শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইরানের ৩৮তম ইসলামি বিপ্লববার্ষিকী ও প্রায়োগিক দিকসমূহ

পোস্ট হয়েছে: মার্চ ১২, ২০১৭ 

রাশিদ রিয়াজ

এমন এক সময় ইরানের ইসলামি বিপ্লব বার্ষিকী অতিক্রান্ত হচ্ছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাতটি দেশের অভিবাসী নিষিদ্ধ করে রণহুঙ্কার দিচ্ছেন। তাঁর হাত ধরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে আহ্বান জানিয়েছেন একাট্টা হতে যাতে দুটি দেশ পুরো বিশ্বকে একচেটিয়া শাসন করতে পারে। আর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন একই অভিপ্রায়ে। যে সাতটি দেশের অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ট্রাম্প, তার অন্যতম দেশ ইরান প্রতিরক্ষাজনিত নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে কয়েকটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করায় প্রবল গোস্বা হচ্ছেন কারা এবং খেয়াল রাখুন তার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশ সিরিয়া ও ইয়েমেনে সামরিক আগ্রাসন চালাচ্ছে পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে মিলে। বিশ্বে ইসরাইলের অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই কেন?
একারণেই বিশ্বে ইরানের ইসলামি বিপ্লব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এবং তার প্রায়োগিক বিষয়টি জানান দেয়। দিন কয়েক আগে ইরান তার সমুদ্রসম্পদ জরিপে নিজেদের তৈরি জাহাজ ভাসিয়েছে। এমন এক জাহাজ তৈরির প্রেরণা দিয়েছিলেন বিপ্লবের মহান ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী। ৩ লাখ ঘণ্টা ব্যয় করে প্রযুক্তিবিদ, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মিলে জাহাজটি তৈরি করেছেন। এমন নবযাত্রার অনেক কাহিনীর জন্ম দিয়ে চলেছে নিরন্তর ইরানের ইসলামি বিপ্লব। সাম্রাজ্যবাদের এককেন্দ্রিক রাজনীতি তাই ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে উঠছে। ইউরোপ, চীন, ভারত, রাশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার দেশসহ অনেক রাষ্ট্রই বিলম্বে হলেও ইরানের ইসলামি বিপ্লবের গ্রহণযোগ্যতা অনুধাবন করে অবরোধ কিংবা নিষেধাজ্ঞাকে পায়ে মাড়িয়ে সহাবস্থানে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছে। শোষক ও স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরানের ইসলামি বিপ্লব এখন গবেষণার বিষয়। এ গবেষণা প্রয়োজন বৈষম্যহীন বিশ্ব সৃষ্টির জন্য। কিউবা, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, ব্রাজিল, আর্জেন্টনা, নিকারাগুয়ার গণমিছিলের সঙ্গে একদিন হয়ত বাংলাদেশের মানুষও যাত্রা শুরু করবে অভিন্ন গন্তব্যে। এ যাত্রায় ইসলামভীতি বা ইসলামকে জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপন করে যারা অস্ত্র ও অর্থ জুগিয়ে চলছে ¯্রফে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত ও শোষণের হাতিয়ার যুগ যুগ টিকিয়ে রাখতে তার বিপরীতে ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও সংস্কৃতি মানুষের জন্য বেঁচে থাকার অনন্য সৃষ্টি। কিন্তু ইরানের বিপ্লব খোদায়ী প্রেমের এমন এক নজির স্থাপন করেছে যা পরাশক্তিকে তুচ্ছ ভেবে মাথা উঁচু করে সাহসের সঙ্গে দাঁড়াতে সাহায্য করে।
২০১৫ সালে বিশ্বের ৬টি পরাশক্তির সাথে যে পারমাণবিক চুক্তিতে তেহরান সম্মত হয়, সে অনুযায়ী আরো অন্তত আট বছর তারা ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিয়ম মেনে চলবে। ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হোসেইন দেহগান বলেছেন, তাঁরা পূর্বঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করবেন। এতে কোনো হস্তক্ষেপ বা প্রভাব গ্রহণযোগ্য নয়।
