মঙ্গলবার, ১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

আশুরা কোরবানির মরমি ব্যাখ্যা

পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ৩, ২০২১ 

সংকলন : ড. এম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র, মা ফাতিমাতুয যাহরা ও শেরে খোদা হযরত আলী (আ.)-এর কলিজার টুকরা, বেহেশতের সর্দার হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ৬১ হিজরির দশই মুহররম কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। অভিশপ্ত ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার হুকুমে নামধারী মুসলমানদের হাতে তিনদিনের দানাপানিবিহীন ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত অবস্থায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সপরিবারে কোরবানি হওয়ার বেদনায় যে কোনো মানুষের হৃদয় কেঁদে ওঠে। কিন্তু এ ক্রন্দন কি শুধুই একটি মানবিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ যা অন্য সব মানুষের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়? নাকি আশুরা কোরবানির আলাদা কোনো মহিমা রয়েছে, যা জাগতিক ও মানবিক স্তরকে অতিক্রম করে যায় এবং আধ্যাত্মিক ও ঐশ্বরিক স্তরে গিয়ে পৌঁছে? আল-কোরআনে যাকে ‘যিব্হ-ই আযীম’ তথা মহাকোরবানি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নিশ্চয় যারা আশুরার শোকাবহ অনুভূতিকে অস্বীকার করতে চায় তারা নিজেদের চিন্তা ও বিশ্বাসকে জাগতিকতার ঊর্ধ্বে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হয়নি। যে ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর বিখ্যাত দোয়া-ই আরাফা’র মধ্যে ঘোষণা করেছেন : ‘হে আমার রব! যে তোমাকে পেয়েছে সে কী হারিয়েছে? আর যে তোমাকে হারিয়েছে সে কী পেয়েছে?’ সেই ইমামের এই মহান কোরবানি যে জাগতিক ও মানবিকতাকে ছাড়িয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই এ প্রবন্ধে আশুরার দিনে সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহান কোরবানির একটি মরমি তথা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা উপস্থাপনের প্রয়াস চালানো হয়েছে।
মরমিবাদী আরেফগণ ইমাম হোসাইন (আ.)-কে একজন ইনসানে কামেল তথা পূর্ণাত্মা মানবের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে মনে করে থাকেন। একারণে তাঁদের নিকট ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মর্যাদা নিছক একজন ইমাম তথা সমাজের নেতার পর্যায় থেকে অতিক্রম করে অনেক ঊর্ধ্বে চলে যায়। কেননা, একজন ইমাম যদি রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে মুসলমানদের বিষয়াদি পরিচালনা করার দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তবে একজন ইনসানে কামেল এর দায়বদ্ধতা গোটা বিশ্বজাহানের কাছে। অন্যভাষায় বলা যায়, ইনসানে কামেল হচ্ছেন জমিনে আল্লাহর খলীফা তথা প্রতিনিধি। তিনি যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যান, তার অর্থ হলো গোটা বিশ্ব জাহান ও জীবনের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়া। একারণে মরমিবাদী আরেফগণ আশুরার ঘটনাকে এমন একটি ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করেন যেখানে একজন ইনসানে কামেল উপস্থিত ছিলেন। আরেফগণের শুহুদী দৃষ্টিতে নিশ্চয় এ কোরবানির চেহারা ধরা পড়বে এক অনবদ্য আধ্যাত্মিক পরিমাত্রায়, ঐশ্বরিক সুবাসে।
আশুরার প্রতি ইরফানি দৃষ্টিভঙ্গিতে ইরফানের মাকাম তথা স্তরসমূহও বিবেচনায় নেওয়া হয়। এই দৃশ্যপটে আশুরার প্রত্যেক শহীদ একদিকে যেমন এক একটি ইরফানি উপাদান, আবার একই সাথে এক একটি ইরফানি সিম্বল তথা প্রতীকও বটে। এভাবে আশুরায় যে ইরফানি সেইর ও সুলুক সংঘটিত হয়েছে তার কোনোটাই দৃষ্টি থেকে বাদ পড়ে না। স্বয়ং ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন ইরফানের কুতুব তথা মূল অক্ষ। আর অবশিষ্ট মহান শহীদগণও অন্যান্য ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। উল্লেখ্য, সব মরমি সাধকই যে এ ব্যাপারে একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, সেটা বলা যায় না। কিংবা সে বিষয়ে আলোচনা করাও এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। বরং বিখ্যাত মরমি কবি হাকিম সানায়ী গাযনাভী’র কাব্যের আলোকে শীর্ষ আরেফগণের দৃষ্টিভঙ্গিই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
হাকিম আবদুল মাজদ মাজদুদ বিন আদাম সানায়ী গাযনাভী (১০৮০-১১৪১ খ্রি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা পোষণ করতেন। তিনি আহলে বাইতের প্রতি এই ভালোবাসা আর বনি উমাইয়্যার প্রতি ঘৃণার মাধ্যমে নাজাতের আশা রাখতেন। আলী (আ.)-এর প্রতি ও তাঁর দুই পুত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের প্রতি ভক্তি এবং ভালোবাসার মাধ্যমে তিনি বেহেশতে প্রবেশ করার তাওফিক কামনা করতেন :
আমি দুইটা কারণকে আশায় রাখি
যদিও আমি গোনাহগার পাপী
এই দুই কারণে পেতে পারি নাজাত
যা থেকে বে-খবর সবে ইয়া রব!
