আল্লামা ইকবাল- ইসলামী বিশ্বের এক মহান সংস্কারক
পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ৬, ২০১৪
মাহমুদ বায়াত
‘বর্তমান যুগ ইকবালের বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ,
তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব
যিনি লক্ষ জনকে অতিক্রম করেছেন,
কবিকুল পরাজিত সৈন্য বাহনীর মতো দিগি¦দিক ছুটেছে,
আর তিনি তো শত অশ্বারোহীতুল্য যোদ্ধা।’
(মালেকুশ শোয়ারা বাহার)
ইকবালের জীবন ও কর্মের বর্ণনা তথা প্রাচ্যের এই দার্শনিকের চিন্তা ও কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন এক দুরূহ বিষয়। সৌভাগ্যের বিষয় যে, পৃথিবী তাঁকে উত্তমরূপেই জানে। তিনি ছিলেন এক বিশাল ও মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। মানবিক ও আত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং একজন মুসলমান হিসাবে তিনি বিশেষ কোন ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে নিজেকে সংশ্লিষ্ট রাখেননি। ইকবালের চিন্তাধারা হচ্ছে সমগ্র ইসলামী চিন্তাদর্শ বিকাশের দর্পণস্বরূপ যা ধীরে ধীরে সমগ্র ইসলামী বিশ্বে বিস্তার লাভ করেছে। তিনি কেবল এক বিশাল ব্যক্তিই নন; বরং তিনি ছিলেন মানুষের জন্য একটি দৃষ্টান্ত ও আদর্শ।
বস্তুত ইকবালকে ইসলামী বিশ্বের বিশেষত উপমহাদেশের সংস্কারক হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। তাঁর সংস্কারধর্মী চিন্তাধারা নিজ দেশের সীমা অতিক্রম করেছে। তাঁরই সাহসী প্রেরণায় একটি ইসলামী দেশ হিসাবে পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল।
তিনি বলেন
قلب ما از هند و روم و شام نیست
مرز و بوم ما بجز اسلام نیست
‘আমাদের আত্মা শাম (সিরিয়া), রোম ও
ভারতে সীমাবদ্ধ নয়,
একমাত্র ইসলামই আমাদের সীমান্ত।’
ইকবালকে অনুধাবন কোন ব্যক্তি বিশেষের অনুধাবন নয় বরং একটি সংগঠন ও একটি আদর্শের অনুধাবন এবং সর্বোপরি আমাদের অবস্থা, পরিবেশেরও অনুধাবনস্বরূপ।
ইকবাল সে প্রথম পর্যায়ের ব্যক্তিদেরই একজন যিনি সমাজ ও দার্শনিক চিন্তাধারার পুনর্গঠন করে এটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করেন- যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা-দর্শন ও আইনগত বিশেষ প্রক্রিয়ায় সুবিন্যস্ত। ইকবাল তাঁর দর্শন ও চিন্তাধারাকে তাওহীদের ভিত্তির ওপরে বিন্যস্ত করেন। ইকবালের দৃষ্টিতে তাওহীদ হলো এক আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন- যা নির্ভর করে মানুষের ঐক্য ও দৃশ্যমান জগতের প্রতিটি উপকরণের ঐক্যের ওপর। আর এর মধ্যেই মানুষ তার প্রাকৃতিক পর্যায়ে পূর্ণতা লাভ করে থাকে। ইকবালের চিন্তাধারার গভীর উপলব্ধি ব্যতীত উপমহাদেশের সাম্প্রতিক বিবর্তন ও ঘটনা প্রবাহের অনুধাবন অসম্ভব।
ইকবাল কেবল চিন্তা-ভাবনা করেই ক্ষান্ত হননি; বরং তিনি ছিলেন এক সংগ্রামী পুরুষ। কার্যত তিনি ছিলেন একজন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লোক। নিজস্ব চিন্তাধারাকে কাব্যের আঙ্গিকে প্রকাশ করাই হচ্ছে ইকবালের বিশেষত্বসমূহের একটি। তবে তাঁর চিন্তা, দর্শন ও কাব্য প্রতিভা ইসলামের সেবায়ই নিয়োজিত ছিল।
