সোমবার, ১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইতিহাসের সাক্ষী নয়াবাদ মসজিদ

পোস্ট হয়েছে: মে ২৭, ২০১৮ 

news-image

দিনাজপুরের নয়াবাদ মসজিদ এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ঐতিহাসিক কান্তজিউ মন্দিরের পাশেই অবস্থিত নয়াবাদ মসজিদ। মসজিদটি দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার নয়াবাদ গ্রামে অবস্থিত। সুদূর পারস্য থেকে আগত কান্তজিউ মন্দিরের শিল্পীরাই নিজেদের প্রয়োজনে ইসলাম প্রচারের স্বার্থে এ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।

মসজিদের পাশেই ঢেপা নদী। জেলা সদর থেকে দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার। মসজিদের প্রবেশদ্বারের ওপর ফারসিতে লেখা লিপি অনুযায়ী সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সময় ১২০০ বাংলা সনে (১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। আজ থেকে প্রায় তিন শ’ বছর আগে ১৭২২ সালে তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা প্রাণনাথ বর্তমান কাহারোল উপজেলার কান্তনগর গ্রামে একটি মন্দির নির্মাণের জন্য মধ্যপ্রাচ্য (খুব সম্ভবত মিসর) থেকে একদল কারিগর আনেন। কারিগরদের সবাই মুসলমান ছিলেন। মন্দির নির্মাণকাজে এসেও ভুলেনি নিজ ধর্ম পালন করতে। নির্মাণকালীন সময় মন্দিরের পাশেই খোলা আকাশের নিচে নামাজ আদায় করতেন তারা। এরই মধ্যে কারিগরদের প্রধান (হেডমিস্ত্রি) নেয়াজ অরফে কালুয়া মিস্ত্রি মহারাজার দরবারে গিয়ে সব মিস্ত্রির থাকা ও ধর্ম পালনের নিমিত্তে একটি মসজিদ নির্মাণের জায়গা চান।

এ সময় মহারাজা মন্দির থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্বে ঢেপা নদীর পশ্চিম কোলঘেঁষে নয়াবাদ গ্রামে ১ দশমিক ১৫ বিঘা জমি মসজিদ নির্মাণের জন্য দেন। এ ছাড়া মসজিদের পাশে থাকার বাড়ি করার নির্দেশ দেন মহারাজা। মহারাজার নির্দেশ মোতাবেক মিস্ত্রিরা মন্দিরের পাশাপাশি নয়াবাদ গ্রামে নিজেদের থাকার বাড়ি ও নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ নির্মাণকাজ চালিয়ে যান। নয়াবাদ মসজিদ নির্মাণের পর তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন সেখানে।

একপর্যায়ে মহারাজা প্রাণনাথের মৃত্যুর পর তারই দত্তক ছেলে মহারাজা রামনাথের আমলে ১৭১৫ সালে মন্দিরের নির্মাণকাজ শেষ হয়। এরই মধ্যে মন্দিরের পাশাপাশি মসজিদের কাজও শেষ করেন মিস্ত্রিরা। মন্দির নির্মাণের কাজ শেষে কারিগরেরা ফিরে যান নিজ দেশে। কিন্তু এদেশ ছেড়ে যেতে চায় না নেয়াজ ওরফে কালুয়া মিস্ত্রি ও তার ছোট ভাই। আবার নেয়াজ মিস্ত্রি মহারাজার দরবারে হাজির হন। এবার স্থায়ীভাবে বসবাস ও জীবিকা নির্বাহের জন্য মহারাজার কাছে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছু জমির আবদার করেন। তাৎক্ষণিক মহারাজা কিছু জমি তাদের দুই ভাইকে দান করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মিসরীয় এই দুই ভাই মহারাজার দানকৃত জমিতে ফসল আবাদ করে দিনাতিপাত করেন। মৃত্যুর পর মিস্ত্রি ও তার ছোট ভাইয়ের বংশধররা নয়াবাদ মিস্ত্রিপাড়ায় বসবাস করছেন।

দিনাজপুর জেলা শহরের প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম কোণে ঢেপা নদীর পশ্চিম কোলঘেঁষে অবস্থিত মসজিদটি ১ দশমিক ১৫ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে মসজিদটি প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধীনে চলছে উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ।

উত্তর-দক্ষিণে মসজিদটিতে একটি করে জানালা রয়েছে। দরজা-জানলার খিলান একাধিক খাঁজযুক্ত। যার ভেতরে পশ্চিমাংশে আছে তিনটি মেহরাব। মাঝের মেহরাবের তুলনায় দুইপাশের গুলো একটু ছোট। মাঝের মেহরাবের উচ্চতা ২ দশমিক ৩০ মিটার ও প্রস্থ ১ দশমিক ৮ মিটার। মসজিদজুড়ে আয়তাকার বহু পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। পোড়ামাটির নকশাগুলো বহু জায়গায় খুলে পড়েছে। ফলকগুলোর আয়তন দশমিক ৪০ মিটার দশমিক ৩০ মিটার। ফলকগুলোর মধ্যে লতাপাতা ও ফুলের নকশা রয়েছে। এরূপ মোট ১০৪টি আয়তাকার ফলক রয়েছে। তবে ফলকের মধ্যে অলঙ্করণের অনেকটাই প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত।

নয়াবাদ মসজিদ আয়তাকার মসজিদটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট। এর চারকোনায় রয়েছে চারটি অষ্টভুজাকৃতির টাওয়ার। বাইরের দিক থেকে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৪৫ মিটার ও প্রস্থ ৫ দশমিক ৫ মিটার। দেয়ালের প্রশস্ততা ১ দশমিক ১০ মিটার। মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্বদিকে রয়েছে তিনটি খিলান। মাঝের খিলানের উচ্চতা ১ দশমিক ৯৫ মিটার, প্রস্থ ১ দশমিক ১৫ মিটার। পাশের খিলানদ্বয় সমমাপের এবং অপেক্ষাকৃত ছোট। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর নয়াবাদ মসজিদের অনেক অংশ সংস্কার করে। ঐতিহাসিক এই মসজিদের মাঝের খিলানের উচ্চতা ১ দশমিক ৯৫ মিটার, প্রস্থ ১ দশমিক ১৫ মিটার। পাশের খিলানদ্বয় সমমাপের এবং অপেক্ষাকৃত ছোট। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর নয়াবাদ মসজিদের অনেক অংশ সংস্কার করে চার পাশ ঘিরে দেয়াল দিয়েছে। মসজিদ এলাকায় পর্যটকদের জন্য করা হয়েছে চলাচল ও বসার ব্যবস্থা। সংযোগ দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ লাইন, স্থাপন করা হয়েছে সোলার প্যানেলও। – নয়াদিগন্ত