বুধবার, ১৭ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

বিশ^পরিস্থিতিতে এবারের আল-কুদস দিবসের আহ্বান

পোস্ট হয়েছে: জুন ১২, ২০২০ 

 

রাশিদুল ইসলাম

পবিত্র মাহে রমজানে এবার শুধু মুসলমান নয়, বরং সারাবিশে^র মানুষকে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতেও ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসন থেমে নেই। সিরিয়াতে ইসরাইলি বোমারু বিমান হামলা চলছেই।
রমজানের শেষ শুক্রবার যথারীতি মুসলিম বিশ্বে পালিত হবে আন্তর্জাতিক আল-কুদস দিবস। দীর্ঘ দিন ধরে ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলে থাকা মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের দাবিতে প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয় দিনটি। ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত সফল ইসলামি বিপ্লবের পর মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে কুদস দিবস ঘোষণা করেন। সেই থেকে ইরানসহ বিশ্বের বহু দেশে কুদস দিবস পালিত হয়ে আসছে এবং দিন দিন কুদস পালনকারী দেশের সংখ্যা বাড়ছে।
এবার এমন এক সময় দিবসটি পালিত হতে যাচ্ছে যখন ইসরাইল জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোকে গ্রাস করার জন্য অগ্রসর হওয়ার ফন্দি আঁটছে। ইতিমধ্যে সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিম দেশ এব্যাপারে নিশ্চুপ অথবা কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরাইল এ আগ্রাসন শুরু করতে যাচ্ছে যা ফিলিস্তিনির সঙ্গে চুক্তিরও বরখেলাপ। জেরুসালেম ও সিরিয়ার গোলান মালভূমি নিয়ে যে সমঝোতা রয়েছে তাকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না ইসরাইল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের তথাকথিত ‘দি ডিল অব দি সেঞ্চুরি’ ফিলিস্তিনিদের আইনগত কোনো অধিকার রক্ষা করতে কাজে আসছে না।
গত ২০ এপ্রিল ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বেন্নি গান্তজ ঐক্যমতের সরকার গঠন করতে চুক্তি করেন। এখন ট্রাম্পের ‘ডিল অব দি সেঞ্চুরি’র আলোকেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনি ভূমিতে আগ্রাসন চালাতে অগ্রসর হচ্ছেন। ১৭৬৭ সালে ইসরাইল পশ্চিম তীর দখল করে নেয়ার পর তা ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে ফিলিস্তিন। ট্রাম্পের নতুন মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনায় পশ্চিম তীরে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং জেরুসালেমকে তার অবিভক্ত রাজধানী হিসেবে রেখে একটি নতজানু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে। ট্রাম্পের এ পরিকল্পনা ফিলিস্তিনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পশ্চিম তীর নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ নিস্পত্তির জন্য মুসলিম দেশগুলো এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হয় বরং ট্রাম্পের তথাকথিত ডিল অব দি সেঞ্চুরি মেনে নেয়ার জন্য কোনো কোনো দেশ সরাসরি ফিলিস্তিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এতে সায় দিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলো। ওআইসির এতে কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই।
এবারের আল-কুদস দিবসে এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। প্রতিরোধ গড়ে তোলার পূর্বশর্ত হিসেবে ঐক্য গড়ে তোলার তাগিদ দিচ্ছে। এরই মধ্যে জার্মানিতে হিজবুল্লাহ আন্দোলনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে হাতে গোনা যে কয়েকটি দেশ বা গোষ্ঠী সোচ্চার হয়ে আছে তার মধ্যে ইরান ও হিজবুল্লাহ অন্যতম প্রধান মিত্র হিসেবে কাজ করছে। তেহরান জার্মানির এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
আল-কুদস দিবসে আমাদের ভাবনায় আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোর বিচার বিশ্লেষণ জরুরি। রমজানে যেমন দৈহিক ও আত্মিক সংযমের মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ আসে তেমনি জাগতিক ও আধ্যাত্মিক যাবতীয় কল্যাণকর্মে সাফল্যের সোপানে সহজে আরোহণ করা সম্ভব তখনি হবে যখন পরিবর্তিত বিশ^পরিস্থিতি নিয়েও আমাদের সম্যক ধারণা থাকবে। তা না হলে মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা জানা সম্ভব হবে না। আল-কুদস দিবস সেই ডাকই দিয়ে যায় যাতে আমরা অনুধাবন করতে পারি, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কেন এবং কিভাবে পরাশক্তিগুলো বিভেদ জিইরে রাখে এবং সেই চক্রান্তের জালে বিভ্রান্ত হয়ে আমরা কিভাবে বছরে পর বছর জুড়ে আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিকভাবে মার খেতে থাকি!