একই সঙ্গে ইরান নিজেদের তৈরি চারটি উপগ্রহ নিক্ষেপ করেছে। এও বলে দেওয়া হয়েছে, ইরান একদিনের জন্যও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়াবে না। সাতটি দেশের অন্যতম ইরানের কোনো নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দেশটি অনুরূপ পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। ঠিক ওই সময় ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইরান এসে বলেছেন, এ বছর ইরানের নাগরিকদের জন্য তাঁর দেশ ভিসা দ্বিগুণ করবে। ইরান আরো বলছে, আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের পরিচয় উল্লেখ করবে না। রাশিয়া, আযারবাইজান, তুরস্ক, ইরাক সহ নানা দেশ ইরানের সঙ্গে নিজেদের মুদ্রায় লেনদেন শুরু করেছে। অথচ অন্য ৬টি দেশ সোমালিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন ইরানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না কেন? কারণ, ওই ৬টি দেশে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মতো কোনো বিপ্লব সংঘটিত হয় নি। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ২২০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য হয় এবং এ সাতটি দেশের মুসলিম অভিবাসীদের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বছরে যুক্তরাষ্ট্রকে ৬৬ বিলিয়ন ডলার মাশুল গুণতে হবে বলছে এক জরিপে। ইরানে বোয়িং বিমান বিক্রির জন্য যে সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে তা বাতিল হলে বছরে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হারাবে। আগামী ১০ বছর ধরে বোয়িং কোম্পানির এসব বিমান ইরানে সরবরাহ দেওয়ার কথা।

মধ্যপ্রাচ্যের ১৪টি দেশে বিদেশি বিনিয়োগের তুলনায় ইরান ১২তম অবস্থানে ছিল। কিন্তু অবরোধ প্রত্যাহারের ৬ মাসের মাথায় ইরান এখন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পরেই অবস্থান করছে। ন্যাটো বা কোনো প্রভাবশালী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা প্রমাণ দিতে পারে নি ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্পাই স্যাটেলাইটগুলো অনুরূপ কোনো প্রমাণ দিতে পারে নি।
ইরান যা করছে তা হচ্ছে বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি। গত বছর ২২টি বিদেশি বিনিয়োগ চুক্তি করতে সমর্থ হয় ইরান। বোয়িং এর সঙ্গে চুক্তির পাশাপাশি ১১৮টি বিমান কিনতে ইরান এয়ারবাসের সঙ্গে ২৭ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। এসব চুক্তি স্মরণকালের সবচেয়ে কম দামে বিমান কেনার ক্ষেত্রে দরকষাকষি করে সফলতা পেয়েছে ইরান। ইরান তার প্রতিবেশি দেশ ইরাক, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ভারত, এমনকি চীনের সঙ্গে জ্বালানি রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি রেল যোগাযোগ উন্নয়নে অনেক দূর এগিয়েছে। ইরাকে রপ্তানি হচ্ছে ইরানের বিদ্যুৎ। আইএস জঙ্গি দমনে সিরিয়া ও ইরাকে রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের সহযোগিতায় এধরনের সন্ত্রাস প্রতিরোধে অভাবিত সফলতা মিলেছে। অথচ ২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র একা সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করেও আইএস জঙ্গি দমনে সামান্যই এগুতে পেরেছে।
তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে আগামী দশ বছরে গ্যাসের বিনিময়ে পণ্য কিনবে ইরান এবং এধরনের পণ্য বিনিময়ের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলার। ইরানের জাতীয় নেতৃত্ব যদি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা না করে দুর্নীতির অতলে তলিয়ে যেত তাহলে অবরোধ মোকাবেলা করে অর্থনৈতিকভাবে এভাবে এগিয়ে যাওয়া দেশটির পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ইরান ছাড়া বাকি ৬টি দেশে সন্ত্রাস দমনে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে তার জন্য পশ্চিমা দেশ ও মিত্র আরব দেশগুলো দায়ী। লিবিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, সিরিয়া, ইরাক, সুদানে আজকের পরিস্থিতির জন্য পশ্চিমা দেশগুলো পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী চক্র সৃষ্টি করেছে। তাকে দমনের নামে এসব দেশে অভিযান চালাচ্ছে। আর