হজের শিক্ষা ও তাৎপর্য সম্পর্কে ইমাম খোমেইনী (র.)


ইসলামী বিপ্লবের নেতা খোমেইনী (রহ.) পবিত্র হজ উপলক্ষে বায়তুল্লাহ আল-হারামে সমবেত হাজী সাহেবদের উদ্দেশে প্রতি বছর নিয়মিত বাণী প্রদান করতেন। এসব বাণীতে হজের সত্যিকার শিক্ষা ও তাৎপর্য এবং বর্তমান সময়ের মুসলিম উম্মাহ ও আলেম সমাজের কর্তব্য সম্পর্কে অত্যন্ত মূল্যবান বক্তব্য রয়েছে। নিম্নে ইমামের এ সম্পর্কিত কয়েকটি বাণীর কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা হলো :

মুসলমানদের প্রকৃত খুশির দিন

মুসলমানদের জন্য প্রকৃত আনন্দ ও খুশির দিন হবে সেদিন যেদিন সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানরা ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আলেমদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জেগে উঠবে এবং বিশ্বগ্রাসী অত্যাচারী ও শোষকদের নিপীড়নমূলক শাসন থেকে নিজেদের মুক্ত করার লক্ষ্যে এক দুর্বার অভিযান শুরু করবে। ইসলামের এই মহত্তম লক্ষ্য অর্জন করা তখনই সম্ভব হবে যেদিন আমাদের আলেমগণ ইসলামী আদর্শের একটি পরিপূর্ণ চিত্র দুনিয়ার নিপীড়িত-নির্যাতিত জনগণের সামনে উপস্থাপন করবেন যা এতদিন তাদের সামনে অনুন্মোচিত ছিল, যেদিন আলেম সমাজ ইসলামের অনুদ্ঘাটিত দিগন্ত দুনিয়ার জাতিসমূহের সামনে তুলে ধরবেন এবং এই অনুপম কর্ম সম্পাদনের মূল্যবান সুযোগ তাদের সামনে পেশ করবেন। বস্তুত মহান হজের সমাবেশই হচ্ছে এর জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ যা মহিমান্বিত ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর নির্দেশে প্রতিপালিত হচ্ছে। কিন্তু এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, ইসলামী দেশগুলোর শোষক সরকারগুলোর বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি, অবিবেচক ও ধূর্ত দরবারি আলেমদের আচরণ এবং এসব আলেম ও অন্যদের ভুল ব্যাখ্যার কারণে পবিত্র হজের মতো মুসলিম জাতির ভাগ্যনির্ধারণী এই অনুষ্ঠানের প্রকৃত তাৎপর্য ও এর বহুবিধ ফায়দা আজ আমরা হারাতে বসেছি। মূলত এ ধরনের আলেমরাই বিভিন্ন মুসলিম দেশে তাদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার একটি কল্পিত পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। এরাই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করছে; কেননা, এরা মনে করে, ইসলামী রাষ্ট্র খোদাদ্রোহীদের পরিচালিত রাষ্ট্রের চেয়েও খারাপ। এই বিপথগামী ও ভ্রান্ত মানসিকতার কারণে এরা পবিত্র হজ অনুষ্ঠানকে তার প্রকৃত তাৎপর্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে এবং হজকে কতকগুলো প্রাণহীন বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। এমনকি এরা যুক্তি দেখাচ্ছে যে, পবিত্র হজের সময় মুসলমানদের সাধারণ্যে কোন আওয়াজ তোলা ইসলামবিরোধী। এভাবে তারা ধর্মীয় সত্যের ওপর একটা ছদ্মাবরণ দেয়ার চেষ্টা করছে।

শোষক ও বিভ্রান্ত সরকারের পোষ্য এসব লোক দুনিয়ার আনাচ-কানাচ থেকে পবিত্র স্থানে সমবেত শোষিত-বঞ্চিত লোকদের শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলাকে নাস্তিকতাঅনৈসলামিকবলে আখ্যায়িত করছে। এদের মতলব হচ্ছে মুসলমানদের দাবিয়ে রাখা এবং লুটেরা ও ইসলামের ওপর আধিপত্য বিস্তারকামীদের জন্য পথ করে দেয়া। এরা চায় ইসলামকে মসজিদ ও খানকার চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতে। এরা বলে বেড়াচ্ছে যে, মুসলমানদের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা বা তাদের কোন সমস্যার ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করা ইসলামবিরোধী, এটা মুসলমানদের এবং আলেম সমাজের দায়িত্ব-কর্তব্যের পরিপন্থী।

হজের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য

বিশ্বাসঘাতকরা হজের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যটি ধামাচাপা দেয়া এবং তাকে বিস্মৃতির অন্তরালে মিলিয়ে দেয়ার জন্য অনেক অপচেষ্টা চালিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো দীর্ঘ সময় ধরে তারা এই অপচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। কিন্তু অন্য কোন সময় অপেক্ষা মুসলমানরা আজকের এই দিনে-যেদিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় জংলি যুগের কথা-হজের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর বেশি দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে এবং তার ওপর সবিশেষ জোর দিচ্ছে কেন? কেননা, আজকের দিনে আন্তর্জাতিক ক্ষমতালিপ্সুরা মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য এবং তাদের উন্নতি-সমৃদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি করার জন্য একটির পর একটি ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত পাকাচ্ছে। আর অন্যদিকে তাদের স্বার্থান্বেষী চর ও ভাড়াটিয়া বাহিনী এবং তাদের সঙ্গে একদল বিভ্রান্ত ব্যক্তি, দরবারি আলেম ও অন্যান্য লোকজন (যারা খাঁটি ঈমানদার, অথচ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত) মিলে পবিত্র হজের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিককে আস্তে আস্তে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য চক্রান্তের জাল বুনে চলেছে।