একটি হলো আলে রাসূলের ভালোবাসা
ঐ সিংহপুরুষের, যিনি বাতুলের জোড়া
অপরটি হলো আলে বু-সুফিয়ানের ঘৃণা
যারা ছিল আলে মুহাম্মাদের শত্রু সর্বদা
আশা, এই দুই উসিলাই দেবে নাজাত আমায়
আর জাহান্নাম থেকে আমাকে দেবে রেহাই
রোজ হাশরের দিনে এটুকুই সম্বল আমার
আশা করা যায় এটাই হবে দ্বীনের বিচার।
উপরিউক্ত বয়েতগুলোতে ‘তাওয়াল্লা’ এবং ‘তাবাররা’- এই দুইটি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে। তাওয়াল্লা হচ্ছে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি। আর তাবাররা হচ্ছ ইয়াযিদ ও সমস্ত বনি উমাইয়্যা হতে। উপরন্তু ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের প্রতি ভালোবাসা নাজাতের কারণ এবং খোদায়ী বেহেশতে প্রবেশের উসিলা হবে বলে আশা প্রকাশ।
আট বেহেশতকে কখনো কি সন্ধান পাবে কোথাও
যদি না থাকে মহব্বত আলীর, শাব্বিরের ও শুবাইরের।
সানায়ী গাযনাভী বিশ্বাস করতেন যে, হাসানাইন (আ.)-এর সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আগে হোসাইনী হাল, চরিত্র ও স্বভাবের অধিকারী হতে হবে। একারণে তিনি মনে করতেন, যে ব্যক্তি আহলে বাইতের অনুসারী বলে দাবি করে, তাকে সবদিক থেকে পুণ্যময় চরিত্র দ্বারা চরিত্রবান হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে :
তুমি ঈমানের দাবি করবে আর নাফ্্সের নির্দেশ মেনে চলবে?
বাইয়াত করবে আলীর সাথে আর হাসানকে বিষ পান করাবে?
সানায়ী ইয়াযিদ ও তার লোক-লস্করের প্রতি এতটাই ঘৃণা পোষণ করতেন যে, ইয়াযিদের হাতে বাইয়াতকারীদেরকে আরেক ইয়াযিদ বলে আখ্যায়িত করেন। নতুবা কোনো সুস্থ-বিবেকের মানুষ ইয়াযিদের সাথে বাইয়াত করতে রাজি হতে পারে না, আর মুমিন মানুষের তো প্রশ্নই আসে না। ইয়াযিদ ও শিমারের প্রতি তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে তিনি ‘শহীদদের স¤্রাট’ বলে মনে করেন।
গোটা দুনিয়ার সবখানে ভরা কত শহীদে
কিন্তু কারবালার হোসাইনের ন্যায় শহীদ তুমি পাবে কোথায়?