এসব দেশের মানুষ অভিবাসী হিসেবে মানবেতর জীবন যাপন ও সস্তা শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে। ইরানের নেতারা এসব বিষয় খুব ভালো বুঝেন বলেই নিজেদের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক গতিধারা বিনির্মাণ করেছেন যার নির্দেশনা দিয়েছে ইসলামি বিপ্লব। অবরোধ উঠে যাওয়ার পর এজন্য আগামী মার্চের মধ্যে ইরান ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তেল রপ্তানি করতে সমর্থ হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে ইরানের সঠিক কর্মপন্থা।
যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন মিডিয়া মিলিটারি টাইম্স বলছে, ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে এ বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু ইরাক ও সিরিয়ায় বিমান হামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৮৬১ বার। এসব হামলার ১৩ হাজার ৯৮৯টি যুক্তরাষ্ট্র একাই করেছে। বাকিগুলো করেছে মিত্র দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জর্ডান, নেদারল্যান্ড, সৌদি আরব, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত। এসব হামলায় দেশগুলোর জঙ্গি বিমান উড়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৯ বার। এরপরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, ইরাক দ্রুত দখল করে নিচ্ছে ইরান। তার দেশ ইরাকে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জন্য ইরানকে সতর্কবার্তা দেন ট্রাম্প। কিন্তু ইরান তো কোনো দেশ আক্রমণ করছে না। অন্যদেশের মতো তারও নিরাপত্তা ও নিজেকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে। ইসলামি বিপ্লবের নেতাদের সঠিক নেতৃত্বে ইরান তাই করছে। হুমকির জবাবে ইরানের সংসদে জাতীয় নিরাপত্তা, ফরেন পলিসি কমিশনের সদস্য ও বিপ্লবী গার্ড রেজিমেন্টের সাবেক নেতা মুজতাবা জোনুর ফার্স নিউজকে যথার্থই বলেছেন, ইরান থেকে তেলআবিবে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পৌঁছতে মাত্র ৭ মিনিট সময় লাগবে। ইসরাইলের জেরুজালেম পোস্ট তা ফলাও করেই ছেপেছে।
ট্রাম্প একদিকে ইরানকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জন্য হুমকি দিচ্ছেন, অন্যদিকে ইসরাইলকে সামরিক উন্নয়নে ২০২৮ সালের মধ্যে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের অনুদান যোগান দিতে সম্মত হয়েছেন। ফিলিস্তিনে নতুন করে আরো ৩ হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনে নেতানিয়াহুকে সমর্থন দিয়েছেন। ইরানের ‘শিহাব’ ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবেলায় ইসরাইল যে অ্যারো-থ্রি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করেছে সে সম্পর্কে ট্রাম্প কেন কোনো কথা বলছেন না? কারণ, এ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে মার্কিন বোয়িং কোম্পানি ও ইসরাইলের যৌথ উদ্যোগে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল উইলিয়াম কুলে জানান, এধরনের অ্যারো-থ্রি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মার্কিন কংগ্রেস ও প্রশাসনের সহায়তায় ১০ বছর ধরে গড়ে তোলা হয়েছে। সর্বশেষ ইসরাইলের পাঁচ বছর সামরিক পরিকল্পনায় ২০২০ সালের মধ্যে ৭৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে। দেশটির সামরিক কর্মকর্তা ডাবড গিডিয়ন বলছেন, লেবানন, সিরিয়া, গাজা, ইরানের পশ্চিম উপকূল থেকে সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকানো ছাড়াও ইরানের সামরিক সক্ষমতা বিবেচনা করেই এধরনের বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কই, ট্রাম্পতো ইসরাইলকে কোনো হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন না। যে পরিমাণ অস্ত্র রপ্তানি করে ইসরাইল তাতে দেখা গেছে প্রতি ১০ জন ইসরাইলি নাগরিকের ১ জন এধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
