সালের ২২ মার্চ নওরোজের দ্বিতীয় দিন ফায়জিয়া মাদ্রাসায় ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে হাজার হাজার লোক অংশগ্রহণ করে। শাহের লোকেরা এ অনুষ্ঠানে আক্রমণ করে অনেককে হত্যা ও আহত করে। শুধু তাই নয় কয়েকদিন পর যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ছিল তাদেরকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়।
এ ঘটনার চল্লিশতম দিনে সারা দেশে প্রচ- বিক্ষোভ হয়। জনতা ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এর পরপরই আশুরা সমাগত হয়। সাভাক বাহিনী হুকুম দেয় যে, ফায়জিয়া মাদ্রাসায় ইমামের বক্তৃতা দেওয়া চলবে না। ইমাম এ অন্যায় আদেশ উপেক্ষা করে আশুরার বিকেলেই মাদ্রাসা ফায়জিয়ায় পৌঁছান। ইমাম তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছি যে, তারা ইসলাম ও ধর্মীয় নেতৃত্বের বিরোধী। ইসরাইল আমাদের পবিত্র ঐশী গ্রন্থ আল কোরআনকে হেয় করতে চায় এবং ধর্মীয় নেতৃত্বকে নির্মূল করতে চায়। ইসরাইল আমাদের অর্থনীতি, ব্যবসা ও কৃষিকে পাকাপোক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।’
ইমামের ভাষণে জনগণ ক্রোধে ফেটে পড়ে। রাতে ইমামকে গ্রেফতার করা হয়। মুহূর্তে খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জনতা স্লোগান তোলে : ‘হয় খোমেইনী, না হয় মৃত্যু।’ তেহরানে বিশাল মিছিল হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, দোকানপাট বন্ধ থাকে। সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়।
১৯৬৩ সালের ৫ জুন গণবিক্ষোভে গুলি বর্ষণ করলে তেহরানে ১৫০০০ ও কোম শহরে ৪০০ লোক শাহাদাতবরণ করে। জনগণের দাবির মুখে ১৯৬৪ সালের ৭ এপ্রিল শাহ ইমামকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ক্যাপিটিউলেশন আইন
১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর ইরানি পার্লামেন্টে ইরানে বসবাসরত মার্কিন নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আইন পাশ করা হয়। এ আইনে মার্কিন নাগরিকদের বিচার করার কোনো ক্ষমতা ইরান সরকারের থাকবে না এবং তাদের বিচার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
ইমাম এর বিরোধিতা করে বক্তৃতা রাখেন। তিনি বলেন, ‘এহেন অপমানের প্রতিবাদ করার ভার এখন ইসলাম প্রচারক ও বক্তাদের উপরই ন্যস্ত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে দেশের স্বাধীনতার জন্য কলম ধরতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের উচিত পার্লামেন্টে গৃহীত সিদ্ধান্তের পেছনে কী রহস্য নিহিত রয়েছে, সে সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা। এ সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সর্বসম্মত নীতি গ্রহণ করতে হবে। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ইসলাম ও কোরআনের গৌরব বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হওয়া এবং একই সাথে মুসলমানদের সমর্থনে কাজ করে যাওয়া উচিত।’
ইমাম সেনাবাহিনীকে জেগে উঠে শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান জানান। শাহ বুঝতে পরল যতদিন ইমাম দেশে আছেন ততদিন জনগণের স্বার্থের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করা যাবে না। তাই আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য ইমামকে নির্বাসনে পাঠানোর কথা ভাবল। ১৯৬৪ সালের ৪ নভেম্বর ইমামকে কোম থেকে গ্রেফতার করে তুরস্কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সৈন্যরা ধর্মীয় নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করে। ইমাম খোমেইনীর জ্যেষ্ঠপুত্র মোস্তফা খোমেইনীও গ্রেফতার হলেন। দু’মাস পর তাঁকেও তুরস্কে নির্বাসন দেয়া হয়।
১৯৬৫ সালের অক্টোবরে তুরস্ক সরকার তাঁকে ইরাকের নাজাফে প্রেরণ করে। সেখানে তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। তিনি সেখান থেকে তাঁর বাণী ইরানে প্রেরণ করতেন এবং আলেমরা তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতেন।
ইমাম খোমেইনীকে মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মোস্তফা খোমেইনীকে ১৯৭৭ সালের ২৩ অক্টোবর বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।
১৯৭৮ সালের ৭ জানুয়ারী ইমাম খোমেইনীর মর্যাদা নষ্ট করে পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ইমামকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার দালাল বলে উল্লেখ করা হয়।
এর প্রতিবাদে কোমে বিক্ষোভ হয় এবং ২০০ লোক শাহাদাতবরণ করেন। কোমের শহীদদের স্মরণে তাবরীজে বিক্ষোভ হয়। এতে ৫০০ জন শহীদ হন। এরপর ইরানের প্রতিটি শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। শত শত লোক শহীদ হয়।
১৯৭৮ সালের মুহররম মাসে লাখ লাখ মানুষ তেহরানের রাস্তায় নেমে আসে। নিরস্ত্র জনতা কাফনের কাপড় পড়ে মেশিনগান সজ্জিত সেনাবাহিনীর সামনে ছুটে যেতে থাকে। ৮ সেপ্টেম্বর ৫০০০ লোক শাহাদাতবরণ করে।
অক্টোবর মাসে ইমামকে ইরাক থেকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও ইমাম কোনো মুসলিম দেশে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কোনো মুসলিম দেশ ইমামকে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। তাই তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে চলে যান।