ইকবালের কবিতা কেবল কবিতা নয়; বরং এগুলো হলো দর্শন, চিন্তা এবং একটি নতুন দেশ ও জাতি গঠনের উদাত্ত আহ্বান ও পরিকল্পনায় পূর্ণ।
ইকবাল পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি উত্তমরূপে জানতে পেরেছিলেন এবং এর পারিপার্শ্বিকতাকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। যার ফলে পাশ্চাত্যও তাঁকে দার্শনিক হিসাবেই অভিহিত করেছিল।
ইকবাল তাঁর সমস্ত জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধির আলোকে পাশ্চাত্য সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পান এবং পরিপূর্ণ আদর্শের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে অন্তঃসারশূন্য হিসাবে দেখতে পান।
কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি মুসলমানদেরকে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের জন্য আহ্বান জানান। তবে সাথে সাথে তাদেরকে পাশ্চাত্যের অনুকরণ ও পাশ্চাত্য প্রীতি হতে দূরে থাকতে বলেছেন।
তিনি বলেন :
ای اسیر رنگ پاک از رنگ شو
مؤمن خوب کافر افرنگ شو
رشته سود و زبان در دست توست
آبروی خاوران در دست توست
‘হে পবিত্র রঙের বন্দী, রঙের আলোকেই মু’মিন হও,
পাশ্চাত্যকে প্রত্যাখ্যান করো,
লাভ-ক্ষতির বিষয় তো তোমার হাতেই,
প্রাচ্যের মান-সম্ভ্রম তো তোমার হাতেই নিবদ্ধ।’
ইকবাল গভীর অভিনিবেশ সহকারে কুরআন অধ্যয়ন করেন। তিনি তাঁর জীবনের কোন পর্যায়েই কুরআন অধ্যয়ন থেকে দূরে সরে যাননি।
তিনি বলেন :
گر تومی خواهی مسلمان زیستن
نیست ممکن جز به قرآن زیستن
پیش قرآن بنده و مولا یکی است
بوریا و مسند و دیبایکی است
‘যদি তুমি মুসলমান হিসাবে বেঁচে থাকতে চাও-
তবে কুরআন অবলম্বন ছাড়া তা সম্ভব নয়;
কুরআনের নিকট রাজা প্রজা সবাই সমান,
চাটাই, সিংহাসন ও রেশম একই।’
ইকবাল মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করেন। তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে শিক্ষামূলক ও বিপ্লবী কবিতা রচনা করেন যা ছিল ইকবালের কাব্য দর্শন ও কাব্য-চিন্তার মূল উৎস।
তিনি বলেন :
هر که عشق مصطفی سامان او است
بحر و بر تر گوشه دامان اوست
در دل مسلم مقام مصطفی است
آبروی مازنام مصطفی است
‘মোস্তফার প্রেমই যার সম্বল
সাগর ও ভূমি তার করতলে,
মুসলমানের হৃদয়ে রয়েছে,
মোস্তফার আসন,
আর আমাদের সম্ভ্রম মোস্তফার নাম থেকেই উৎসারিত।’
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর প্রশংসায় তিনি বলেন :
مسلم اول شه مردان علی
عشق را سرمایه ایمان علی است
از ولای دودمانش زنده ام
در جهان مثل گهرتا بنده ام
‘বীর শ্রেষ্ঠ আলীই হচ্ছেন প্রথম মুসলমান,
ইশ্কই হচ্ছে আলীর ঈমানের পুঁজি,
তাঁর পরিবারের ভালোবাসার বন্ধনেই আমি বেঁচে আছি,
আর আমি বিশ্বে আলোক বিচ্ছুরণকারী মণি-মুক্তাস্বরূপ।’
মহানবীর আদরের দুলালী হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর প্রসঙ্গে তিনি বলেন : ‘তিনটি কারণে ফাতেমা যাহরা মর্যাদার অধিকারী। প্রথমত, রাসূলের কন্যা, দ্বিতীয়ত, হযরত আলী (আ.)-এর স্ত্রী, তৃতীয়ত, কারবালার মহান শহীদ ইমাম হোসাইনের মা।’ এছাড়াও তিনি এই মহীয়সী মহিলার অনুসরণ করার জন্য মহিলাদেরকে উপদেশ দিয়েছেন।