সানায়ী’র দৃষ্টিকোণ থেকে আশুরা বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণ ছিল এটা যে, একদল দুনিয়ালিপ্সু লোকের ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ন্যায় অপার্থিব ব্যক্তিত্বকে সহ্য করার সামর্থ্য ছিল না। বাদুড় যেমন দিনের আলোয় চলতে পারে না বলে সূর্যের আলোকে এড়িয়ে রাতের আঁধারে বের হয়, জুলুমপূজারী জালেমরাও তদ্রƒপ তাদের চলার পথে বাধা হিসাবে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সূর্যের ন্যায় আলোকোজ্জ্বল অস্তিত্বকে সরিয়ে ফেলতে তৎপর হয়ে ওঠে। এই অন্ধকারে বিচরণকারী দলটি শুধু যে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সাথে এরূপ আচরণ করেছে, তা নয়; বরং এর আগে তাঁর মহান পিতার সাথেও একই আচরণ করেছে। আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর সাথে তাদের বিরোধিতার পেছনেও মূল দর্শন ছিল এটাই। আর আলী (আ.)ও যে তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরতেন, সেটাও ছিল এই কারণে। কেননা, শেরে খোদার প্রত্যেকটি তলোয়ার আঘাত যা নিশাচরীদের মস্তকের উপর নেমে আসত, উদ্দেশ্য ছিল যাতে খোদায়ী নূরের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ সে আলো থেকে উপকৃত হতে সক্ষম হয়।
তারা যেহেতু জাহেলি যুগে এবং হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের আমলে তাঁর থেকে বিষাক্ত আঘাতে জর্জরিত হয়েছিল, একারণে ৬১ হিজরিতে এর বদলা গ্রহণে উদ্যত হয়, যাতে ঐসমস্ত পরাজয়ের আংশিক উসূল করতে পারে। আর হোসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের প্রতি গালি ও অভিসম্পাত বর্ষণের মাধ্যমে মাওলা আলীকে খাটো করতে পারে। সুতরাং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কতলের রহস্য খুঁজতে হবে ইয়াযিদী জাহেল ও জুলুমপূজারীদের সেই সব পরাজয়ের মধ্যে যেগুলো তারা শেরে খোদার জুলফিকারের মাধ্যমে পরাজিত হয়েছিল। সানায়ী এরূপ ইরফানি দৃষ্টিকোণ থেকেই ইয়াযিদ ও তার লোক-লস্করকে লানতের ও অভিসম্পাতের পাত্র হিসাবে গণ্য করেন এবং তাদেরকে নিন্দা ও সমালোচনা করা মানুষের জন্য ইহকাল ও পরকালে সম্মান ও মুক্তির উসিলা বলে মনে করেন :
যে কেউ ঐ কুকুরগুলোর নিন্দাবাদ জানাবে
জেনে রাখ, সে বাদশাহি পাবে পরলোকে।
মরমি আরেফ সানাযী প্রকাশ্যে ও নির্দ্বিধায় ইয়াযিদ ও শিমারের প্রতি লানত বর্ষণ করেন এবং তাদেরকে চিরকালীন অভিশপ্ত হিসাবে গণ্য করেন। তিনি তাঁর ‘লোগাতনামা’র মধ্যে জল্লাদদের একজন একজন করে নাম উল্লেখ করেছেন এবং তাদের উপর লানত বর্ষণ করেছেন। তাদের কৃতকর্মকে অত্যন্ত লজ্জাজনক আখ্যায়িত করে তাদেরকে নিন্দাবাদ জানিয়েছেন এবং প্রত্যাখ্যাত বলে ঘোষণা দিয়েছেন :
কারবালা যখন করল মাকাম ও মঞ্জিল নির্মাণ
সহসাই ইবনে যিয়াদ সেথা হানল আক্রমণ
দেহ থেকে মস্তকগুলো কাটল খঞ্জরে
বড় ফায়দার লোভ ছিল তাদের এই কর্মে
পিপাসিত আলী আসগর তাকেও করে না রহম
আর ঐ কুকুরেরা মেনে নেয় এই নিদারুন জুলুম।
সানায়ী গাযনাভী কোথাও কোথাও ইয়াযিদ ও তার লোক-লস্করকে সামুদ গোত্রের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, তারাও ঠিক সেই কাজগুলোই করেছে যা সামুদ গোত্র করেছিল :
আমর বিন আস ও ইয়াযিদ ও ইবনে যিয়াদ
ঠিক যেন সেই গোত্র সামুদ, সালেহ ও আদ।
সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে অস্বীকার আর অস্বীকার
জুলুম আর অন্যায় করাই তাদের যত অঙ্গীকার।
অবিচার করায় একবারও করল না বিবেচন