সেখান থেকে ইমামের বাণী রেকর্ড করে ইরানে প্রেরণ করা হতো। তেহরানের বহু লোক ফোনে সরাসরি তাঁর কথা রেকর্ড করে রাখতেন। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তাঁদের ছাত্রদের মাধ্যমে গ্রাম-গ্রামান্তরে তা পৌঁছে দিতেন।
১৯৭৮ সালের ৪ নভেম্বর তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ইমামকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবিতে মিছিল করে। শাহের বাহিনী এ মিছিলের উপর গুলি করলে ৬৫ জন ছাত্র শহীদ হয়। এরপর মুহররম ৯ ও ১০ তারিখ (১৯৭৯) পুনরায় বিক্ষোভ হয়। ইমাম তাঁর প্রেরিত বাণীতে বলেন : ‘মুহররম হলো তরবারির উপর রক্তের বিজয়ের মাস’।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সারা দেশে কার্ফু ঘোষণা করা হয়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে যে, কার্ফু মানা হবে না। তাই তা প্রত্যাহার করা হয়। প্রায় ৫০ লক্ষ লোক মিছিল করে উত্তর তেহরানের দিকে ধাবিত হয়। তারা শাসকদের ভবনগুলোতে তালা লাগিয়ে দেয়। শাহ বুঝতে পারে আর টিকে থাকা সম্ভব নয়। সে কট্টর ধর্মবিরোধী নেতা শাপুর বখতিয়ারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে। সে শাহকে নিরাপদে দেশ থেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়। শাহ পালিয়ে যাবার সময় বলে : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু দিন বেড়িয়ে আসি। শাহ আমেরিকায় কিছুদিন অবস্থান করে। আমেরিকার সরকার তার নিরাপত্তার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করে। সে মিশরে আনোয়ার সাদাতের আশ্রয় নেয় এবং সেখানেই মারা যায়।
ইমামকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য জনগণ বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। কিন্তু শাপুর বখতিয়ার এ দাবিকে উপেক্ষা করে। ইমাম বখতিয়ারের অনুমতি ছাড়াই দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। বিমান বন্দরে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। ইমামকে এ ব্যাপারে অবহিত করার পরও তিনি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ফ্লাইটে দেশে ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
শাপুর বখতিয়ার বিমান বন্দর বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও বিমান বন্দরের কর্মচারীরা তা উপেক্ষা করে ইমামের বিমান অবতরণের ব্যবস্থা করে দেয়। এভাবে ১৯৭৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ইমাম বিজয়ীর বেশে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রায় ৬০ লক্ষ লোক তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়।
ইমাম প্রথমেই বিপ্লবের শহীদদের কবরস্থান বেহেশতে যাহ্রায় যান এবং সেখানে বক্তব্য রাখেন। তিনি রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও মজলিশকে অবৈধ ঘোষণা করেন। তিনি সেনাবাহিনীকে জনগণের সাথে একাত্মতা ঘোণার আহ্বান জানান। তাঁদেরকে স্বাধীনতার দিকে উৎসাহিত করেন। তিনি মেহেদী বজারগানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। বাজারগান অস্থায়ী মন্ত্রিসভা গঠন করেন। দেশে দু’টি সরকার অস্তিত্ব লাভ করে।
সেনাবাহিনীর সদস্যদের দলত্যাগের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১০ ফেব্রুয়ারী বিমান বাহিনীর ক্যাডেটরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সেনাবাহিনীর প্রধান দেশে সামরিক আইন জারির চিন্তা করে। ইমাম সামরিক আইন উপেক্ষা করে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর অফিস, রেডিও স্টেশন, টেলিভিশন স্টেশন, সংসদ ভবন, সাভাব বাহিনীর সদর দফতর ও নির্যাতন কেন্দ্রগুলোতে গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় ৮০০ লোক নিহত হয়। জনগণের প্রবল চাপে শাপুর বখতিয়ার রাতের আঁধারে পালিয়ে যায় এবং ১১ ফেব্রুয়ারি বিপ্লব পূর্ণ সফলতা লাভ করে। ১৯৭৯ সালের ৩০ মার্চ গণভোট হয় এবং দেশের ৯৮.২% জনগণ ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোটদান করে। ১ এপ্রিল ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়।
বিপ্লবের পরপরই খুব কম সময়েই মধ্যে আয়াতুল্লাহ্ মুর্তাজা মোতাহ্হারী, আয়াতুল্লাহ্ তালেকানী, আয়াতুল্লাহ্ বেহেশতীসহ বিপ্লবের প্রথম কাতারের ৭৩ জন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে শহীদ করা হয়। বোমা বিস্ফোরণে শহীদ করা হয় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী রাজাই ও প্রধানমন্ত্রী ড. জাওয়াদ বাহোনারকে। বর্তমান রাহবার আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যে বিপ্লব ধ্বংসের জন্য এত প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবাণীতে আজও তা স্বমহিমায় টিকে আছে। শুধু তা-ই নয়, ইরান দিন দিন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে শনৈঃশনৈ উন্নতি মাধ্যমে বিশে^র প্রথম শ্রেণির দেশগুলোর মাঝে নিজেদের স্থান করে নিতে নিজেকে সক্ষম করে তুলছে।