তাই আজকের দিনে যেসব আল্লাহর রাহে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ও ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল লোক স্বীয় ঈমানকে বিস্মৃতির অতলে হারাতে রাজি নন, তাঁদের কর্তব্য হয়ে পড়েছে ঈমানের এই বৈশিষ্ট্যের উজ্জীবনে নিজেদের সকল সহায়-সম্পদ কাজে লাগানো এবং বিশেষ করে হজের সময় তাঁদের লেখনি ও বক্তৃতার সর্বাধিক ব্যবহার করা। এতে করে মুসলমানরা পবিত্র হজে আগমন করে হজের এই উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে পারবে এবং অতঃপর তারা নিজ দেশে ও দুনিয়ার সর্বত্র মুসলমান ও নির্যাতিত জনগণকে জাগ্রত করতে বেরিয়ে পড়বে। তারা বিশ্বশোষক ও অত্যাচারীদের হাত থেকে নির্যাতিত জনগণের মুক্তি আনয়নের জন্য তাদেরকে সংগঠিত করবে।

হজের এ হচ্ছে এমন এক বিরাট ও মহতি সম্মেলন যেখানে দুনিয়ার প্রতিটি দেশ থেকে নিপীড়িত-নির্যাতিত মুসলমানরা এসে সমমেত হয়, যেখানে বিভিন্ন  ভাষাভাষী বিভিন্ন বর্ণের ও গোত্রের লোকেরা একই পোশাক পরে উপস্থিত হয় এবং যেখানে একে অন্যের মধ্যে পার্থক্যের কোন চিহ্নমাত্র থাকে না। এই মহাসম্মেলন যদি মুসলমানদের রাজনৈতিক সমস্যাবলির সমাধানে ব্যর্থ হয়, এটি যদি পৃথিবীর অত্যাচারী ও শোষকদেরকে তাদের প্রাপ্য আঘাত প্রদানে ব্যর্থ হয় তবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আঞ্চলিক ভিত্তিতে আয়োজিত সম্মেলনগুলো মুসলমানদের সমস্যা সমাধানে কোন বিশেষ অগ্রগতি সাধন করতে পারবে না।

জনগণের কেন্দ্র

আল্লাহর ঘর (বায়াতুল্লাহ আল-হারাম) হচ্ছে দুনিয়ার সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ স্থান। জনসাধারণের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এটা সকল মানুষের জন্য পবিত্র স্থান। কোন এক ব্যক্তি, কোন একটি সরকার বা কোন একদল লোক এই ঘরের সঙ্গে জড়িত থাকার ক্ষেত্রে কোন বিশেষ মর্যাদা ভোগ করতে পারবে না। এই পবিত্র স্থানে যেমন রয়েছেন কাবাঘরের খাদেমগণ, তেমনি রয়েছেন শহরবাসী, গ্রামবাসী, মরুবাসী এবং রাষ্ট্রনেতাগণ। এই পবিত্র স্থান নির্মিত হয়েছে জনগণের জন্য, জনগণের উত্থানের জন্য এবং জনগণের কল্যাণে গণঅভ্যুত্থানের জন্য। কিন্তু জনগণের কল্যাণের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে বিশ্বের অত্যাচারিত ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার দেশগুলো থেকে শোষকের হাত কেটে দেয়া। এর ফলে এসব দেশের যে ঐশ্বর্যরাজি রয়েছে তা থেকে এদের হাত গুটিয়ে দেওয়া হবে। তাহলে কেন আমরা এই পবিত্র স্থানে সেইভাবে সমবেত হই না, যে উদ্দেশ্যে এটা নির্মাণ করা হয়েছে? জনগণের কল্যাণে গণঅভ্যুত্থানের মতো সুমহান উদ্দেশ্যে যে পবিত্র স্থানের সৃষ্টি তা অবশ্যই মুসলমানদের গণজাগরণের কেন্দ্রস্থল হতে হবে।

এই মহিমান্বিত ও পবিত্র ঘরের সঙ্গে জড়িত সমগ্র মুসলমান জনগণের স্বার্থ আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালাতে হবে এবং সে কথা মনে রেখেই হজের সময় ছোট ও বড় শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপের কার্য সম্পাদন করতে হবে।

মসজিদ ও হারামের খাদেমদের বৈশিষ্ট্য

শুধু সীলমোহর সংরক্ষণ, হাজী সাহেবানদের জন্য পানি সরবরাহের ব্যবস্থাকরণ এবং মসজিদুল হারামের দেখাশোনা করার মাধ্যমেই এই পবিত্র স্থানের খাদেমের দায়িত¦ ও তার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ হয় না। অপরপক্ষে যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি অলংকরণ ও সৌষ্ঠবপূর্ণ করার চেয়ে তা না করার মাধ্যমেই এই ঘরের অধিক সেবা করা যায়। পবিত্র স্থানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন কোন কার্য করার চেয়ে একে যে অবস্থায় আছে সেরূপ রাখা বরং উত্তম এবং এর পরিচালনা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আমলে এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে যেমন ছিল সেরূপ রাখাই বাঞ্ছনীয়। মুসলমানদের উচিত ইসলামের এই পবিত্র স্থানে নিজেদের সকল সামাজিক পদ ও মর্যাদা ভুলে গিয়ে শুধু একজন বান্দা হিসেবে সমবেত হওয়া। এই পবিত্র স্থানের অলংকরণ অথবা এর সৌন্দর্য ও অঙ্গসৌষ্ঠব বৃদ্ধি করা অপেক্ষা হযরত ইবরাহীম (আ.) ও ইসলামের প্রাথমিক যুগের মতো পরিচালনা করার মাধ্যমেই এর মর্যাদা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। আর যদি আল্লাহর ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির দিকেই আমরা মনোযোগ নিবদ্ধ করি তাহলে তা আমাদেরকে আল্লাহর ঘর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য-লক্ষ্য অর্থাৎ মানবজাতির উত্থানের সাক্ষ্য হওয়া ও মুসলিম জাতির স্বার্থ সংরক্ষণ থেকে বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে।