মুস্তাফা ও মূর্তজার কথা করল না স্মরণ।
বুল-হাকামকে গ্রহণ করল, না আহমদ
নিজের কৃতকর্মে করল দোযখকে খরিদ।
অবশ্য মানুষের মধ্যে এমনও অনেকে রয়েছে যাদের অন্তর নিরেট কালো হওয়ার কারণে এবং আল্লাহর মারেফত না থাকার কারণে ইরফানের স্বাদই আস্বাদন করতে পারেনি। এরা দুনিয়ার মূল্যে নিজেকে বিক্রি করে দেয় এবং ইয়াযিদদের কাতারে দাঁড়ায়। যে কেউ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর রক্ত ঝরাবার কাজে রাজি থাকবে, অবশ সে পুণ্যবানদের ও আরেফগণের পক্ষ থেকে লানত ও অভিসম্পাত পাওয়ার যোগ্য হবে। অতএব, যে ব্যক্তি ইয়াযিদ ও আমর বিন আসের ন্যায় পাপিষ্ঠ লোকদের অনুসরণ করবে এবং এ নিয়ে গর্ব করবে, নিশ্চিতভাবে সে কেবল দুনিয়াতেই যে শুধু পুণ্যবানদের দোয়া-খায়ের থেকে বঞ্চিত হবে, তা নয়; বরং দুনিয়া এবং আখেরাতে তাদের বদদোয়া ও লানতের ভাগীদার হবে :
তুমি যে বল ইয়াযিদ আমার আমীর
আর পাপিষ্ঠ আমরে আস আমার পীর
তবে জেন পাপিষ্ঠ ইয়াযিদ হয় যার আমীর
কিংবা আমর বিন আস হয় যার পীর
আযাব ও লানত পাওনা হবে তার
সে তো নরাধম এক পাপিষ্ঠ বে-দ্বীন।
শুধু যে ইয়াযিদ ও তার দোসররা দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর আযাব ও আউলিয়াগণের লানতের পাত্র হবে, তা নয়; বরং যারা অন্যায়ভাবে এসব দুরাচারীকে পুণ্যভরে স্মরণ করবে, তারাও তাদের দলভুক্ত হবে :
ন্যায়বিচারীর লানত হোক তাদের উপর
যারা শ্রদ্ধায় স্মরণ করে এই জালেমদের।
তবে অবশ্য ওলি-আউলিয়াগণ এবং তরিকতের সাধকবৃন্দ ইমাম হোসাইন (আ.) ও আত্মোৎসর্গী সঙ্গী-সাথিদের প্রতি দরুদ ও সানা প্রেরণ পাঠ করাকে নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করে থাকে। আর এ কারণেই তাঁরা নিজেদেরকে সেই কাফেলার সহযাত্রী হিসাবে ঘেষেণা করেন যে কাফেলায় বর্শার মাথায় কাটা শির মোবারক থেকে কোরআন তেলাওয়াত করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ আর ইয়াযিদ ও তার দোসরদের প্রতি লানত প্রেরণ করা হচ্ছে হক ও বাতিল এই দুই বিপরীত পক্ষের মধ্যে সংগ্রামের অব্যাহত ধারাবাহিকতা। যা হযরত আদম সৃষ্টির শুরু থেকে অদ্যাবধি চলমান রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত চলতে থাকবে। একারণে ইমাম হোসাইন (আ.) সম্পর্কে কিংবা ইয়াযিদ সম্পর্কে একজন মানুষ কোন্্ অবস্থান গ্রহণ করবে তার উপর নির্ভর করবে সে হক পথে সাইর করছে নাকি বাতিল পথে। আর একারণেই ইরফানি দৃষ্টিকোণ থেকে ইয়াযিদ, শিমার ও তাদের দোসরদের প্রতি লানত বর্ষণ করা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে ও ভিত্তি খুঁজে পায়। সানায়ী’র ভাষায় :
আশুরা কোরবানির স্মরণ
সে তো সাইরকারীদের কল্বের শক্তির কারণ
সানায়ী দ্বীনি আমলসমূহ পরিপালনে কষ্ট ও মুসিবত সহ্য করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি তরিকতের বিভিন্ন স্তরে কঠিন শোকতাপগুলোকে বরণ করে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নিকট থেকে মদদ কামনা করেন। ইরফানের অঙ্গনে ইমাম হোসাইন ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে তিনি এমন এক মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেন যা আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। আর এ কারণেই আশুরার কোরবানি সম্পর্কে অধ্যয়ন করাকে নিজের উপরে এবং হাকিকত অন্বেষী মরমি সাধকদের জন্য ফরয বলে মনে করেন।