মুসলমানদের মার খাওয়ার একটি বড় কারণ যে অনৈক্য, তা সবার জানা। কিন্তু এই অনৈক্য কিভাবে লজ্জাজনকভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তাও জানা প্রয়োজন। হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করায় জার্মানিকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কোনো মুসলিম দেশ একই ভূমিকা পালন করছে। অথচ ইয়েমেনে বছরের পর বছর আগ্রাসন চলছে এবং পশ্চিমা দেশগুলো এ আগ্রাসনে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় সন্ত্রাস আর কী হতে পারে? এই সন্ত্রাসের শিকার হতে হচ্ছে ইয়েমেনের নিরস্ত্র জনতাকে। দুর্ভিক্ষ চলছে দেশটিতে। অনাহারে অপুষ্টিতে নারী ও শিশু মারা যাচ্ছে। এধরনের সন্ত্রাস সম্ভব হচ্ছে কোনো মুসলিম দেশগুলোর সহায়তায় যা পশ্চিমা রাষ্ট্র ও ইসরাইল সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান সহ বিভিন্ন দেশে অব্যাহত রেখেছে। এবং তা হচ্ছে সন্ত্রাস দমনের নামেই। আল-কুদস দিবসের অন্যতম আহ্বান হচ্ছে এসব বিভ্রান্তির জাল ছিন্ন করে মুসলমানদের বিরদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং তাহলেই ফিলিস্তিনিদের পাশে মুসলিম বিশ^ একাট্টা হয়ে দাঁড়াতে পারবে এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করার সত্যিকার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী একটি দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ’র ব্যাপারে জার্মানির সর্বশেষ নেওয়া সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। এও বলেছে, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে তারা তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। অথচ হিজবুল্লাহ বিশে^র কোথাও কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত তার কোনো প্রমাণ আন্তর্জাতিক বিশ^ দিতে পারেনি। ফিলিস্তিনিদের পাশে, গাজায় অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করছে হিজবুল্লাহ তার সাধ্যমত। এটি সন্ত্রাসের সংজ্ঞায় পড়ে কিভাবে? দেশটি বিশ্বব্যাপী শান্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সন্ত্রাসী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলেও মন্তব্য করছে। অথচ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জর্দানের পশ্চিম তীরে আগ্রাসনে যে অগ্রসর হচ্ছেন তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছে না কেন প্রভাবশালী দেশগুলো।
উল্টো বরং দেশটি রীতিমত ইসরাইলের সাংস্কৃতিক সেবায় নেমেছে। ফিলিস্তিনের ভূমি দখলদার ও বর্ণবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াকে এবার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও টেনে এনেছে তারা। প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোর প্রখ্যাত আলেম ওলামাদের মতামত গ্রহণ না করে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার ইসরাইলের পক্ষে বক্তব্য রেখে ও ইহুদি ধর্ম আর ইসরাইলকে একই অর্থবোধকরূপে দেখিয়ে ভূমিকার প্রতিবাদে আলেম ওলামাদের জেল খাটতে হচ্ছে এমন নজীরও রয়েছে। ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় এবার ‘উম্মে হারুন’ বা ’হারুনের মা’ নামে একটি টেলিভিশন সিরিয়াল সম্প্রচার শুরু হয়েছে।
