শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

পরিশেষে মুসলমানরাই ইহুদিদের ওপর বিজয় লাভ করবে

পোস্ট হয়েছে: জুন ১২, ২০২০ 

 

মো. আশিফুর রহমান

বনি ইসরাইল তথা ইহুদি জাতির অতীত ও বর্তমান ইতিহাস হলো আল্লাহ্র বিরুদ্ধাচরণ, ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস। তারা সবসময় পৃথিবীতে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলনের ব্যাপারে চেষ্টা করে এসেছে। সম্ভবত তাদের বৃহত্তম যুদ্ধের আগুন তারা প্রজ্বলিত করেছে মুসলিম উম্মাহ্র বিরুদ্ধে, যার বিস্তৃতি ঘটানোর জন্য তারা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকেও উস্কে দিচ্ছে।
ইহুদিরা সব সময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে করে এসেছে। মদীনায় হিজরত করার পর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাদের সাথে সন্ধিচুক্তি করেছিলেন, কিন্তু তারা সুযোগ পেলেই চুক্তি ভঙ্গ করে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। শুধু তা-ই নয় পূর্ববর্তী নবী-রাসূলের সময়ও তারা তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, এমনকি অনেক নবীকে তারা হত্যাও করেছে।
অতীতের মতো বর্তমানেও ইহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিশেষ করে মুসলমানদের ভূখ- ফিলিস্তিন দখল করে সেখানে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু ইহুদিদের পরাজয়ের ব্যাপারে পবিত্র কোরআন এবং মহানবী (সা.) ও ইমামগণের হাদিসে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যা অবশ্যম্ভাবী।
পবিত্র কোরআনের সূরা বনি ইসরাইলে মহান আল্লাহ্ ইহুদীদের বিপর্যয় সৃষ্টি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের ধ্বংসের বিষয়ে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা ঘোষণা করেছেন : ‘আমি বনি ইসরাইলকে (তাদের) কিতাবে স্পষ্ট বলে দিয়েছি, তোমরা পৃথিবীতে দু’বার বিপর্যয় (ফিতনা) সৃষ্টি করবে এবং তোমরা অতিশয় অহংকার প্রকাশ করবে। অতঃপর যখন এ দুয়ের প্রথমটির প্রতিশ্রুতিকাল উপস্থিত হলো তখন আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কঠোর যোদ্ধা বান্দাদেরকে প্রেরণ করলাম। অতঃপর তারা (তোমাদের) প্রতিটি জনপদের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল। আর এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়ারই ছিল। অতঃপর আমি তোমাদের অনুকূলে তাদের বিরুদ্ধে পালা ঘুরিয়ে দেব, তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও পুত্র-সন্তান দ্বারা সাহায্য করব এবং তোমাদের জনবল (সামরিক শক্তি) বৃদ্ধি করে দেব। তোমরা যদি ভালো কর তবে নিজেদের জন্যই ভালো করবে। আর যদি মন্দ কর তবে তাও নিজেদের জন্যই। এরপর যখন দ্বিতীয় অঙ্গীকারের সময় এসে যাবে তখন (অন্য) বান্দাদেরকে প্রেরণ করব যারা তোমাদের মুখম-ল বিকৃত করে দেবে, মসজিদে ঢুকে পড়বে যেমন প্রথমবার তারা ঢুকেছিল এবং যা কিছু তাদের করায়ত্বে আসবে তারা তা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে।’ (বনি ইসরাইল : ১-৭)
আয়াতে উল্লিখিত ইহুদিদের প্রথম ফিতনার শাস্তি ইসলামের প্রাথমিক যুগেই মুসলমানদের হাতে বাস্তবায়িত হয়েছে। আজ যখন মুসলমানরা প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছে, তখন মহান আল্লাহ্ ইহুদিদেরকে তাদের ওপর বিজয়ী করে দিয়েছেন। এ পর্যায়ে আবারও ইহুদিরা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ও সীমা লঙ্ঘন করছে। কিন্তু যখনই মুসলমানরা ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে তখনই দ্বিতীয় শাস্তির সময় এসে যাবে এবং তা মুসলমানদের হাতে বাস্তবায়িত হবে।
অনেকে বলতে চান ইহুদিদের দ্বিতীয় শাস্তি তারা পেয়েছে মিশর, ইরান বা রোমের শাসনকর্তারা যখন তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল সে সময়ে। কিন্তু এটি ঠিক নয়। ইহুদিদের প্রতিশ্রুত দ্বিতীয় শাস্তিপ্রাপ্তি যে মুসলমানদের হাতেই হবে তার প্রমাণ হচ্ছে, যে জাতিকে ইহুদিদের বিরুদ্ধে পুনরায় প্রেরণ করার প্রতিশ্রুতি মহান আল্লাহ্ দিয়েছেন তারা একই উম্মততুক্ত এবং তাদের যেসব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে কেবল মুসলমানদের সাথেই সাদৃশ্যপূর্ণ। কারণ, মিশর, ব্যাবিলন, গ্রীস, ইরান, রোম এবং অন্যান্য জাতির রাজা-বাদশাহ্ বা শাসকবৃন্দ যারা ইহুদিদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের সাথে পবিত্র কোরআনের আয়াতে উল্লিখিত ‘আমাদের বান্দা’Ñ এ বৈশিষ্ট্যটি খাপ খায় না। আবার ঐ সব রাজা-বাদশাহ্ ও শাসকের ওপর ইহুদীদের বিজয়ী হবারও কোন ঘটনা ঘটে নি। অথচ ইসলামের প্রথম যুগে মুসলমানদের হাতে ইহুদিদের প্রথম শাস্তিভোগের পর তারা বর্তমানে আমাদের ওপর বিজয়ী হয়েছে। আর মহান আল্লাহ্ তাদেরকে এমনভাবে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করেছেন যে, বিশ্বে