যারা হাজীদের পানি সরবরাহ করে এবং মসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করে, তোমরা কি তাদেরকে তাদের সমজ্ঞান কর যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে? আল্লাহর নিকট তারা সমতুল্য নয় এবং আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।’ (সূরা তাওবা : ১৯)

মনে হচ্ছে, পবিত্র কুরআন মজীদের এ আয়াতটি আমাদের এ যুগেই নাযিল হয়েছে, যে যুগে আমরা বসবাস করছি। মনে হচ্ছে, এ আয়াতের মধ্যে আমাদের যুগের শোচনীয় অবস্থারই প্রকৃত বর্ণনা রয়েছে। আমরাও এমন একটি যুগে বাস করছি যে যুগে হজকে নিয়ে একদল লোক ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। তারা হজের সময় হাজী সাহেবদের পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর জন্য জাঁকজমকপূর্ণ ব্যবস্থা করছে এবং সেই সঙ্গে মসজিদুল হারামকে এমন জাঁকালোরূপে সাজানো হচ্ছে যাতে খোদায়ী ভাবগাম্ভীর্যের কোন নাম-নিশানা নেই এবং যাতে খোদার রাহে সংগ্রামের বা পরকালের (শেষ বিচারের দিনের) ধারণার কোন পরিচয় মেলে না। পবিত্র কুরআন মজীদের ভাষ্য মোতাবেক এই ধরনের কাজ অন্যায়ের শামিল এবং যারা এই ধরনের কাজ করছে তারা হচ্ছে অত্যাচারী ও শোষক।

মহিমান্বিত ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর ঈমান এবং পরকালে ঈমানই জনগণকে আল্লাহর রাহে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে এবং ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থানের অনুপ্রেরণা যোগায়। যারা ভিন্নরূপ কর্ম করে অর্থাৎ আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে না আল্লাহ তাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না, কেননা, তারা অত্যাচারীর দলভুক্ত।

হজের আধ্যাত্মিক দিক

হজের আধ্যাত্মিক দিক হচ্ছে মানুষের অনন্ত জীবনের চাবিকাঠি এবং তা মানুষকে একত্ববাদের দিকে ধাবিত করে এবং তার জীবনের পবিত্রতাকে করে তোলে অজেয়। হজের ধর্মীয় বিধিনিষেধ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাস্তবায়িত করা না হলে উপরিউক্ত মহৎ লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা সম্ভব নয়। সম্মানিত হাজী সাহেবান এবং হজযাত্রীদলের নেতৃত্বদানকারী আলেম সমাজের এই ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা চালানোর গুরুদায়িত্ব রয়েছে। প্রথম দল অর্থাৎ হাজী সাহেবদের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্জন আর দ্বিতীয় দল অর্থাৎ আলেমদের দায়িত্ব হচ্ছে হজের অনুষ্ঠান সম্পর্কে জ্ঞান দান। ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে পরিজ্ঞাত ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে তার সঙ্গী-সাথিদের এ ব্যাপারে উপদেশ দেয়া যাতে সে হজের আনুষ্ঠানিক আচার ভঙ না করে। হজের রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করা তখনি সম্ভব হবে যখন এর আধ্যাত্মিক ও খোদায়ী দিকগুলো প্রতিপালিত হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর দাওয়াতে সাড়া প্রদান এবং তাঁর দেয়া বিধানগুলো সঠিকভাবে পালন করলেই আমরা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পারব।

হে হাজী সাহেবগণ! আপনারা দৃঢ় মনোবল ও আত্মপ্রত্যয় নিয়ে প্রস্তুত হোন, সর্বশক্তিমান আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছান এবং আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে যে কোন প্রকার শিরক প্রত্যাখ্যান করুন। আপনারা আপনাদের দৈহিক সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর আত্মিক দিদার লাভ করুন। এই দেহসত্তাই বহুত্ববাদের প্রধান উৎস। আল্লাহ আপনাদের গৌরবান্বিত করুন। যাঁরা এভাবে নিজেদের দেহসত্তা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য চাইবেন তাঁদের পুরস্কার তাঁরা পরকালে আল্লাহর কাছে পাবেন। তাঁদের ইন্তেকালের পূর্বেই তাঁরা পার্থিব দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছেন। আর যদি হজের আধ্যাত্মিক দিককে ভুলে যান তাহলে মনে রাখবেন মন্দ আত্মার থাবা থেকে আপনারা কখনোই নিজেদের মুক্ত করতে পারবেন না। আর যতক্ষণ পর্যন্ত আপনারা প্রবৃত্তি ও পাশবিক লালসায় বন্দি হয়ে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত আপনারা আল্লাহর রাহে জিহাদের ময়দানে নামতে পারবেন না এবং আল্লাহর সৃষ্ট জগতের রক্ষণাবেক্ষণ করতে সক্ষম হবেন না।