এই সিরিয়ালে গত শতকের চল্লিশের দশকে কুয়েতের কোনো কোনো ইহুদির ওপর কোনো কোনো মুসলমানের নির্যাতনের কথিত কাহিনী প্রচার করে পরোক্ষভাবে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্বকে বৈধতা দেয়ার এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা ও তাদেরকে বিতাড়নের অপরাধগুলোকে ধামাচাপা দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এ ছাড়াও ইসরাইলের অবৈধ অস্তিত্বকে বৈধ ও বাস্তব হিসেবে তুলে ধরা এবং ফিলিস্তিনি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রচার করা হচ্ছে কমেডি সিরিজ ‘মাখরাজ-সাত’। এ দুই সিরিজেই ফিলিস্তিনিদের ত্যাগ ও কুরবানিকে পদদলিত করা হয়েছে।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, পবিত্র রমজান মাসে এসব সিরিয়াল সম্প্রচার শুরু হয়েছেÑ যে রমজানের শেষ শুক্রবারকে পালন করা হয় মুসলমানদের প্রথম কিবলাকে ইসরাইলি দখল থেকে মুক্ত করার জন্য বিশ্ব কুদস দিবস হিসেবে। এ দিবসে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের বিরুদ্ধেও বৈশ্বিক গণ-বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। এখানে আল-কুদস দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিহিত রয়েছে। কারণ, নেতানিয়াহুসহ সন্ত্রাসী কোনো কোনো ইসরাইলি নেতা দাবি করেন যে আরব বিশ্বের জনগণকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে বিদ্বেষমূলক নানা প্রচারণার মাধ্যমে ক্ষেপিয়ে রাখা হয়েছে যা আরব-ইসরাইল শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান বাধা! তাহলে ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে ফিলিস্তিনি শিশু হত্যা কি বন্ধ রয়েছে? ইসরাইলি কারাগারগুলোতে বিনা বিচারে আটক হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে কেনো মুক্তি দেয়া হচ্ছে না সে নিয়ে কি কোনো দেশ ধারাবাহিক টেলিভিশন অনুষ্ঠান বা প্রামাণ্য চিত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে?
বরং ইতিহাস বিকৃত করে ও জনগণের তেল-বিক্রির অর্থ খরচ করে ইসরাইলের নেতানিয়াহুদের পক্ষ নিয়ে সাংস্কৃতিক প্রচারণা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। মন থেকে না চাইলেও অনেক দেশ ইসরাইল ও মার্কিন সরকারের সেবাদাসত্বে নিয়োজিত। আল-কুদস দিবসের আহ্বান হচ্ছে মুসলমানদের এধরনের সেবাদাসত্ব থেকে বের হয়ে আসতে প্রয়োজনীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি নিতে হবে।
এরপরও বলছি পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণেই মার্কিন অর্থনীতির বেহাল দশা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করেছে। মার্কিন সরকারের দেনা পৌঁছে গেছে ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার। বেকারত্ব গিয়ে ঠেকেছে গত মার্চ পর্যন্ত সাড়ে তেত্রিশ মিলিয়নে। সিএনএন বলছে, এপ্রিল মাসে বেকারের সংখ্যা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০.৫ মিলিয়নে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪.৭ শতাংশ মানুষ বেকার। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছে। এদের সংখ্যা আরো বাড়বে। এই যুক্তরাষ্ট্রই ইরান, ভেনিজুয়েলা সহ বিশে^র যেসব দেশ মাথা তুলে স্বাধীনভাবে চলতে চেয়েছে তাদের ওপর দশকের পর দশক ধরে অন্যায়ভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। তেল রফতানিতে বাধ সেধেছে। আর আজ সেই তেলের দর পড়ে গিয়েছে প্রায় শূন্যের অঙ্কে। বিশে^র সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ তৈরি প্রতিষ্ঠান বোয়িং ইরানের সঙ্গে চুক্তি করেছিল শতাধিক বিমান সরবরাহের। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন তা হতে দেয়নি। আজ সেই বোয়িং লে-অফে মালিকানা হারিয়েছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে যেয়ে। এসব অর্থনৈতিক বিষয় আল-কুদস দিবসে নানা আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি বিবেচনার দাবি রাখে।