তাদের সমর্থকদের সংখ্যা মুসলমান এবং তাদের মিত্রদের চেয়েও বেশি এবং তারা পরাশক্তিবর্গের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত হয়েছে। আজ ইহুদিরা তাদের নাশকতামূলক কর্মকা- ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার দ্বিতীয় পর্যায়ে এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্যের তুঙ্গে অবস্থান করছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, যেমনভাবে মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা প্রথমবার মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে পৃথিবীতে তাদের গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিল ঠিক তেমনি মুসলমানরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে অথবা তাঁর সাথে মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করবে এবং তাদের আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্বকে ধ্বংস করে দেবে।
ইহুদিদের অস্তিত্ব বিলুপ্তকারী যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার আগে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের আগমন ও বসতি স্থাপন এবং তাদের সে দেশটি জবর-দখলের সাথে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু বর্ণনা (রেওয়ায়েত) পাওয়া যায়। আর এ বর্ণনাগুলো নিম্নোক্ত আয়াতেরও ব্যাখ্যাস্বরূপ : ‘আর তার পরে আমরা বনি ইসরাইলকে বললাম : তোমরা পৃথিবীতে বসবাস কর। আর যখন কিয়ামতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে তখন তোমাদেরকে একত্র করে উপস্থিত করব।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ১০৪)
অর্থাৎ আমরা প্রতিটি প্রান্ত থেকে তোমাদের সকলকে একত্রিত করব। ‘নূরুস সাকালাইন’ নামক তাফসীর গ্রন্থেও এ বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : ‘তোমরা কি ঐ নগরীর নাম শুনেছ যার খানিকটা অংশ সমুদ্রের ভেতরে।’ যখন তাঁকে সবাই হ্যাঁ বলল, তখন তিনি বললেন : ‘নবী ইসহাকের সত্তর হাজার বংশধর কর্তৃক ঐ শহরটি আক্রমণের শিকার না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না।’ (মুসতাদরাকে হাকিম, ৪র্থ খ-, পৃ. ৪৭৬)
ইমাম মাহ্দী (আ.) এবং মুসলমানরা এ সব ফিতনা সৃষ্টিকারীদের চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করবেন এবং তাদের মধ্য থেকে যারা নিহত হবে তাদের জন্য মহান আল্লাহ্ জাহান্নামকে কারাগার করে দেবেন এবং মুসলমানরা তাদের অবশিষ্টদেরকে কারাগারে অন্তরীণ করে তাদের নাশকতামূলক কর্মতৎপরতা ও ফিতনা চিরতরে বন্ধ করে দেবে। আর এভাবেই মুসলমানদের চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালার প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়িত হবে।
ইসলাম ধর্মের বিজয়ের যুগ হবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগ। মহানবী (সা.) এবং তাঁর বংশের পবিত্র ইমামগণ থেকে অসংখ্য হাদিস ও বর্ণনা এ বিজয়ের সুসংবাদ প্রদান করেছে। ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাহায্যকারী হিসাবে ইরান ও ইয়েমেনের ভূমিকা প্রধান হবে বলে হাদীসসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সব হাদীস ও বর্ণনায় বলা হয়েছে, ইরান ও ইয়েমেনে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সমর্থক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। মাহ্দী (আ.)-এর ইরানি সাথিরা তাঁর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে সরকার গঠন করে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। অবশেষে তারা ঐ যুদ্ধে বিজয়ী হবে।
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে ইরানীদের মধ্য থেকে দু’ব্যক্তি আবির্ভূত হবেন। তাঁদের একজনকে ‘খোরাসানী সাইয়্যেদ’ বলে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বংশধর এবং তিনি রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দেবেন। আর অপরজন শুআইব ইবনে সালিহ্, যিনি হবেন সামরিক নেতা এবং এ দু’ব্যক্তির নেতৃত্বে ইরানি জাতি তাঁর আবির্ভাবের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : ‘কালো পাতাকাসমূহ খোরাসান (ইরান) থেকে বের হয়ে বাইতুল মাকাদ্দাসে (জেরুজালেম) পতপত করে উড়া পর্যন্ত কোনো কিছুই তাদেরকে পরাস্ত করতে ও প্রতিহত করতে পারবে না।’ (মালাহিত ওয়া ফিতান, পৃ. ৪৩); হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন : “রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : ‘খোরাসানের দিক থেকে কালো পতাকাবাহীরা আবির্ভূত হবে (মাহ্দীর সমর্থনে)। অবশেষে সেগুলো ইলিয়ায় (বায়তুল মুকাদ্দাসে) স্থাপিত হবে এবং কোনো কিছুই তা প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না’।” (জামে আত তিরমিযী, ৪র্থ খ-, হাদীস নং ২২১৫, পৃ. ১৫৬, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত)