বাংলা নববর্ষের ইতিহাস


‘সন’ ও ‘তারিখ’ দুটিই আরবী শব্দ। প্রথমটির অর্থ হল ‘বর্ষ’ বা ‘বর্ষপঞ্জী’ এবং অন্যটির অর্থ ‘দিন’। ‘তারিখ’ বলতে আবার ইতিহাসও বোঝায়। ‘সাল’ হচ্ছে একটি ফারসী শব্দ, যার অর্থ হল বৎসর। বাংলা সনের সূত্রপাত হয় আরবী হিজরী সনের ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ ইসলামী সনের ওপর ভিত্তি করেই একজন মুসলমান বাদশাহ কর্তৃক বাংলা সনের প্রবর্তন। স্বভাবতই, যারা ইতিহাসকে স্বীকার করেন না বা যারা ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ, তারাই মনে করেন যে, বাংলা সন অমুসলিমদের দ্বারা প্রবর্তিত একটি বর্ষপঞ্জী।

‘ইংরেজি’ তথা ‘গ্রেগরীয়ান’ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মক্কা থেকে মদীনায় ঐতিহাসিক হিজরত অবলম্বন করে প্রবর্তিত, এই হিজরী সন শুরু হয় ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬৫ জুলাই তারিখ থেকে। বাংলা সনের মূলে হিজরী সন বিদ্যমান বিধায় হিজরী সালকেই সুকৌশলে বাংলা সনে রূপান্তরিত করা হয়।

মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে তারই নির্দেশে ৯৯৮ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। বাদশাহ আকবর ৯৬৩ হিজরীতে অথাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে (১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে) দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনা চিরন্তরণীয়  করে রাখার জন্য ৯৬৩ হিজরী অবলম্বন করেই বাংলা সন চালু করা হয়। অর্থাৎ ১, ২, ৩-এভাবে হিসেব না করে মূল হিজরী সনের চলতি বছর থেকেই বাংলা সনের গণনা শুরু হয়। ফলে জন্ম বছরেই বাংলা সন ৯৬৩ বৎসর বয়স নিয়ে যাত্রা শুরু করে।

হিজরী সনের ক্ষেত্রে যে রকম হিজরতের দিন ও মাস (১২ রবিউল আউয়াল) সুনির্দিষ্টভাবে অবলম্বন না করে শুধুমাত্র সালটিকেই (৬২২ খ্রিস্টাব্দে) সংরক্ষণ করা হয়, বাংলা সনের ক্ষেত্রেও তেমনি সম্রাট আকবরের রাজ্যভিষেকের দিন ও মাস (১৪ইং ফেব্রুয়ারি) অবলম্বন না করে শুধুমাত্র বৎসরটি (৯৬৩ হিজরী) সংরক্ষিত হয়।

হিজরী সনের প্রথমদিন হল পহেলা মহররম। বাংলা সনে তা পরিবর্তন করে পহেলা বৈশাখ করা হয়। ৯৬৩ হিজরীতে মহররম মাস ও বৈশাখ মাস একই সঙ্গে আসে। ফলে, তদানীন্তন শকাব্দের প্রথম মাসটি গ্রহণ না করে হিজরী সনের প্রথম মাস  মহররমের অর্থাৎ বৈশাখ মাসকেই বাংলা সনের মাস হিসাবে পরিচিহ্নিত করা হয়।

বাংলা সনের সৃষ্টি হয় ফসল তোলার সময় লক্ষ্য করে। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সৌর বৎসর অবলম্বনে এই নতুন সন গণনা শুরু হয়। তাই, প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ‘ফসলী সন’ নামে অভিহিত হতো। ‘বাংলা’র জন্য উদ্ভাবিত বলে এটি পরবর্তী পর্যায়ে ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিহ্নিত হয়। উল্লেখ্য, একইভাবে ভারতের উড়িষ্যা ও মহারাষ্ট্র প্রদেশে যথাক্রমে ‘বিলায়তী’ ও ‘সুরসান’ নামে আঞ্চলিক সনের সৃষ্টি হয়। এসব সনেরও উৎস-সন হিসেবে হিজরী সনকেই গ্রহণ করা হয়।