ইকবাল শহীদদের নেতার প্রশংসায় বলেন :
رمز قرآن از حسین آموختیم
زآتش او شعله ها اندوختیم
‘কুরআনের রহস্য হোসাইন থেকে শিখেছি,
তাঁর অগ্নি থেকেই শিখাসমূহ সংগ্রহ করেছি।’
ইকবালের দৃষ্টিতে মানবিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমেই কেবল সামাজিক পরিশুদ্ধি অর্জন সম্ভব। আর এভাবেই সৃষ্টির উন্নতি এবং যথাযথ বিকাশ সম্ভব। সমস্ত অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব মানুষ এবং তার উপলব্ধি থেকেই উৎসারিত হয়ে থাকে।
ইকবালের দর্শন হচ্ছে আত্মোপলব্ধির দর্শন। অর্থাৎ আত্মার স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতা। তাঁর দৃষ্টিতে যদি কেউ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার লাভে সমর্থ হয় এবং আত্মাকে চিনতে সক্ষম হয়, তাহলে তিনি তার ভিতরে এমন একটি জগৎ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন যা বাহ্যিক জগতের সমস্ত অপরিপূর্ণতাকে দূর করতে সক্ষম।
ইকবাল মানুষকে সচেতন, স্বাধীন, চিন্তাশীল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হিসাবে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর মতে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি আসক্তিই হচ্ছে মানুষের বড় শত্রু। তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার উপকরণগুলোকে বস্তুবাদী এবং এর প্রকৃতিকে সাম্রাজ্যবাদী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
তিনি বলেন :
آدمیت زار نالید از فرنگ
زندگی هنگامه برچید از فرنگ
پس چه باید کردای اقوام شوق
یاز روشن می شود ایام شرق
در ضمیرش انقلاب آمد پدید
شب گذشت و آفتاب آمد پدید
مشکلات حضرت انسان از اوست
آدمیت را غم پههان از اوست
‘পাশ্চাত্যের যাঁতাকলে (পিষ্ট হয়ে) মানবতা ক্রন্দন করছে,
পাশ্চাত্যের অভিশাপে মানব জীবন বিপর্যস্ত;
হে, প্রাচ্যের জাতিসমূহ! তোমরা কি জান আজ আমাদের করণীয় কি?
প্রাচ্যের দিনগুলো পুনরায় আলোকিত হতে যাচ্ছে,
এর (প্রাচ্যের) হৃদয়ে বিপ্লব দানা বেঁধে উঠছে,
রাত্রি অতিক্রান্ত হয়েছে এবং সূর্য উদ্ভাসিত হয়েছে।
তার (পাশ্চাত্য) কারণেই মানুষের যাবতীয় সমস্যা,
আর তার কারণেই মানবতার যত ভোগান্তি।’
ইকবাল বিশ্বাস করেন যে, ইসলামী প্রাচ্য তার প্রকৃত সত্তাকে হারিয়ে ফেলেছে এবং তাকে অবশ্যই এর পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হতে হবে।
তাঁর মতে বর্তমান অবস্থায় ইসলামী সমাজ পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসার কারণে একদিকে যেমন তার স্বকীয় জাতিসত্তাকে হারিয়ে ফেলেছে তেমনি ব্যক্তিবর্গের ওপরও অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছে। ইকবাল আরো বলেন যে, তাদের অভ্যন্তরীণ স্বকীয় বৈশিষ্ট্য যা ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার আলোকে আলোকিত- সে দিকেই তাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
ইকবাল বলেন :
ای غنچه خرا بیده چونرگس، نگران خیز
کاشانه ما رفت به تاراج، غمان خیز
از ناله مرغ چمن ازبانگ اذان خیز