বরং রাশিয়া ও তুরস্ককে নিয়ে ইরান আপ্রাণ চেষ্টা করছে সিরিয়া সংকট সমাধানের। ইরাকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ রপ্তানি করে দেশটির উন্নয়নে অবদান রাখছে। মার্কিন আদালত ইরানের ২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ আটক করার যে নির্দেশ দিয়েছে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছে দেশটি। ইরানে সামুদ্রিক মাছ রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৪শ’ মিলিয়ন ডলারে। অস্কার স্বীকৃতি পেয়েছে যেমন ইরানের চলচ্চিত্র ‘দি সেলসম্যান’ তেমনি ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘হার্ন্টি’ ও ‘সাইলেন্স’ যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে অ্যাটলাস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। ইরান ফারা বোর্সের প্রধান নির্বাহী আমির হামোনি বার্তা সংস্থা ইরনাকে জানিয়েছেন, অবরোধ উঠে যাওয়ার পর দেশটির শেয়ার বাজারে ১২৫ মিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। বিপ্লব সফল হওয়ার শুরুতে ইরানে মাথাপিছু আয় ছিল ৪ হাজার ২৬৭ ডলার আর ২০১৫ সালে তা উন্নীত হয়েছে ১৬ হাজার ৯১৮ ডলারে। একই সময়ে দেশটির জনসংখ্যা ৩৮ থেকে ৭৯ মিলিয়নে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার হয়েছে। জ্বালানি ব্যবহারে ইরানের নাগরিকরা বিশ্বমানের চেয়ে ৩ গুণ এগিয়ে আছেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না এর একটি উদাহরণ হচ্ছে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ঘাপলায় অভিযুক্ত কোটিপতি ব্যবসায়ী বাবাক জানজানিকে মৃত্যুদণ্ডিত হতে হয়েছে। ফলে অবরোধের মধ্যে নিজেদের টিকে থাকার লড়াই ইরানকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়। ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধে যোগ দিয়ে ইউরোপ প্রবল অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে। কারণ, ইউরোপ জ্বালানি তেলের জন্য ইরানের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের মতো দেশও ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধের পর ক্ষতির মুখে পড়ে। কর্মসংস্থানের গতি হ্রাস পায়। অবরোধ প্রত্যাহারের পর স্বাভাবিকভাবে ইউরোপসহ এসব দেশ ইরান থেকে তেল আমদানি বৃদ্ধি করছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান, রাশিয়া ও তুরস্ক এখন এক কৌশলগত ভিত্তি রচনা করে আইএস জঙ্গিদের হটিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিমে ভারতের সঙ্গে ইরানের কৌশলগত রণকৌশল অনেককে মুগ্ধ করছে। ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ না মেনেই চীন ও ভারত দেশটি থেকে তেল আমদানি করে এবং এখন নতুন গ্যাস পাইপলাইন, রেলপথ ও নৌপথ তৈরি করে বিশ্বায়ন ব্যবস্থায় নতুন এক বিকল্প অবস্থান তৈরি করছে ইরান। তেল ও অন্যান্য পণ্য ক্রয় বাবদ ভারতকে ৫৫ ভাগ মূল্য ইরানের কাছে মার্কিন ডলারে নয়, মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ইউরো’তে এবং বাকি ৪৫ ভাগ পরিশোধের সুযোগ মিলেছে রুপিতে। ভারত ইরানের চবাহার সমুদ্র বন্দরে ২০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। চবাহার বন্দরটি অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে ভারতের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
কার্যত ইরানের ওপর অবরোধ চীন, আমিরাতসহ অনেক দেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে যারা দেশটিতে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধি করছিল। এই অবরোধ ইরান প্রশ্নে পুরো বিশ্বকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। অবরোধ এখন অচল বিষয়। ইউরোপ, চীন, ভারত, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো নিজেদের বাণিজ্য স্বার্থেই ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ দেওয়া হলে ভবিষ্যতেও তা মানবে বলে মনে হয় না। রাশিয়া ইরানের বিরুদ্ধে যে কোনো অবরোধের বিরুদ্ধে আইনগত সহায়তাসহ রাজনৈতিক চাপ মোকাবেলায় ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে কাজ করবে।
