শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

English

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও আজকের ভাবনা

পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ১৭, ২০১৯ 

news-image

মুজতাহিদ ফারুকী : মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পৃথিবীতে শুভ আগমনের দিন ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। এটি মুসলিম বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। আনন্দের দিন। প্রতি বছর হিজরি সালের ১২ রবিউল আউয়াল মাসে দিনটি পালন করা হয়ে থাকে।

খ্রিস্টজন্মের ৫৭০ বছর পর রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার সুবহে সাদিকের নির্মল প্রকৃতিতে ধরাধামে আগমন করেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। এই মহামানবের জন্মতারিখ নিয়ে সিরাত গ্রন্থ, জীবনীকার, ইতিহাসবেত্তা ও জ্যোতির্বিদগণের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। তবে প্রায় সবাই এ বিষয়ে একমত যে, তাঁর জন্ম হয়েছিল রবিউল আউয়াল মাসের শুক্লপক্ষে সোমবার প্রত্যুষে বা ভোরবেলায়। এছাড়া ৭, ৮, ১১, ১২ রবিউল আউয়াল সম্পর্কেও কেউ কেউ মত দিয়েছেন। আমাদের উপমহাদেশে সুদীর্ঘকাল ধরেই ১২ রবিউল আউয়াল মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন হিসেবে পালন হয়ে আসছে। আবার কোন কোন মাজহাবের অনুসারীরা ১৭ রবিউল আউয়ালে মহানবীর জন্মদিন পালন করে থাকেন। তবে ইসলামি বিপ্লবের পর ইমাম খোমেইনীর নির্দেশনায় ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ইরান ১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত ‘ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ’ পালন করে আসছে।

ইমাম খোমেইনীর উদ্দেশ্য ছিল, নবীজীর জন্মতারিখ নিয়ে যে মতপার্থক্য রয়েছে সেটিকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং এই ঐক্য সপ্তাহে নবীর আদর্শ অনুসরণ ও বাস্তবায়নে কীভাবে আরও বলিষ্ঠ উদ্যোগ নেওয়া যায়, এক্ষেত্রে কী কী করণীয় সেসব বিষয়ে সারা বিশ্বের সব মাজহাবের পণ্ডিতরা একসঙ্গে বসে যেন চিন্তা-ভাবনা করতে এবং সুনির্দিষ্ট উপায় উদ্ভাবন করতে পারেন সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। প্রসঙ্গত বলা দরকার, মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস ইহুদিদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার এবং নির্যাতিত ফিলিস্তিনী মুসলমানদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে গোটা মুসলিম বিশ্বে বর্তমানে যে ‘আল-কুদ্স দিবস’ পালন করা হচ্ছে সেই দিনটিরও ঘোষণা দিয়েছিলেন ইমাম খোমেইনী। 

আমাদের দুর্ভাগ্য, ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন নিয়ে আমরা বিতর্ক ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে গেছি। ইমাম খোমেইনীর ঐক্য সপ্তাহ পালনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও আমরা উপলব্ধি করি নি। নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমনে দূরীভূত হয়েছিল অন্ধকার, নির্যাতন-নিপীড়ন-নিষ্পেষণের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল মানবতা। কিন্তু বর্তমানে তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ থেকে আমরা অনেকটাই বিচ্যুত হয়ে পড়েছি এবং তাঁর আদর্শ সঠিকভাবে উপলব্ধি ও অনুসরণ করতে না পারায় আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ঘোর অমানিশার অন্ধকারের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি আমাদের মধ্যে গভীর অনৈক্য সৃষ্টি করেছে যা চিন্তা ও মননে যেমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে তেমনই লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপনের তাৎপর্য কোথায়?

এই দিনটিতে সর্বস্তরের মুসলমানই নবীজীর শানে মিলাদ পাঠ করেন, তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম পৌঁছে দেন, তাঁর জীবন, কর্ম ও আদর্শ অর্থাৎ ইসলাম নিয়ে আলোচনা এবং তা জীবনে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বেশিরভাগ মুসলমান ইসলামের অবশ্য পালনীয় নির্দেশাবলিও পালন করেন না; ঘুষ, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, অন্যের অধিকার হরণ ইত্যাদি অন্যায়-অপকর্ম ছাড়তে পারেন না; মিথ্যা বর্জন করতে পারেন না; লোভ, হিংসা, মোহ থেকে মুক্ত হতে পারেন না।