ইরানী হাজীদের প্রতি উপদেশ

হে ইরানী হাজী সাহেবগণ! আপনারা একটি বিজয়ী দেশ (ইরান) থেকে এসেছেন, যে দেশ বহু বছর ধরে রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর অনুগ্রহ ও দ্বাদশ ইমামের (তাঁর জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গীকৃত হোক) কল্যাণকামী দোয়ায় অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙে ফেলেছে এবং ইসলামের জন্য হাজার হাজার লোকের শাহাদাত ও পঙ্গুত্বের বিনিময়ে নিজেদের বিপ্লবী মনজিলে মকসুদে পৌঁছেছে। আপনারা হজের সময় এমন এক জাতির বাণী বহন করছেন যাঁরা তাঁদের বিপ্লবের মাধ্যমে আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী একটি সরকারকে উৎখাত করেছেন এবং দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করেছেন। এভাবে বিপ্লবের মাধ্যমে আপনারা দেশকে চরম ধ্বংসপ্রাপ্তি তথা পাশ্চাত্যের নিকট বিকিয়ে যাওয়া থেকে যা দেশে স্বধর্ম ত্যাগ, দুর্নীতি ও পতিতাবৃত্তির সয়লাব বইয়ে দিয়েছিল রক্ষা করেছেন। এখন আপনারা ইসলামী বিপ্লবের বাণী সর্বত্র ছড়িয়ে দিন এবং শুধু মুসলিম দেশই নয়, দুনিয়ার নির্যাতিত জনগণের সামনে ইসলামের ইনসাফপূর্ণ শাসনের পরিচিতি উপস্থাপন করুন। আপনারা তাঁদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন যাঁরা দুই পরাশক্তি এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ব্লকের চক্রান্ত মোকাবিলা করে এবং তাদের পোষ্য সন্ত্রাসবাদীদের অন্তর্ঘাতী তৎপরতার ফলে সৃষ্ট নানারূপ প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে তাঁদের নতুন ইসলামী বিপ্লবকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ইসলামের আকর্ষণীয় আদর্শ এবং জনগণের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে এই ইসলামী বিপ্লব মুসলিম দেশগুলো এবং দুনিয়ার নির্যাতিত জাতিগুলোর মধ্যে নবজাগরণের সৃষ্টি করতে পেরেছে এবং তাদেরকে ইসলামী আদর্শের দিকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। ইসলামের মহান বাণীর প্রতিধ্বনি- তা যত কম ক্ষমতাসম্পন্ন বা ক্ষীণ হোক না কেন দুনিয়ার জনগণের দৃষ্টি তার প্রতি আকৃষ্ট হবেই।

হে সম্মানিত ইরানী হজযাত্রীরা! আপনারা এই জাতিরই বাণী বয়ে নিয়ে গিয়েছেন এবং এই দেশেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। সুতরাং আপনারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন এবং আপনাদের ঘাড়ে রয়েছে এক গুরু দায়িত্ব। ইনশাআল্লাহ, আপনারা আপনাদের দৃষ্টান্তমূলক ব্যবহার এবং ইসলামী ও বিপ্লবী যুক্তি পেশের মাধ্যমে অন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবেন। আপনারা দুনিয়ার জাতিগুলোর সামনে ইসলামের সত্যিকারের মডেল পেশ করবেন এবং তার প্রতি তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করবেন। আপনারা আপনাদের ভ্রাতৃত্বমূলক ও সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা ইরানের মহান ইসলামী বিপ্লবের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন এবং প্রচারমাধ্যমগুলোর দুর্নীতিপরায়ণ ও পক্ষপাতমূলক ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দেবেন। তাহলে আল্লাহ আপনাদের হজ কবুল করবেন এবং আপনাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কারে ভূষিত করবেন। আর আল্লাহ না করুন, যদি কোন অজ্ঞ ব্যক্তি প্রদত্ত নির্দেশনাবলির বিপক্ষে কাজ করে তবে সে আল্লাহর সামনে, মুসলমানদের কিবলা বায়তুল্লাহর সামনে এক মস্তবড় পাপ করল। আমি বিশ্বাস করি, এমন কোন ঘটনা ঘটবে না। যদি কেউ এরূপ করে তবে হজ, হযরত (সা.)-এর রওজা মোবারক যিয়ারত, জান্নাতুল বাকীতে মাসুম ইমামদের মাজার যিয়ারত ইত্যাদি সবকিছু থেকে সে বাদ পড়বে এবং পাপের একটি বোঝা পিঠে বহন করে বাড়ি ফিরবে।

মুসলমানদের দুশমন কে?

এই গৌরবান্বিত রওজা মোবারকে যেসব মুসলমান ভাই সমবেত হয়েছেন, তাঁরা যে দেশ থেকেই আসনু না কেন, তাঁদের একটি কথা খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, ইসলাম মহাসম্মানিত কুরআন মজীদ এবং আমাদের প্রিয় রাসূল (সা.)-এর প্রধান দুশমন হচ্ছে পরাশক্তিগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার জারজ সন্তান ইসরাইল। ইসলামী দেশগুলোর ওপর তাদের লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে এবং এসব দেশে যে বিশাল ঐশ্বর্য রয়েছে তা লুণ্ঠন ও ভোগদখল করার জন্য যত জঘন্য ও লোমহর্ষক ষড়যন্ত্র করা ও অপরাধে লিপ্ত হওয়া দরকার, প্রয়োজন হলে তা করতেও এরা কোনরূপ কুণ্ঠাবোধ করবে না। তাদের এই নাপাক ষড়যন্ত্রে তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি হচ্ছে, যে কোন উপায়ে সম্ভব মুসলমানদের মধ্যে সংঘাতের বীজ বপন করা। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, এই হজ সম্মেলনে শিয়া-সুন্নি বিরোধ সৃষ্টি করার জন্য তারা তদের পোষ্য মোল্লাদের লাগিয়ে দিতে পারে। তারা তাদের এই শয়তানি চক্রান্তের জাল হয়ত এমন জায়গায় বিস্তার করবে যেখানে কতিপয় সরলমনা মুসলমান রয়েছে এবং তারা এদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে ফেলবে এবং এর ফলে তা থেকে একটা সংঘাত ও দুর্নীতির সূত্রপাত ঘটবে। উভয় মাজহাবের ভাই ও বোনদের অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং তাদের জানতে হবে এসব ভাড়াটিয়া লোকজনের আসল মতলব হচ্ছে ইসলাম, আল-কুরআন ও সুন্নাহর নাম ভাঙিয়ে মুসলমানদেরকে ইসলাম, আল-কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা অথবা অন্ততঃপক্ষে তাদেরকে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করা। ভাই ও বোনেরা! আপনাদের অবশ্যই জানতে হবে যে, আমেরিকা ও ইসরাইল ইসলামের মূল ভিত্তিরই বিরোধী; কারণ, তারা মনে করে ইসলাম, আল-কুরআন ও সুন্নাহ তাদের পথের কাঁটা; কেননা, এগুলোর অস্তিত্ব তাদের জবরদখল ও আগ্রাসী তৎপরতার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তাছাড়া তারা দেখেছে ইরানের জনগণ আল-কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে একটি বিপ্লব সাধন করেছে এবং বিজয়ী হয়েছে এবং এখন সে তাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত ইরান, ইরানের সরকার ও হিজবুল্লাহদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র একটি অজুহাত বৈ কিছু নয়। শাহের আমলে তারা ছিল ইরানের পক্ষে, কেননা, সে আমলের ইরান ছিল তাদের পদপ্রান্তে নিবেদিত। শোষক শাহ তাদের ওপর ইরানকে নির্ভরশীল করে রাখার জন্য সবকিছু করেছে; তখন ইরান থেকে ইসলামকে বিতাড়নের জন্য কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছিল। তারা এখন ইরানের বিরুদ্ধে; কেননা, আমাদের দেশের সম্পদ থেকে তাদের হাত চিরতরে কেটে দেয়া হয়েছে এবং তাদের উপদেষ্টা ও খদ্দেরদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