বিশেষ করে নতুন সিল্ক মহাসড়ক নির্মাণ পরিকল্পনায় ইরান যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে তা দেশটিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃঢ় ভিত্তিমূলের ওপর দাঁড় করিয়েছে। সিল্ক মহাসড়ক চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপকে শুধু যুক্তই করবে না একই সঙ্গে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় এক বিশাল মুক্তবাণিজ্য এলাকার সৃষ্টি করবে। সিল্ক মহাসড়ক বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলে একচেটিয়া মার্কিন বাণিজ্য নীতি অকার্যকর হয়ে পড়বে। অবরোধ নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই ইরানের। ইরানের মনোযোগ চীন, কাজাখাস্তান, তুর্কমেনিস্তান হয়ে রেল সংযোগের মতো অসংখ্য প্রকল্প কতটা বাস্তবায়িত হলো তার ওপর। অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত তেল খাতকে চাঙ্গা করতে কীভাবে ২শ’ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ সম্ভব হয়ে ওঠে তার ওপর।
পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বোঝাপড়ার ক্ষমতা আন্তর্জাতিক বিশ্বের নজর কেড়েছে। ইরানের সমুদ্রসীমায় ভুল করে মার্কিন নৌ সেনারা ঢুকে পড়লে তাদের আটকের পর ছেড়ে দেয় ইরান। আবার যেদিন ইরানের ৪শ’ মিলিয়ন ডলার পাওনা ফেরত দিল ওয়াশিংটন সেদিন তেহরান কারাগার থেকে বেশ কয়েকজন মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দেওয়া হয়। হেগ ট্রাইবুনালের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওই পাওনা ফেরত দিতে বাধ্য হয়। এরপর পরই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর অবরোধের সময়সীমা বৃদ্ধি করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জারিফ চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, সকল পক্ষকে তা মেনে চলা উচিত, না হলে এর বিকল্প ব্যবহার করবে তেহরান। বিশেষ করে গত বছর তেহরানে চীনের প্রেসিডেন্ট ঝি জিনপিংএর সফর ছিল এক বড় চমক। দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি ৪০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে ১৮টি চুক্তি হয়। আগামী ২৫ বছরে তা ৬শ’ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে আশা করছে দুটি দেশ। চীন এখন ইরান থেকে সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করছে।
এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ইরান সম্পর্ককে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অবরোধ সত্ত্বেও পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে রাশিয়া ইরানকে নীরবে সহায়তা করে গেছে। রাশিয়ার তেল কোম্পানিগুলো একের পর এক ইরানে বিনিয়োগ করছে। দুটি দেশের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এধরনের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইরান ও ইউরোশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন মিলে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। তার আগেই দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ ভাগ। বিশ্ব রাজনীতিতে এ দুটি দেশ এখন বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।
আরো একটি বড় চমক দেখাতে যাচ্ছে ইরান, আর তা হচ্ছে পারসিয়ান ক্যানেল নির্মাণ করে ইউরোএশিয়াকে যুক্ত করা। ইরানের এ পরিকল্পনা হচ্ছে বিকল্প সুয়েজ খাল নির্মাণ। দশ বছরের মধ্যে কাস্পিয়ান সাগর থেকে পারস্য উপসাগরে তৈরি ওই খাল দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথ নির্মাণ কবে শেষ হবে সেদিকে চেয়ে আছে চীন ও রাশিয়া। কারণ, এমন খাল নির্মাণ হলে শুধু ইরান নয়, ওই বৃহৎ দুটি দেশও উপকৃত হবে। আর এ খালটির সামরিক গুরুত্ব হবে আরো বেশি। বসফরাস প্রণালি দিয়ে রাশিয়া পণ্যভর্তি কিংবা যুদ্ধজাহাজ যেটাই এখন পাঠিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে, পারসিয়ান ক্যানেল দিয়ে যেতে পারলে সে দুশ্চিন্তা আর থাকবে না। ভূমধ্যসাগরের বন্দর হয়ে সুয়েজ খাল পাড়ি না দিয়ে পারসিয়ান ক্যানেলের বিকল্প পথ ধরবে অনেক দেশের জাহাজ। বিশ্বে পরাশক্তির একচেটিয়া বাণিজ্য কিংবা অবরোধের হুঙ্কার অবশিষ্ট থাকবে না। তথাকথিত ‘হার্ডলাইনার’দের দিনও শেষ হয়ে যাবে।