এর কারণ, মানুষের স্বভাবগত পারলৌকিক তথা আধ্যাত্মিকতার চেতনা আজ নানা কারণে লুপ্ত হতে চলেছে। বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তারকারী পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী চেতনা এবং বৈষয়িক ভাবনাসঞ্জাত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ক্রমশই মানুষকে যেনতেন প্রকারে বৈষয়িক লাভালাভের দিকে চালিত করছে। এক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতারও কোনও পরোয়া করছে না তারা। শুধু তা-ই নয়, পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রবৃত্তিতাড়িত সংস্কৃতির নিত্য হাতছানিতে মুসলমানদের আদর্শিক ও মূল্যবোধনির্ভর ইসলামি সংস্কৃতিও আজ হুমকিগ্রস্ত। কোনো জাতিকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করতে হলে আগে তার নিজস্ব সংস্কৃতি ঐতিহ্য মুছে দিতে হবে- সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির এই এজেন্ডা বাস্তবায়িত হচ্ছে আজ মুসলিম দেশগুলোতে। প্রযুক্তির ঔৎকর্ষের এই যুগে প্রযুক্তিনির্ভর অপসংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন যুবসমাজ। মুসলমানদের বড় একটি অংশের মাঝে বিরাজিত অপসংস্কৃতির অপচ্ছায়া দূর করতে হলে নিজস্ব বোধ-বিশ্বাসের ইসলামি সংস্কৃতি সামনে নিয়ে আসতে হবে। কেননা, মুসলমানদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ রয়েছে কেবল রাসূলের জীবনেই।

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন : ‘(হে নবী) আমি আপনাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ সুতরাং মুহাম্মাদ (সা.)-এর পৃথিবীতে আবির্ভাব কেবল মুসলমানদের জন্য নয়; বরং গোটা মানব জাতির মহান পথপ্রদর্শক রূপে। মুহাম্মাদ (সা.) এক আদর্শ মহামানব। এর স্বীকৃতিস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে রয়েছে অনুপম আদর্শ।’ তিনি মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রে আদর্শ। শিশু, যুবা, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবার জন্যই তিনি আদর্শ।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মের সময় পবিত্র কাবাঘরে তিন শতাধিক মূর্তি স্থান পেয়েছিল। আরবসহ সারা বিশ্বের আইন-বিচার ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে চলছিল বর্বর শাসন, মানুষে মানুষে হানাহানি, উটকে পানি খাওয়ানোর মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে চলছিল যুগের পর যুগ যুদ্ধ, জীবন্ত কবর দিচ্ছিল বাবা তার নিজ কন্যাসন্তানকে, সুদ ছিল দুনিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি, ব্যভিচার, মদ ও জুয়া ছিল সমাজের উপর তলার লোকদের নিত্যদিনের কাজ। অসহায় অনাথ বঞ্চিত মানবতা তখন গগণবিদারী আর্তনাদ করছিল। নারী জাতি ছিল মর্যাদাহীন খেলার বস্তু, আদর্শিক-নৈতিক অবস্থা বলতে কিছুই ছিল না- সে সময়, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন।

মুহাম্মাদ (সা.) নিজের সততা, আমানতদারি, বিচক্ষণতা, অনুপম ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বের সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ নারীদের মর্যাদা দান এবং দাসপ্রথার অবসানের মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তির দিশা দেখান। অত্যাচার, নিপীড়ন অর্থনৈতিক অবরোধ, সামাজিক বয়কট, হত্যার হুমকি, কুৎসা রটনা এবং পাগল-জাদুকর, কবি, দেশদ্রোহী, গণক, ধর্মবিরোধীরূপে আখ্যাসহ সকল প্রকার বাধা-বিপত্তির মুখে তিনি সুদৃঢ় ঈমান নিয়ে তাঁর সঙ্গীদেরকে আল-কোরআনের আদর্শে গড়ে তোলেন। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে আরবের এক পশ্চাদপদ বর্বর মানবগোষ্ঠী। এই মহামানবের জীবনচরিত আলোচনা ও তা বাস্তবে রূপদান করাই হলো আজকে ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপনের মহান শিক্ষা ও তাৎপর্য।