তাদের প্রকৃত দুশমন হচ্ছে ইসলাম। অবশ্য তাদের সেবাদাস সরকার এবং পদলেহী মোল্লাদের (যারা সরকার থেকেও নিকৃষ্টতর) সৃষ্ট ইসলাম হলে তা তাদের দুশমন নয়। এই তথাকথিত ইসলামকে তারা স্বাগত জানায়, কেননা, এই ইসলাম তাদের সমর্থক ও তাদের স্বার্থের রক্ষক। এই ধরনের তথাকথিত ইসলামের ধারকরাই আজ মুসলিম জাগরণের কেন্দ্রস্থল ও ওহী নাযিলের স্থানে ইরানী হজযাত্রীদের নির্দোষ আওয়াজকে দাবিয়ে রাখছে এবং তাদেরকে ধর্মীয় সত্য আচ্ছাদানকারীদের দলভুক্ত বলে আখ্যায়িত করছে। মহান হজের দিবসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি এ একটি ঘোষণা যে, আল্লাহর সাথে মুশরিকদের (অংশীবাদীদের) কোন সম্পর্ক নেই এবং তাঁর রাসূলের সাথেও নয়।’ (সূরা তাওবা : ৩)।  সুতরাং হাজীদের খোদায়ী কর্তব্য হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টির লক্ষ্যে যারা বক্তব্য রাখছে তাদের যে কোন কথাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা। হাজীদের কর্তব্য হচ্ছে ঐসব পবিত্র স্থানে ধর্মীয় সত্যের আচ্ছাদানকারী ও তাদের নেতাদের থেকে দূরে থাকা, যাতে তাঁদের হজ মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর হজের তুল্য হয়। তা না হলে অনেকের বিলাপ, কিন্তু স্বল্প লোকের (খাঁটি) হজপ্রবাদ বাক্যটি তাঁদের জন্য প্রযোজ্য হবে।

জাগতে হবে সকলেই

একথা পরিষ্কার, যে জাতির আলেম, বুদ্ধিজীবী, লেখক ও বক্তাগণ যুলুম, শোষণ ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হবেন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের জাল তাঁদের বিরুদ্ধেই বিস্তারিত হবে বেশি। আজ দুঃখের সাথে বলতে হয়, মুসলিম জাতিগুলো সক্রিয় ও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের দেশগুলোকে ঐসব শক্তিরই বাজারে পরিণত করেছে। এমনকি পরিতাপের বিষয়, মক্কা-মদীনার মতো মহানবী (সা.), জিবরাঈল এবং আল্লাহর ফেরেশ্তাদের পুণ্য স্মৃতি বহনকারী পবিত্র শহরগুলোকেও আজ শয়তানি শক্তিগুলোর মার্কেটে পরিণত করা হয়েছে। ফলে সেখানে মুসলিম ঐক্যের আহ্বান উচ্চারিত হয় না; বরং অনেক হাজীই আমেরিকান, ইউরোপিয়ান ও জাপানি চমকপ্রদ পণ্য কিনে বেড়ান এবং হজের সম্মানকে ক্ষুণ্ন করেন।

হে বিশ্বের সম্মানিত হাজী এবং আলেমগণ! প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যুলুমবাজদের প্রত্যাখ্যান করুন, ইরানী জাতির মতো অপমানের পরিবর্তে শাহাদাতকে বেছে নিন এবং রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে ইসলামের দুশমনদের বিতাড়িত করুন।

তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে তিনি তোমাদের কদম মজবুত করে দেবেন।’ (আল কুরআন)। হে খোদা! স¦ল্পসংখ্যক অধিবাসীর একটি ছোট দেশ থেকে তোমার এক নগণ্য বান্দা আমি আবেদন করছি : তুমি মুসলিম জাতির ওপর তোমার খাস রহমত নাযিল কর এবং পৌত্তলিকতার দাসত্ব থেকে তাদের মুক্ত কর। বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের, বিশেষ করে মুসলিম জাতির ওপর থেকে অশুভ শক্তিকে বিতাড়িত কর। মুসলমান সরকারগুলোকে এমন সাহস, হিম্মত ও শৌর্যবীর্য দান কর যেন তারা বিদেশীদের দাসত্ব ছেড়ে দিয়ে নিজ সম্পদ ও শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে। তাদেরকে শুভবুদ্ধি দানে ধন্য কর।