সানায়ী ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কোরবানিকে শুধু একটি আত্মত্যাগের মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেই ক্ষান্ত হননি; বরং মরমিবাদের যে ‘মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুকে আস্বাদন করার চর্চা রয়েছে’- সেদিক থেকে তিনি ইমাম (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদেরকে স্বাভাবিক মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুকে আস্বাদন করার উত্তম নজির হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মহান ওলি-আউলিয়াগণ ও খোদায়ী পুরুষগণ হচ্ছে তাঁরাই যাঁরা ইহজগতে তাঁদের নাফসের মৃত্যুকে অবলোকন করেছেন। পরিশেষে সানায়ী দাবি করেন যে, ইমাম হোসাইন (আ.) এই পরীক্ষাটি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন।
সানায়ী গাযনাভী আশুরা বিপ্লবের প্রকৃত স্বরূপ আর ইমাম হোসাইন (আ.)-এর চির অম্লান ব্যক্তিত্বের সঠিক অনুধাবন তখনই সম্ভব বলে মনে করেন যখন মানুষ গায়রুল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা লাভ করবে। অন্যথায় হোসাইন (আ.)-এর কাহিনী পাঠ করে তার কোনো উপকারে আসবে না। কারণ, ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক অগ্নিপরীক্ষার অভিজ্ঞতায় নেমেছেন যা মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদনকারীরা ছাড়া তা আস্বাদন করতে সক্ষম হবে না এবং তা অনুধাবন ও স্পর্শ করতে পারবে না।
হাকিম সানায়ী বিশ্বাস করেন, হক সবসময় বিজয়ী। যদিও ক্ষণিকের জন্য কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে। তাই ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক আন্দোলনের সূচনা করেন যার মূল শিকড় প্রোথিত রয়েছে আল্লাহর হাক্কানি সত্তার মধ্যে। এই কারণে তা কখনই বিস্মৃতির কবলে পড়বে না। পরাজয়ের ধুলোর আস্তরণও এর গায়ে বসবে না। হাকিম সানায়ী মনে করেন, যদিও পাপিষ্ঠ জালেমরা জাহেলিয়াতের বশবর্তী হয়ে খোদার দ্বীনের সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করেছে এবং রেসালাতের খান্দানের পবিত্র দরজা, যা ছিল জগতের শুদ্ধ পুরুষদের পছন্দনীয়, সেটাকে তারা পদদলিত করেছে, আর আলে ইয়াসীনের কর্তিত মস্তকগুলোকে বর্শার উপরে তুলেছে এবং তাদের শিরকাটা দেহগুলোর উপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়েছে, কিন্তু আসলে তারা তাদের এসব কৃতকর্ম দ্বারা অনন্তকালীন লানত ও অভিসম্পাতে আক্রান্ত করেছে। আমি সানায়ী বনি উমাইয়্যা খান্দানের এসব অপকর্মের প্রতি অসন্তুষ্টি ঘোষণা করছি। কিন্তু কারবালার ¯িœগ্ধ সমীরণ বেহেশতের বারতা বয়ে আনে যা অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য বটে। তাই আমি সেই নারীর গোলাম যিনি কারবালার ¯িœগ্ধ সমীরণের সুবাস গ্রহণের জন্য প্রতিদিন শহরের বাইরে চলে আসতেন এবং পিশাচ দুশমনের কোনো পরোয়া করতেন না। ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের অমরত্ব ও চিরন্তনতার পেছনে যে রহস্য নিহিত, সেটা হলো এই যে, তাঁরা হক (আল্লাহ) ও তাঁর সিফাতসমূহের তাজাল্লীকারী ছিলেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে খোদায়ী জামালের দর্পণসমূহ কখনই ভেঙ্গে যাবে না। বরং প্রত্যেক যুগ ও জামানায় আরও স্থায়ী ও টেকসই হবে। হাকিম সানায়ীর দৃষ্টিতে কারবালা হচ্ছে আল্লাহর বেহেশতেরই একটি টুকরা, যা জমিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর কারবালার শহীদগণ হচ্ছেন সেই পবিত্র ফুলসমূহ, যা কারবালার মাটিতে ফুটেছে এবং গোটা জাহানকে সুরভিময় করে তুলেছে।