ازگرمی هنگامه آتش نفسان خیز
از خواب گران، خواب گران، خواب گران خیز
از خواب گران خیز
‘হে ঘুমন্ত পুষ্প কলি ! নার্গিসের মতো জেগে উঠো,
আমাদের আবাসগুলো লুণ্ঠিত হয়েছে,
পরিতাপ নিয়ে জেগে উঠো,
বাগানের বুলবুলের ক্রন্দন এবং আজানের সুমধুর
ধ্বনিতে জেগে উঠো,
শৌর্য বীর্য বিপ্লবী চেতনায় জেগে উঠো,
তোমার দীর্ঘ নিদ্রা, দীর্ঘ নিদ্রা, দীর্ঘ নিদ্রা হতে জেগে উঠো,
তোমাদের দীর্ঘ নিদ্রা থেকে জেগে উঠো।”
ইকবাল যেমন ছিলেন একজন চিন্তাশীল দার্শনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তি তেমনি তিনি শিল্প ও সাহিত্য বিশেষত ফারসি কবিতায়ও অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। তিনি আসরার ও রামুজ, পায়ামে মাশারেক, জাবুরে আজম, জাভিদ নামেহ, পাস চে বায়াদ কারদ ও আরমুগানে হেজাজ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে ৯ হাজারেরও অধিক ফারসি শ্লোক রচনা করেন যা হচ্ছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এবং ইরানের কবিদের প্রতি এ বিপ্লবী কবির গভীর আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ। বিভিন্ন কবিতায় তিনি এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তিনি বলেন :
پارسی بین تاببینی نقش های رنگ رنگ
بگذر از مجموعه اردو که بیرنگ منست
گرچه هندی درعذوبت شکّر است
طرز گفتار دری شیرین تر است
‘ফারসির প্রতি লক্ষ্য করো যাতে করে তুমি বৈচিত্র্যময় বক্তব্য দেখতে পাবে,
আমার বৈচিত্র্যহীন উর্দু রচনাবলি ত্যাগ করো,
যদিও মাধুর্যের দিক থেকে হিন্দি সুমিষ্ট,
(কিন্তু) ফারসি ভাষার বর্ণনারীতি অধিকতর সুমিষ্ট।’
যদিও ফারসি ভাষার এ উন্নত মর্যাদার কবি কখনো ইরান সফর করেননি, তথাপি তিনি ইরানকে স্মরণ করে বলেন :
محرم رازیم باما راز گوی
آنچه میدانی از ایران بازگوی
‘আমরা গোপন কথার রক্ষক
আমাদের কাছে গোপন কথা বলতে পারো,
ইরান সম্পর্কে তুমি যা কিছু জানো আবার বলো।’
ইকবাল আরো বলেন :
تهران هوگر عالم مشرق کا جنیوا
شاید کره ارض کی تقدیر بدل جائی گا
‘তেহরান যদি প্রাচ্যের জেনেভা হয়,
তাহলে বিশ্বের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়ে যাবে।’
ইকবালের বিশ্বদর্শনই হচ্ছে ইকবাল দর্শনের প্রকৃত স্বরূপ যা বিশ্বমানবতার সাথে সংশ্লিষ্ট। তাঁর বাণী হচ্ছে মানবতার প্রতি দরদ ও ভালোবাসার বাণী- স্বাধীনতার বাণী। নিঃসন্দেহে সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা কখনো মৃত্যুবরণ করেন না। ইকবালের তেজোদ্দীপ্ত আত্ম-অনির্বাণ অনুভূতিসমূহ তরঙ্গের ন্যায় গর্জন করছে। আর বিশ্বমানবতা বিশেষ করে মুসলমানদেরকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতার দিকে আহ্বান করছে।
ইকবাল বলেন :
نه ترکیم ونه افغان وتتاریم
چمن زادیم واز یک شاخساریم
تمیزرنگ وبو بر ما حرام است
که ما پرورده یک شاخساریم
‘আমরা তুর্কী নই, আফগানী নই, তাতার নই,
এ শ্যামল সবুজ মাঠেই আমাদের জন্ম,
আমরা একই শাখা-প্রশাখা হতে সৃষ্ট।
আমাদের জন্য রং ও ঘ্রাণের পার্থক্যকরণ অবৈধ।
কেননা আমরা একই শাখা-প্রশাখা থেকে প্রতিপালিত হয়ে এসেছি।’
(অনুবাদ : আরিফ বিল্লাহ)