মুসলমানদের প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে

মুসলিম দেশগুলোর রয়েছে বিপুল মানব সম্পদ এবং অন্যান্য সম্পদের ব্যাপক মজুদ যা পরাশক্তিগুলোর জন্য অতীব জরুরি। এমতাবস্থায় মুসলমানরা ও ইসলামী দেশের সরকারগুলো যদি তাদের শক্তিশালী অবস্থান থেকে বৃহৎ শক্তিগুলোর মোকাবিলা করে, পরাশক্তিবর্গের হুমকিকে ভয় না করে, প্রাসাদচারীদের উচ্ছৃঙ্খলতায় শঙ্কিত না হয়, মিথ্যা প্রচার-প্রপাগান্ডায় কোনরূপ প্রভাবিত না হয় এবং আল্লাহর অসীম শক্তির ওপর নির্ভর করে ও তাঁর অপার করুণার প্রতি শুকরিয়াস¦রূপ পরাশক্তিবর্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাদের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করার হুমকি দেয় ও তেলসহ তাদেরকে সর্বপ্রকার সম্পদের সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তাহলে এটা নিঃসন্দেহ যে, মুসলিম শক্তির সামনে পরাশক্তিবর্গ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। মুসলমানদের শক্তি যে কত বড়, সে সম্পর্কে আমরা এখনো অনবগত রয়ে গেছি।

হে শক্তিশালী মুসলিম জাতি! আপনারা জাগ্রত হোন, নিজেদের শক্তিকে জানুন। বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করুন। মহান আল্লাহর দেয়া বিধান এবং পবিত্র কুরআন মোতাবেক আপনাদের মাজহাবী ও আঞ্চলিক ভেদাভেদ ভুলে যান। আপনাদের মধ্যকার ভেদাভেদ হচ্ছে অপরাধী পরাশক্তিবর্গ ও তাদের এজেন্টদের চক্রান্তের ফসল। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির মাধ্যমে আপনাদের সহায়-সম্পদ লুণ্ঠন করা এবং আপনাদের মানবিক ও ইসলামী মান-মর্যাদা ও সম্মান ভূলুণ্ঠিত করা। আপনারা ভাড়াটে মোল্লাদের এবং ইসলামের শক্তি সম্পর্কে অপরিজ্ঞাত জাতীয়তাবাদী (নেতাদের) প্রত্যাখ্যান করুন। তারা ইসলামের যে ক্ষতি করছে তা কোনক্রমেই বিশ্বগ্রাসী পরাশক্তিদের ক্ষতির চেয়ে কম নয়। তারা ইসলামের অপব্যাখ্যা করে এবং এভাবে লুটেরাদের জন্য লুণ্ঠনের পথ খুলে দেয়। আমি আল্লাহর কাছে মুনাজাত করছি, তিনি যেন ইসলাম এবং মুসলিম দেশগুলোকে বিশ্বগ্রাসী শয়তানি পরাশক্তি ও তাদের অনুচরদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন।

ইসলামের সোনালি যুগে হাজীরা পবিত্র মক্কায় সমবেত হয়ে তাঁদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনা করতেন এবং এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তও নিতেন। নবম হিজরির হজের প্রাক্কালে কাফের ও মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের (বারায়াত) নির্দেশ দিয়ে সূরা তাওবার প্রথমাংশ নাযিল হলে রাসূলে করীম (সা.) তা হাজীদের পড়ে শোনাবার জন্য হযরত আলী (আ.)-কে মক্কায় প্রেরণ করেন। অথচ ইরানের হাজীরা ১৯৮৭ সালের হজ উপলক্ষে বর্তমান যুগের কুফরি ও মুশরিকি শক্তির ধ্বজাবাহী আমেরিকা, রাশিয়া ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে ধ্বনি উচ্চারণ করলে সৌদি শাসকগোষ্ঠী আল্লাহ সেই মেহমানদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং ৪০০ হাজীকে শহীদ করে। শুধু তাই নয়, ইরানী হাজীদের বিরুদ্ধে মক্কা ও মদীনা দখলের মিথ্যা অভিযোগও আনা হয়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার প্রেক্ষিত বর্ণনা করে ইমাম খোমেইনী এক বাণীতে বলেন : আল্লাহর ঘরের হাজীদের হত্যাকা- দাম্ভিক কুফরি চক্রের নীতিসমূহের হেফাজত ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর নির্ভেজাল ইসলামের প্রসার ঠেকানোর জন্য একটি ষড়যন্ত্র মাত্র। ইসলামী দেশসমূহের অপদার্থ শাসকদের কলংকজনক ও ঘৃণ্য কার্যকলাপ কেবল অর্ধমৃত ইসলাম ও মুসলমানদের দুঃখ-কষ্ট ও বালা-মুছিবতই বৃদ্ধি করেছে। ইসলামের পয়গাম্বর অভিজাত মসজিদ ও সুরম্য মিনারসমূহের কোন প্রয়োজনই রাখেননি। ইসলামের পয়গাম্বর শুধু তাঁর অনুসারীদের ইজ্জত, সম্মান ও গৌরবের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন যা দুঃখজনকভাবে ভাড়াটে শাসকদের ভ্রান্ত নীতি অবলম্বনের কারণে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের মুসলমানগণ কি ভুলে যাবেন যে, আলে সৌদের ঘৃণ্য দীর্ঘ শাসনামলে মুসলমানদের সকল মাজহাবের শত শত আলেম, হাজার হাজার নর-নারী এবং আল্লাহর ঘরের হাজীদের পাইকারী হত্যার মতো গর্হিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে? মুসলমানরা কি দেখতে পাচ্ছেন না যে, বিশ্বে ওয়াহাবি ফের্কার কেন্দ্রগুলো ফিতনা ও গুপ্তচরবৃত্তির আখড়ায় পরিণত হয়েছে? একদিকে অভিজাত ধনিক-বণিক শ্রেণির ইসলাম, আবু সুফিয়ানের ইসলাম, ঘৃণ্য দরবারি আলেমদের ইসলাম, দ্বীনী মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চেতনাহীন ভণ্ড পীর-মাশায়েখ ও মোল্লাদের ইসলাম, যিল্লতি ও লাঞ্ছনার ইসলাম, অর্থবিত্ত ও জবরদস্তির ইসলাম, প্রতারণা, আপোসরফা ও বন্দিত্ব বরণের ইসলাম এবং মজলুম ও নাঙ্গা পা সর্বহারাদের ওপর পুঁজি ও পুঁজিপতিদের ইসলাম- তথা এক কথায় আমেরিকান ইসলামকে ওরা (ওয়াহাবিরা) প্রচার করছে এবং অন্যদিকে তাদের প্রভু বিশ্বদস্যু আমেরিকার দরবারে সেজদা করছে।…

