আলেম, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিকদের উদ্দেশে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নসিহত
পোস্ট হয়েছে: অক্টোবর ২২, ২০১৯
মাহদি মাহমুদ –
ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর বিপ্লব ও সংগ্রামের উদ্দেশ্য সুবিস্তরে তুলে ধরেছেন মিনায় প্রদত্ত ভাষণটিতে যা অনাগত কালের মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আজ আমরা ওই ভাষণেরই একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
ইমাম হোসাইন মক্কায় অবস্থানকালে এই ভাষণটি দিয়েছিলেন। আমীর মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর যখন ইয়াযীদের পক্ষে বাইআত করার জন্য তাঁর ওপর জোর-জবরদস্তি শুরু হয় তখন তিনি মদিনা ত্যাগ করেন এবং মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একাধারে হজ করা এবং হজের জন্য আগত মুসলিম বিশ্বের মানুষের উদ্দেশে সতর্কবাণী পৌঁছে দেয়া, বনি উমাইয়ার মাত্রাছাড়া জাহেলিয়াত, সুন্নাহবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদেরকে সচেতন করা। সেই লক্ষ্যেই ৬০ হিজরির জিলহজ মাসে মিনায় ইমাম হোসাইন এই ভাষণটি প্রদান করেন।
ভাষণে তিনি ‘হে লোকসকল বা জনগণ’ সম্বোধনে শুরু করেন। অতঃপর তিনি কুরআনের আয়াত পাঠ করেন, ‘কেন ধার্মিক ব্যক্তিরা (আল্লাহওয়ালা আলেমগণ) এবং প-িতগণ তাদের পাপের কথা ও নিষিদ্ধ বস্তু ভক্ষণ হতে নিষেধ করে না? নিশ্চয় তারা যা করছে তা অত্যন্ত জঘন্য।’ (সূরা মায়িদা : ৬৪)
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, ইমাম হোসাইনের ভষণটি সামগ্রিকভাবে তৎকালীন এবং অনাগত যুগের সচেতন জনগণের উদ্দেশে এবং নির্দিষ্ট করে বললে, মুসলিম আলেমসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশেই ছিল। এভাষণে তিনি আলেমসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে ‘হে শক্তিমান সম্প্রদায়! যারা জ্ঞানে বিখ্যাত’ বলেও সম্বোধন করেছেন। আলেমসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে তিনি শক্তিমান মনে করেন। কেননা, তাঁদের আছে প্রজ্ঞা। জনগণ তাঁদেরকে ভরসা এবং সম্মান করে। তিনি বলছেন, ‘মর্যাদাবান ব্যক্তি তোমাদেরকে (আলেম এবং বুদ্ধিজীবী) মূল্যায়ন করে এবং দুর্বল ব্যক্তি তোমাদেরকে শ্রদ্ধা করে।… তোমরা সম্রাটদের শান সহকারে এবং বুজুর্গদের সম্মান সহকারে রাস্তায় পথ চল।’ কিন্তু কেন? তিনি নিজেই উত্তর দিচ্ছেন, ‘এসব কি এজন্যই নয় যে, জনগণ তোমাদের প্রতি আশা রাখে যে, তোমরা আল্লাহর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন করবে?’