একই সঙ্গে ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি আরব সরকারগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে গোপনে সহযোগিতা করে এসেছে। একদিকে সস্তায় তেলসম্পদ কিনের নেয়ার নামে লুটপাট অন্যদিকে ট্রিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে পরাশক্তি দেশগুলো মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রেখেছে। ১৯৯০-র দশকে ওমান ও কাতারে খোলা হয় ইসরাইলি বাণিজ্য দপ্তর। আরও আগে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে প্রকাশ্যে নতজানুমূলক রাজনৈতিক আপোষ-চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল মিশর ও জর্দান। আর আরব বিশ্বের বাইরেও কোনো মুসলিম দেশের সঙ্গেও ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রায় সব ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল ও তা এখনও বজায় রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে অনেক প্রভাশালী মুসলিম দেশে একাধিক ইসরাইলি শীর্ষ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা সফর করেছেন। ইসরাইলি মিডিয়াগুলোতে তা বড় বড় হেডলাইনে সংবাদ হিসেবে প্রচার পেয়েছে। নিশ্চুপ আর অসহায় হয়ে কোনো মুসলিম দেশের নেতারা মরুভূমিতে উটপাখির মতো মুখ গুঁজে থেকেছেন। ২০১৮ সালে ওমান সফর করে ওমানের তৎকালীন সুলতানের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তারপর থেকে শুরু। কিন্তু আল-কুদস দিবসকে সামনে রেখে প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছুর পরও কি ফিলিস্তিনিরা তাদের হারানো ভূমি, বায়তুল মোকাদ্দাস ফিরে পেয়েছে।
এজন্যই গত তিরিশে এপ্রিল এক বিবৃতিতে ইরান বলেছে, জার্মানিতে হিজবুল্লাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং দেশটির সরকারের এ সিদ্ধান্ত লেবানন সরকার ও জনগণের জন্য সম্পূর্ণ অসম্মানজনক, যেহেতু হিজবুল্লাহ ওই দেশের সরকার এবং সংসদের একটি সরকারি ও বৈধ অঙ্গ। প্রশ্ন হচ্ছে অন্য কোনো মুসলিম দেশ জার্মানির কাছে এ প্রশ্ন তুলতে পারছে না কেন? কোথায় ওআইসি? কোথায় আরব লীগ?
তার মানে কার্যকরভাবে ফিলিস্তিনিদের পাশে যে কোনো সংগঠন দাঁড়ালেই তাকে সন্ত্রাসীর সংজ্ঞায় ফেলে দেয়া হবে? অথচ আমরা সবাই জানি মহানবী (সা)-এর নবুওয়াতের ঘোষণার পর থেকে মুসলমানদের কাছে বায়তুল মোকাদ্দাস পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কুরআন শরিফে বায়তুল মোকাদ্দাসকে পবিত্র ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছেÑ ‘(স্মরণ করো, মূসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল) হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন, এতে তোমরা প্রবেশ করো এবং পশ্চাৎপসারণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ২১)
এবার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে কেনো বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করা প্রয়োজন তার সংক্ষেপ বর্ণনা দিয়ে এ লেখা শেষ করছি। এটা শুধু মুসলিম উম্মাহর হারানো গৌরব বা মান-সম্মান ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন নয়, বিশ্বব্যাপী সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যও তা জরুরি। বায়তুল মোকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন হচ্ছে রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক কৌশলগত দিক থেকে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাÑ এ গুরুত্বপূর্ণ তিন মহাদেশের ট্রানজিট পয়েন্ট বা প্রবেশদ্বার। এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটি সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে আজ তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রধান তিন মহাদেশের ওপর কর্তৃত্ব করা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য সহজ হয়েছে।
আল-কুদস দিবস এসব বিষয় নিয়ে ভাবনার তাগিদ দিচ্ছে। মজলুম ফিলিস্তিনি জাতির ওপর জগদ্দল পাথর হয়ে ইহুদিবাদী শাসন, শোষণ, নিপীড়ন ও তাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটানো এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও এ দিবসের আরেকটি বড় লক্ষ্য। এজন্য মুসলমানদের ঐক্যই যথেষ্ট।