আজ কি মুসলমানগণ বিশ্বাস করছে যে, ইরানের হাজীরা আল্লাহর ঘর ও পয়গাম্বরের রওজা মুবারক দখল করার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে এবং কাবাকে লুট করে কোম নিয়ে যেতে চায়? বিশ্বের মুসলমানগণ যদি বিশ্বাস করতে পারতেন যে, তাঁদের রাষ্ট্রপ্রধানগণ আমেরিকা, রাশিয়া ও ইসরাইলের প্রকৃত দুশমন তাহলে হয়তো তাদের প্রচারে বিশ্বাস করতেন। অবশ্য আমরা আমাদের বৈদেশিক ও আন্তর্জাতিক নীতিমালায় বার বার এ বাস্তবতা ও সত্যতাকে ঘোষণা করেছি। আমরা বিশ্বে ইসলামের প্রতিপত্তি বিস্তার ও বিশ্বদস্যুদের আধিপত্য হ্রাস করতে চেয়েছি ও চাচ্ছি। এখন যদি আমেরিকার ভৃত্যেরা এর নাম সম্প্রসারণবাদ’  ও বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তারের চিন্তা বলে অভিহিত করে, তাতে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই; বরং আমরা তাকে স্বাগত জানাব। আমরা বিশ্বে ইহুদিবাদ, পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের পচা বিষমূলসমূহকে জ্বালিয়ে দিতে চাই। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, মহামহিম আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ ও করুণায় এ তিন স্তম্ভের (ইহুদিবাদ, পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের) ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থাসমূহকে নাস্তানুবাদ করব এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নেজামে ইসলামকে (ইসলামী সমাজব্যবস্থাকে ) দাম্ভিক কুফরি বিশ্বে ছড়িয়ে দেব। আজ হোক কাল হোক, শিকলবদ্ধ জাতিসমূহ তা প্রত্যক্ষ করবে।

ইনশাআল্লাহ, আমরা এটা মোটেই হতে দেব না যে, মানবতার উচ্চতম শৃঙ্গস্বরূপ কাবা ও হজ- যেখান থেকে মজলুমের ফরিয়াদকে সমগ্র বিশ্বে অবশ্যই পৌঁছাতে হয় এবং তাওহীদের বাণীকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করতে হয়, সেখান থেকে আমেরিকা, রাশিয়া ও কুফর-শিরকের সাথে আপোসের আওয়াজ উঠবে। আমরা আল্লাহর কাছে এ শক্তি চাই যাতে শুধু মুসলমানদের কাবা থেকেই নয়; বরং বিশ্বের গির্জাসমূহের চূড়া থেকেও আমেরিকা মুর্দাবাদরাশিয়া মুর্দাবাদেরঘণ্টাধ্বনি বাজাতে পারি। আমাদের ইসলামী বিপ্লব বিশ্বলুটেরাদের জন্য যে কুল-কিনারাহীন বারযাখ’ (কবরদেশ) তৈরি করেছে তাতে বিশ্বের মুসলমানগণ ও সমগ্র বিশ্বের বঞ্চিত সর্বহারাগণ আজাদীর গৌরব অনুভব করুক এবং নিজেদের জীবন ও ভাগ্যে আজাদী ও স্বাধিকারের ডংকা বাজাক আর নিজেদের জখম ও ক্ষতসমূহের ওপর মলম দিক। কেননা, অচলাবস্থা ও হতাশার দিন এবং কুফরের এলাকায় শ্বাস গ্রহণের দিন ফুরিয়ে এসেছে। আর জাতিসমূহের গুলিস্তান (কুসুম কানন) মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমি আশা করছি যে, সকল মুসলমানই আজাদীর কুঁড়িসমূহ, বসন্তের সৌরভময় পুবাল-হাওয়া, মুহব্বত ও এশকের কুসুমরাজির প্রস্ফুটন এবং নিজেদের ইচ্ছা-বাসনার স্বচ্ছ সলিলের ঝরনাধারা প্রত্যক্ষ করুক। আমেরিকা ও রাশিয়ার কর্মকর্তারা নীরবতা ও নিশ্চয়তার মরাপানি ও গভীর কাদায় মৃত্যু ও বন্দিত্বের যে বীজ ছড়িয়ে দিয়েছে তা থেকে আমাদের সবাইকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে এবং সেই দরিয়ার পানে ছুটে যেতে হবে- যেখান থেকে জমজমকুয়ার পানি বের হয়ে এসেছে। আর আমেরিকান নাপাক দুশমনরা ও মার্কিন পোষ্যরা কাবা ও খোদার হেরেমের যে পর্দাকে অপবিত্র করেছে তাকে আমরা নিজেদের চোখের পানি দিয়ে ধৌত করব।…