আলেমগণের শ্রদ্ধার মাপকাঠি জনগণের নিকটে এজন্য হওয়া উচিত যে, তাঁরা আল্লাহর অধিকার প্রতিষ্ঠার জ্য আন্দোলন করেন। জনগণকে সংগঠিত করেন। দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে যেখানেই নিপীড়িত মানুষ রয়েছে, যেখানেই যালেমরা মযলুমের রক্ত ঝরাচ্ছে সেখানেই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠবে আলেম এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ।
ইমাম তাঁর ভাষণের এই পর্যায়ে আবারো হুশিয়ার করে দিচ্ছেন যে, আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতি মানুষের ইতিবাচক মূল্যায়ন এবং আল্লাহপ্রদত্ত অধিকার ও ক্ষমতা এজন্য নয় যে, তাঁরা বেশি বেশি নামায পড়েন কিংবা ব্যক্তিজীবনে ঈমানদারির পরিচয় দেন।
ইমাম বলছেন, ‘আল্লাহর প্রতি ঈমানদার বান্দা সংখ্যায় অনেক, কিন্তু জনগণ তাদের শ্রদ্ধা করে না। আর তোমরা আল্লাহর কারণে জনগণের মাঝে সম্মানের পাত্র। এখন তোমরা স্বচক্ষে আল্লাহর নির্দেশ-আল্লাহর প্রতি কৃত অঙ্গীকারসমূহকে ভঙ্গ হতে দেখেও কেন ভয় করছ না?’
ইমাম হোসাইন তৎকালীন এবং অনাগত যুগের আলেম এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন- ‘তোমাদের ব্যাপারে আমার আশংকা হয় যে, ঐশী কোনো প্রতিশোধ তোমাদের ওপর নেমে আসবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের ওপর দুর্দশা অন্যদের চেয়েও বড়। কারণ, তোমরা যারা আলেম এবং প-িত, তোমরা তোমাদের জ্ঞান এবং মর্যাদাকে রক্ষার দায়িত্বে ব্যর্থ হয়েছ।’
কী এমন অপরাধ যার কারণে ইমাম হোসাইন এভাবে হুশিয়ার করে আশংকা করছেন যে, তাঁদের ওপর আল্লাহর গজব নাযিল হবে? কি ছিল আল্লাহর প্রতি কৃত অঙ্গীকার এবং আল্লাহর অধিকার- যা প্রতিনিয়ত ভঙ্গ হচ্ছিল এবং আজকের যুগেও হয়ে চলেছে?
ইমাম হোসাইন নিজেই কোরআন মজীদের দুটি আয়াত দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। আল্লাহর বাণী মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
ঈমাম হোসাইন বলছেন, “মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষকে ভয় করো না। ভয় করো আমাকে।’ (সূরা মায়িদা : ৪৪)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘মুমিন নরনারীরা একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজে আদেশ করে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে। (সূরা তওবা : ৭১)।”
ইমাম হোসাইন এরপর বলছেন, ‘আল্লাহ সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করাকে ফরজ করেছেন। কারণ, তিনি জানতেন, যদি এই ফরজটি পালন করা হয় বা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সহজ-কঠিন সব ফরজই পালন করা হবে।’
এই ‘আম্্র বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ আসলে কোন্গুলো? মানুষকে জোর করে নামাযে ধরে নিয়ে যাওয়া? জবরদস্তি করে ইসলামের পথে আনা? ধরে-বেঁধে জোর করে ধর্মীয় মজলিশে নিয়ে যাওয়া? না।
অতঃপর তিনি ব্যাখ্যা করলেন, এসকল ‘আম্র বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ বলতে আল্লাহ তাআলা কোন্গুলো বুঝিয়েছেন।
‘সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ হলো অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া অধিকার ফিরিয়ে দেয়া (এর জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করা), যালিমের বিরোধিতা, বাইতুল মাল ও গনিমত বণ্টন, যাকাতের নিসাব থেকে যাকাত গ্রহণ এবং তা যথার্থ খাতে ব্যয় করা।’
তিনি ভাষণেরই আরেক স্থানে বলছেন, ‘সকল জনপদে অন্ধ, বোবা আর দুর্বলেরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছে এবং তাদের ওপর দয়া করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে তোমরাও তোমাদের (আলেম ও বুদ্ধিজীবী) পদ অনুযায়ী এবং দায়িত্ব মোতাবেক কাজ করছ না। আর যে ঐ কাজ করছে তাকেও সাহায্য করছনা। যালিমদের সাথে আঁতাত ও আপোস করে নিজেদেরকে ঝামেলামুক্ত রাখছ। এসবই হলো সেই সকল জিনিস যেগুলোকে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধের জন্য আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।’
