‘আশূরা- কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার স্মরণ বার্ষিকী
পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ২২, ২০১৮
সম্পাদকীয়
‘আশূরা- কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার স্মরণ বার্ষিকী
দশই মহররম শোকাবহ ‘আশূরা; হিজরি ৬১ সালের এ দিনে সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা বেহেশতে যুবকদের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় তাঁর স্বজন ও সহচরগণ সহ ইয়াযীদী বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এ ঘটনা মানব জাতির ইতিহাসের করুণতম ঘটনা- প্রেক্ষাপট সহ যে ঘটনা ইতিহাসের বিতর্কাতীত বিষয়াবলির অন্যতম।
আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পরে হযরত ইমাম হাসান (আ.) খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ্কে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সম্ভাব্য রোমান হামলা থেকে রক্ষার লক্ষ্যে তিনি তাঁর বৈধ খেলাফতকে মুআবিয়ার হাতে ছেড়ে দেন। মুআবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে কৃত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে মৃত্যুকালে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হাতে খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিবর্তে স্বীয় চরিত্রহীন পাপাচারী পুত্র ইয়াযীদকে খেলাফতে অধিষ্ঠিত করে গেলে ইয়াযীদ হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে শক্তিপ্রয়োগে বাই‘আত্ আদায়ের জন্য মদীনার প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ন্যায় ব্যক্তি ইসলামের সমস্ত সীমারেখা অমান্যকারী ইয়াযীদের আনুগত্য করলে যে কারো জন্য তা ইসলামি মূল্যবোধ বিসর্জনের সপক্ষে দলিল হিসেবে গণ্য হতো। এ কারণে তিনি ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করা থেকে বিরত থাকেন এবং রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে রাতের বেলা মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান।
মক্কায় যাবার পথে এবং সেখানে উপনীত হবার পরেও তিনি জনগণকে তৎকালীন হুকূমাতের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইয়াযীদ সেখানে তাঁকে হজ্বের ভীড়ে হত্যার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠালে হযরত ইমাম (আ.) পবিত্র স্থানে রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং কূফার জনগণের দাওআতে সাড়া দিয়ে সেখানে পৌঁছার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে কারবালায় উপনীত হন। সেখানে ইয়াযীদী বাহিনী দ্বারা সপরিবারে অবরুদ্ধ অবস্থায় ও শত্রুশিবিরেরর দলনেতাদের এবং সবশেষে সবসাধারণের উদ্দেশে চেতনা জাগ্রতকারী ভাষণ ও নসিহতের মাধ্যমে রক্তপাত এড়াবার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ইয়াযীদের নির্দেশে হযরত ইমামের (আ.) ওপরে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করার জন্য কঠোরভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু হযরত ইমাম (আ.) কোনো অবস্থায়ই ফাসেক্ব ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করাকে জায়েয গণ্য করেন নি বিধায় এ চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। এমতাবস্থায় ইয়াযীদী বাহিনী তাঁকে তাঁর সকল পুরুষ স্বজন ও সহচর সহ, এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুকেও নির্মমভাবে হত্যা করে; কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ ইচ্ছায় হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ঐ সময় ভীষণ অসুস্থ থাকায় এ হত্যাকা- থেকে রেহাই পান।
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগের এ ঘটনা মুসলমানদের জন্য বাতিলকে সহ্য করার সীমারেখাকে সুস্পষ্ট করে দেয়। এভাবে কারবালার ঘটনা যুগ যুগান্তর ধরে প্রকৃত ইসলামের অনুসারীদের জন্য প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, কারবালার ঘটনা সম্পর্কে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা মতৈক্যের বরখেলাফে ইদানিং কিছু লোক একদিকে কারবালার ঘটনার গুরুত্ব হ্রাস করার লক্ষ্যে অতীতের অনেক ইতিবাচক ঘটনা আশূরার দিনে ঘটেছিল বলে দাবি করছে-যার সপক্ষে কোনো অকাট্য দলিল নেই-এবং এর ভিত্তিতে আশূরার এ শোকের দিনকে, এমনকি আনন্দের দিন বলে অভিহিত করার মতো জঘন্য মানসিকতার প্রদর্শন করতেও দ্বিধা করছে না। অন্যদিকে তারা কারবালার ঘটনাকে ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন রাজনৈতিক সংঘাত ও হযরত ইমাম হুসাইনকে বৈধ (?!) খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী ক্ষমতালোভী হিসেবে চিত্রিত করার এবং স্বৈরাচারী ও চরিত্রহীন ইয়াযীদকে নির্দোষ প্রমাণের ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা দাবি করছে যে, ইয়াযীদের অনুমতি ছাড়াই কারবালার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। আমরা এ ব্যাপারে কোনো দীর্ঘ আলোচনা ও মন্তব্য না করে কেবল মুক্ত বিবেক মানুষদের কাছে প্রশ্ন করব : যদি তা-ই হয়ে থাকে তো যারা এ জন্য দায়ী ইয়াযীদ তাদেরকে শাস্তি দেয় নি কেন, বরং কেন তাদেরকে পুরষ্কৃত করেছিল এবং হযরত ইমামের পরিবারের সদস্যদেরকে কারারুদ্ধ করে রেখেছিল?
এটা আজ অনস্বীকার্য যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামের বিজয় ও ইসলামি ঐক্য অভিমুখে মুসলিম উম্মাহ্র নবযাত্রা শুরু হয়েছে। তাই ইসলামকে ছিন্নভিন্ন ও নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বহুমুখী হামলা শুরু হয়েছে এবং ‘আশূরা সহ ইসলামের বিতর্কাতীত বিষয়গুলোকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা এ ষড়যন্ত্রমূলক হামলার প্রধান কর্মসূচি। এমতাবস্থায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের দুশমনদের এ ষড়যন্ত্র ও হামলাকে অকাট্য জ্ঞানের অস্ত্র দ্বারা শক্তভাবে মোকাবিলা করা অপরিহার্য।
আমরা ‘আশূরা উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি, বিশেষ করে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি এবং মহান আল্লাহ্র কাছে দো‘আ করছি যাতে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মহান আত্মত্যাগ আমাদের সকলের জন্য বাতিলের মোকাবিলায় সত্যের ওপরে আমৃত্যু অটল ও আপোসহীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকার প্রেরণা বয়ে নিয়ে আসে।