আমরা মক্কায় থাকি আর না-ই থাকি, আমাদের অন্তর ও রূহসমূহ ইবরাহীম (আ.) ও মক্কার সাথে রয়েছে। রাসূলুল্লাহর মদীনা শরীফের দরজাসমূহকে আমাদের সামনে বন্ধ রাখুক বা খুলে দিক, তাতে রাসূলের সাথে আমাদের মুহব্বতের বন্ধন কখনো ছিন্ন হবে না। আমরা কাবার দিকেই নামাজ পড়ে যাব ও কাবার দিকে মুখ করেই মৃত্যুবরণ করব। আল্লাহর শুকরগুজারি করছি যে, আমরা কাবার খোদার সাথে কৃত আমাদের ওয়াদায় (মিছাক) অটল রয়েছি এবং মুশরিকদের সাথে বারাআতের স্তম্ভসমূহকে হাজার হাজার প্রিয়তম শহীদের খুন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং এ অপেক্ষায় থাকিনি যে, ইসলামী ও অনৈসলামী দেশের কোন কোন ব্যক্তিত্বহীন শাসক আামাদের আন্দোলনকে সমর্থন দিক। আমরা সর্ব ইতিহাসের চির মজলুম, মাহরুম (হক থেকে বঞ্চিত) ও নাঙ্গা-পা সর্বহারা দল। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই। হাজার বারও যদি সবাই টুকরো টুকরো হয়ে যাই তবু যালিমের সাথে সংগ্রাম থেকে হাত-পা গুটাব না। ক্ষমতাসীনদের সৃষ্ট রাজনৈতিক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও বিশ্বের যে সকল স্বাধীনতচেতা মুসলমান কনফারেন্স, সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে আমেরিকা ও আলে সৌদের অপরাধের রহস্যময় পর্দা উন্মোচন করেছেন এবং দুনিয়াবাসীদের কাছে আমাদের মজলুম অবস্থাকে তুলে ধরেছেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। মুসলমানদের অবশ্যই জানা উচিত যে, যদ্দিন পর্যন্ত বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য তাদের সপক্ষে পরিবর্তিত না হবে তদ্দিন তাদের স্বার্থের ওপর বেগানা দুশমনদের স্বার্থসমূহই প্রাধান্য পেতে থাকবে আর প্রতিদিনই শয়তানে বুজুর্গ’ (আমেরিকা) অথবা রাশিয়া নিজ স্বার্থে বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলবে। সত্যি, মুসলমানগণ যদি তাদের ইস্যুসমূহের ব্যাপারে বিশ্বলুটেরাদের সাথে শক্তভাবে ফায়সালায় না পৌঁছেন অথবা অন্ততঃপক্ষে নিজেদেরকে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের সীমান্তে না পৌঁছান তাহলে কি শান্তিতে থাকতে পারবেন? এই মুহূর্তে যদি আমেরিকা একটি ইসলামী দেশকে স্বীয় স্বার্থ সংরক্ষণের বাহানায় মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় তাহলে কে তার পথরোধ করে দাঁড়াবে? সুতরাং সংগ্রাম ছাড়া আর কোন পথ নেই। পরাশক্তিবর্গ বিশেষ করে আমেরিকার নখর ও দাঁতগুলোকে অবশ্যই ভেঙে ফেলতে হবে। আমাদের বাধ্যতামূলক দুটির যে কোন একটি বেছে নিতে হবে- হয় শাহাদাত, নয় বিজয়; আর আমাদের আদর্শে দুটিই বিজয়। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ পাক বিশ্বগ্রাসী শাসক ও যালেমদের প্রণীত নীতিমালা ছুঁড়ে ফেলার শক্তি এবং মানবিক মূল্যবোধ ও ইজ্জত-সম্মানের চারপাশ ঘিরে দেয়াল গড়ে তোলার সাহস সকল মুসলমানকে দান করবেন। আর সবাইকে যিল্লতির পাতালপুরী থেকে সম্মান ও শান-শওকতের সুউচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করার সহায়তা দান করবেন।

গত বছর (১৯৮৭) হজের তিক্ত ও মিষ্টঘটনার পূর্ব পর্যন্ত অনেক লোক মুশরিকদের সাথে বারাআত মিছিলের ওপর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের গুরুত্বারোপের যুক্তি-দর্শন উত্তমরূপে উপলব্ধি করতে পারেননি; বরং নিজেদের ও অন্যদের জিজ্ঞেস করতেন হজ সফরে এবং এ গরম হাওয়ায় মিছিল ও সংগ্রামের ফরিয়াদ করার কি আবশ্যকতা রয়েছে? অথবা মুশরিকদের সাথে বারাআতের ফরিয়াদ না হয় করা হলো, কিন্তু তাতে উদ্ধত কুফরি ও শয়তান চক্রের কি ক্ষতি হবে? কত সরলমনা মানুষই না ভাবতেন যে, বিশ্বগ্রাসী দস্যুদের তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার পক্ষে এ ধরনের রাজনৈতিক ব্যাপারস্যাপার তো বরদাশত করারই বিষয়, এটা বরং স্বীয় বিরোধীদেরকে বেঁচে থাকার ও মিছিল ও বিক্ষোভের সুযোগ এর চেয়ে বেশি করে দেবে। এ দাবির পিছনে কারণ এটি নয় যে, তথাকথিত মুক্ত পাশ্চাত্যে বিক্ষোভ মিছিলের স্বাধীনতা রয়েছে; বরং এ বিষয় পরিষ্কার হতে হবে যে, এ ধরনের মিছিলসমূহ পরাশক্তিবর্গ ও অন্যান্য শক্তির জন্য কোন প্রকার ক্ষতিকারক নয়। আসলে মক্কা-মদীনার মিছিলের পরিণতিতেই যে সৌদিদের তেলের পাইপ লাইন বন্ধ হয়ে যাবে, মক্কা ও মদীনার মিছিলই যে রাশিয়া ও আমেরিকা দালালদের ধ্বংসযজ্ঞে গিয়ে শেষ হবে। আর ঠিক এ কারণেই স্বাধীন নর-নারীদের পাইকারী হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তা ঠেকানো হচ্ছে। মুশরিকদের সাথে এ বারাআতের ছায়াতলেই সরলমতি মানুষেরা বুঝতে পারবেন, রাশিয়া ও আমেরিকার দরবারে মাথা ঠেকানো মোটেই ঠিক নয়।…

(নিউজলেটার, জুন ১৯৯১)