সম্রাট আকবরের আমলে সুবা-এ-বাংলা (বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা) মোগল শাসনের আওতাভুক্ত হয়। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এক জটিল সমস্যা দেখা দেয়। প্রজাদের দেয় খাজনা ফসলের মাধ্যমে আদায় করতে হলে বছরে একটি সময় নির্দিষ্ট থাকা আবশ্যক। কিন্তু সে কালের রাজকীয় সন অর্থাৎ হিজরী সন চন্দ্র সন হওয়ার প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় সম্ভব হতো না। ফলে, সম্রাট আকবর একটি সৌরভিত্তিক সন প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। উল্লেখ্য, চান্দ্র বৎসর ৩৬৫ দিনের না হয়ে ৩৫৪ দিনের হয়ে থাকে। ফলে, চান্দ্রভিত্তিক আরবী মাস বৎসরের সৌরভিত্তিক ঋতুর সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কোন সামঞ্জস্য বহন করে না। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, বাংলাদেশে পবিত্র রমযান এখন পুরোপুরি না হলেও প্রায় শীতকালে উদযাপিত হয়। কিন্তু ১৫-১৬ বৎসর পূর্বে এটি প্রচণ্ড ও দুর্বিষহ গ্রীষ্মের সময় উদযাপিত হতো।

সম্রাট আকবরের নির্দেশে প্রচলিত হিজরী সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজ-জ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী বহু ভাবনা-চিন্তার পর সনসমূহের উদ্ভাবন করেন তাদেরই একটি হচ্ছে “ফসলী সন’’ বা ‘বাংলা সন’। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, ফসলের মওসুমের কথা বিবেচনায় রেখে এই নতুন সনের প্রবর্তন হয় বলে এর নাম ‘ফসলী সন’ হয়। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন অঞ্চলের নাম অনুযায়ী ‘ফসলী সন’ পরিবর্তিত রূপ ধারণ করে এবং বাংলাদেশে তা ‘বাংলা সন’ নামে অভিহিত হয়।

বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণঃ
বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হযেছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে । বাংলা মাসের এই নামগুলি হচ্ছেঃ
• বৈশাখ – বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• জ্যৈষ্ঠ – জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• আষাঢ় – উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• শ্রাবণ – শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• ভাদ্র -উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• আশ্বিন – অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• কার্তিক – কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• অগ্রহায়ণ(মার্গশীর্ষ) – মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• পৌষ – পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• মাঘ – মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• ফাল্গুন – উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• চৈত্র – চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী-র মাসের নামগুলি প্রচলিত ছিল পারসি ভাষায়, যথা: ফারওয়াদিন, আর্দি, ভিহিসু, খোরদাদ, তির, আমারদাদ, শাহরিযার, আবান, আযুর, দাই, বহম এবং ইসক্নদার মিজ।

বাংলা দিনের নামকরণঃ
বাংলা সন অন্যান্য সনের মতোই সাত দিনকে গ্রহণ করেছে এবং এ দিনের নামগুলো অন্যান্য সনের মতোই তারকামন্ডলীর উপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে।
• সোমবার হচ্ছে সোম বা শিব দেবতার নাম অনুসারে
• মঙ্গলবার হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের নাম অনুসারে
• বুধবার হচ্ছে বুধ গ্রহের নাম অনুসারে
• বৃহস্পতিবার হচ্ছে বৃহস্পতি গ্রহের নাম অনুসারে
• শুক্রবার হচ্ছে শুক্র গ্রহের নাম অনুসারে
• শনিবার হচ্ছে শনি গ্রহের নাম অনুসারে
• রবিবার হচ্ছে রবি বা সূর্য দেবতার নাম অনুসারে
বাংলা সনে দিনের শুরু ও শেষ হয় সূর্যোদয়ে । ইংরেজি বা গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির শুরু হয় যেমন মধ্যরাত হতে ।

উইকিপিডিয়া /টেকটুইটস  থেকে সংক্ষেপিত