মুসলমানদের যে একক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এথেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার মধ্যেই ঐক্যের মূলভিত্তি নিহিত রয়েছে তা উপলব্ধি করতে না পারলে পরাশক্তি কর্তৃক উম্মাহর মাঝে ছড়িয়ে দেয়া দ্বন্দ্ব থেকে আমরা উদ্ধার পাব না। আমাদের তেলসম্পদ, মানবসম্পদ, মেধাশক্তি ব্যবহার করে অন্যরা লাভবান হবে আর আমরা চিরকাল পরস্পর বিভক্ত হয়ে খাঁচার পাখির মতো কেবল ডানা ঝাঁপটাব, তা কখনো হতে পারে না। এজন্য আমাদেরকে কোরআন ও হাদিসের আলোকেই নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেখানে আল্লাহর রঙে জীবন রাঙানো এবং আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে ধরার কথা বলা হয়েছে। এটি হতে পারে কেবল তখনই যখন আমরা ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমঝোতায় আসতে পারব। মুসলমানদের কিছু মৌলিক বিষয়, যেমন : নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত এগুলো নিয়ে যেহেতু কারো মধ্যে কোনও বিরোধ নেই সেহেতু এগুলো মুসলমানদের ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে। মৌলিক বিষয়ের বাইরে ছোটখাটো বিষয়ে কে কী করছে, যেমন : কে লম্বা টুপি পরছে আর কে গোল টুপি, কে কোন পীর মানছেন, কে ছোট জোব্বা পরছেন কে লম্বা জোব্বা, নামাজে হাত বুকে বাঁধছেন নাকি নাভির ওপর, ফরজের পর দোয়া মোনাজাত করছেন কি করছেন না, কে দেওবন্দী আর কে কওমী ধারার অনুসারী এসব বিষয় সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যেতে হবে। কিংবা বিভিন্ন দিবস উদ্যাপন জায়েয কি না-জায়েয এধরনের বিষয়গুলোও পরিহার করতে হবে। কারণ, এগুলো কোনভাবেই ধর্মীয় মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ বেশিরভাগ মুসলমান এসব বিষয় নিয়েই অযথা বিপুল সময় ব্যয় করেছেন এবং এভাবে অনৈক্যের আবর্তে পুরো উম্মাহকে টুকরো টুকরো করে ফেলছেন।
আমরা সবাই একমত যে, মিলাদুন্নবী (সা.)-এর মূল শিক্ষা হলো একমাত্র কালিমা তৈয়্যবা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’ আল্লাহ ভিন্ন উপাস্য নেই, মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর প্রেরিত পুরুষ। এ কালেমার গূঢ়ার্থ হাজারও প্রকারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ অথচ অতি সংক্ষিপ্ত ও অতি নিখুঁত বিশ্লেষণ হলো ইমানে মুজমাল- ‘বিশ্বপ্রভু আল্লাহর প্রতি আমি ইমান আনলাম, তাঁর সব আদেশ মেনে নিলাম।’
মোদ্দা কথা, মিলাদুন্নবী (সা.)-এর আসল শিক্ষা হলো : মহানবী (সা.)-এর ২৩ বছরের ভালোবাসার, কঠোর সাধনার পরিপূর্ণ ও একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম বা জীবনবিধান ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে সর্বস্তরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শান্তির ধর্ম ইসলামকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠা করা। আর এটাই নবী বা রাসূল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য; যা পবিত্র কোরআনে বারবার বিবৃত হয়েছে : ‘তিনি সেই মহান প্রভু, যিনি রাসূল প্রেরণ করেছেন, সঠিক পন্থা ও সত্যধর্ম সহযোগে, যাতে সেই ধর্মকে প্রকাশ করতে পারেন সর্বধর্মের শিখরে।’ (সূরা তাওবা : ৩৩ / সূরা ফাতহ : ২৮)।
নবী-রাসূল পাঠানোর লক্ষ্য হলো মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তাই আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসূল (সা.)-এর পথ অনুসরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের ঘোষণা : ‘…যা দিয়েছেন তোমাদের রাসূল (সা.), সুতরাং তা ধারণ করো; আর যা থেকে বারণ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকো।’ (সূরা হাশর : ৭)।
আল-কোরআনে আরও বলা হয়েছে : ‘বলুন (হে রাসূল!) যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসবে, তবে আমার অনুকরণ করো; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।” (সূরা বাকারা : ৩১)
এ আলোকে নিশ্চিত করে বলা যায়, রাসূল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ইমানের পূর্বশর্ত। আর এই ভালোবাসা তাঁর নির্দেশ পালন ও অনুকরণের মধ্যেই প্রকাশ পাবে। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তথা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইন-কানুন যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সর্বত্রই রাসূল (সা.)-এর অনুপম আদর্শ রয়েছে। বর্তমান দুনিয়ার সর্বত্র মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করলে সত্যিকারের কল্যাণময় বিশ্ব বিনির্মাণ সম্ভব।