এরপর ইমাম হোসাইন আলেম সমাজের নখদন্তহীন দুর্বল এবং সম্মানহানীর কারণ তুলে ধরেন।
‘নির্দেশাবলি ও বিধি-বিধানের বাস্তবায়ন আল্লাহর জ্ঞানে প-িত ও বিদ্বানের ওপর ন্যস্ত যারা তাঁর হালাল ও হারামের বিশ্বস্ত রক্ষক এবং শাসনকর্তৃত্ব তাদের হাতেই থাকতে হবে। সুতরাং তোমরা হলে তারাই যাদের থেকে সেই পদ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, তোমরা সত্যপথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছ এবং যথেষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নীতিপন্থা স¤পর্কে মতবিরোধ করেছ।’
তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা নিজেরাই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছ এবং খোদায়ী শাসনকর্তৃত্বকে তাদের (যালিমদের) হাতে সোপর্দ করেছ যাতে তারা সংশয়প্রণোদিত কাজ করে এবং স্বীয় কামনার বশীভূত হয়ে চলে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের মৃত্যুভয় এবং দুনিয়ার জীবন- যা তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই তাদেরকে এই পদে আসীন করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তারা (আলেম এবং বুদ্ধিজীবী) তাদের সময়ে যারা যালিম ছিল তাদের নোংরা ও জঘন্য কাজ প্রত্যক্ষ করত, কিন্তু তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করত না- তাদের হাতে যা ছিল তার লোভে এবং কোণঠাসা হয়ে পড়ার ভয়ে।’
এর ফলশ্রুতিতে মুসলিম সমাজের পরিণতি কী হলো?
‘তোমাদের (আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের) এরূপ মানসিকতা (উদাসীনতা) এবং জীবনপদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমেই তোমরা অক্ষমদেরকে তাদের (যালিমদের) অধীন করেছ। ফলে অক্ষমদের একদল এখন তাদের গোলামি শুরু করেছে। আরেকদল এক লোকমা খাবারের সন্ধানে নিরুপায় হয়ে পড়েছে। এবং এসকল শাসক তাদের মতো করে রাষ্ট্রকে ওলট-পালট করে এবং পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে।’
অতঃপর ইমাম হোসাইন যুগের আলেম ও বুদ্ধিজীবীদেরকে তাঁদের হৃত সম্মান ও ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পথ বাতলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ‘তোমরা যদি (যালেমদের) নিপীড়নে ধৈর্যধারণ করো এবং আল্লাহর পথে সহনশীল হও তাহলে শাসনকর্তৃত্ব তোমাদের হাতে ফিরে আসবে এবং তোমাদের পক্ষ থেকেই বাস্তবায়ন হবে এবং তোমরাই জনগণের বিষয়াদির সমাধানস্থলে পরিণত হবে।’
পরিশেষে ইমাম হোসাইন বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি জান যে, আমার থেকে যা কিছু প্রকাশ পেয়েছে তা শাসনকর্তৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নয় এবং দুনিয়ার পণ্যের লোভেও নয়। এজন্য যে, তোমার দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত দেখব এবং তোমার রাজ্যে সংস্কার করব আর তোমার নিপীড়িত বান্দাদেরকে চিন্তামুক্ত করব এবং তোমার ওয়াজিব এবং (নবীর) সুন্নাত এবং বিধিবিধান পালন করব।’
এই ভাষণে জনগণের উদ্দেশে তাঁর শেষ কথা ছিল- ‘তোমাদের উচিত আমাদের সহায়তা করা। আমাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা। যালিমদের শক্তি তোমাদের ওপর রয়েছে। তারা তোমাদের নবীর নূরকে নিভিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। আর আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাঁর ওপরেই ভরসা করি, তাঁর দরবারেই প্রত্যাবর্তন করব। শেষ পরিণতি তাঁরই অভিমুখে।’