আরব বসন্তে ৮৩ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের স্মৃতি নিয়ে সংঘাতের চিহ্ন বহন করছে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার যেসব দেশ, তাদের জন্য ইরান বরং নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে। এজন্য ইরান পোল ডটকমের এক জরিপে দেখা গেছে ৮৪ ভাগ উত্তরদাতা মনে করছেন মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা রক্ষায় বরং ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি হওয়া দরকার। ৮০ ভাগ মনে করছেন সিরিয়া পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে তা আরো বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে। ৭৭ ভাগ মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের নীতির পাল্টা বিকল্প থাকা উচিত। ইরাক যখন ইরানে আক্রমণ করে তখন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর অবরোধ আরো জোরদার করে। আর সেই ইরাককে পুনর্গঠনে ইরান সহায়তা করে যাচ্ছে। আমেরিকান গণতন্ত্র সম্পর্কে ইরানের যথেষ্ট ধারণা আছে বৈকি। নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক লরা সেকর তাই ইরানের এগিয়ে যাওয়াকে বিপ্লব ও কাজের অগ্রগতি হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, সংগ্রামই ইরানের আত্মা এবং তা এক বাস্তবতা।
অন্যদিকে ইরান, চীন, ইরাক ও পাকিস্তান মিলে যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে যাচ্ছে তা শুধু ভূ-কৌশলগত অবস্থানকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে না, একই সঙ্গে অন্তত ৩ বিলিয়ন মানুষের জন্য নতুন ভাগ্য গড়ে দিচ্ছে। এরাই হচ্ছে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ। যাদের সম্পদ কুক্ষিগত করে নয়, যুদ্ধ বাঁধিয়ে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে নয়, বোমারু বিমান উড়িয়ে নয়, বরং প্রেম ও ত্যাগের মহিমায়, সহায়তার হাত বাড়িয়ে ইরান, চীন ও রাশিয়ার বিশ্বমানের বিজ্ঞানীরা এক অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। আর এধরনের একাধিক কাজে প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে ইরানের ইসলামি বিপ্লব। কিন্তু ওয়াশিংটন বরাররের মতোই ইরানকে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আর তাই ইরানের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইসরাইল ও তার মিত্র আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে ইয়েমেন, সিরিয়া, বাহরাইন সহ মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসনের মোকাবেলা করে স্থিতিশীলতা টিকিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে নিজের শক্তিকে জানান দেওয়া এবং অন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে মাটি চাপা দেওয়া। হযরত আলী (রা) এর দুধারি তরবারির মতো ইরানকে নানা ধরনের যুদ্ধের ময়দানে লড়তে হচ্ছে। আশার কথা, পেট্রোডলারের সেই দাপট আর নেই। তেলনির্ভর অর্থনীতির দিনও শেষ। ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তির ব্যবহার এখন বিশ্বে পাত্তাও পাচ্ছে না। খুব কম সময়ের মধ্যেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একে অপরের সঙ্গে মিলিত হচ্ছেন, অথচ তাঁদের দেশের নাগরিকরা এধরনের হম্বিতম্বি পছন্দ করছেন না। এদিক থেকে ইরান স্বতন্ত্র ও ভিন্ন। দেশটির নাগরিকদের জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতিতে যুক্ত করে প্রযুক্তি ও পুঁজির ব্যবহারে ইরানের নেতারা বাস্তবিকই ইসলামি বিপ্লবের এক মহান নজরানা উপস্থাপন করছেন। যা টিকে থাকার জন্য এসেছে, ফুরিয়ে যাবার জন্য নয়।